সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬

রাজজ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী ও হাল আমলের বাংলাদেশ


প্রাচীন কালের রাজারা তাদের দরবারে জ্যোতিষী পুষতেন বলে জানা যায়। রাজজ্যোতিষীদের কাজ ছিল রাজপরিবারের সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভাগ্য গণনা, নূতন বছরের পঞ্জিকা প্রণয়ন, আবহাওয়ার পূর্বাভাষ প্রদান ও চাষাবাদের ব্যাপারে দিকদর্শন প্রণয়নে রাজ দরবারকে সহযোগিতা প্রদান। কথিত আছে যে, সিংহলের (বর্তমান শ্রীলংকা) রাজার একজন জ্যোতিষী ছিলেন। একবার রাজা এই জ্যোতিষীকে বৃষ্টির পূর্বাভাষ দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন যাতে করে তার প্রজারা তার ভিত্তিতে সেচের পানি সংরক্ষণ ও চাষাবাদের কাজে তা ব্যবহার করতে পারেন।
রাজজ্যোতিষী বাড়ি ফিরে এসে এই গণনায় লেগে যান এবং এ সংক্রান্ত সমস্ত পাঁজি ও বই পুস্তক ঘেঁটে একটি ফলপ্রসূ সুরাহায় পৌঁছার কাজে ব্রতী হন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেও তিনি এর সমাধান বের করতে ব্যর্থ হন। এদিকে তার স্ত্রী এবং পুত্রবধূ বার বার তাকে খাবার পরিবেশন করে খাবার আসনে বসাতেও ব্যর্থ হন। তিনি রাজকীয় নির্দেশ পালনে এতই মশগুল ছিলেন যে, খাবার দাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় তার পুত্রবধূ তাকে ডাকতে আসেন এবং বার বার ডেকেও কোন সাড়া না পেয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাজ কর্ম লক্ষ্য করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তার শশুর বৃষ্টির পূর্বাভাষ নিয়ে নিষ্ফল পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এবং তাতে এতই নিমগ্ন রয়েছেন যে, খাওয়া-দাওয়া এবং বাইরের দুনিয়ার সবকিছু ভুলে গেছেন। পুত্রবধূটির নাম ছিল খনা। খনা তখন শ্বশুরের সামনে থেকে পাঁজি-পুস্তক সবকিছু সরিয়ে তাকে বললেন-
“কি কর শ্বশুর লেখা আর জোখা
চাইয়া দেখা আকাশের রেখা
কোদালে কুঁড়লে আকাশের গাঁ
এই ত হলো বৃষ্টির ধা -
চাষাকে বল বাঁধতে আল
আজ না হলে হবে কাল।”
রাজজ্যোতিষী সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলেন এবং পরদিন রাজদরবারে তা পেশ করে রাজার প্রশংসাভাজন উপদেষ্টায় পরিণত হন। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকায় খনা একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত; খনার বচন মানুষের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে খনার বচনের বহুল প্রচলন রয়েছে। কথিত আছে যে রাজজ্যোতিষী খনার শ্বশুর তার সকল কাজে খনা-নির্ভর ছিলেন। তখন প্রকৃতির আচরণ, গ্রহ নক্ষত্রের আনাগোনা, পশু-পাখির অনুভূতি-প্রসূত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং মানুষের ঝোঁক প্রবণতা ও সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি প্রভৃতিকে ভিত্তি করে মেধাকে কাজে লাগিয়ে জ্যোতিষরা সরকারকে পরামর্শ প্রদান করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরামর্শ নিখুঁত বলে প্রমাণিত হতো।
খনার বচন আজকে আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়। কয়েক দিন আগে খুলনা গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে যশোর এবং যশোর থেকে খুলনা। আসার দিন যশোর থেকে ঢাকা অভিমুখী ফ্লাইট ছিল সকাল ৮-৩০টায়। বরাবর খুলনা থেকে ৭টায় রওনা হয়ে ফ্লাইট ধরতাম, কিন্তু এই দিন সবাই পরামর্শ দিলেন যে, অবশ্য অবশ্যই ভোর ৫-৩০টায় রওয়ানা হতে হবে। কেননা ঐ দিন ছিল পাটকল শ্রমিকদের অবরোধের দিন। তাই করলাম। কিন্তু অবরোধ থেকে বাঁচতে পারলাম না। খুলনার পাটকল শ্রমিকরা কিছুতেই অবরোধ তুলে আমাদের গাড়ি আসতে দিল না, ফিরিয়ে দিল এবং বাধ্য হয়ে বিকল্প গ্রামীণ পথে পাটকল এরিয়া এড়িয়ে মহাসড়কে উঠে যশোরের পথে আসতে হয়েছে। যশোরের নওয়াপাড়া পাটকলের কাছে এসেও একই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। পথে ড্রাইভারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হলো। তার মুখে গ্রামগঞ্জ ও মফস্বলের যে গুমোট আবহাওয়ার কথা শুনলাম তা অত্যন্ত ভয়াবহ। তার ভাষায়, ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা গ্রামগঞ্জের মানুষকে জিম্মি বানিয়ে বর্তমানে সারা দেশে একটি লুটপাট ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তার দলীয় পরিচয় জানতে চাইলাম, তিনি বললেন যে, তিনি পেটের দলের সদস্য, খেটে খাওয়া মানুষ, কোনও রাজনৈতিক দল করেন না। তবে দেশের কথা ভাবেন। তিনি জানালেন যে, বর্তমান সময়ে ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নব্য কিছু নেতানেত্রী তাদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ব্যাভিচার, ঘুষ রিসওয়াত ও নানা অপকর্ম দ্বারা শুধু সরকারকে গণবিচ্ছিন্নই করছে না বরং দলের ত্যাগী ও পুরানো নেতাকর্মীদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তার দুঃখ বর্তমান সরকার ও তার দল দেশকে এমনভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে যে তার রেশ হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকবে। ড্রাইভার ভদ্রলোকের বয়স খুব বেশি নয়; ৩০ অথবা ৩৫ হবে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে কিন্তু রাজনীতি বিশ্লেষণে তার পারঙ্গমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর অর্থ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা আর বাঙ্গাল নেই, রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপকে উপেক্ষা করে মানুষ হয়ে গেছে। তার গ্রামের বাড়ির কথা বললেন এবং জানালেন যে, তার ইউনিয়নে বিএনপি করে অথবা আওয়ামী লীগ করে না এ রকম শত শত যুবক, কিশোর ও প্রৌঢ় ব্যক্তি এখন ঘরছাড়া। তারা বাড়িতে থাকতে পারেন না, দাড়ি টুপিওয়ালা অথবা নামাজিরা জামাতী, তাদের এলাকায় থাকাও অপরাধ। এদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধেই মামলা, তিনি আরো বলেন যে, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলভিত্তিক করে পাড়ায় মহল্লায় এবং বাড়িতে বাড়িতে হিংসা বিদ্বেষ যেভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা আমাদের সমাজ এবং দীর্ঘ দিনের সামাজিক সংহতি ও বন্ধনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও এই ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তটি আওয়ামী লীগের নবীন প্রবীনের মধ্যেও মারাত্মক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। এখন ক্ষমতার আশ্রয়ে থেকে তারা এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে দেশীয় নয় মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না। এতে সামগ্রিকভাবে সমাজ কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং দুষ্কৃতি প্রতিরোধ ও সুকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকছে না। তিনি ছাত্রলীগের কলেজ পড়ুয়া এক নেতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বললেন যে, এই ছেলেটির পরিবার এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে নিয়মিত বাজার সাজার করতে পারতো না। এখন তার বাড়িতে বিলাসবহুল ছয় তলা ভবন উঠেছে। তার আয়ের উৎস নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন তার মতে একটি প্রহসন, এখানে অর্থ ও অস্ত্র দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে। অন্যদের কথা বাদ দিলেও আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। যারা বিদ্রোহী অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের কিছু যোগ্যতা আছে, কিন্তু সরকার ও এমপিদের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা। তারা অস্ত্র ঠেকিয়ে অথবা তার ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখছে। তার ধারণা অত্যাচার অবিচারের ফলে মানুষের মনে যে বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে যে কোন সময় তার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে এবং এর ফলে প্রতিহিংসার যে আগুন জ্বলে উঠবে তাতে আমাদের সমাজ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে।
