শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৬

এরশাদের মুখে হঠাৎ চুক্তিভঙ্গের কথা


সাবেক স্বৈরশাসক এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আবারও যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আওয়ামী লীগের দিকে তীর ছুঁড়েছেন। গত ১২ এপ্রিল দলীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ তুলে বলেছেন, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে অর্থাৎ জনাব এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে মর্মে চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে জাতীয় পার্টিকে আনুপাতিক হারে মন্ত্রিত্ব দেয়ারও শর্ত ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সব ‘ভুলে যায়’। জাপার সঙ্গে ওয়াদা বরখেলাপ করে। এ পর্যন্ত এসেই থেমে যাননি সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল’। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানালেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর দলটি যে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ঘটানোর পাশাপাশি তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল- এ ধরনের আরো কিছু তথ্যও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এরশাদ। বলেছেন, এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালেও তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে আওয়ামী লীগ। আর সে কারণেই তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। এরশাদ প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, ‘আমি ডার্টি পলিটিক্স (নোংরা রাজনীতি) করি না। যেটা সত্য তা-ই বলি। সেটা অপ্রিয় হলেও বলি, প্রিয় হলেও বলি।’
বলা দরকার, যথেষ্ট তাৎপর্যপূণ হলেও জনাব এরশাদের এসব বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিন্তু মোটেও আলোড়ন ওঠেনি। কারণ, তিনি আসলে নতুন কোনো কথাই বলেননি। শুধু একটি কথা নিয়ে অবশ্য বিশেষ কারণে কিছুটা আলেচনা চলছে। সে কথাটা হলো, ‘আমাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল’। এই ওয়ান-ইলেভেন এবং উদ্দিন সাহেবদের সরকারের সঙ্গে কথিত সহযোগিতা সম্পর্কিত স্বীকৃতির কারণে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলার যে অভিযান চলছে, সে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এরশাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। কারণ, তিনি জানান দিয়েছেন তারাই আসলে ওয়ান-ইলেভেন ঘটিয়েছিলেন। এটা সত্য হলে ২০০৬ সালের অক্টোবরে সংঘটিত লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের দায়দায়িত্বও এরশাদদের ওপরই বর্তায়। আর সাবেক এ জেনারেল যেহেতু ‘ডার্টি পলিটিক্স’ করেন না এবং অপ্রিয় হলেও সত্য কথাই বলেন সেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষেও দায় এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না।
এটা খুবই গভীর একটি বিষয় বলেই এখানে বরং এরশাদ-বর্ণিত সেই চুক্তি বা সমঝোতার ব্যাপারে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। বস্তুত ‘ডার্টি পলিটিক্স’ এবং মিথ্যাচারের কারণে যতো অভিযোগই তার বিরুদ্ধে থেকে থাকুক না কেন, এই একটি বিষয়ে তিনি মিথ্যার ধারে-কাছে যাননি। সত্যই বলেছেন। কারণ, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। এ ব্যাপারে এরশাদ নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর। সে সময়ও গুঞ্জনে শোনা গিয়েছিল, শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনে এরশাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছাড়াও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। সুতরাং ‘বোনের’ সঙ্গে ‘ভাইয়ের’ বৈঠক হয়ে থাকলে তাতে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না। এরশাদ আরো বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। সবাইকে চমকে দিয়ে এরশাদ তখন আরো বলেছিলেন, এ শুধু তার ইচ্ছা নয়, শেখ হাসিনাও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বানানোর শর্তেই জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন! সেবার লন্ডন থেকে ফেরার পর পর এরশাদ একই সঙ্গে সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করতে শুরু করেছিলেন।
নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তুলে ধরাসহ এরশাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও ঘোষণা সে সময় ১৪ দলীয় জোটে তীব্র টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছিল। বাম দলগুলো এ কথা পর্যন্ত বলেছিল যে, তারা আর ১৪ দলে থাকবে কি না তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, তাদের বিচারে জাতীয় পার্টি ‘অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক দল’ এবং এরশাদ একজন ‘স্বৈরশাসক’। বামপন্থীরা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এরশাদের বিরুদ্ধে জনগণকে নয় বছর আন্দোলন করতে হয়েছে, অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কোনো দলের পক্ষে অমন একজন চিহ্নিত ‘স্বৈরশাসকের’ সঙ্গে একই জোটে থাকা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ অবশ্য প্রথম থেকেই কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এরশাদকে ‘কোনোক্রমেই’ বাদ দেয়া সম্ভব নয়। জিল্লুর রহমান শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছিলেন যে, প্রয়োজনে ১৪ দলের সবাই কিংবা যে কোনো দল চলে যেতে পারে, কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ছাড়া আওয়ামী লীগের চলবে না। এমন এক কঠোর অবস্থান থেকেই ১৪ দলকে ‘অটুট’ রেখে জোটের সম্প্রসারণ করার অর্থাৎ একই সঙ্গে ১৪ দল এবং আওয়ামী মহাজোট নিয়ে তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। দুটিরই নেতৃত্ব গিয়েছিল আওয়ামী লীগের দখলে।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এভাবেই এক বিচিত্র কৌশল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে যুক্তি দেখাতে গিয়ে দলটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘বড় অপরাধীর’ বিরুদ্ধে ‘ছোট অপরাধীকে’ সঙ্গে নেয়ায় দোষের কিছু থাকতে পারে না। এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের দিক-পরিবর্তনকারী ছাত্রনেতা শহীদ ডা. মিলনের মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক ‘বড় অপরাধী’ বিএনপির তুলনায়  স্বৈরশাসক এরশাদকে ‘ছোট অপরাধী’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন। প্রতিবাদও উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে। কারণ, ‘ছোট’ হলেও এরশাদকে আওয়ামী লীগ ‘অপরাধী’ই মনে করতো। তা সত্ত্বেও কথিত ‘বড় অপরাধী’ বিএনপিকে নির্বাচনে হারানোর লক্ষ্য নিয়ে দলটি এরশাদের সঙ্গে ঐক্য করেছিল। উল্লেখ্য, রাজ্জাক যে অনুষ্ঠানে কথাটা বলেছিলেন সেখানে শহীদ ডা. মিলনের দল জাসদ-বাসদের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু  কাউকেই প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে এরশাদের সঙ্গে ঐক্যের কারণ দেখাতে গিয়ে কথার তুবড়ি ছুটিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বেসরকারী টিভি চ্যানেলের টকশোতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একথা পর্যন্ত বলেছিলেন, জাতীয় পার্টিকে মহাজোটে নেয়ার বিষয়টি নাকি ‘ভোটের বোঝাপড়া’- এটা আদর্শগত কোনো জোট নয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়াটাই ছিল বড়কথা।
এসব তথ্যের আলোকে বলা যায়, এরশাদকে সঙ্গে রাখার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যায়েই আগাম পরাজয় ঘটেছিল আওয়ামী লীগের। নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘হর্স ট্রেডিং’ বা দর-কষাকষি কাকে বলে, সে কথাও আওয়ামী লীগের ‘ঝানু’ নেতাদের শিখিয়ে ছেড়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগকে ৫০টি আসন ছাড়তে হয়েছিল। ঘটনাপ্রবাহে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এরশাদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। ‘ক্ষমতায় যাই যাই’ অবস্থানে এসে যাওয়া ‘এত বড়’ একটি দলকেও কেন মাত্র সেদিনের স্বৈরশাসক এরশাদের ইচ্ছা পূরণ করতে হয়েছিল- সে প্রশ্নের উত্তর দিতে আওয়ামী লীগের নেতারা রাখ-ঢাক করেননি। বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় যেতে চান। আর বিএনপি ও তৎকালীন চারদলীয় জোটকে নির্বাচনে হারাতে হলে এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ অনেকভাবেই করে দেখেছিলেন তারা। ১/১১-এর পর কিছুদিন পর্যন্ত মনে হয়েছিল যেন দমন-নির্যাতনে দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে আসার পাশাপাশি দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেখানে মইন-ফখরুদ্দিনদের ‘নিয়ে আসা’সহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল, বিএনপি সেখানে ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। বিএনপিতে ভাঙন ঘটানোর এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে জোট থেকে বের করে আনার কোনো চেষ্টা ও পরিকল্পনাও সফল হয়নি। ঘটনাপ্রবাহে চারদলীয় জোট বরং আরো ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছিল। সে কারণে আওয়ামী লীগকে শুধু নয়, বিএনপি বিরোধী অন্য সকল পক্ষকেও নতুন করে হিসাব মেলাতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর কারণ, নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী অন্য দলগুলোর তুলনায় জাপা ছিল বেশি সম্ভাবনাময় একটি দল। সে সময় পর্যন্ত সর্বশেষ তথা অষ্টম সংসদেও জাতীয় পার্টির ১৪ জন এমপি ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট করেছিল একমাত্র রাশেদ খান মেনন ছাড়া সে দলগুলোর প্রধান নেতারাও কখনো নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি। তাছাড়া ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেনারেল (অব.) এরশাদের তৎপরতা শুরু হয়েছিল সবার আগে। কয়েক মাস ধরেই বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুরে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন তিনি। ফলে জাতীয় পার্টির সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল বলে এরশাদ অন্তত মনে করতেন।
ঘটনাপ্রবাহের ওই পর্যায়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা, জনপ্রিয়তা ও উদ্দেশ্যসহ নানাদিক। কারণ, ‘বড় দল’ আওয়ামী লীগ সাধারণত খুব সহজে কারো সঙ্গে হাত মেলায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এসে সে দলটিই যখন আগ বাড়িয়ে নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। কথাটা কঠিন সত্যও ছিল। কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পাও এগিয়ে অসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কথায় কথায় হরতাল চাপানো থেকে দিনের পর দিন ধরে বর্জনের মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করে ফেলার মতো বিভিন্ন উদাহরণের ভিড়ে যাওয়ার পরিবর্তে অল্প কথায় বরং বলা যায়, বিরোধী দলের নেত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা কোনো একটি প্রশ্নেই জনগণের স্বার্থে সামান্য ‘অবদান’ রাখার প্রমাণ দিতে পারেননি। তাকে সব সময় শুধু সরকারের ‘পতন’ ঘটানোর কাজেই ব্যস্ত দেখা গেছে- যেন বেগম খালেদা জিয়ার স্থলে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হলেই দেশ ও জাতির সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজীরও শেখ হাসিনাই বারবার স্থাপন করেছিলেন। জনগণও তাই তার আহবানে সাড়া দেয়নি- তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। ওদিকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেননি বলেই শেখ হাসিনা জনগণের আস্থাও অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। নিজেদের তো বটেই, ‘বন্ধুরাষ্ট্র’সহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। মূলত এই হতাশা থেকেই ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে এসে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। জোট গঠনের এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অক্ষমতা ও জনসমর্থনহীনতার কথাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। একই সঙ্গে সামনে এসেছিল অন্য একটি সত্যও- আওয়ামী লীগ যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়।
এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বানচাল করে দেয়ার কর্মকাণ্ড থেকে। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে সরকাকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পর নির্দলীয় এবং দুর্বল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেই কেন লগি-বৈঠার তান্ডব চালানো হয়েছিল- এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটু চিন্তা করলেই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের দিকটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ, নির্বাচনে অংশ নেয়ার সামান্য ইচ্ছা থাকলেও যে কারো তখন নির্বাচনমুখী কার্যক্রমেই ব্যস্ত হয়ে ওঠা উচিত ছিল। অন্যদিকে লগি-বৈঠার হত্যা ও তান্ডব চালানোর পাশাপাশি দাবির পর দাবি তুলে আওয়ামী লীগ এবং তার সঙ্গি-সাথীরা শুধু ঝামেলাই বাড়িয়েছিল। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করেছিল তারা পাল্লা দিয়ে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক দিনগুলোতে এমন কোনো বড়ো দাবির কথা বলা যাবে না যা পূরণ করা হয়নি। কিন্তু সংবিধান নির্ধারিত প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি কে এম হাসানকে দিয়ে ‘অপারগতা’ প্রকাশ করানো থেকে শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজকে ‘ছুটিতে’ পাঠানো পর্যন্ত অযৌক্তিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক প্রতিটি প্রধান দাবি পূরণ করার পরও আওয়ামী জোট ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিটি উদ্যোগকেই তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ব্যর্থ করে দিয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে সেই সঙ্গে বঙ্গভবন অবরোধ করার এবং বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গৃহযুদ্ধেরও ভয় দেখিয়েছিলেন। সব মিলিয়েই আওয়ামী জোটের উদ্যোগে পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছেও তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথিত পরিবেশ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য হলে আর যা-ই হোক মানুষ হত্যার মতো নিষ্ঠুর কর্মকান্ড চালানো এবং দাবির পর দাবি তুলে ঝামেলা বাধানো হতো না। শেখ হাসিনা নিজেও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, ড. ফখরুদ্দিনের সরকার তাদেরই আন্দোলনের ‘ফসল’- তারাই ফখরুদ্দিনদের ক্ষমতায় এনেছেন!
কিন্তু বিএনপিকে অনুসরণ করে ১৪টি দলকে নিয়ে জোট গঠন করলেও আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়নি। বাম দলগুলো বরং দলটির জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছিল। এজন্যই আওয়ামী লীগ এরশাদের দিকে হাত না বাড়িয়ে পারেনি। এরশাদও সুযোগ নিতে ছাড়েননি। নিজে রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছেন, জাপার জন্য আদায় করেছেন কম-বেশি ৫০টি আসনের নিশ্চয়তা। অন্যদিকে এমন ১৪টি দলই আওয়ামী লীগের ‘নীতি-আদর্শগত’ জোটে ছিল যাদের ওপর একটি আসনের জন্যও ভরসা করা যাচ্ছিল না। এজন্যই আওয়ামী লীগের নেতারা এরশাদের কোনো বাড়াবাড়িকেই খারাপ বলতে পারেননি। শুধু তা-ই নয়, পাছে এরশাদ বেঁকে বসেন- এই ভয়ে জাপা নেতাদের ‘সুধা সদনে’ ডেকে আনার ঝুঁকি এড়াতে আওয়ামী লীগের নেতারাই সে সময় এরশাদের ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে’ গিয়ে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন!
কিন্তু দলটি আওয়ামী লীগ বলেই ‘চুক্তি’ অনুযায়ী এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানায়নি। অথচ এরশাদ নিজেই শুধু বলেননি, রটনাও রয়েছে, কথা নাকি ছিল, আওয়ামী মহাজোট ক্ষমতায় গেলে তাকেই রাষ্ট্রপতি বানানো হবে। সমস্যা থাকলে নিদেনপক্ষে মাস ছয়েকের জন্য হলেও তিনি রাষ্ট্রপতি হবেন। কিন্তু আরেক ‘বৃদ্ধ’ জিল্লুর রহমানের কাছে তাকে হেরে যেতে হয়েছিল। এসব দুঃখ-বেদনা এরশাদ আরো অনেক উপলক্ষেই প্রকাশ করেছেন। যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের পর আওয়ামী লীগের এমপিরা যখন জাতীয় সংসদে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বক্তব্য রাখার পাল্লা দিচ্ছিলেন তখন, ৩ মার্চ জাতীয় পার্টির এক অনুষ্ঠানে অনেকটা গোপন তথ্য ‘ফাঁস’ করে দেয়ার ঢঙে এরশাদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনী ‘সহযোগিতা না করলে’ আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও’ ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। এজন্যই সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের ‘কৃতজ্ঞ’ থাকা উচিত। সেবারও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিলেন এরশাদ। সুতরাং সব মিলিয়েই বলা যেতে পারে, মনে অনেক দুঃখ থাকলেও নিতান্ত অসত্য কিছু বলেননি সাবেক এই স্বৈরশাসক।
বর্তমান পর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে অবশ্য অন্য কারণে। কে জানে, এরই মধ্যে বিশেষ কোনো সংরক্ষিত এলাকা কিংবা কোনো দক্ষিণী কেন্দ্রের কোনো ‘সিগনাল’ পাওয়া গেছে কি না। এমন অনুমানের কারণ, ‘ডার্টি পলিটিক্স’ করেন না বলে এরশাদ নিজে যতো সাফাই-ই গাইতে থাকুন না কেন, তার বিরুদ্ধে ‘ডার্টি পলিটিক্স’ করার অভিযোগ অনেক পুরনো। গুরুতর এ অভিযোগটি প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে অনেক আগে।
এজন্যই এতদিন পর হঠাৎ পুরনো দিনের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে ধরার অন্তরালে বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে! ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর দায়দায়িত্ব স্বীকার করার বিষয়টিকেও নিশ্চয়ই হাল্কাভাবে নেয়া যায় না!
আহমদ আশিকুল হামিদ  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads