শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

প্রয়োজন মানুষের রাজনীতি


কাক্সিক্ষত সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে মানব জাতির অনেক কিছুই করণীয় আছে। কিন্তু করণীয় বিষয়ের সামনে এখন যেন বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এক দানব। কেউ কেউ বলছেন দানব নয়, এটা আসলে একটা ফাঁদ। এই ফাঁদের নাম সন্ত্রাসবাদ। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা আলোচনা। তবে এখানে বলার মত বিষয় হলো, সন্ত্রাস নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তেমন লক্ষ্য করা যায় না, প্রপাগান্ডার মাত্রাই বেশি। প্রপাগান্ডার মাধ্যমে কারো মতলব, রাজনীতি কিংবা মতবাদ প্রচার করা গেলেও আসল কাজের কিছুই হয় না। ফলে বৈশ্বিক বাতাবরণে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এত কথা ও কর্মসূচির পরও তেমন কোনো সুফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
যে কোনো সমস্যার সমাধানে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা যখন মানুষের আর্তনাদ শোনেনি, তখন ক্ষুব্ধ মানুষের মনে দেখা দিয়েছে দ্রোহ। বিদ্রোহী মানুষ তখন জালেম ও শোষকদের বিরুদ্ধে তুলে নিয়েছে অস্ত্র, সৃষ্টি করেছে আতঙ্ক। এই পথ যে সঠিক পথ নয়, তা বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, কিন্তু ওদের এ পথে নামতে যারা বাধ্য করলেন তাদের বিরুদ্ধেও যৌক্তিক বক্তব্য রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক শাসন পরিচালনার কারণে আমরা গেরিলাগোষ্ঠীর উদ্ভব লক্ষ্য করেছি। শ্রেণি বৈষম্যের কারণেও আমরা উগ্রতা ও সশস্ত্র সংগ্রাম দেখেছি। আবার আগ্রাসী রাষ্ট্রের জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও আমরা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো পর্যালোচনা করলে চলে আসে আইরিশ গেরিলা, পিএলও হামাস, শ্রেণি সংগ্রাম, নকশাল, তামিল গেরিলা, মরো মুক্তি ফ্রন্ট ও কাশ্মীরী মুক্তি সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ। এদের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নানা পার্থক্যও লক্ষ্য করা গেছে। কেউ এদের মুক্তি সংগ্রামী বলেছেন, আবার অপরপক্ষ তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এইসব মতপার্থক্য থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য বলে কি কিছু নেই? যে যা বলবে সেটাই কি সঠিক? না, এতটা হতাশ হওয়ারও কারণ নেই। আসলে বর্তমান সময়ে যারা পৃথিবী পরিচালনা করছেন, তারা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে একটু ন্যায়নিষ্ঠ হন তাহলে পৃথিবীর অনাকাক্সিক্ষত চিত্র পাল্টে যেতে পারে। লোপ পেতে পারে সন্ত্রাসবাদও। বলা যেতে পারে, সমস্যা আসলে ওপরের মহলে। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয়েছে এবং যারা সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য রাখেন, তারা যদি মানুষ হয়ে না ওঠেন, তাহলে মানুষের সংকট দূর হবে কীভাবে? এজন্য বর্তমান বাস্তবতায় যারা মানবোচিত সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী চান তাদের জেগে উঠতে হবে। সমাজে, রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি, অমানুষের সংখ্যা কম। এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে বীরের মত উচিত কর্ম সম্পাদন প্রয়োজন। অনুরোধ, উপরোধ, আফসোস ও বিলাপ তো অনেক করা হয়েছে, তাতে বিশ্ববাতাবরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অতএব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের জনপদে মানুষকে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে মানুষের রাজনীতি করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় অপশাসকদের ধর্ম-বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা ও শ্রেণি স্বার্থের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে রাজত্ব করার সুযোগ আর দেয়া যাবে না। অতীতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই এ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে লাখো কোটি মানুষ। এই প্রসঙ্গে চলে আসে ফিলিস্তিনীদের কথা।
১৯১৬ সালের প্রথম ৬ মাসে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৩৮৪ জন শিশুসহ প্রায় ৭৪০ জন ফিলিস্তিনীকে গৃহহীন করেছে। গত ২৭ জুলাই বুধবার মানবাধিকার সংগঠন ‘বি-সেলেম’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আল-জাজিরা পরিবেশিত খবরে আরো বলা হয়, পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এলাকা জুড়ে এরিয়া ‘সি’ এর অবস্থান এবং এখানে প্রায় ৩ লাখ ফিলিস্তিনীর বাড়ি-ঘর রয়েছে। বর্তমানে এটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বি-সেলেমের মুখপাত্র মিচেলি বলেন, যেখানে মানুষের রাজনৈতিক প্রভাব নেই, এমন জনবিরল অঞ্চলকে লক্ষ্য করে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনীদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালায়। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এসব ফিলিস্তিনীর এরিয়া ‘বি’-এর দিকে সরাতে চাইছে, যাতে তারা বসতি সম্প্রসারণের জন্য এরিয়া ‘সি’ দখল করতে পারে। এটা ইসরাইলি নিপীড়ন ও আগ্রাসনের একটা ক্ষুদ্র চিত্র মাত্র। তবে এখানেও লক্ষ্য করা গেছে, যেখানে মানুষ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয় সেই এলাকাই ইসরাইলি সেনাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। এমন বাস্তবতায় আবারও উল্লেখ করতে হয়, এই পৃথিবীতে অমানুষের বদলে মানুষের নেতৃত্ব প্রয়োজন। মানুষ মেরুদ- সোজা করে ন্যায়ের চেতনায় মানুষের রাজনীতিকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে এগিয়ে এলে শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়, সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন, অজাচার-অনাচার পরাভূত হতে বাধ্য।

শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জঙ্গিদের রুখার প্রশ্ন


রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির এক গণবক্তৃতায় আওয়ামী লীগ সমর্থত বুদ্ধিজীবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, ‘রক্তমাখা হাত উদারতার সংস্কৃতির গলা টিপে ধরেছে। চতুর্দিকে রক্ত। বিএনপির দুহাতে, হেফাজতে ইসলামের দুহাতে, জামায়াতের দুহাতে রক্ত এবং আওয়ামী লীগের দুহাতে রক্ত। এই রক্ত ও রক্তপাত থেকে আমাদের রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ মে ২০১৪)
আসলেই চারিদিকে রক্ত। আর এ রক্ত ঝড়ছে বিরোধী দলের জন্য নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের অদূরদর্শীতার জন্য।  বলতে গেলে হঠাৎই সক্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের নতুন-পুরোনো সব জঙ্গি গোষ্ঠী। ছোট ছোট নানা দলে ভাগ হয়ে সংগঠিত হচ্ছে নতুন নতুন নামে। দলে ভেড়াচ্ছে শিক্ষিত তরুণদের। অস্ত্র-বিস্ফোরকের মজুত গড়ার চেষ্টাও করছে তারা। কেউ কেউ সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও তথ্য মিলছে।
২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সন্ত্রাসী আক্রমণে সারা বিশ্বে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০ হাজারের মতো।  ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ে মধ্য লন্ডনের তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হন ৫২ জন। আহত হন সাত শতাধিক মানুষ। ব্রিটেনের মাটিতে এটাই ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। লন্ডনে বোমা হামলাকারী চার জঙ্গির সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ ছিল।
ভারতের ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাই হামলা পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। সেদিন ওই শহরের তাজ হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে ১০টিরও বেশি ধারাবাহিক গুলি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৪ জন নিহত ও কমপক্ষে ৩০৮ জন আহত হন। হামলাকারী জঙ্গিরা ছিল পাকিস্তানি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবার সদস্য। মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা এশিয়াজুড়ে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সক্ষমতার একটি চিত্র তুলে আনে।
 ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এতে নিহত হয়েছে ১৩০-এর বেশি শিক্ষার্থী। নিহত শিক্ষার্থীদের বয়স ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়। জঙ্গি হামলায় একই বয়সী আরও অন্তত ১২০ জনের বেশি স্কুলশিশু আহত হয়। বিশ্বব্যাপী চলা সন্ত্রাসবাদের মধ্যে এটি ছিল ভয়ঙ্করতম। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান এ হামলার দায় স্বীকার করে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লেবাননের বৈরুতে বেশকিছু সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে আল-কায়েদা সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। এসব ঘটনায় অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। লেবাননজুড়েই আইএসের তা-ব চলছে।
দক্ষিণ বৈরুতের শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ৪৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হন। লেবাননে এই ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট। শিয়া হওয়ার কারণেই এখানকার মানুষ আইএসের টার্গেট হয়েছে।
২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর প্যারিসে হামলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল জঙ্গিবাদী সংগঠনের অপতৎপরতার সমস্যাটি বৈশ্বিক এবং সম্মিলিতভাবেই এর মোকাবিলা করা দরকার। ওইদিন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের যে এলাকায় প্রগতিশীল তরুণ ও মধ্যবিত্তের সমাবেশ হয় সে জায়গায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
জঙ্গি আক্রমণ ও হুমকি মোকাবিলায় আরেকটি দুর্ভাবনার বিষয় হচ্ছে এ নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা। গুলশানের ঘটনার আগে এ দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে বহু জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে ২৭টিতে আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও ৭টিতে একিউআইএস (আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা) দায় স্বীকার করে ইন্টারনেটে তাদের নিজস্ব ফোরামে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সরকার শুরু থেকেই বলে আসছে, এ দেশে আইএস বা আল-কায়েদা নেই। বরং প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো তদন্ত ছাড়াই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছে। কখনো এ জন্য দেশি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করা হলেও এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনের কথা বলা হয়েছে। (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ১১ জুলাই ২০১৬) 
বিদেশীদের ওপর জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে গোয়েন্দা তথ্য দেয়া হয়। তারপর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়ে যায়। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন তার বাসভবনে বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে বলেন, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের তথ্য আছে যে, বাংলাদেশে পশ্চিমা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট স্থানে হামলা হতে পারে। (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ২৯ নভেম্বর ২০১৫)
ঘটলও তাই। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের আশংকা প্রকাশের দু’ঘণ্টার মধ্যে গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। তারপর নিরাপত্তার অজুহাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো শোয়ারের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়ে যায়। বিদেশী কনসার্টসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাতিল হয়।
২০১৫ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে পশ্চিমা নাগরিকদের ওপর আবার সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন হামলার ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে’ দাবি করে নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক করেছে দেশটি। ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের এক নিরাপত্তা বার্তায় এমন সতর্কতা জারি করা হয়। সন্ধ্যায় বার্তাটি দূতাবাসের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক হোটেলগুলোতে আয়োজিত পশ্চিমা নাগরিকদের বড় ধরনের জমায়েতসহ অন্যান্য স্থানে তাদের লক্ষ্য করে হামলা হতে পারে। এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য তাদের কাছে আছে।
১৮  অক্টোবর ২০১৫ দায়িত্ববোধ থেকেই নিজ দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে চলাচলে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাট। যুক্তরাষ্ট্র এখনও উদ্বিগ্ন বলে উল্লেখ করেন তিনি। ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার সঙ্গে আইএস জড়িত কিনা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কোন নতুন সতর্কতা দেয়নি, শুধুু পূর্বের সতর্কবার্তা হালনাগাদ করা হয়েছে।
মার্কিন দূতাবাসের হালনাগাদ করা বার্তায় বলা হয়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির একজন এবং ৪ অক্টোবর জাপানের এক নাগরিককে হত্যার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে আইএসআইএল। ভবিষ্যতেও মার্কিন নাগরিকসহ পশ্চিমাদের লক্ষ্য করে হামলা হতে পারে। বাংলাদেশে বিদেশিদের নিরাপত্তা জোরদার করতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সন্ত্রাসের হুমকি বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবেই রয়েই গেছে। বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশে ভ্রমণরত কিংবা অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া, নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং স্থানীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতির পরিবর্তনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জনসমাগমের স্থলে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে হেঁটে, মোটরসাইকেলে, সাইকেলে কিংবা কোন খোলামেলা বাহনে চলাফেরা করতেও মার্কিন নাগরিকদের নিষেধ করা হয়েছে বার্তায়।
ঢাকায় ইতালিয়ান নাগরিক তাবেলা সিজার ও রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যার পর বাংলাদেশে ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। ভ্রমণ সতর্কতার কারণে বাংলাদেশে বিদেশী পর্যটক আসা কমে গেছে। একই সঙ্গে পোশাক শিল্পের ক্রেতারাও আসতে স্বস্তিবোধ করছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আততায়ীদের হাতে খুন হন ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা ও জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। ঘটনার পর থেকেই এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ‘হাত’ আছে। বিএনপি বলছে, আসল অপরাধীদের আড়াল করতেই সরকার বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা যদি অপরাধের ‘হাত’ না খুঁজে পুরো শরীরটি খুঁজত, তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন সহজ হতো ।
সিজার তাবেলা হত্যার প্রায় এক মাসের মাথায় ঢাকার পুলিশ কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে সন্দেহভাজন ঘাতক হিসেবে যাঁদের চিহ্নিত করলেন, তাঁরা কেউ মাদক ব্যবসায়ী, কেউ অস্ত্রের জোগানদাতা, কেউ পাড়ার বখাটে। এঁদের মধ্যে তামজিদ আহমেদ রুবেল নামের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তাঁর পরিবার বলছে, নির্যাতনের মুখে এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। ২৬ অক্টোবর ২০১৫ আসামিদের আদালতে হাজির করা হলেও অনেক আগে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তাহলে এত দিন আসামিরা কোথায় ছিলেন? আইন অনুযায়ী কাউকে গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটি মেনে চলেছে কি? পুলিশের দাবি, অভিযুক্তদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তারা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করেছে। এর আগে সিসিটিভির ফুটেজে দুই আরোহীসহ একটি মোটরসাইকেল ও টেলিফোনে আলাপরত এক যুবককেখো গিয়েছিল। সিসি টিভিতে ধরা পড়া যুবকদেরই কি পুলিশ গ্রেফতার করেছে, না অন্য কাউকে?
পুলিশের হাতে আটক চারজনের চেয়ে আলোচনায় এসেছে তাঁদের কথিত বড় ভাই, যাঁর বা যাঁদের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার কোনো বড় ভাইয়ের নাম না বললেও পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়ে দিলেন, ‘বড় ভাই’ বিএনপির মহানগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কমিশনার ম এ কাইয়ুম। তিনি বিদেশে পলাতক, কেউ বলছেন মালয়েশিয়ায়, কেউ বলছেন লন্ডনে। পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বললেন, কাইয়ুমকে তিনি ‘বড় ভাই’ বলেননি। কাইয়ুম সন্দেহের তালিকায় আছেন। তাহলে কি সরকার ‘বড় ভাই’ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না, না বড় ভাইয়ের ওপরের কোনো বড় ভাইকে তারা খুঁজছে? (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ অক্টোবর ২০১৫)
বাংলাদেশে পুলিশ বিভাগ যেভাবে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, যেভাবে এর হর্তাকর্তাদের মুখে রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যায়, তাতে এটিই তো হওয়ার কথা। গুলশান ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেননি। কিন্তু অন্তত তিনজন শীর্ষ নেতা এ ঘটনায় আইএস জড়িত থাকার প্রায় অকাট্য প্রমাণ (বিশেষ করে আইএসের ওয়েব পেজের তাৎক্ষণিক আপডেট) থাকার পরও এ জন্য বিএনপি-জামায়াতকেই দায়ী করেছেন।
১১ জুলাই ২০১৬ মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে, আগের দিন আইন-শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এবং ৯ জুলাই ২০১৬  চৌদ্দ দলের বৈঠকে একের পর এক হামলা ও সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।  সেখানে হামলা ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করা যায়।
এ মুহূর্তে চাইলেও জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়-এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে সরকার। তবে যেসব প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে, তাতে এ বছরের মধ্যে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশাবাদ সরকারের নীতিনির্ধারকদের। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যে এ বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সরকার।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা, কথিত ভিডিও প্রকাশ করে আরও হামলার হুমকি এবং শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে হামলার পর জঙ্গিদের কর্মকা- নতুন করে পর্যালোচনা করছে সরকার।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন


দেশের অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো এখন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের প্রধান যোগান প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কমতে শুরু করেছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমাদের প্রবাসীরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৯ কোটি ডলার (প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা) কম। অপর এক প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ও কিশোরগঞ্জ জেলার শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশের পোশাক খাতের বিদেশী ক্রেতারা অনিরাপদ বোধ করায় তারা বাংলাদেশের বাইরে আমাদের পোশাক শিল্পের মালিকদের সাথে বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছে। আরো একটি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচার এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের এক নেতা বলেছেন ঢাকায় বিদেশী ক্রেতাদের বেশ কয়েকটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেসব এখন বাতিল করছে। তারা এখন ভারত ও হংকংসহ অন্যান্য দেশে বসে বাংলাদেশের বৈঠকগুলো সেরে নিতে চাচ্ছে। তিনি আরো বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার ক্ষতি ও আতঙ্ক বিদেশীদের লক্ষ্য অন্য দেশে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। আগামীতেও যে তারা যাবে না তার নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবে? যে যাই বলুন না কেন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতিতে। এদিকে দেশব্যাপী ধারাবাহিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে দেশী-বিদেশী সকলের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্বেগের প্রধান কারণ হলো বিনিয়োগ স্থবিরতা। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলছেন, আস্থার সংকটে পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য বিপুল অংকের অর্থ মজুদ থাকলেও বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। সরকারের শতভাগ অর্থ খরচের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এবারেও ব্যর্থ হয়েছে। ওদিকে কাজে সফলতা আসেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ তদারকিসহ বিশেষ নির্দেশনা, সচিবদের সাথে প্রকল্প পরিচালকদের সমন্বয়, তিন মাস পরপর অগ্রগতি প্রতিবেদন, পিডিদের কাজের মূল্যায়নে পদোন্নতি, পরিকল্পনা মন্ত্রীর গুচ্ছ পরিকল্পনা। সোজা কথায়, এক কঠিন গ্যাঁড়াকলে আটকে পড়েছে আওয়ামী সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন।
যে যত কথাই বলুন না কেন, অনেক দিন থেকেই জনগণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে রয়েছে। এর একমাত্র কারণ অগণতান্ত্রিক, ভোটারবিহীন স্বঘোষিত অটো সরকারের উপর আস্থার সংকট। এর সূত্র উৎস নিয়ে নতুন করে বিশদ আলোচনা না করলেও দেশের গণতন্ত্রপ্রেমিক সকল সচেতন মহল জাতীয় স্বার্থে নাজুক পরিস্থিতি উত্তরণের পক্ষে ঐকমত্য ঘোষণা করলেও কোন অদৃশ্য অপশক্তির গোপন স্বার্থ হাসিলে আওয়ামী সরকারের সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক একগুঁয়েমি এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী তোষামোদকারী চক্রের ভ-ামি এবং সরকারের কোন কোন মহলের নানা মতলবি ব্যাখ্যার কারণে পরিস্থিতিতে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন করা যায়নি। অর্থনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরলেই তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিদিনই উন্নতি হচ্ছে। এ যে এক ধরনের মিথ্যাশ্রয়ী গোঁজামিলের মধ্যে সত্য প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা সে কথাটাই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা একাধিকবার বলে আসছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কার্যকর বাস্তবতায় নিয়ে যেতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে এবং এখনো বলা হচ্ছে। বাস্তব কথাটিই হচ্ছে সরকারের কোন কোন মহল এক ধরনের সাজানো গোছানো পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেশের জনগণ এবং সচেতন মহলকে বোকা বানানোর যে অপচেষ্টা করে আসছে এবার সেই মুখোশই খুলে গেছে প্রবাসী আয়ের হিসেবে। এক বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে ধাক্কা লেগেছে।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদেশে আমাদের জনশক্তি রফতানিতে ধস, বিশ্ববাজারে তেলের দরপতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের দেশে ফেরত আসা ও ক্ষুদ্র অংকের প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের গতি প্রবাহ কমে গেছে। বিশ্লেষকরা আশংকা প্রকাশ করছেন যে, পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে প্রবাসী আয়ে আরো ধস নামা অস্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যেই চলমান সন্ত্রাসী হামলাগুলোতে বাংলাদেশী ধনী ঘরের সন্তান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়াদের সম্পৃক্ততার কথা যেভাবে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
এদিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গত সপ্তায় রাজধানীর একটি হোটেলে আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিনিয়োগ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে বিনিয়োগের জন্য তহবিল নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা না থাকলেও দুশ্চিন্তা রয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট নিয়ে। বলা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতিমালা সহজ করলেও কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ সংশয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের চলমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এতে আরো বলা হয়েছে, এমনিতেই বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছেন না। তার উপর বিদেশীদের হত্যায় আরো সংশয় বেড়ে গেছে। আলোচনায় যথার্থই উঠে এসেছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কথা। গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা-মালিকরা। গুলশানে বিদেশীদের হত্যায় অনেক বিদেশী ক্রেতাই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই অর্ডার বাতিল করেছেন। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রধান ক্রেতা দেশ হচ্ছে জাপান, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়া। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলাগুলোতে এসব দেশের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। গুলশান ঘটনার পরপরই বলা হয়েছে, বিদেশী ক্রেতারা তাদের অর্ডার নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ছেড়ে পৃথিবীর অন্যান্য নিরাপদ দেশে বিনিয়োগ করার চিন্তাভাবনা করছেন। এ কথাই সমর্থন করে চরম নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ক্রেতাদের বাংলাদেশে বৈঠক বাতিল করা। যে কেউ স্বীকার করবেন, আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে প্রধানত প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক খাতের বৈদেশিক আয়ের উপর। আমাদের পোশাক খাতের আয় কেবল বৈদেশিক মুদ্রার জন্যই নয়, দেশের লাখ লাখ কর্মবিনিয়োগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সেদিক থেকে বলা যায়, এই খাতের ধস নামলে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কার্যত দেশ এখন আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। সে বিবেচনায় যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাতে ব্যাপক ধস নামে তাহলে তা যে দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দেবে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এখনই অনুধাবন করেছেন কী? রাষ্ট্র পরিচালকরা যত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কথাই বলুন না কেন, আমাদের জাতীয় অর্থনীতি সক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সবই যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যাবে, তাও কি বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকার জন্য যে আস্থার প্রয়োজন তা কার্যত এখন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজনৈতিক আস্থার পরিবেশ না থাকাটাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার মুখে যত চমকপ্রদ কথাই বলুন না কেন, দেশের পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সে কথা সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাবলী এবং পরবর্তী নানা পরিস্থিতির বিশ্লেষণে সচেতন নাগরিকদের মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আস্থার সংকট কতোটা বেড়ে গেছে তা বুঝা যায় অন্য এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত মার্কিনীদের স্বেচ্ছায় ঢাকা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সাথে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের চলাচলের ক্ষেত্রে নিজ দেশের নাগরিকদের সাবধানের পরমার্শ দিয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে দু’টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে জানা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের পরিবর্তে এখন বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রেই হবে। অপরদিকে এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টার আয়োজিত টেলিকমিউনিকেশন্স বিষয়ক সম্মেলনটির ভেন্যুও পরিবর্তিত হয়েছে। এখন ঢাকার পরিবর্তে শ্রীলংকা অথবা থাইল্যান্ডে হতে পারে। নিরাপত্তার অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যেই পাশ্চাত্যের অনেক দেশ বাংলাদেশে তাদের কার্গোফ্লাইট বাতিল করেছে। সামগ্রিকভাবে এখন আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্রম উন্নতির ভাবনাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার সময় এসে গেছে। শুধুমাত্র কারো প্রতি হুমকি-ধমকি নয়, ক্ষমতার দম্ভে অতি কথন বা কথার ফুলঝুরি কিংবা তোষামোদ নয়, এখনই এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে কেন এবং কোন কোন কারণে প্রকৃতই দেশের অর্থনীতি এমন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী আপনারা মুখে যাই বলুন না কেন, সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ঘটনা যে আমাদের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং আগামীতেও যে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কে দেবেন? সামগ্রিকভাবে আস্থার সংকট দূর করতে না পারলে মূল পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা করাটা আদৌ সম্ভব হবে কি? রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বাস্তব সংকট নিরসনে সকল দল ও মত নির্বিশেষে সর্বদলীয় জাতির ঐক্য গড়ে তুলে সম্মিলিতভাবে কার্যকর  পদক্ষেপ নেবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জঙ্গি হামলার গুজব ছড়ানো অপরাধ : তাহলে আনন্দ বাজারের রিপোর্টটি কী?


সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে ভিত্তিহীন গুজব ও আতঙ্ক ছড়ানো অবশ্যই একটি অপরাধ। এই অপরাধ আইনত দণ্ডনীয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জনাব আসাদুজ্জামান মিয়া ঠিকই বলেছেন যে, জঙ্গি হামলার গুজব সৃষ্টি একটি ফৌজদারি অপরাধ। এই গুজবে কান না দেয়ার জন্য জনাব আসাদুজ্জামান মিয়া জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার তার অফিসে উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, “আমি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, একটি কুচক্রী মহল অসৎ উদ্দেশ্যে মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট গুজব ছড়িয়ে জনগণের মনে ভীতি এবং আতঙ্ক তৈরি করছে। কখনো বলছে অমুক তারিখে হামলা হবে, কখনো বলছে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জঙ্গি হামলা হবে, কখনো বলছে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জঙ্গি হামলা হবে। স্কুলে জঙ্গি হামলা হবে, রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা হবে, হোটেলে-মার্কেটে জঙ্গি হামলা হবে, শপিংমলে জঙ্গি হামলা হবে। এই ধরনের গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। আমি সকলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করবো, এই ধরনের মিথ্যা গুজবে কেউ কান দেবেন না।”
আছাদুজ্জামান বলেন, “এই ধরনের গুজব রটিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে যারা দেশকে অশান্ত করতে চায়, দেশের দৃশ্যমান উন্নয়নকে ব্যাহত করতে চায়, তারা প্রকৃত অর্থে জঙ্গিদেরই পৃষ্ঠপোষক, জঙ্গিদেরই সমর্থক। তাদের বিরুদ্ধে আমরা দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৎপর রয়েছি।”
জঙ্গি হামলা ঠেকাতে পুলিশের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়ে মানুষকে তাদের দৈনন্দিন কাজ করার আহ্বান জানান ডিএমপি কমিশনার। জঙ্গি হামলার গুজব বিষয়ক যে কোনো তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে জানানোর জন্য অনুরোধও করেন তিনি।
আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “যারা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, দেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি এ ধরনের কোনো তথ্য পান, সরল বিশ্বাসে কারো সঙ্গে শেয়ার না করে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান। আমরা সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” ‘দেশে কোনো ধরনের কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। “পুলিশ আপনাদের পাশে আছে। আপনাদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছি।”
ডিএমপি কমিশনারের সম্পূর্ণ বক্তব্যই আমরা তুলে দিলাম। পুলিশ সম্ভাব্য জঙ্গি আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কী কী করছে এবং ভবিষ্যতে যাতে জঙ্গিরা মাথা তুলতে না পারে তার জন্য পুলিশ যে সব বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সেসব পরিকল্পনাও জনগণ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জেনে গেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, পুলিশ তার সামর্থ্যের মধ্যে যা যা করা সম্ভব তার সব কিছুই করছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ধরনের গুজব এবং আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কারা? যখন বলা হয় যে, আমি খোলাখুলি কিছু বলব না, ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলব আপনারা বুঝে নেন, তখন কি এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয় না? যখন বলা হয়, বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। আগামীতে ঐ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার চক্রান্ত চলছে, আপনারা সতর্ক থাকুন, তখন কি আতঙ্ক ছড়ানো হয় না? যখন বলা হয় যে, গাছের পাতা যখন নড়ে না, প্রকৃতি যখন শান্ত কিন্তু স্তব্ধ থাকে তখন সেটা ঝড়ের ইঙ্গিত দেয়, তখন কি আতঙ্ক ছড়ানো হয় না? এসব কথা বলেছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যিনি আওয়ামী লীগেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আবার সরকারেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যখন এই ধরনের কথা বলেন তখন মানুষ সহজেই তা বিশ্বাস করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এসব উক্তি নিয়ে মধ্যবিত্তদের ড্রইং রুমে এবং অফিস পাড়ায় তুমুল আলোচনা হয়েছে। আমরা এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এই ধরনের উক্তিকে গুজব ছড়ানো বলব না, তবে এটুকু বলব যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য তার ঐসব উক্তি যথেষ্ট। তার ঐসব উক্তির মাধ্যমে শুধু সাধারণ আতঙ্কই ছড়িয়ে যায় না, রীতিমত ভয়াবহ আতঙ্কও ছড়িয়ে যায়।
॥দুই॥
জাতীয় সংসদের দুই সদস্য সেদিন সংসদের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতায় বলেন, আমরা মরতে ভয় পাই না। কিন্তু তাই বলে লজ্জাজনক মৃত্যু চাই না। ডিসি এসপিসহ সচিব পর্যন্ত সকলকেই তাদের নিরাপত্তার জন্য গানম্যান দেয়া হয়। অথচ আমরা অর্থাৎ এমপিরা প্রোটোকলের দিক দিয়ে সচিবের ওপরে হলেও আমাদেরকে গানম্যান দেওয়া হয় না। এই দাবি তুলেছেন দুই জন সদস্য। তারা হলেন জাতীয় পার্টির জনাব ফিরোজ রশিদ এবং জাসদের মঈনুদ্দিন খান বাদল। তারা সংসদের স্পিকারের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি করেন, জাতীয় সংসদের সকল সদস্যকে গানম্যান দেয়া হোক। তাদের এই দাবির প্রতি জাতীয় সংসদের সমস্ত সদস্য প্রচ- শব্দে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ‘সরাসরি’ নামে যে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে সেই টেলিভিশন চ্যানেলে এই অধিবেশনের পূর্ণ ধারাবিবরণী সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। এখন দেশের প্রায় সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেলই সরকার সমর্থক। দুয়েকটি চ্যানেল আছে যাদেরকে সরাসরি সরকার সমর্থক বলা যাবে না। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং বিরোধী দলের কোন রকম রাজনৈতিক তৎপরতার অনুপস্থিতিতে ওরাও পরোক্ষভাবে সরকার সমর্থক চ্যানেলে পরিণত হয়েছে। তাই এই সব প্রাইভেট চ্যানেলসমূহেও ঐ দুই এমপির বক্তব্য এবং সদস্যদের টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থনের দৃশ্য ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। পত্রপত্রিকাতেও প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে খবরটি ছাপা হয়েছে। এমপি সাহেবদের এই সব উক্তির মাধ্যমে কি সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে না? টেলিভিশনে এই দৃশ্য দেখে এবং পরদিন পত্রপত্রিকায় অধিবেশনের ধারাবিবরণী দেখে জনসাধারণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভয় এবং আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাদেরকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, মন্ত্রীরা যদি চলাফেরা করতে ভয় পান, ৩৪৫ জন সংসদ সদস্য যদি চলাফেরা করতে ভয় পান এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য যদি গানম্যান প্রয়োজন হয় তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কত করুণ এবং অসহায় হতে পারে? সুতরাং এসব ঘটনার মাধ্যমেও ভয় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে চৌকশ বাহিনী বলা হয়। তবে আওয়ামী লীগ এই বাহিনীকে অতিরিক্ত রাজনীতিকরণ করার ফলে জনগণের আস্থায় চিড় ধরেছে।
॥তিন॥
দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মন্ত্রীদের সাবধানে চলাফেরা করতে অনুরোধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন তার মন্ত্রীদের সাবধান থাকার এবং সতর্ক হয়ে চলাফেরার পরামর্শ দেন তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে ঐ পরামর্শকে হালকা ভাবে নেয়া যায় না। কারণ প্রধানমন্ত্রী কেবল সমস্ত ক্ষমতারই অধিকারী নন, তিনি সমস্ত তথ্যেরও আধার। কারণ দেশের যেখানেই বা যে প্রান্তেই যখন কোন গুরুতর ঘটনা ঘটে অথবা ঘটার আশঙ্ক থাকে তখন তাৎক্ষণিকভাবে সে সংক্রান্ত তথ্য যথাযথ সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো হয়। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে উজবেকিস্তানে অনুষ্ঠিত আসেম সম্মেলন থেকে ফিরে বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী। আমার কাছে সব খবরই আসে। এসব খবরের মধ্যে যতটুকু প্রকাশ করা উচিত ততটুকুই আমি প্রকাশ করি। অবশিষ্ট তথ্যসমূহ আমি সাধারণত সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রকাশ করি না। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা এক শত ভাগ সত্য। তিনি সমস্ত খবর রাখেন। তাই তিনি যখন তার মন্ত্রীদেরকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলেন, তখন নিশ্চয়ই কোন কারণ ছাড়া তিনি বলেন না। এখন তথ্য প্রবাহের এমন উন্নতি হয়েছে, তথ্য প্রবাহ এমন বেগবান হয়েছে যে, যখন প্রধানমন্ত্রীর পর্যায় থেকে এই ধরনের কোন সংবেদনশীল বক্তব্য রাখা হয় তখন জনগণের মধ্যেও সেটি প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। আমরা প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের এসব বক্তব্যকে কোনভাবেই ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করছি না। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন যে এই ধরনের বক্তব্যে জনগণের মধ্যে ভয় এবং আতঙ্কের সৃষ্টি হয় কিনা।
॥চার॥
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জনাব আসাদুজ্জামানের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার প্রতি পূর্ণ আস্থা, সম্মান এবং শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, মন্ত্রীদের কাছে সতর্কভাবে চলাফেরার জন্য তিনি যে এসএমএস বার্তা পাঠিয়েছেন সেটা তিনি তার দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধের আওতার মধ্যেই পাঠিয়েছেন। মন্ত্রীদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান অবশ্যই পুলিশের কর্তব্য। কিন্তু তার এই এসএমএস পাঠানোর খবর এবং টেক্সট ম্যাসেজ সমস্ত পত্র পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলে ব্যাপকভাবে প্রচারিত এবং সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি আগেই বলেছি যে এটি হয়তো তিনি তার কর্তব্যবোধের আওতার মধ্যেই করেছেন। কিন্তু এদেশে মন্ত্রীদের কাছে উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের এই ধরনের টেক্সট ম্যাসেজ পাঠানো এবারই প্রথম। তাই যেসব পাঠক পত্রিকায় ঐ খবর পাঠ করেছেন অথবা যেসব দর্শক টেলিভিশনে ঐ খবর দেখেছেন তারা বিস্মিত এবং হতচকিত হয়েছেন। জনগণ পুলিশের এই পদক্ষেপকে এ্যাপ্রিসিয়েট করেও বলছেন যে, মন্ত্রী বা এমপিরা পুলিশি নিরাপত্তা পাচ্ছেন, ভাল কথা। কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেবে কে? এসব আলোচনাও কি এখন গুজব ও আতঙ্ক ছড়ানোর মধ্যে পড়বে?
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের কাছে পাঠানো ডিএমপি কমিশনারের ওই এসএমএসে সালাম জানিয়ে বলা হয়, গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, যে কোনো সময় যে কোনো মন্ত্রীর ওপর জঙ্গিগোষ্ঠী হামলা চালাতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। অনুগ্রহ করে সতর্ক থাকবেন এবং আপনার গানম্যান ও নিরাপত্তা দলকে বিষয়টি অবহিত করবেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালানো হতে পারে- এমন তথ্য দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভার সব সদস্য ছাড়াও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সতর্কভাবে চলাফেরার জন্য বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত গানম্যান ও হাউস গার্ডকে সতর্কাবস্থায় থাকার জন্য ব্রিফ করা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে বাড়িওয়ালাদের ভীতি ভাড়াটিয়া নিয়ে। তাদের ভয়, কখন না জানি কোন ভাড়াটিয়াকে জঙ্গিদেরকে বাসা ভাড়া দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিদিন খবরের কাগজ এবং টেলিভিশন জুড়ে জঙ্গিবাদের এত খবর থাকছে যে এটাই এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি হয়ে গেছে।
কথায় বলে ‘একে তো নাচুনে বুড়ি, তার ওপরে ঢোলের বাড়ি’। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা জঙ্গি হামলার গুজব ও আতঙ্কে ঢোলের বাড়ি দিয়েছে। গত ৮ জুলাই কলকাতার এই বহুল প্রচারিত পত্রিকাটি যা লিখেছে তার অংশ বিশেষ নিচে তুলে দিচ্ছিÑ
“বাংলাদেশের ২৪ স্থানে হামলা চালাবে জঙ্গিরা।”
“সন্ত্রাস কৌশলের যে চিরাচরিত ছকের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দারা, গুলশান কাফে সেই ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। গুলশানের তদন্তে যে সব তথ্য উঠে আসছে, তাতে স্পষ্ট, এখনই সামাল দেওয়া না গেলে আগামী দিনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করে আছে। গত এক সপ্তাহ ধরে তদন্ত চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা মাপের হামলা চালানোর জন্য জঙ্গিদের একটি বড়সড় রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি হয়ে রয়েছে রাজধানীর ১৫ কিলোমিটার বৃত্তের মধ্যে! আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের কমপক্ষে ২৪টি স্থানে জঙ্গিরা হামলা চালাবে বলে জানা গেছে। খবর: আনন্দবাজার।” এরপর পত্রিকাটি লিখেছে, “বুধবার বাংলাদেশে ফের হামলা চালানোর হুমকি দেওয়া যে ভিডিওটি সামনে এসেছে, গুলশান এবং কিশোরগঞ্জে হামলা নিয়ে তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা।” রিপোর্টের অন্য স্থানে বলা হয়েছে, “গুলশান-কিশোরগঞ্জের মতো হামলা যে অদূর ভবিষ্যতে আরও ঘটতে চলেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রশাসনকে ফের সতর্ক করেছে নয়াদিল্লি। ভারত জানিয়েছে, ঢাকার মতো বড় শহর ছাড়াও কিশোরগঞ্জ মডেলে ছোট ছোট জমায়েতে হামলা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবে জঙ্গিরা। সম্প্রীতি নষ্ট করতে হামলা চালানো হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরেও। ভারত-বাংলাদেশ জঙ্গি দমন সমন্বয়কে অকেজো করে দেয়াটাও লক্ষ্য।”
এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলুন, জঙ্গিবাদের হামলার আশঙ্কা ও গুজব ছড়াচ্ছে কারা? 

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জাতীয় ঐক্য এবং জাতির মর্যাদা


 এই সময়ে লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে যা বেছে নেয়া দরকার সেদিকে যাওয়ার উপায় নেই। কেন, তার উত্তর জানতে হলে ক্ষমতাসীনদের দিকে লক্ষ্য করাই যথেষ্ট। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের প্রত্যেকে যেন যুদ্ধে নেমে পড়েছেন! তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথা তো বলাই বাহুল্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জাসদ বিরোধী কঠোর আক্রমণের মুখে মিস্টার ইনুর যখন যাই যাই অবস্থা হওয়ার কথা, ঠিক তখনই একের পর এক ঘটেছে হামলা ও হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ঘটনা। গুলশানের অবরোধ বা জিম্মি নাটক থেকে শোলাকিয়ার হামলা ও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাই বিশেষ করে তার এবং জাসদের জন্য এসেছে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি সচেতন সকল মহলও জাসদকেন্দ্রিক বিতর্কের কথা ভুলে গেছেন। সেই সাথে বেঁচে গেছেন ইনু সাহেবরাও! ওদিকে সবাইকে স্তম্ভিত করে গত ১৭ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  ঘোষণা করেছেন, দেশে বিরাজমান সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে নাকি জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে! এই ঐক্য কাদের সঙ্গে হয়েছেÑ তারও জবাব দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, যাদের সঙ্গে ঐক্য হওয়া প্রয়োজন তাদের সঙ্গেই জাতীয় ঐক্য হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী একই সাথে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধেও যথারীতি সমালোচনা করেছেন। হত্যা-সন্ত্রাসের জন্য সব দোষ চাপাতে চেয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে যথেষ্টই বলা হয়েছে। সেদিকে যাওয়ার আগে জানিয়ে রাখি, এখানে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে না। তবে একটি কথা মানতেই হবে। কথাটা হলো, ঘটনাপ্রবাহকে এমনভাবে এগিয়ে নেয়া হয়েছে ও হচ্ছে যে, এসবের সঙ্গে কারো পক্ষেই তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। ‘কৃতিত্ব’ কাকে বা কোন গোষ্ঠীকে দিতে হবে- সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। মানুষের দৃষ্টি ও মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য এ ধরনের ঘটনার আসলে তুলনা হয় না। ফলে ধরেই নেয়া যায়, পেছনে তৎপর রয়েছে এমন কোনো গোষ্ঠী, যারা ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছুর পরিকল্পনা করছে। সে অনুযায়ী ময়দানে হাজির করা হচ্ছে সেই সব লোকজনকে, যাদের আগে থেকেই ‘জঙ্গি’ বা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি দেয়া হয়েছে। গুলশানের কথাই ধরা যাক। সেখানে পাঁচ-পাঁচজন ‘ওয়ান্টেড’ জঙ্গির লাশ পাওয়া গেলো, পুলিশ যাদের বহুদিন ধরে ‘খুঁজছিল’ বলে জানিয়েছেন স্বয়ং পুলিশের আইজি। ঠোঁট কাটারা বলেছেন, ওই পাঁচজনের ভাগ্য ভালো। কারণ, তাদের অন্তত বনে-জঙ্গলে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ প্রাণ হারাতে হয়নি। তারা মারা গেছে গুলশানের মতো অভিজাত একটি এলাকায়, যেখানে রয়েছে ‘নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা’! বলা দরকার, টিভি ক্যামেরার সামনে এই ‘ওয়ান্টেড’ জঙ্গিদের সম্পর্কে বলার জন্য আইজি সাহেবকে নাকি ধমক খেতে হয়েছে। কারণ, তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি প্রচারণা জোরদার হয়েছে যে, ‘ওয়ান্টেড’ পাঁচজনকে অনেক আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল ‘বন্দুক যুদ্ধ’ কিংবা ‘ক্রস ফায়ারের’ জন্য কোনো উপলক্ষের। গুলশানের জিম্মি নাটকের আড়ালে সে সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করা হয়েছে! এটা অবশ্য আমাদের কথা নয়, লোকমুখে শোনা গেছে।
জঙ্গিদের তৎপরতা এবং হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু করলেও এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নয়। আমরা বেশি উদ্বিগ্ন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ বা ভাবমর্যাদা নিয়ে। দেশ আসলে বহুদিন ধরেই ইমেজ সংকটে ভুগছে। জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড একটি বড় ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের ইমেজ সংকট শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। বড় কথা, সেখানে কথিত জঙ্গিদের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একটি উদাহরণ হিসেবে ঢাকার হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে যাওয়া কার্গো ফ্লাইটের ওপর বিভিন্ন দেশের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ খবর হলো, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের পর জার্মানিও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটা গত মাস জুনের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। এর ফলে হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই করে সরাসরি কোনো বিমানই জার্মানিতে যেতে পারবে না। এমনকি জার্মানির রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা লুফথান্সার কোনো বিমানও ঢাকা থেকে ওঠানো পণ্য নিয়ে সে দেশে ঢুকতে পারবে না। লুফথান্সাকেও জার্মানির অনুমোদিত তৃতীয় কোনো দেশের বিমান বন্দরে পণ্যগুলো রি-স্ক্যানিং করাতে হবে। সেখানে অনাপত্তিপত্র পাওয়া গেলেই ঢাকা থেকে নেয়া পণ্যসহ লুফথান্সার বিমান দেশটিতে ঢুকতে ও পণ্য খালাস করতে পারবে। নিষেধাজ্ঞার কারণ জানাতে গিয়ে খবরে বলা হয়েছে, বিমান বন্দরের রফতানি টার্মিনালে যারা কাজ করে তাদের বেশিরভাগই বহিরাগত। নামমাত্র স্ক্যানিং করেই তারা টার্মিনালে ঢুকে পড়ে এবং যখন-তখন বাইরে যাতায়াত করে। তারা যে পণ্যের সঙ্গে বোমা বা অন্য কোনো বিস্ফোরক এবং ধ্বংসাত্মক কিছু পাঠাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একই কারণে অনেকদিন ধরে সতর্ক করার পর চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে জার্মানি বলেছিল, এর মধ্যে বহিরাগতদের বিদায় করে নিজস্ব কর্মচারী নিযুক্তি না দেয়া হলে দেশটি বাংলাদেশ বিমান এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য কোনো দেশের বিমানকে কার্গো পরিবহন করতে দেবে না।
উল্লেখ্য, মূলত নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত বছর, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞা প্রথম চাপিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এর ফলে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার লোকসান গুণতে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার পর গত মার্চে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিটেন। এজন্যও বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশের রফতানি। এ দুটি দেশের পাশাপাশি জার্মানির নিষেধাজ্ঞা ক্ষতির পরিমাণকে কেবল বাড়াবেই। তাছাড়া একযোগে বহির্বিশ্বে ক্ষুণœ হবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা। উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনে বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বা ৮৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি করা হয়। দেশ তিনটির মধ্যে আমদানির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর জার্মানি রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এতদিন শুধু লুফথান্সার মাধ্যমেই মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতো বিমান। নিষেধাজ্ঞার ফলে ওই নিশ্চিত আয় বন্ধ হয়ে যাবে। ওদিকে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, গার্মেন্ট পণ্যের নমুনাসহ তৈরি পোশাক খাতের বড় অংশই আকাশ পথে শুল্কমুক্ত সুবিধায় জার্মানিতে যেতো। এ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।
এদিকে অনুসন্ধানেও কেবল অভিযোগের সত্যতাই পাওয়া যায়নি, বেরিয়ে এসেছে ভীতিকর বিভিন্ন তথ্যও। যেমন হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পুরো কার্গো রফতানি টার্মিনালই বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশন- ‘বাপা’ নামের একটি সংগঠনের দখলে রয়েছে। বাপা কর্মীদের অধিকাংশই চোরাচালানসহ বিভিন্ন মামলার আসামী, রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্যাডার এবং স্থানীয় সন্ত্রাসী। তারা নামমাত্র স্ক্যানিং করিয়েই কার্গো টার্মিনালে ঢুকে পড়ে এবং সর্বত্র অবাধে তৎপরতা চালায়। যখন-তখন টার্মিনালের বাইরে যাতায়াত তো করেই, তাদের নানা ধরনের পণ্যও আনা নেয়া করতে দেখা যায়। বাপার এসব কর্মির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের বিমানে রফতানি পণ্য ওঠানো বা লোড করা হয়। বিমান থেকে পণ্য খালাসও তারাই করে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, কার্গো টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ রেডলাইন নামের যে ব্রিটিশ সিকিউরিটি কোম্পানিকে নিযুক্তি দিয়েছে সে কোম্পানির সঙ্গেও বাপা কর্মীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উভয়পক্ষের মধ্যে গোপন লেনদেনের তথ্যও বিভিন্ন উপলক্ষে ফাঁস হয়েছে। বিষয়টি বিভিন্ন দেশ অবশ্যই লক্ষ্য করেছে আর সে কারণেই দেশগুলো বিমান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেয়ার দাবিও জানিয়েছে তারা। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারের কানেও পানি ঢোকেনি। মূলত সেজন্যই পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিমানের কার্গো পরিবহনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক দিক থেকেই শুধু ক্ষতিকর নয়, দেশের ভাবমর্যাদার জন্যও অত্যন্ত লজ্জাকর। অথচ বিমান কর্তৃপক্ষ যদি দেশগুলোর আপত্তি সম্পর্কে জানার পর  থেকেই বহিরাগতদের বিদায় করে কার্গো টার্মিনালে নিজস্ব জনবল বাড়ানোর পদক্ষেপ নিত তাহলে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের পর জার্মানির জন্য এতটা কঠোর ও অসম্মানজনক পদক্ষেপ নেয়ার অজুহাত তৈরি হতো না। কথাটা বলার কারণ, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বহিরাগতদের ব্যাপারে কোনো দেশের অভিযোগই অসত্য বা অমূলক নয়। আসলেও জনা কয়েক নিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া টার্মিনালে কর্মরতরা সবাই বহিরাগত। তারা দফায় দফায় বাইরে যাতায়াত করে। অনেকে নানা পণ্যও বহন করে। কিন্তু কোনোবারই আর স্ক্যানিং বা সার্চ করা হয় না। এর ফলে তাদের পক্ষে বোমা,  বিস্ফোরক বা অন্য যে কোনো ধ্বংসাত্মক বস্তু পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। বিষয়টি ধীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করেই বিভিন্ন দেশ বিমান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছে। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ বা সরকার গুরুত্ব দেয়নি। সেজন্যই পরিস্থিতি এতটা বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্গো টার্মিনালকেন্দ্রিক সমস্যার অবশ্যই আশু সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, দেশের ভাবমর্যাদার প্রশ্ন তো রয়েছেই, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। নিষেধাজ্ঞার ফলে রফতানি খাতে হাজার কোটি টাকার অংকে ক্ষতির শিকার হবে দেশ। বাস্তবে এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরুও করেছেন রফতানিকারকরা। এভাবে চলতে থাকলে ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোও নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে। তেমন অবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে গার্মেন্ট শিল্প শুধু নয়, কৃষি খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে শাক-সবজিও কার্গোর মাধ্যমেই রফতানি করা হয়। অর্থাৎ কার্গো নিষিদ্ধ হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে সর্বাত্মক। এজন্যই টার্মিনাল থেকে বহিরাগতদের বিদায় করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে এমনভাবে নেয়া দরকার, যাতে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্য কোনো দেশ যাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে। 
পাঠকরা সম্ভবত এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার এবং বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার সংকটের জন্য ক্ষমতাসীনরা প্রধানত কথিত জঙ্গিদের তৎপরতাকেই দায়ী করে থাকেন। সশস্ত্র হামলা ও হত্যাকান্ডের কথা বলতেও ভুল হয় না তাদের। অন্যদিকে এসব কর্মকাণ্ড কিন্তু অতি সাম্প্রতিক সময়ের। বাস্তবে বাংলাদেশ তার ভাবমর্যাদার সংকটে পড়েছে সরকারের নানামুখী ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কারণে। হজরত শাহ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপদজনক অব্যবস্থাপনা সেসবের একটি উদাহরণ মাত্র। দেশের ভাবমর্যাদার সংকটের পেছনে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলে নেতাকর্মীদের ওপর চলমান নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনও বিরাট ভ’মিকা পালন করে চলেছে। বহুবার আলোচিত বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে কথা না বাড়ানোই ভালো। তবে একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার। সাজানো নাটকের মাধ্যমে সব সময় সংকট লুকিয়ে রাখা বা সমস্যা আড়াল করা যায় না। কারণ, সত্যের ঢোল আপনা-আপনিই বেজে ওঠে। যেমনটি আইজিপির বদৌলতে বেজে উঠি-উঠি অবস্থায় এসে গিয়েছিল গুলশানের জিম্মি নাটক। অন্তরালের পরিকল্পনাকারীরাও অবশ্য জবরই দেখিয়েছেন। গুলশানকে দিয়ে তারা জাসদকেন্দ্রিক সংকটকে আড়াল করেছেন। এরপর এসেছে শোলাকিয়ার ঘটনা। কিন্তু এরকম প্রশ্নসাপেক্ষ পন্থায় কি সবকিছু অনির্দিষ্টকাল ধরে লুকিয়ে রাখা বা আড়াল করা যাবে? আমরা তো মনে করি, কৎসিত ও প্রশ্নসাপেক্ষ নানা পন্থায় দফায় দফায় দেশকে ডোবানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা। সে কথাটাই বলা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। বিএনপি বলেছে, জাতীয় ঐক্যের নামে প্রধানমন্ত্রী আসলে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের ঐক্যের কথাই বুঝিয়েছেন, যা মোটেও সমগ্র জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের আহ্বানে সাড়া দেয়া হয়নি বলেই দেশে প্রতিদিন ২০/২২ জন পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি ১৪ দলীয় জোটের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্যই দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার এখনো দোষারোপের রাজনীতিকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বিএনপি মনে করে, ঐক্য করতে হবে সকলকে নিয়ে। এমনকি কেবল সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য হলেও চলমান সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব হবে না। বিএনপি সরকারের দোষারোপের রাজনীতিরও তীব্র সমালোচনা করেছে। বলেছে, কিছু ঘটলেই তার দায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত ঘাতক-সন্ত্রাসীরা পার তো পেয়ে যাচ্ছেই, প্রশ্রয়ও পাচ্ছে। সে জন্যই নতুন নতুন হত্যা-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটতে পারছে। অন্যদিকে এসবের দায় সরকার শুধু বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছে না, মিথ্যা অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে। তাদের নামে মিথ্যা অভিযোগে মামলাও চাপাচ্ছে। বিএনপি নেতারা সরকারের এই কর্মকা- বন্ধ করার এবং অবিলম্বে কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে’ বলে প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তা একেবারেই অন্যায্য ও অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী যদি ১৪ দলীয় জোটের কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তার বক্তব্য ঠিক আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষও এখন বুঝতে পারে যে, এটা জাতীয় ঐক্য নয়। বরং ঐক্য সৃষ্টির পরিবর্তে দোষারোপের রাজনীতির মাধ্যমে সরকার জাতিকে বিভক্তির দিকেই ঠেলে দিয়েছে। জঙ্গি দমনের নামে নাটকীয়তা সৃষ্টি করে জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অব্যাহতভাবে খুন করা হচ্ছে। অনেকেই গুম হয়ে যাচ্ছেন। অনেকের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে বিভিন্ন ঘটনার দায় স্বীকার করার জন্য মিথ্যা জবানবন্দী আদায় করা হচ্ছে। এ সমস্ত কার্যক্রম প্রকারান্তরে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদেরকেই আড়াল করার এবং আস্কারা দেয়ার শামিল। হত্যা-সন্ত্রাসের এই দুর্যোগ থেকে জাতিকে মুক্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ সৃষ্টির করতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই দলীয় একচোখা রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল অনুরোধ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যাতে দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করেন এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে কার্যকর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সরকারী ও বিরোধী দল নির্বিশেষে চিন্তাশীল, বিবেকবান এবং সকল পর্যায়ের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াতের পরামর্শ ও আহ্বানের মধ্যেই রয়েছে কথিত জঙ্গিদের উৎখাত করার পাশাপাশি দেশের ভাবমর্যাদার সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা। নাহলে অযথাই বারবার নাটক সাজানোর ঝুঁকি নিতে হবে। কথিত জাতীয় ঐক্য নিয়েও নাটকীয়তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বড় কথা, এত বেশি ঝুঁকি নেয়াটাও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!
আশিকুল হামিদ 

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সন্ত্রাসবাদ অজেয় কিছু নয়


সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। তবে এখানে বলার মতো একটি বিষয় রয়েছে। মানুষ স্বতই শ্রেষ্ঠ নয়, শ্রেষ্ঠ হওয়ার মতো সম্ভাবনা মানুষের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে। কাক্সিক্ষত গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষ শ্রেষ্ঠ হতে পারে। মানুষ যেমন তার সম্ভাবনার কথা জানে, তেমনি জানে সীমাবদ্ধতার কথাও। তাই তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে একে অপরের সহযোগিতায় উন্নত জীবন যাপনের লক্ষ্যে। কালক্রমে মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে, সংবিধান রচনা করেছে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের মাধ্যমে প্রগতির অভিযাত্রাকে আরো সমুন্নত করতে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানুষ কিংবা মানুষের রাষ্ট্র সব সময় কাক্সিক্ষত অভিযাত্রায় চলতে পারেনি। কখনো মানুষ, কখনো রাষ্ট্র হয়েছে পথচ্যুত ও পথভ্রষ্ট। বর্তমান সময়েও আমরা তেমন চিত্র লক্ষ্য করছি। সন্ত্রাসবাদের দানব ক্রমশই তার থাবা বিস্তার করছে এবং বর্তমান সভ্যতায় মানুষের জনপদ পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে। কখন যে কে কোনদিক থেকে হামলা করবে এবং মানুষের জীবন ঝলসে যাবে তার কোনো তথ্য নেই। মানুষের হাতে মানুষ এভাবে নিহত হবে, সমাজ বিপর্যস্ত হবে- এজন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি কিংবা রাষ্ট্র গঠন করেনি।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে মনে হয়, সন্ত্রাসবাদই যেন বর্তমান সময়ের সবচাইতে বড় সমস্যা। সবাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথাও বলছে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। তারপর আমরা ইরাক ও আফানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি, ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি লিবিয়া ও সিরিয়ায়। বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের ফলে সন্ত্রাস কমেনি বরং বেড়েছে। এক সময় আমরা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আল কায়েদার নাম বেশি শুনতাম। এখন শুনছি আইএস-এর কথা। আইএস-এর সন্ত্রাস এবং ধ্বংসযজ্ঞ বর্তমান সময়ে মানুষের জনপদগুলোকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবাই যখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এবং পরাশক্তিগুলো যখন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হচ্ছে না কেন? এখানে কোনো রহস্য বা গোমড় আছে কি না সেই প্রশ্ন পুরানো। এখন তো স্বয়ং যুক্তরাজ্যের সরকার মহল থেকেও বলা হচ্ছে, আমেরিকার কারণেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে। আর ইরাক যুদ্ধবিষয়ক বৃটিশ তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জন চিলকোট তো বলেছেন, ভুল গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইরাক যুদ্ধে জড়িয়েছিল বৃটেন। ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের তথ্য ছিল ভিত্তিহীন। ইরাকের বিরুদ্ধে বৃটেনের আগ্রাসী যুদ্ধকে ত্রুটিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির রিপোর্টটিও সঠিক ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন জন চিলকোট। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, যুদ্ধের কারণে যে ঝুঁকি তৈরি হবে তা যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে সমর্থ হয়নি বৃটেন। ইরাক যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই তো আজকের এই আইএস এবং সন্ত্রাস-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও কি সন্ত্রাসবাদের জন্য ইসলাম, মুসলিম কিংবা অন্য কাউকে অভিযুক্ত করা যায়?
আমাদের প্রিয় স্বদেশও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। গুলশান হামলায় কেঁপে উঠেছে পুরো দেশ। আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ এবং তাদের ধর্মীয় চেতনা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। ফলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালালে এ দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ পালাতে বাধ্য হবে। তবে এই লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে দুইভাবে। দেশের ভেতরে সন্ত্রাসের মানসিকতা দূর করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে পেশিশক্তির বদলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তথা সহিষ্ণুতার প্রসার ঘটাতে হবে। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করার লক্ষ্যে সর্বস্তরে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়া উন্নত মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে নৈতিক চেতনার প্রসার ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে এভাবে পরিগঠিত করা গেলে বাইরের কোনো শক্তি বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না। ভেতরের এই কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি যাথারীতি ব্লেমগেমে উৎসাহ দেখানো হয় তাহলে সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হবে কেমন করে? সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ভুল পথ গ্রহণ করা হলে সন্ত্রাসবাদের সংকট আরো বেড়ে যাবে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বড় বড় শক্তিগুলোর মদদ কেমন পরিণতি ডেকে এনেছে? ওই দেশগুলোর উদাহরণ থেকেও কি আমরা কোনো শিক্ষা নেব না? বাস্তবতা হলো কাছের বা দূরের কোনো বড় দেশকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাস নির্মূলে নাক গলাতে দেওয়া যাবে না। বড় বড় দেশগুলোর স্বার্থও বড়। ওদের স্বার্থের চাপ বহন করার মত সামর্থ্য ছোটদেশগুলোর নেই, বাংলাদেশেরও নেই। আমাদের বুঝতে হবে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির ফসল এই সন্ত্রাসবাদ। তাই বড় দেশগুলোর লক্ষ্য ও কৌশল সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বাইরের বিপদ মোকাবিলা তখনই সহজ হবে, যখন আমরা ভেতরের দুর্বলতাগুলো দূর করতে পারবো। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে শুধু চাতুর্য ও কথামালা দিয়ে সন্ত্রাসবাদের মহাবিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।

শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু কাম্য নয়


মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলার ঘটনায় প্রথমে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক, পরে পুলিশ রিমান্ডে থাকা কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে সাজানো ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করায় সারাদেশে তীব্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশের প্রতি সকলের সন্দেহের দৃষ্টি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ও পাঠক মতামতে এ ঘটনার প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। ফাহিমকে হত্যা করার বিষয়ে যে বিবরণ পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তাতে নতুন কিছু নেই। অতি পুরনো, অতিকথিত কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। দেশের সচেতন মানুষ পুলিশের এই ক্রসফায়ারের গল্প বিশ্বাস করে না। মানুষ মনে করে, এটা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের টার্গেট কিলিংয়ের মতোই পুলিশের এক ধরনের ‘টার্গেট কিলিং’ বা ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’। ফাহিমের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ২০ দলীয় জোট, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী সমাজ, আইন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিমান্ডে থাকা আসামী হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় এভাবে নিহত হতে পারে এটা কী করে বিশ্বাসযোগ্য হয়?
পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে এবং নিñিদ্র পাহারার মধ্যে থাকার পরও যদি দেশের কোন নাগরিক হত্যার শিকার হয় তবে তার দায় পুলিশ এড়াতে পারে কি? ফাহিম ছিল রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলার ঘটনায় একমাত্র আসামী। তার গ্রেফতার করার কৃতিত্ব কিন্তু পুলিশের নয়, আশপাশের কিছু লোক তাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। গত কয়েক দিনে পুলিশের পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে নানা সাজানো-গোছানো কথা বলা হয়েছে। তার কাছ থেকে হামলার উদ্দেশ্য, হামলায় আরো কারা কারা জড়িত ছিল, নেপথ্যে কারা ছিল এসব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেত। অথচ প্রকৃত অপরাধী ও কুশীলবদের আড়াল করতেই হয়তো তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
দেশের অনেকেই শর্ষের ভেতর ভূতের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। টিভির টকশোগুলোতে এ হত্যাকা- নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগত কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলের নেতা এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের অনেকেই ‘পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘ক্রসফায়ার করে হত্যাকা-’ ঘটনো নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী অটো সরকারের বন্ধু স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রাষ্ট্র আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের প্রশ্নÑ পুলিশ কাকে আড়াল করতে এই কথিত বন্দুকযুদ্ধ করেছে? ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক জাসদ নেতা মাইনুদ্দিন খান বাদলও কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছেন। পুলিশ রিমান্ডে থাকা কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশেরই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা মিডিয়ায় যখন তোলপাড় চলছে, তখনই ঢাকার খিলগাঁও মেরাদিয়া বাঁশপট্টিতে ব্লগার অভিজিত হত্যা মামলার আসামী শরিফুল ভেবে যে যুবককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়, পরে জানা যায় তার নাম মুকুল রানা।
পুলিশের রিমান্ডের আসামীর ক্রসফায়ারে হত্যা করা বা মেরে ফেলার ঘটনা নাৎসী বাহিনীর বর্বর হত্যাকা-ের ভয়াবহ ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের হেফাজতে যখন আসামী থাকে তখন সকল দায় রাষ্ট্রের। একজন শিক্ষকের উপর কথিত হামলা করতে গিয়ে সে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হলো। পরে পুলিশ বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এরপর পুলিশী রিমান্ডে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় কিভাবে এটা হলো তা সাধারণ বুদ্ধিতে ধরে না। বলা বাহুল্য, সাধারণ বুদ্ধিতে না ধরার কিছু নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেছেন, বড় কোন ঘটনাকে আড়াল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হলো কিনা এ ধরনের প্রশ্ন জনগণের মধ্যে আসতে পারে। কোন প্রশ্ন নয়, বিএনপির পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতেই ক্রসফায়ারে ফাহিমকে হত্যা করা হয়েছে।
জানা যায়, সারা দেশে গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার এবং পুলিশী হেফাজতে ৪৫৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৮৩ জন এবং চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৭৩ জন কথিত বন্দুকযুুদ্ধে বা পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সব কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের সাজানো গোছানো কাহিনী ছিল প্রায় অভিন্ন। পুলিশের রিমান্ডে থাকাবস্থায় মাদারীপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিবিসি বাংলাকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশী রিমান্ডের সময় আইনজীবী এবং নিকট আত্মীয় ও পরিচিত কারো উপস্থিতির বিধান থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। দেশে কারো কোন সন্দেহ নেই যে, পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ মেরে ফেলছে। ২০০৪-০৫ সালে হয়তো কেউ কেউ পুলিশের ক্রসফায়ারের কিচ্ছা বিশ্বাস করতো, এখন কেউ বিশ্বাস করে না। তিনি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে নিম্ন আদালতের রিমান্ডে মঞ্জুরের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলা ভিশনের টকশোতে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার গত ১৫ থেকে ২০ বছরের পুলিশের একটি ধারাবাহিক গল্প। যে গল্পের কাহিনী, দৃশ্য, চরিত্র, অংক কোন কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। ক্রসফায়ার বিষয়টা হচ্ছে একটি বিশেষ অভিযানে কখনো কখনো কথিত অপরাধীর পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়, যে যুদ্ধে পুলিশ নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গুলী করে। তখন ঐ গুলীতে অপরাধীর কেউ মারা যায়। এমন একটি গল্প আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন তদন্তে পুলিশকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত কোন পুলিশ বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মারা গেছে এ রকম দেখিনি। এক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমেরিকায় প্রতিবছর ক্রসফায়ারে অপরাধীরা মারা যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যও মারা যায়। অথচ বাংলাদেশে শুধু একপক্ষ মারা যায়, অন্যপক্ষের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে ফাহিম নিহতের ঘটনাকে আষাঢ়ে গল্প হিসেবে অভিহিত করে ফেসবুকে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট থাকার পরও ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। পুলিশ বলছে, তার বুকের বাঁ পাশে দু’টি গুলীর চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আশংকাটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর উপর কথিত হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই, সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম। কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই। যারা ফাহিমের মতো কিশোর-তরুণদের গুম করে এসব অপারেশনে যেতে বাধ্য করে, তাদের পক্ষে এ রকম অবস্থায় বসে থাকলে চলে না। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে লেখেন, একদিকে সরকার নিজদলীয় সিরিয়াল খুনিদের ফাঁসিসহ সকল সাজা মওকুফ করে দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করছে। অন্যদিকে জনতার হাতে ধরাপড়া কথিত হামলাকারী, টার্গেট কিলারদের খুন করে সব প্রমাণ আড়াল করছে। তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এর নাম কি ন্যায়বিচার? কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বন্দুক তুমি যুদ্ধ চেন, তদন্ত চেন না।’ সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ফাহিম হত্যকা-ই উত্তর, কারা দেশে জঙ্গি টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়।’ আওয়ামী অটো সরকারের একান্ত অনুগত প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী ফেসবুকে লিখেছেন, আমাদের ভালো ইচ্ছেগুলোকে করে দেয়া হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। ফাহিম ছেলেটির রিপোর্টে পড়ছিলাম আদালতে বিচারককে সে চিৎকার করে বলে এই ঘটনার সাথে সে জড়িত না। স্থানীয় এক নেতা তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত কোনো জঙ্গি এভাবে কোর্টে বলে না। কিন্তু পুলিশ তাকে রিমান্ডে এনে মেরে ফেললো ক্রসফায়ারে? স্থানীয় যে নেতার কথা ফাহিম বলেছিল, সে কি পুলিশের জন্য বিব্রতকর ছিল? ফাহিমের পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফাহিমের নিহত হওয়ার খবরে তার বাবা-মা আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের সন্তান যদি কথিত সন্ত্রাসী কিংবা কোনো জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকে তার বিচার চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মতো নাটক সাজিয়ে হত্যা করতে হবে। এখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে কেউ যেন গণমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য না করে। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছেন, যারা অপরাধী তাদেরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্রসফায়ার সম্পর্কে বলেছেন, পুলিশ প্রথমে কথিত অপরাধীদের ধরে কোর্ট হাজতে থানায় নিয়ে যায়। এরপর সেই অপরাধীরা পুলিশের রিমান্ড থেকে আর জেলখানায় বা তাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যায় না। সাজা চলে যায় ক্রসফায়ারে। হয়তো অপরাধী এমন কিছু তথ্য দেয়, যার ফলে সরকারই জড়িয়ে যাবে। এ জন্য তখন তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সবারই ধারণা, এমন কোনো কারণ হয়তো থাকতে পারে, যে জন্য ক্রসফায়ারে কলেজ ছাত্র ফাহিমকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐ কথিত হামলা ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনই নয়, আরো অনেক কিছু জানার জন্য তাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি ছিল। প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে যে কাহিনী শোনানো হয় তা একই রকম হওয়ায় গভীর সন্দেহ জাগায়।
সারাদেশের লাখ লাখ পাঠক, বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া ও জাতীয় দৈনিক সমূহের অনলাইন সংস্করণের কথিত বন্দুক যুদ্ধে ফাহিমের নিহতের খবরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলতে গেলে, গোটা দেশবাসী পুলিশের বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য এবং সাজানো নাটক হিসেবে অভিহিত করছেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের পর একইভাবে বক্তব্য দেয় পুলিশ। অথচ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কোথায় ক্রসফায়ারের গোলাগুলি হলো। আমজনতা আশ্বস্ত হতে পারছে না পুলিশের কথায়। শুধু দেশের মানুষ নয়, ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী এবং তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী, সুশীল এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতারাও কথিত বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ক্রসফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। সারাদেশের পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ তা বুঝতে পেরে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আড়াল করার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকা শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের মতো মানবাতাবিরোধী অপরাধ জনগণ সমর্থন করে না, করতে পারে না। আমাদের এই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সাফল্য রয়েছে। র‌্যাবের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জঙ্গিনেতা বাংলাভাই ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, র‌্যাব-পুলিশের সম্মুখ যুদ্ধে জেএমবি’র অনেক রাঘব-বোয়াল গ্রেফতার হন। তাদের কারো বিচার হয়েছে। কেউ এখনো বিচারের মুখোমুখি। গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার না থাকায় দেশে আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট, সন্ত্রাসী তাণ্ডব এখন চরম পর্যায়ে। বিদেশি আধিপত্যবাদী আগ্রাসী অপশক্তি ও তাদের এ দেশীয় প্রভাবশালী দোসরদের চক্রান্তে সন্ত্রাস ও কথিত জঙ্গি অপতৎপরতা বেড়ে চলেছে এবং একের পর এক অপহরণ, গুম, খুন এবং গুপ্ত হত্যার ঘটনা ঘটছে। অথচ দেশের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মানুষ সন্ত্রাস, কথিত জঙ্গিবিরোধী এবং এ ধরনের হত্যা-গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করে না। মূলত হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার কিংবা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, কোনোভাবেই চলমান সমস্যা আর সংকটের আদৌ সমাধান দিতে পারবে কী? আমাদের সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং প্রচলিত বিধিবদ্ধ আইনকে কেউ উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে অপহরণ, খুন, গুম, হত্যা, গুপ্তহত্যা, গ্রেফতার, গণগ্রেফতার, রিমান্ডের নামে বর্বর নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত বন্দুকযুদ্ধ এবং ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিলে তার পরিণাম  ভবিষ্যতের জন্য আরো কোনো ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে না তো? জনগণের ভোটের অধিকারের পাশাপাশি বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই আজ বড় বেশি প্রয়োজন। অন্যথায় গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা কেবল বেড়েই যাবে। বর্তমানে দেশে কথিত জঙ্গি শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট নয়। এটা রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে বলেই আমরা মনে করি।

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জঙ্গি দমনে জাতীয় ঐক্য


জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমন ও নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আবারও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গুলশানের হোটেলে জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণে মঙ্গলবার আয়োজিত এক শোক সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এসব হামলা ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি করা হলে প্রকৃত অপরাধীদের দমন করা যাবে না বরং তারা পার পেয়ে যাবে। মির্জা আলমগীর প্রসঙ্গত আরো বলেছেন, যখনই কোনো হামলা বা হত্যাকা- ঘটে তখনই আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বক্তৃতা শুরু করে দেন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদেরকেই খুশি করা হয়। তারা একই সাথে নতুন নতুন অপরাধ সংঘটনের সুযোগ পেয়ে যায়। এভাবে দোষারোপের রাজনীতি চলতে থাকলে দেশ থেকে কোনোদিনই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমন ও নির্মূল করা সম্ভব হবে না। সত্যিই সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দেয়া এবং দলমত নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া।
বিরোধী দলকে দায়ী করার মধ্য দিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে মির্জা আলমগীর তারও সমালোচনা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রের ওপর ক্ষমতাসীনরা যে আঘাত হেনেছেন তার পরিণতিতেই দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের তৎপরতা এতটা বিপদজনকভাবে বেড়ে গেছে। জনগণের মধ্যেও আতংক বেড়ে চলেছে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত এসব কর্মকা- আরো বাড়তেই থাকবে এবং গোটা জাতিই আক্রান্ত হয়ে পড়বে বলে হুশিয়ার করে দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব। তার মতে, বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দেশকে ধ্বংসও করে দিতে পারে। অমন আশংকার বিপরীতে জনগণের ঐক্যই কেবল দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। আর এজন্য দরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সে কারণে সরকারের উচিত বেগম জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দেয়া।
মঙ্গলবারের ওই শোক সমাবেশে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির অন্য নেতারাও একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন এবং মূল কথায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দমন ও নির্মূল করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা এই অভিমত ও আহ্বানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে যা কিছু বোঝানোরই চেষ্টা চালানো হোক না কেন, একথা প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে না। সরকারের বিরামহীন প্রচারণা সত্ত্বেও জনগণও সেটাই বিশ্বাস করে এসেছে। অন্যদিকে সব জেনেবুঝেও ক্ষমতাসীনরা দোষারোপের রাজনীতি থেকে সরে আসেননি। এখনো পর্যন্ত সরে আসার নাম করছেন না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মূলত ক্ষমতাসীনদের এই বিচিত্র ও ধ্বংসাত্মক কৌশল ও মনোভাবের কারণেই বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকা- কেবল বেড়েই চলেছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সর্বশেষ একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তিনদিনের আকস্মিক সফরের শেষ পর্যায়ে মঙ্গলবার সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি বলেছেন, হত্যা-সন্ত্রাসের বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ সরকার অতীতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফসল বলে মনে করতো। কিন্তু এতদিনে সরকারের চিন্তায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হত্যা-সন্ত্রাসের সঙ্গে যে বৈশ্বিক রাজনীতির সম্পর্ক আছে সরকার সেটা মেনে নিতে শুরু করেছে। মার্কিন মন্ত্রীর মতে এটা একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। নিজের অভিমত জানাতে গিয়ে নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেছেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে যেহেতু আন্তর্জাতিক যোগসাজশ রয়েছে সেহেতু যে দেশেই ঘটুক না কেন তা মোকাবিলায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
আমরা মনে করি, কিছুটা ঘুরিয়ে নিজেদের মতো করে বললেও মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও মূল কথায় জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টিকেই গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এনেছেন। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমন ও মোকাবিলার জন্য তিনিও জনগণকে সঙ্গে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে দোষারোপের রাজনীতি করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, ইঙ্গিতে তারও উল্লেখ রয়েছে মার্কিন মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে। তিনি বলেছেন, সরকার অতীতে হত্যা-সন্ত্রাসকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফসল মনে করতো। কিন্তু এতদিনে এসে সরকার বুঝতে শুরু করেছে, এর সঙ্গে বৈশ্বিক সন্ত্রাসের যোগসাজশ রয়েছে।
আমরা অবশ্য মন্ত্রী বিসওয়ালের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একমত পোষণ করতে পারি না। কারণ, তিনি বোঝাতে চাইলেও বাস্তবে সত্য হলো, সরকার প্রথম থেকেই জানতো যে, জঙ্গিবাদ তথা হত্যা-সন্ত্রাসের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে তৎপর কিছু গোষ্ঠীর যোগসাজশ ও অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু সব জেনেও দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার এবং বিরোধী দলকে চাপের মুখে ফেলার কৌশল থেকে সরকার দোষারোপের রাজনীতি করে এসেছে। সে রাজনীতি থেকে এখনো সরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও আমরা আশা করতে চাই, সরকার নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং দেশকে ভয়ংকর পরিণতির কবল থেকে বাঁচানোর সদিচ্ছার ভিত্তিতে অবিলম্বে জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দেবে। সরকারকে একই সঙ্গে দোষারোপের রাজনীতিও বন্ধ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গুলশানের জিম্মি সংকট সরকারি ব্যর্থতারই প্রমাণ


গত শুক্রবার রাতে ঢাকা মহানগরীর অভিজাত গুলশান এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারী রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা ও রুদ্ধশ্বাস বারো ঘণ্টার জিম্মি সংকট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিনসহ ২ জন পুলিশ অফিসার, ১ জন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশী আমেরিকানসহ ৩ জন বাংলাদেশী, ৭ জন জাপানী ও ৯ জন ইতালীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। পুলিশ অফিসার ছাড়া বাকি ২০ জনকে সন্ত্রাসীরা গলা কেটে হত্যা করেছে।
বলাবাহুল্য ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অপারেশন শেষে সেনাবাহিনীর অপারেশন থা-ার বোল্টের মাধ্যমে সংকটের অবসান ঘটে এবং এতে ৬ জঙ্গি নিহত হয়, একজন সন্দেহভাজন গ্রেফতার এবং ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন। বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পথে মানুষের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়ে তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের সমূলে নির্মূল করে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন।
এদিকে গুলশানের ঘটনার নিন্দা করে দেশ বিদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা বিবৃতি দিয়েছেন এবং গণমাধ্যমসমূহ এই ঘটনার উপর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, শেখ হাসিনার সরকার দেশে জঙ্গি তৎপরতা বিস্তার রোধের চেয়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করা এবং বিরোধীপক্ষকে কোণঠাসা করতে বেশি শক্তি ব্যয় করছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদক্ষ শাসন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস এবং অস্থিতিশীলতার ভিত্তি রচনা করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এখন নষ্ট করার মতো সময় নেই। দেশের প্রধান বিরোধী পক্ষকে যদি স্তব্ধ করে রাখা হয় তাহলে একের পর এক সরকার বিরোধী পক্ষ সন্ত্রাসের পথ বেছে নেবে। ওয়াশিংটন পোস্ট আরো বলেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশই দেশটিতে জঙ্গিবাদী তৎপরতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেণ্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগলম্যান বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অভ্যন্তরে সকল সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য বিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিকে দায়ী করছেন। কিন্তু দেশে অন্য কোন জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করার ফলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো উল্লেখ করা হয় যে গত মাসে সরকারের একজন সিনিয়রমন্ত্রী সন্ত্রাসী ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ইসরাইলের ষড়যন্ত্রের একটি অস্পষ্ট অভিযোগ আনেন। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতা রোধে পুলিশী অভিযানে অন্তত ১২ হাজার মানুষকে আটক করা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছোট খাট অপরাধী এবং বিরোধী দলের সমর্থক নিরপরাধ মানুষ।
লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রায় দেড় বছর ধরে পশ্চিমা গোয়েন্দারা বাংলাদেশকে বড় ধরনের হামলার আশংকা করে আসছিলেন। বিদ্যমান জঙ্গি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ঢাকার উপর পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে চাপ আসে। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। ব্যবস্থা নেয়ার বদলে আওয়ামী লীগ সরকার এই পরিস্থিতি থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট ছিল। তারা উল্টা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর দোষ চাপিয়েছে বা দেশে আইএস বা আল কায়েদার মতো কোনও গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব সরাসরি অস্বীকার করেছে। পত্রিকাটি তার রিপোর্টে বলেছে, ২০১৩ সাল থেকে গত তিন বছরে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতা দেখেছে বাংলাদেশ। অথচ সরকার এসব হত্যাকা-ের দায়ভার চাপিয়েছে বিরোধী দলের উপর। জঙ্গী দমনের নামে আটক করেছে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। শুক্রবারের এই রক্ত ভেজা জঙ্গি হামলাকে তাই জঙ্গি দমন নয় বিরোধী দমনের প্রায়শ্চিত্ত বলে বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে।
বিদেশী পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যম কেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ দেশের বিদ্যমান হালচাল সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও তাদের অংগসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের যে স্টিম রোলার চালাচ্ছে তা নজিরবিহীন। সারাদেশ এখন বিরোধীদের জন্য কারাগারে পরিণত হয়েছে। শহরে হোক গ্রামে হোক, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকা- চালাতে পারেন না। প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিভাবান রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দকে জেল, জুলুম, ক্রসফায়ার ও ফাঁসির শিকার বানানো হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে এখন কিছু নেই, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা দলীয় সন্ত্রাসের কবলে পড়ে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠান দলীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, বাড়িঘর, শোবার ঘর কোথাও মানুষের নিরাপত্তা যেমন নেই, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিও নেই। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন দল ও তার অংগ সংগঠনের নেতা কর্মীরা দেশকে একটি লুটপাট সমিতিতে রূপান্তরিত করেছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, রাহাজানি, ব্যভিচার, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে টানাটানি, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর হামলা, পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই, প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, গ্রেফতার বাণিজ্য, ব্যাংক লুট আধিপত্য বিস্তারকে নিয়ে সন্ত্রাস, গোলাগুলি এবং খুনাখুনি, বিরোধীদের হত্যা ও বাড়িঘর লুট প্রভৃতি এমন কোনও অপরাধ নেই যার সাথে ক্ষমতাসীন দল ও তার অংগসংগঠন জড়িত নেই। এর ফলে সারা দেশের আবহাওয়া এমনভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে যা যে কোনও সময় জীবন্ত আগ্নেয়গিরির আকার ধারণ করে ধ্বংসাত্মক অগ্ন্যুৎপাতের জন্ম দিতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের দুঃশাসন, ক্ষমতার অপব্যবহার বিরোধী দল নিধনের অদম্য স্পৃহা ও তাদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশবিরোধী তৎপরতা ও দেশের স্বার্থ বিসর্জন প্রভৃতি মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে এই ক্ষোভ যে কোনও সময় গণবিস্ফোরণে পরিণত হতে পারে। ঐ বিস্ফোরণকে সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করা বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দেয়ার সামিল হবে।
এখন গুলশানে ফিরে আসি। গুলশানে যা ঘটেছে তা শুধু অমানবিক নয়, বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম অপমানকরও। বিদেশেীদের হত্যার ঘটনা বাংলাদেশকে সারা দুনিয়ায় অমানুষের দেশ হিসেবে পরিচিত করেছে। খুনিদের যে পরিচয় পাওয়া গেছে তাতে তাদের সাথে ইসলামের বা ইসলামী কোনও সংগঠনের ন্যূনতম সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। ঘটনার পর পর শাহরিয়ার কবির এর জন্য জামায়াতকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছেন। মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ জামায়াত বিএনপির ওপর দোষ চাপিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। কোন কোন ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে যে জামায়াত নেতা মীর কাসেমের আসন্ন ফাঁসি ঠেকানোর জন্য জামায়াত এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
আবার বাংলাদেশের কোন কোন মহলের মতে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সেনা ও বিশেষ বাহিনী প্রেরণের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা বাংলাদেশের কিছু বিভ্রান্ত তরুণকে দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। গুলশান হামলার পর পর ভারতের তরফ থেকে বিশেষ বাহিনী প্রেরণের প্রস্তাব তাদের এই অভিলাষেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। সোস্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে যে বিশ্লেষণ চলছে তা দীর্ঘ দিন অব্যাহত থাকবে বলে অনুমান করা যায়। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই ঘটনা সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের মাথা হেঁট করে দিয়েছে এবং এই জাতিকে দীর্ঘদিন এর খেসারত দিতে হবে।
গুলশানে জঙ্গিদের হামলা এবং বিদেশী নাগরিক, পুলিশ অফিসার এবং সাধারণ নাগরিকসহ ২৮ জনের মৃত্যু একটি ভয়াবহ ঘটনা। আমরা মৃত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তাদের স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি জানাই। উদ্ধার তৎপরতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ বাহিনী যে ভূমিকা পালন করেছে তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। সেনা বাহিনীর তরফ থেকে আইএসপিআর যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে সরকার প্রধানের ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়েছে যে, তিনি উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ঐ নির্দেশ অনুযায়ী তারা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে জীবিতদের উদ্ধার করেছেন এবং জঙ্গিরা নিহত হয়েছে। সকলের মনে এখানে একাধিক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গিরা শুক্রবার রাতে রেস্তোরাঁয় হামলা করে সেখানে অবস্থানরত দেশী বিদেশী লোকদের জিম্মি করেছে। তাদের হাতে দু’জন পুলিশ অফিসার নিহত ও অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এটা রাতেই ঘটেছে। এই ঘটনা পরিস্থিতির ভয়াবহতারই পরিচায়ক। এই যদি অবস্থা হয়, সরকার প্রধান রাতেই সেনা হস্তক্ষেপের নির্দেশ দিলেন না কেন? এটা কি তার ব্যর্থতা না উদাসীনতা? দুই. জঙ্গিরা রাতেই ১৭ জন বিদেশীসহ ২০ জন জিম্মিকে গলা কেটে হত্যা করেছে এবং এতে তাদের যথেষ্ট সময় লেগেছে। রাতের বেলা সেনা হস্তক্ষেপ হলে এই লোকগুলোকে জীবন দিতে হতো না। তিন. পাঁচজন জঙ্গি সবাই নিহত হয়েছে। তাদের কি জীবিত আটক করা যেতো না? জীবিত থাকলে তাদের কাছ থেকে হয়তো এমন সব মূল্যবান তথ্য পাওয়া যেতো যা জঙ্গির উৎস ও জঙ্গি তৎপরতা দমনে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারতো।
জঙ্গিদের যে পরিচয় পাওয়া গেছে তা বিস্ময়কর। এদের প্রত্যেকেই শিক্ষিত বিত্তশালী পরিবারের সন্তান; মাদরাসা বা তথাকথিত মৌলবাদ, ধর্মীয়, সংগঠন অথবা জামায়াতের সাথে কিংবা বিরোধী দল বিএনপির সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। জিম্মি ঘটনায় জঙ্গিদের যে নেতৃত্ব দিয়েছে তার নাম রোহান ইবনে ইমতিয়াজ বলে পত্রপত্রিকায় ছবিসহ খবর প্রকাশিত হয়েছে। রোহান ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে। বাবুল বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন, বাস্কেট বল ও সাইক্লিং ফেডারেশনেরও একজন পদস্থ কর্মকর্তা। অনেকের কাছে খুনি ও সন্ত্রাসী বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের শ্যালক হচ্ছেন এই ইমতিয়াজ খান বাবুল। বাবুল দীর্ঘদিন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জানা গেছে টপ টেরর কামাল পাশা বাবুলের শ্যালক। এই পাশা এক সময়ের আলোচিত দুই ভাই রুবেল এবং জুয়েলকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে ৫ মিনিটের মধ্যে খুন করেছিল। অর্থাৎ জঙ্গি রোহান ইবনে ইমতিয়াজ সন্ত্রাসী পরিবারেরই সন্তান, সন্ত্রাসী জঙ্গি হিসেবে তার উত্থান ও পতন। এর সাথে ধর্ম বা জিহাদের কোনও সম্পর্ক নেই। জঙ্গি নিবরাস ইসলাম, মীর সাবিহ মুবাশ্বির, রাইয়ান মিনহাজ ও আন্দালিব আহমেদও ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে প্রেম বিরহে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেও আছে এবং প্রায় সবাই ধর্মহীন পরিবেশে মানুষ হয়েছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সাথে তাদের কখনো সম্পর্ক ছিল না। তাদের পিতামাতা তাদের চরিত্র গঠনের জন্য কখনো কোনও উদ্যোগ নিয়েছেন বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের লোক ক্ষমতাসীন মহলের একটি অংশকে বিবেকহীনই শুধু করে তোলেনি, তারা মনুষ্যত্ববোধও হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়। তাদের উৎসাহে সন্ত্রাস শান্তিপূর্ণ এই দেশটিকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও আঘাত হানা শুরু হয়েছে। সরকার প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে বিরোধীদল দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা ৭৫ বছরের পুরনো ও অভিজ্ঞ এবং তৃণমূল পর্যায় বিস্তৃত একটি রাজনৈতিক দলসহ বিরোধী প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। তাদের দলের লোকদের অপরাধ-সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। মানুষের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিয়েছেন। এই অবস্থায় গুলশানের ঘটনা শুধু সরকার নয় বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য একটি অশনিসংকেত বলে অনেকে মনে করছেন। বিদ্যমান পরিবেশে সরকার যদি নিজের এবং দেশের ভাল চান তাহলে অবিলম্বে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত বলে দেশবাসী মনে করেন। নিজের অযোগ্যতা বিরোধী প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তারা কোনও কুল রক্ষা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

শনিবার, ২ জুলাই, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বাংলার মানুষ গুলশানের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না


পাঠক ভাইয়েরা ব্যাকুল প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন, গুলশানের ঐ স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে হামলা এবং অতঃপর যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অপারেশনের সর্বশেষ খবর জানার জন্য। আপনারা আজকের খবরের কাগজের সর্বশেষ সংবাদে হয়তো সেটা পেয়ে যাবেন অথবা ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন। কিন্তু আমি আপনাদেরকে এই কলামে সেই সর্বশেষ সংবাদ দিতে পারছি না। কারণ টেলিভিশনে ঘোষণা করা হলো যে, আইএসপিআর নামক সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ দপ্তর থেকে আজ (শনিবার) বিকাল ৩.৩০ মিনিটে একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠান করা হবে। ঐ সংবাদ সম্মেলনে সর্বশেষ পরিস্থিতি বলা হবে। ঐ সংবাদ সম্মেলন দেখে এবং শুনে এই কলামে খবর দেয়া এবং মন্তব্য দেয়ার সময় আর থাকবে না। তাই আপনাদেরকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে পারছি না। তবে ইতোমধ্যেই কিছু কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যেগুলো আর পরিবর্তিত হবে না। তবে এই ঘোষণা দেওয়ার পরবর্তী ঘোষণায় বলা হয় যে, বেলা সাড়ে ১২ টায় আইএসপিআরের প্রেস ব্রিফিং হবে। সাড়ে ১২ টায় প্রেস ব্রিফিং হয়নি।
বেলা দেড়টার দিকে সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের মধ্যে গতকাল শুক্রবার রাতেই ২০ জন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এঁরা কে কোন দেশের তা আজ দুপুর পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি আইএসপিআর। এই ২০ বিদেশি নাগরিকের মধ্যে পাঁচজন নারী ছিলেন। নাঈম আশফাক বলেন, অভিযানের মাধ্যমে তিনজন বিদেশি, যাদের মধ্যে একজন জাপানি ও দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া অভিযান শেষে তল্লাশিকালে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের সবাইকে গতরাতেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়।
॥দুই॥
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই নাঈম আশফাক চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারি নামের একটি রেস্তোরাঁয় দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে প্রবেশ করে। রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি করে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরবর্তীতে পুলিশ কর্ডন করে সন্ত্রাসীদের যথেচ্ছ কর্মকাণ্ড থেকে নির্বৃত্ত করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবি যে সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও পেশাদারি প্রদর্শন করেছে, তা অনন্য।’
আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এই অভিযানকালে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদত বরণ করেন এবং ২০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য আহত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে সরকার প্রধান কর্তৃক আদেশ প্রদান করা হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাবাহিনী গতকাল রাত থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করে।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল আটটায় অপারেশনের সব কার্য সম্পন্ন করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পিস্তল, ফোল্ডেট বাঁট একে ২২ রাইফেল, বিস্ফোরিত আইইডি, ওয়াকি টকি সেট ও অনেক ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কেউ হতাহত হয়নি।
গতকাল রাতে অপারেশনে অংশ নেয়া পুলিশের নিহত দুজন কর্মকর্তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে এই সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সার্বিক কৌশলের মাধ্যমে অতি দ্রুততার সঙ্গে অভিযান সফল করার জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সরকার প্রধানের সময়োচিত, সাহসী, দৃঢ় ও সঠিক দিক-নির্দেশনার জন্য এই অভিযান সফল হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে এই ঘটনার বিষয়াবলি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আপনাদের জানানো হবে।’
শুক্রবার রাত ১২ টার পর র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের বলেন যে, এখানে যা ঘটছে তার প্রতি মুহূর্তের আপডেট প্রকাশ বা সম্প্রচার করবেন না। তার ভাষায়, বৃহত্তর জনস্বার্থেই তিনি সাংবাদিকদের এই অনুরাধ করছেন। দেখা গেল, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদের এই অনুরোধের পর টিভির সরাসরি সম্প্রচারে আহত বা নিহতদের খবর এবং গোলাগুলির দৃশ্য আর সম্প্রচার করা হয়নি।
পরদিন অর্থাৎ শনিবার সকাল ৭.৪০ মিনিটে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেন সেনাবাহিনী। তাদের সাথে ছিল ১০ টি সাজোয়া যান (আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার)। আরো ছিল নৌ বাহিনীর কমান্ডো ইউনিট, বিডিআর, পুলিশের বোমা বিশেষজ্ঞ এবং কমান্ডো অপারেশনে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সোয়াত বাহিনী, পুলিশ এবং র‌্যাব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, হামলাকারীদেরকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল।
সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ধ্যার পর জাতির উদ্দেশ্যে রডিও ও টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন। হতে পারে এই ভয়াবহ ঘটনার এখনো যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে হয়তো সেসব প্রশ্নের উত্তর থাকবে। তবে আমার এই লেখা সেই ভাষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। তার আগেই এটা প্রেসে পাঠাতে হবে।
এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’। এই অপারেশন থান্ডার বোল্টের আগে পুলিশ বাহিনীর যেসব অফিসার শাহাদাত বরণ করেছেন আমরা তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করছি এবং তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। একই সাথে তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। অপারেশন শুরুর আগে রাতে যে ২০ জন জিম্মিকে হত্যা করা হয়েছে সেই বীভৎস এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আমরা তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি। এই লেখার সময় পর্যন্ত এই ২০ জনের জাতি, ধর্ম এবং বর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়নি। জাতি, ধর্ম মোতাবেক আমরা তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের প্রত্যেকের পরিবারের ব্যথায় আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে অদম্য সাহস, ক্ষিপ্রতা এবং যোগ্যতার সাথে মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যে এত বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করা হলো তার জন্য আমরা অপারেশন লিডার আর্মি, নেভি এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক প্রশংসা করছি এবং তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই অপারেশনের মাধ্যমে একটি জিনিস প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন একটি যোগ্য, প্রশিক্ষিত এবং দুর্ধর্ষ সেনা বাহিনী। জাতির সামনে যখনি কোন অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে তখনই সেই সংকট সাফল্যের সাথে আমাদের সেনাবাহিনী মোকাবেলা করতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
॥তিন॥
আমি আগেই বলেছি যে, যে ২০ জন জিম্মি মারা গেছেন তাদের সকলের নাম ধাম এবং জাতি ধর্ম সহ পরিচয় প্রকাশিত হওয়া দরকার। হয়তো সেটি হবেও। সেই সাথে এটিও জানা দরকার যে কারা এই জঙ্গি হামলা চালালো। টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম, তিনটি দল এই হামলার দায় দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এরা হলো, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট বা আইএস। বিগত ৪৫ বছরে আমাদের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনীও দক্ষতা অর্জন করেছে। আমাদের বিশ্বাস, কারা এই হামলা করেছে তাদেরকে ঠিকই সনাক্ত করতে পারবে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
একই সাথে বৃহত্তর পরিসরে একটি কথা না বললেই নয়। আমরা যারা কিছুটা বয়স্ক তারা দেখেছি, অতীতে এই দেশে অভূতপূর্ব সামাজিক সম্প্রীতি নিয়ে বাস করেছে দুইটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়। তারা হলো মুসলমান এবং হিন্দু। সেই অপূর্ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই ফুটে উঠেছে সেই পল্লী সংগীতে, “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”। আমরা গ্রামেও বাস করেছি, মফস্বল শহরেও বাস করেছি। আগে তো হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকে সেদিনের পূর্ব বাংলা এবং আজকের বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৩০ ভাগ। অথচ তার পরেও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রদায়গত মিল ছিল। আমাদের অনেকেরই ব্যক্তি জীবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হিন্দু। অথচ আজ যখন হিন্দু জনসংখ্যা ১০ শতাংশেরও নিচে তখন সমাজে দেখা দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা। একমাত্র ১৯৬৪ সাল ছাড়া এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। অথচ প্রতিবেশী ভারতে শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে। গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরেও সেই মাত্রায় সেই স্কেলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি।
অতীতকে আমাদের পটভূমিতে রেখে আজ সরকারকে খুব সিরিয়াসলি ভাবতে হবে, কেন এই সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। যেভাবে একের পর এক গুপ্ত হত্যা হচ্ছে সেগুলো তো অতীতে এদেশে ছিল না। আজ কেন সেগুলো ঘটছে? গুলশানে যে বীভৎস হত্যাকা- ঘটে গেল সেটি কিন্তু ইতঃপূর্বে ঘটেছে ইরাকে, ঘটেছে আফগানিস্তানে, ঘটেছে সিরিয়ায়, ঘটেছে পাকিস্তানে এবং সাম্প্রতিককালে ঘটছে তুরস্কে। বাংলাদেশ তো এসব দেশের তুলনায় শিশুর মতো শান্ত ছিল। সেই দেশে এক রাতের ঘটনায় জিম্মি, পুলিশ এবং জঙ্গিসহ অন্তত ২৮ ব্যক্তি নিহত হলেন। এই নিহতের তালিকায় পুলিশের ওসি এবং পুলিশের সহকারী কমিশনারও রয়েছেন। এই ধরনের হত্যাকা-ের লোমহর্ষক ঘটনা আমরা অতীতে কখনো শুনিনি। কিন্তু আজ আমরা সেই সব ঘটনা শুধু শুনছি না, চর্ম চক্ষে দেখছিও। কেন ঘটছে এইসব ভয়াবহ, ভয়ংকর, বীভৎস ও লোমহর্ষক ঘটনা? সরকারকে সেটি গভীরভাবে ভাবতে হবে। সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়তো এই ধরনের অপরাধ দমন করা যাবে। কিন্তু তাই বলে তার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে না। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি একজন সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টি নিয়েও সরকারকে বিষয়গুলো ভাবতে হবে। ভাবার পর একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করতে হবে। সেই সমাধানে রাজনৈতিক দল সহ সমাজের সব শ্রেণী এবং পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শুধু আমরা নই, এদেশের মানুষ গুলশানের নারকীয় হত্যা যজ্ঞের পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চায় না। 
আসিফ আরসালান

Ads