ইদানীং আর মাকে স্বপ্নে দেখি না, আব্বাকেও না। হজ্বের আগে মাকে অনেকবার স্বপ্নে দেখেছি। পরে আর দেখি নাই। হজ্বের পরেও মক্কাতে ৮দিন ছিলাম। মাকে দেখার পরে আব্বাকেও স্বপ্নে দেখলাম। তিনি আমার কাছে আসছেন না। দূর দিয়ে আমাকে দেখছেন, কথাও বলছেন,সৎ উপদেশ দিচ্ছেন যেভাবে দিতেন জীবিত থাকাকালে। স্বপ্ন দেখেই জেগে উঠলাম। অজু করে সোজা কাবা শরীফে চলে গেলাম। পথিমধ্যেই তাহাজ্জুদ নামাজের আজান হলো। তাহাজ্জুদ পড়ে অপেক্ষা করলাম। ফজরের আজান হলো। নামাজ শেষ করে বার বারই স্বপ্নের হেতু খোঁজার চেষ্টা করলাম। শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমার আব্বা আমার কাছে কিছু প্রত্যাশা করছেন। আব্বার জন্য কি করা যায় তার উপায় বের করলাম। বাবা-মা দুজনের নামে একটা নফল ওমরা করবো, আর পবিত্র কাবা শরিফ এবং মসজিদে নববীতে একটি করে কুরআন শরীফ দান করবো।
সিদ্ধান্ত মতে ঐদিনই জোহরের নামাজের সময় কুরআন শরিফ একটা কিনে কাবা শরীফে দিয়ে দিলাম আর মদীনাতে গিয়ে অবশ্য প্রথম নামাজের সময়ই একটি কুরআন শরিফ দিয়েছি । স্বপ্ন দেখার পরের দিনই নফল ওমরা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জেদ্দাতে আমার এক বন্ধু বার বারই তার বাসায় দাওয়াত খেতে বলছিলেন। ভাবলাম এইবার এক ঢিলে দুই পাখি মারার একটা সুযোগ হবে। তার নাম আর আমার নামও এক। মিতাকে ফোনে বললাম আজ রাতে আপনার বাসায় আসছি। অন্যান্য সাথীরাও জেদ্দা যাবেন। উদ্দেশ্য কিছু কেনা কাটা এবং ওমরার জন্য সেখান থেকে এহরাম বাঁধা। মাইক্রোবাস ভাড়া করে গেলাম। কেনাকাটা শেষ করে ‘মা হাওয়ার’ কবর দেখা, কেসাস মসজিদ (শিরশ্ছেদ মসজিদ) দেখা, সমুদ্র সৈকত দেখা এবং সর্বশেষ এহরাম বাঁধা। এসব করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল। সাথীরা সবাই ফাতিমা মসজিদ থেকে এহরাম বেঁধে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। আমি ফাতেমা মসজিদেই রয়ে গেলাম। মিতা আমার জন্য গাড়ি পাঠাবেন । তার গাড়িতে তার বাসায় যেতে হবে। সাগরের মধ্যেই মসজিদ। জোয়ারের সময় চারদিকে পানিতে ভরে যায়। এক দর্শনীয় মসজিদ বটে। এখান থেকে মানুষ এহরাম বেঁধে হজ্জ বা ওমরা করে থাকে।
গাড়ি আসছে আসছে করে অনেক সময় পেরিয়ে গেল।আরব সাগরের গর্জন রাতের নীরবতা ভাঙ্গছে। একে একে সব পর্যটক চলে গেছে। পুরো সমুদ্র সৈকতই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। আমি একা। রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কারণ এমন অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। অপরিচিত এক জনশূন্য সমুদ্র সৈকতে আমি একা। রাস্তায় একজন বাংলাদেশী ক্লিনার পেলাম। ওর নাম আশরাফ, বাড়ি কুমিল্লা। পরিচয় পেয়েই ওর ব্যাগ থেকে আমাকে বের করে দিল ফান্টার ক্যান,সাথে ৭/৮শ গ্রাম ওজনের বিশাল এক ডালিম। মিতা গাড়ি পাঠিয়েছেন কিন্তু চালক লোকেশন খুঁজে পাচ্ছে না। আর আমারও অপরিচিত জায়গা। তাই চালকের সাথে যোগাযোগ ও সঠিক লোকেশনের জন্য আশরাফই যোগাযোগ করতে লাগলো। কারণ তখন আরো বিপদ ঘনিয়ে আসছিল এজন্যই যে আমার মোবাইলের চার্জও অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আশরাফের লোকেশন নির্দেশনামতে শেষ পর্যন্তু গাড়ি আসলো। ততক্ষণে ওর দেয়া ডালিম খেয়ে সাদা পাঞ্জাবী লাল করে ফেলেছি।
মিতার বাসায় তার দামি গাড়িতে করে পৌঁছাতেই আরো ৪০ মিনিট লেগে গেল।গিয়ে দেখি ঈদের আয়োজন। হাজিরা ঈদের আনন্দ এবং খাওয়া দাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। সেটা মিতার জানা আছে। কারণ ঈদের দিনই হাজিদের সবচেয়ে ব্যস্ততম ও কষ্টের দিন। সূর্যোদয়ের পরে মুজদালেফা থেকে হেঁটে মিনার তাঁবুতে আসতে হবে, তারপর জামারায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে কঙ্কর নিক্ষেপ,তারপর কুরবানি করা ইত্যাদি সবই কষ্টসাধ্য। সর্বোপরি কুরবানির গোশতও হাজিদের খাওয়ার সুযোগ হয় না। মিতার সেটা জানা আছে বিধায় আয়োজনটা সেভাবেই করেছেন। খাওয়ার পরে ঘটলো আরেক বিপদ। বাথরুমে হাত ধুতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল পাঞ্জাবী। মিতা যাতে টের না পায় সেজন্য বাথরুম থেকে একবারেই ওজু করে বের হলাম। তার চোখকে ফাঁকি দিয়েই কাপড় পাল্টে এহরামের পোশাক পরে নিলাম। দু’রাকাত নামাজ পড়ে জোরে জোরে লাব্বাইক পড়ে জানান দিলাম যে আমি এখন ওমরার জন্য প্রস্তুত। তারপরেও কিছু কথা থাকেই। সাংবাদিক বলে কথা। দেশের খবর, রাজনীতির খবর,ইসলামী আন্দোলনের খবর, নেতৃবৃন্দের অবস্থা জানতে চান তিনি। গল্প করতে করতে আরো পৌনে এক ঘণ্টা। তারপর বিদায় নিলাম। তবে আবারো ড্রাইভার দিয়ে ট্রাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত পেঁৗঁছে দিলেন। ট্যাক্সির ভাড়াটাও ড্রাইভারের পকেটে গুঁজে দিলেন। আমি আপত্তি জানালে তিনি বললেন স্যার যা বলেছেন আমি তাই করছি।
ট্যাক্সি আমাকে পবিত্র কাবা শরীফে পৌছে দিল অত্যন্ত সম্মানের সাথে। এহরাম পরা যেহেতু ড্রাইভার জানে আমি ওমরা করবো। আমি আল্লাহর মেহমান।সে আমাকে নামিয়ে দিল বায়তুল্লাহর চত্বরে।তাওয়াফ ও সাঈ করে ওমরার সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে করতে তাহাজ্জুদের আজান হয়ে গেল। তাহাজ্জুদ এবং ফজর পড়ে তারপর বাসায় এসে ঘুমালান।
বাবা ও মায়ের জন্য এই ওমরাহ পালনের পর থেকে আর মাকে স্বপ্নে দেখিনা। আমার মনে হয় সে আমার কাছে এই প্রত্যাশাই করেছিল। যদি তাই হয় তবে মায়ের মৃত্যুর পরেও আমি তার প্রত্যাশা পূরণ করতে যৎকিঞ্চিৎ সক্ষম হয়েছি। বাবা মায়ের ঋণ কোন সন্তানের পক্ষেই শোধ করা কখনো সম্ভব নয়। আল্লাহ আমার এই খেদমত কবুল করুন।
আমার মায়ের মৃত্যু হয় ২৪ আগস্ট ২০১৩ সালে। তার জানাযা হয় পরের দিন ২৫ আগস্ট সকাল ১০ টায় আমাদের গ্রামের ঈদগাহ ময়দানে। জানাযায় যে বিপুল লোক সমাগম হয় তা না দেখলে হয়তো বুঝতামই না যে আমার মা মানুষের হৃদয়ে কতটা স্থান করে নিয়েছিল।আত্মীয় স্বজন ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এসেছিল তার জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য। জানাজা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকে এসেছেন। এত লোক সমাগমের কারণ হলো ২টা । প্রথমত আমার মা যে গ্রামের মেয়ে সেই গ্রামেরই বধূ। ৯০ টি বছর কেটেছে তার এক গ্রামে। ফলে গ্রামের সবাই তার কোন না কোনভাবে আত্মীয়। আমার দাদা সামাদ মোল্লার বেটার বৌ আর নেহাল উদ্দিন শেখের একমাত্র কন্যা ছিল আমার মা। এই দুই ব্যক্তিই এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিলেন।আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার এবং বিশেষ করে আমার মায়ের ত্যাগ,কষ্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানসহ অন্যান্য অবদান।
১৯৭১ সাল, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বছর। আমার বয়স তখন মাত্র সাড়ে ৭ বছর। আমার ছোট ভাইটা তখন সবে বসা শিখেছে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চের কালো রাতে বর্বরোচিত কায়দায় হামলা চালালো হায়েনা পাক বাহিনী। তারপর শুরু হলো প্রতিরোধ যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তা।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পেলাম নতুন পতাকা, নতুন দেশ,নতুন মানচিত্র।২৫ মার্চ রাতেই সেনা বাহিনীতে কর্মরত আমার বড় ভাই রোস্তম মোল্লা অন্যান্য বাঙ্গালি সৈন্যদের ন্যায় রংপুর সেনানিবাস থেকে অস্ত্রসহ বিদ্রোহ করে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু ভাগ্য তাকে সহযোগিতা করেনি। তাই অস্ত্রসহ ধরা পড়ে যান পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। ক্যান্টনমেন্টেই তাকে কয়েদ করা হয়। অনেককেই হত্যা করা হয়। কিন্তু এক পাকিস্তানী মেজরের খুব প্রিয়পাত্র হওয়ায় তার কেস ডায়রিতে শুধু একটি শব্দ পরিবর্তন করে লেখা হয় উইথ আউট আর্মস। তাই ফাঁসির পরিবর্তে তাকে কয়েদ করা হয়। আর পাঠিয়ে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা কারাগারে।
বড় ভাইয়ের এই অবস্থার কথা আমরা কেউই জানতাম না। বরং সমস্ত খবরাখবর পর্যালোচনা করে সবাই নিশ্চিত ছিল যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এক সাথে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হওয়া তার সহকর্মীরাও খবর দিয়েছিল যে,রোস্তমকে আমি অস্ত্রসহ বের হতে দেখেছি। তবে সে ধরা পড়ে যায়। এমন নিশ্চিত খবরের পরে তার বেঁচে থাকার কথা আর ভাবা যায় কি? বড় ছেলের এরুপ নিশ্চিত মৃত্যুর আশঙ্কা করে কাঁদতে কাঁদতে আমার মা প্রায়ই বেহুশ হয়ে যেতেন। আর আব্বা মাঝে মধ্যেই যেখানে সেখানে শুয়ে বা বসে পড়তেন এবং বিলাপ করতে করতে আছাড়ি বিছাড়ি করতেন। এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। কখনো তারা থাকতো, অভিযানে যেত, আবার ফিরে আসতো। আমাদের বাড়িটা গ্রামের মধ্যখানে এবং বিশাল একটা ঝাকড়া আমগাছ ছিল বাড়ির সামনে। সারা বছরই গ্রামের ছেলেদের আড্ডা চলতো গাছের নিচে।বাঁশ দিয়ে তৈরী ছিল মাচাং যাতে চলতো তাস খেলা, লুডু, দাবা, সাত গুটি-বাঘ বন্ধ ইত্যাদি খেলা। মুক্তিযুদ্ধের বছরে কেউ কোন অভিযান থেকে ফিরে আসলে তার কাছ থেকে খবর নেয়ার জন্য পাড়ার মানুষের ভিড় জমে যেত। আমাদের দুইটি শোয়ার ঘর আর গোয়াল ঘর বাদে সব ঘর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। মেঝে ভাই মকবুল হোসেন তখন হাইস্কুলের ছাত্র। তাকে আমার আব্বা মা কেউ নিষেধ করতেন না মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অভিযানে যেতে। আমাদের বাড়িতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা থাকতো তাদের নেতা ছিলেন আমারই মামাতো ভাই আহম্মদ হোসেন। তার ডাক নাম ছিল পচা। সবাই পচা ভাই বলেই ডাকতো।
একদিনের কথা মনে পড়ে। সেদিন দুপুরে পচা ভাই কোন এক অভিযান শেষে আসলেন, সাথে আরো ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। দূর থেকেই তার স্বভাবসুলভ ডাক “ফুপু ! খুব খিদে লেগেছে খেতে দাও”। মা বললেন, তুই কি আমারে খবর দিয়ে আইছির। এতগুলো মানুষের ভাত তরকারি কি তৈরী থাকে। ঠিক আছে অস্ত্রপাতি রেখে গোছল সেরে আসো।পুকুর থেকে গোসল করে এলেন তারা।এরই মধ্যে খিচুড়ি রান্না করে আমার মা তাদের খেতে দিলেন।এভাবেই চলছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি।
একটি হিন্দু পরিবার আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার আব্বা বলেছিলেন,“আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথায়ও যাব না। বাঁচলেও এখানে মরলেও এখানেই। সহমরণ চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারো। কারণ আমার বড় ছেলেই যখন নেই,তখন আর কার জন্য পালাবো। আমাদের সাথে মুক্তিবাহিনী আছে।” হিন্দু স্বামী-স্ত্রী থাকতো একটি আলাদা রুমে। তবে তারা কখনো আমাদের রান্না করা খাবার খেতনা। মা তাদেরকে চাল,ডাল দিতেন। তারা আলাদা একটা চুলায় রান্না করে খেত। এমনকি তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে টয়লেট পর্যন্ত গোবর মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে তার উপর দিয়ে যেত। আমাদের কাজের লোক অতি প্রত্যূষেই এক দইয়ের পাতিল গোবরপানি তাদের রুমের সামনে রেখে আসতো।
ডিসেম্বর মাসের ১১ কি ১২ তারিখ হবে। ঐদিন সকাল বেলা খবর এলো যে পাকিস্তান আর্মি কামারখালী ঘাট পার হয়ে আমাদের দিকে আসছে। তারা নাকোল বাজার, কমলাপুর ঘাসিয়াড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে বাড়িঘর, বাজারের দোকানপাট, স্কুল ঘর ইত্যাদি গান পাওডার দিয়ে পুড়িয়ে দিল।ঐ গ্রামগুলো আমাদের নোহাটা গ্রাম থেকে অন্তত ৪ কিলোমিটার দুরে। তারপরেও এই খবর আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা আমার আব্বার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো যে আমরা এখান থেকেই প্রতিরোধ করবো। সে মোতাবেক আমাদের বাড়ির তিন দিকে বাঙ্কার খোড়া হলো। গ্রামের অনেকেই আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে গর্ত খুঁড়ে বড় বড় ট্রাংকে করে মূল্যবান মালামাল রেখে মাটিচাপা দিয়ে নিরাপদ এলাকায় চলে গেল। আমার মা আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বাঙ্কারের মধ্যে ঢুকে গেল। আমরা বাঙ্কারের নিচে আর মুক্তিযোদ্ধারা উপরে পজিশন নিয়ে থাকলো। পাক আর্মি আসলে তারাও ভিতরে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ করবে এই ছিল সিদ্ধান্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম পর্যন্ত এলো না। দুপুর পর্যন্ত বাঙ্কারে অবস্থান শেষে আমরা বেরিয়ে এলাম। ঐ বয়সে মাটির নিচে আমাকে ধরে রাখতে মাকে যে কি পরিমাণ জ্বালিয়েছিলাম তা এখনো মনে আছে। পচা ভাইর ভয় দেখিয়ে আমাকে নিবৃত্ত করতেন মা। বলতেন, তোর পচা ভাই বন্দুক নিয়ে বসে আছে উপরে। উঠলেই মারবে।
আশ্চর্যজনক হলেও ঐদিন আমরা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে আর সেই হিন্দু পরিবারটিকে পাইনি। কয়েকদিন পরেই ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলো পাক বাহিনী। দেশ স্বাধীন হলো সব শঙ্কা যখন কেটে গেল তখন আমার আব্বা ঐ হিন্দু পরিবারটির খবর নিতে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেলেন। তাদেরকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। তারা না জানিয়ে কেন এলো কিভাবে এলো জানতে চাইলে তারা আব্বাকে বললো বাঙ্কার খোঁড়ার দিন তারা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিল।কি আশ্চর্য! তাই তোমরা আমাকে একটু বলেও এলেনা? আব্বার এ প্রশ্নের সদুত্তর তারা দিতে পারেনি।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব মুক্তিযোদ্ধারা একে একে ফিরে আসছে। কিন্তু বড় ভাইর কোন খবর আসে না। তিন সপ্তাহ বা আরো পরে এলো বড় ভাইয়ের খবর। কোয়েটা কারাগার থেকে রেড ক্রসের(বর্তমান রেড ক্রিসেন্ট) একটি ফর্মে ১৪ শব্দের মধ্যে ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি। তাতে লেখা আমি বেঁচে আছি কোয়েটা কারাগারে, তোমরা বেঁচে আছো কিনা জানি না। ঐ ফর্মেরই উল্টো পিঠে ১৪ শব্দের মধ্যে আব্বা উত্তর পাঠালেন, আমরা সবাই বেঁচে আছি, তোমার বেঁচে থাকার বিষয় নিশ্চিত ছিলাম না। পরবর্তীতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ত্রিদেশীয় চুক্তির পর বড় ভাই দেশে ফিরে আসেন। ঢাকায় আর্মি হেড কোয়ার্টারে জয়েন করার পর পরই তিন মাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়।
আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন, তোমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এটাকে কখনো স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করবে না। তাহলে তোমাদের অবদান খাটো হয়ে যাবে। আমি যতদূর জানি আমাদের বাড়িতে যারা থাকতেন সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই কোন সার্টিফিকেট নেননি।আব্বার কথা তারা মেনেছেন। আমার বাবা ১৯৮৭ সালে আর মা ২০১৩ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পরে গার্ড অফ অনারও দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের একদিনও পাওয়া যায়নি তাদের অনেকে সার্টিফিকেট নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের দেখা না গেলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার আব্বার নামে বরাদ্দকৃত রিলিফের খাদ্য সামগ্রী,কম্বল ইত্যাদি আত্মসাৎকারীদের অনেককেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।
শহীদুল ইসলাম