নির্যাতিত মানুষ যে হারে সরকারকে অভিশাপ দিচ্ছে ক্ষমতার শৃঙ্গে থাকা সরকার তার খবর পাচ্ছেন না। বিএনপি নেতৃত্বের কাঠামোগত দুর্বলতা অথবা ঘর গোছানোর বিলম্ব সরকারকে উজ্জীবিত করলেও গণ বিস্ফোরণ ঠোকানোর মতো তা যথেষ্ট নয় বলে তিনিসহ অনেকে বিশ্বাস করেন। জামায়াত সম্পর্কে তার ধারণা, দলটিকে আওয়ামী লীগ সরকার অস্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয় করে দিয়েছে। জামায়াত নেতা কর্মীদের জেল জুলুম, মামলা ফাঁসি এবং দল ও তার অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে মিল নেই। দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও অপকর্মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ক্ষমতাসীন দল যখন জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ তোলে তখন মানুষ হাসে। কেননা একই সমাজে বসবাস করার ফলে জামায়াতের প্রতিটি লোকের নাড়ি নক্ষত্র সম্পর্কে তারা জানে এবং যে কেউ তাদের বিভ্রান্ত করতে পারে না। জিজ্ঞাসা করলাম সরকারের ও মিডিয়ার অব্যাহত অপপ্রচারের মুখে আগামী দিনে মানুষ জামায়াত-বিএনপির ডাকে সাড়া দিবে কিনা। উত্তরে তিনি বললেন, জুলুম-নির্যাতনের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তা দীর্ঘ স্থায়ী হতে পারে না। একদিন তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তার প্রক্রিয়া যখন শুরু হবে তখন গণজোয়ার রোধ করা কারুর পক্ষেই সম্ভব হবে না।
কিন্তু তত দিনে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ যে ফসল ফলাচ্ছে তা চিটায় পরিণত হবে এবং মাথা যদি ঠোল হয় তা দিয়ে দেশ চালানো যায় না। একজন মাইক্রো ড্রাইভারের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তির মধ্যে আমি সরকারের জন্য অনেক ম্যাসেজ ও সতর্ক বাণী দেখতে পাই।
আলোচনার শুরুতে আমি খনার গল্প ও রাজজ্যোতিষীর কথা উল্লেখ করেছিলাম। এখন রাজজ্যোতিষী নেই, ভবিষ্যৎ বক্তা নেই। সরকারকে উপদেশ দেন এবং বাস্তব অবস্থা জানান গোয়েন্দারা। অনেকে মনে করেন গোয়েন্দারা কখনো সত্য কথা বা বাস্তব অবস্থা জানিয়ে সরকারের বিরাগভাজন হতে চান না। তারা মোসাহেবি করেন। এই মোসাহেবি সরকার এবং জনগণ উভয়েরই ধ্বংস ডেকে আনে।
বাংলাদেশ এখন একটি কারাগারে পরিণত হয়েছে। সরকার এখন নিজের ছায়া দেখেও ভয় পায়। গণমাধ্যম অথবা গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সত্য কথা বললে সরকারের শত্রু হয়ে যান। তাদের জেলে দিয়েও তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। এই অবস্থায় গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে বছরের পর বছর কারাগারে আটক ব্যক্তিকেও সাত সমুদ্র তের নদীর ঐ পারে সাম্প্রতিক কালে কোনও সরকারি ব্যক্তিকে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত করতে তারা দ্বিধা করেন না এবং তাদের এই বায়বীয় অভিযোগ জনগণকে বিশ্বাস করতে হয়। এই অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে না, সরকারের উচিত দেশ ও জাতির স্বার্থে গোয়েন্দা নয়, আকাশ ও জমিনের বাস্তব অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং দানব নয় মানবীয় আচরণে ফিরে আসা, এতে দেশও বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে এবং দল জনপ্রিয়তা হারাবে না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads