শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬

গণতন্ত্র তো বটেই, তবে...


কিছুদিন আগেও সরকারের নীতি ও কার্যক্রমের মধ্যে যারা বাকশাল-এর পথে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াতেন তাদেরই একটি অংশ আজকাল নিজেদের বক্তব্যে অদল-বদল করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের নামে হত্যাসহ ভয়ংকর সব কর্মকাণ্ড দেখার পর এখন তাদের ধারণা, উদ্দেশ্য একদলীয় শাসন হলেও ক্ষমতাসীনরা সম্ভবত ভিন্ন কোনো কৌশল নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গেই বহুদিন পর আবারও আলোচনায় এসেছেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ক্ষমতা দখল করার এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে সরে যাওয়ার আগেও তার ইতিহাস রয়েছে। বস্তুত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পরোক্ষভাবে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করেছেন আইয়ুব খান। এমনকি চাকরিরত অবস্থায় নিজে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন (১৯৫৪)। তার চাপেই পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একের পর এক যুদ্ধজোটে যোগ দিয়েছে। সামরিক চুক্তির আড়ালে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন আইয়ুব খান। এর ফলে মুসলিম রাষ্ট্র হলেও গোটা মুসলিম বিশ্বই পাকিস্তানকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই সৌদি আরব, ইরাক ও মিসরসহ মুসলিম দেশগুলোতে ঢুকে পড়েছিল ভারত। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সিনেমা ও সংস্কৃতির মতো প্রতিটি বিষয়েই দেশটির সেকালের অনুপ্রবেশ পরবর্তীকালে বিষময় প্রমাণিত হয়েছে। এখনো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো ভারতীয় প্রভাবের বাইরে আসতে পারেনি।
অমন অবস্থার কারণ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে প্রতিটি মুসলিম দেশ যেখানে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল, জেনারেল আইয়ুব খানের কারণে পাকিস্তান সেখানে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল। ওদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ দু-আড়াইশ বছরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের শূন্যস্থানটি পূরণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র সত্যি সত্যিই সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার নতুন মোড়লে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সে অবস্থান এখনো বহাল রয়েছে। 
জেনারেল আইয়ুব খান সম্পর্কিত আলোচনার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনার কারণ হলো, দেশটি পাকিস্তানকে ভারতের দখল থেকে অধিকৃত কাশ্মীর উদ্ধার করে দেয়ার অঙ্গিকার করেছিল। কিন্তু ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫ সালের দুই-দুটি যুদ্ধের পরও পাকিস্তান কাশ্মীরকে ফিরে পায়নি। মাঝখান দিয়ে দেশটি বাংলাদেশকে খুইয়েছে। কোনো একটি সংকট ও যুদ্ধের ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। যা করেছে সবই অভিনয় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হঠাৎ ‘নিরপেক্ষ’ সাজার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানকে বিপন্নও করেছিল। কারণ, ভারতের অস্ত্রশস্ত্র আসতো রাশিয়া তথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। ভারত একই সঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও অস্ত্রশস্ত্র কিনতো। অন্যদিকে পাকিস্তান অস্ত্রশস্ত্রের জন্য সর্বতোভাবে নির্ভরশীল ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটের বন্ধুদের ওপর। সে দেশগুলোই হঠাৎ ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানকে তখন রক্ষা করেছিল তার ‘অবন্ধুসুলভ’ প্রতিবেশী হিসেবে বর্ণিত রাষ্ট্র রাশিয়া। দেশটির প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে সম্পাদিত শান্তি ও যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে সেবারের মতো বেঁচে গিয়েছিল পাকিস্তান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এসব ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের ঘটনা। ১৯৭১ সালেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে একই ধরনের ব্যবহার করেছিল।
আইয়ুব খানের পতনের পর মাঝখানে বহু বছর কেটে গেছে। কিন্তু সুদীর্ঘ এ সময়ের ব্যবধানেও পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-মনোভাব ও কার্যক্রমে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। বর্তমান সময়ে পাকিস্তান বিপদে রয়েছে তালেবান ও নানা নামের ইসলামী বলে বর্ণিত জঙ্গিদের নিয়ে, যারা আসলে যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি বলে প্রচারণায় বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সব মিলিয়ে পাকিস্তান এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর সব কিছুর পেছনেই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তথাকথিত ‘লৌহ মানব’ আইয়ুব খান।
এমন মন্তব্যের কারণ বোঝানোর জন্য কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ সেরে নেয়া যাক। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় একের পর এক সামরিক চুক্তি ও যুদ্ধজোটে অংশ নেয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে স্বাধীনতা অর্জনকারী অন্য অনেক রাষ্ট্রেরও শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান ভারতের অধিকৃত কাশ্মীরকে উদ্ধার করতে পারেনি। তৃতীয়ত, পাকিস্তান ও ইরানসহ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর যুদ্ধংদেহী নীতি ও কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছিল ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’ নামের নতুন বিশ্ব সংস্থা। পাকিস্তানকে এতে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। অন্যদিকে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট যোসেফ টিটো এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসেরের সঙ্গে তৃতীয় প্রধান নেতার আসনটি পেয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু। এটা ছিল পাকিস্তানের জন্য সরাসরি অপমান। একই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হওয়ার জন্য পাকিস্তানকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েও আইয়ুব খানের নীতি ও সিদ্ধান্তের ক্ষতিকর ভুলই প্রাধান্যে এসেছিল।
চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রের কারণে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল। পতনের একেবারে মুখোমুখি এসে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন আইয়ুব খান। সে কথাটাই তিনি তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ফ্রেন্ডস, নট মাস্টারস’-এ বলে গেছেন, ‘প্রভু নয় বন্ধু’ নামে যার বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছিল (১৯৬৭)। এটা ১৯৬৫ সালে ভারতের কাছে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছিলেন আইয়ুব খান। তিনি একই সাথে ঝুঁকেছিলেন গণচীনের দিকে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে তো রক্ষা করতে পারেনই-নি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধ্বংসকেও অনিবার্য করে গিয়েছিলেন তিনি। তার পতনের দু’ বছরের মাথায় বাংলাদেশকে হাারিয়েছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে বুঝতে হয়েছিল, একটি মাত্র দেশের সেবাদাসগিরি করতে গিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে। এদিক থেকে ভারত কিন্তু সকল বিষয়েই লাভবান হয়েছিল। পাকিস্তান যেখানে অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রতিটি বিষয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল, ভারত সেখানে রাশিয়াসহ সব দেশের কাছ থেকেই সাহায্য পেয়েছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল বলেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সশস্ত্র যুদ্ধে তো বটেই, কূটনৈতিক যুদ্ধেও ভারত পরাজিত করতে পেরেছিল। পাকিস্তানের পক্ষে কোনো রাষ্ট্রই দাঁড়ায়নি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও জাতিসংঘের ভেতরেই কেবল লোক দেখানো তৎপরতা চালিয়েছিল।
পাঠকরা সম্ভবত আইয়ুব খান সম্পর্কে এত কথা বলার কারণ বুঝতে পেরেছেন। বর্তমান বাংলাদেশও সেকালের পাকিস্তানের পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে কি না সে প্রশ্ন এখন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে আইয়ুব খানের অন্য এক ঐতিহাসিক ‘কীর্তি’ সম্পর্কে বলা দরকার। সেটা তার বিখ্যাত আবিষ্কার ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। আইয়ুব খান মনে করতেন, পাকিস্তানের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়, তারা এমনকি ভোট দেয়ারও অধিকার পেতে পারে না। এ চিন্তা ও বিশ্বাস থেকেই তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। এ ব্যবস্থায় জনগণ শুধু স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেই ভোট দিতে পারতো। এভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার করে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী বা বিডি মেম্বার নির্বাচিত হতো। এরাই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতো। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এমএনএ আর প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এমপিএ বলা হতো। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামের উদ্ভট ব্যবস্থায় ভোটার তথা ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীকে সহজেই টাকার বিনিময়ে কেনা যেতো। কেনা হয়েছেও। ফলে গণতন্ত্রের সর্বনাশ তো হয়েছিলই, জনগণও হারিয়েছিল ভোটাধিকারসহ সকল অধিকার। এজন্যই আইয়ুব খানের আমলে প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটাধিকার দেয়ার দাবি সব সময় ছিল প্রধান একটি দাবি। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা, মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা এবং সবশেষে ছাত্র সমাজের ১১ দফায়ও এর উল্লেখ ছিল। ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে আইয়ুব খান অবশ্য দাবিটি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আগেও বলা হয়েছে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
বর্তমান পর্যায়ে হঠাৎ আইয়ুব খানকে টেনে আনার অন্তত একটি কারণ সম্পর্কে জানিয়ে রাখা দরকার। সে কারণটি হলো, এরই মধ্যে হাওয়ায় এই মর্মে গুঞ্জন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, আগামী ডিসেম্বরে জেলা পরিষদের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে নির্বাচনে নাকি কেবল তারাই ভোট দিতে পারবেন যারা এখন এবারের ইউপি নির্বাচনে মেম্বার বা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হচ্ছেন। ইউপি নির্বাচন কেমন হচ্ছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। এ প্রসঙ্গে বরং সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। ইউপি নির্বাচনের দৃশ্যপট ও শিক্ষণীয় শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ছিল ‘বিকৃত’ নির্বাচন। ‘বিকৃত’ এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। প্রশ্ন তুলে বলেছেন, প্রশাসন ব্যর্থ হলে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা। কিন্তু কমিশন ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে কে ব্যবস্থা নেবে?
নির্বাচনকে ‘বিকৃত’ বলার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন সুজন সম্পাদক। তিনটি প্রধান কারণের উল্লেখ করে তিনি বলেছেন- প্রথমত, এতদিন মনোনয়ন বাণিজ্য হতো ওপরের তলায় কিন্তু এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল পর্যায়ে। দ্বিতীয়ত, এবারের নির্বাচনে যে সহিংসতা হয়েছে ও হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে তা অতীতের সকল নির্বাচনী সহিংসতাকে ছাড়িয়ে যাবে। আগে সহিংসতা সাধারণত নির্বাচনের দিন হতো, কিন্তু এবার নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও হচ্ছে। ফলে সহিংসতা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী। তাছাড়া সহিংসতা বেশি দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। নির্বাচনকে ‘বিকৃত’ বলার তৃতীয় কারণ হলো, আগের মতো এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি। নির্বাচন বরং ছিল প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। এভাবে সব মিলিয়ে প্রথম ধাপের নির্বাচনকে ‘বিকৃত’ নির্বাচন বলাটাই স্বাভাবিক। 
বস্তুত সহিংসতার মাধ্যমে শুধু নয়, অন্য অনেক পন্থায়ও চলমান ইউপি নির্বাচনকে ‘বিকৃত’ করা হয়েছে। কারণ, সুজন-এর পক্ষ থেকে প্রথম ধাপের কথা বলা হলেও বাস্তবে শেষ ধাপের সময় ঘনিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত অনেক এলাকায় বিএনপির প্রার্থীদের তো বটেই, এমনকি আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীদেরকেও ভয়-ভীতি দেখিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়া হয়েছে। তাদের মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলেছে ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা। বহু এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করার সময়ও ভুল থাকার যুক্তি দেখিয়ে অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এমন এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে, যার ফলে প্রায় কোনো ইউনিয়নেই বিএনপির কোনো প্রার্থী দাঁড়াতে পারেননি। অন্যদিকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষিত হচ্ছে কেবল আওয়ামী লীগের লোকজন। ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে লক্ষণীয় হিসেবে এসেছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। কোনো একটি এলাকাতেই অনিয়ম ও সহিংসতার ব্যাপারে কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এজন্যই সুজন প্রশ্ন তুলেছে, প্রশাসন ব্যর্থ হলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারে বলে আইন রয়েছে কিন্তু কমিশন ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে কে এবং কিভাবে ব্যবস্থা নেবে?
সুজন-এর বক্তব্য ও জিজ্ঞাসাকে যথার্থ না বলে পারা যায় না। কারণ, যে কোনো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আর ইউনিয়ন পরিষদের মতো তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন হচ্ছে প্রথম ধাপেরও প্রথম ধাপ। অন্যদিকে বাংলাদেশে এবারের ইউপি নির্বাচনে সমগ্র সে প্রক্রিয়াকেই বিকৃত করা হয়েছে। এতে বিএনপিসহ কোনো বিরোধী দলই বাধাহীনভাবে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়নি। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও একই অবস্থার শিকার হয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে প্রকাশ্যে। সরকার বিরোধী অনেককে আহত হওয়ার পাশাপাশি জীবনও হারাতে হয়েছে। এমন অবস্থায় জনমনে শুধু ভীতি-আতংকই ছড়িয়ে পড়েনি, জনগণ একই সাথে নির্বাচনের ব্যাপারেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা আস্থা হারিয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপরও। জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, কমিশন আসলে সরকারের সেবাদাসের ভূমিকাই পালন করেছে। আপত্তি হয়তো উঠতো না যদি কমিশনের এ ধরনের ভূমিকা কয়েকটি মাত্র এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকতো। অন্যদিকে প্রতিটি এলাকাতেই কমিশনকে একই ভূমিকায় দেখা গেছে।
বিষয়টি অবশ্যই গুরুতর। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত কর্মকাণ্ডের সময়ও বর্তমান কমিশনকে একই ন্যক্কারজনক ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। তিনশ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে আওয়ামী লীগ ও তার জোটের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও এবং পুরো বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হিসেবে সামনে চলে এলেও নির্বাচন কমিশনকে তৎপর হতে বা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। উদ্বেগের কারণ হলো, বর্তমানে অনুষ্ঠিত হতে থাকা ইউপি নির্বাচনেও সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, প্রতিটি ধাপের নির্বাচনেই প্রথম ধাপের পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে। দেখতে হচ্ছেও। এর ফলে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার ওপরই জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। একই কারণে বাধাগ্রস্ত হবে গণতন্ত্র- যে বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করতে গিয়ে সুজন-এর পক্ষ থেকে যথার্থই বলা হয়েছে, ‘বিকৃত’ এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে। আর এ ধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা ‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে নির্বাচিত হবেন তাদের নৈতিকতা ও জনগণের প্রতি দায়িত্বের বিষয়ে সংশয় থাকবে স্বাভাবিকভাবেই।
উদ্বেগের কারণ হলো, তথাকথিত এই জনপ্রতিনিধিরাই নাকি আগামীতে জনগণের পক্ষে সকল পর্যায়ে ভোট দেবেন! ডিসেম্বরে জেলা পরিষদ নির্বাচনে নাকি তারই প্রথম মহড়া হবে! বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে আসলে আইয়ুব খানের সেই ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে। এরপর আসবে সংসদ নির্বাচনের পালা। এভাবেই নাকি সব কিছু চালানোর চেষ্টা করা হবে। আমরা অবশ্য এখনই অনুমাননির্ভর কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তা সত্ত্বেও আইয়ুব খানের অন্তত দুটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। প্রথমত, কোনো একটি মাত্র রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা এবং সে রাষ্ট্রের পরামর্শ বা নির্দেশ মেনে চলার পরিণতি ভয়ংকর এবং ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য- তা সেটা যতো ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ই হোক না কেন। আইয়ুব খানের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ সংক্রান্ত। জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে দলীয় লোকজনকে ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ বানানোর এবং তাদের মাধ্যমে সকল স্তরে নির্বাচন নামের নাটক সাজানোর পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটাও দেখে যেতে হয়েছে আইয়ুব খানকে। আমাদের ধারণা, নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বার্থে সময় থাকতেই সংশ্লিষ্টরা সতর্ক হবেন।
আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads