শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬

মহান মে দিবস’র তাৎপর্য : বর্তমান প্রেক্ষাপট


আজ পহেলা মে, মহান মে দিবস। শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক সংগ্রামের দিনটাই হচ্ছে মহান মে দিবস। পৃথিবীর সব দেশে যথাযথ মর্যাদার সাথে ঐতিহাসিক মহান মে দিবস পালন করবে দুনিয়ার সকল মজদুর মানুষ। যাদের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে আজকের আধুনিক বিশ্বের এ যান্ত্রিক বিশ্বায়ন সেই যান্ত্রিক বিশ্বায়নের নির্মাতা দুনিয়ার সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, সম্মান ও লাল সালাম নিবেদন করছি এই লেখার মধ্যদিয়ে।
আজ বাংলাদেশে সরকারি ছুটি। দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ও শ্রমজীবী সংগঠনগুলো মে দিবস পালন করবে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে।
জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের জয় হবেই একদিন না একদিন। তাই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই কর’ শ্লোগানটি মে দিবসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। লড়াইয়ের শুরুটা হয়েছিল ১৮৮৬ সালে পহেলা মে। এই দিন আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটে। মানবের প্রতি দানবীয় শ্রমঘন্টার বিরুদ্ধে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে সেই দিন লক্ষ-লক্ষ মানুষ ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমবেত হয়েছিল শিকাগোর হে মার্কেটে। ১লা মে’র শিকাগো ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত রক্ত সংগ্রামে পরিণত হয়। পহেলা মে ধর্মঘট এক পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচিতে পরিণত হয়। অব্যাহত ধর্মঘট চলাকালে ৩ মে রাজপথের বিক্ষোভ মিছিলে শাসক গোষ্ঠির পুলিশি অভিযানে প্রাণ হারান ৫ জন কর্মবীর শ্রমিক। নিরস্ত্র শ্রমজীবী মানুষের উপর অস্ত্রধারী পুলিশের হামলার প্রতিবাদে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠে। পরে ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাইড পার্কে লাখো শ্রমিকের সমাবেশে মে দিবস পালন করা হয়। এর আগে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ২য় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আন্তর্জাতিকভাবে ১লা মে মহান মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ধীরে-ধীরে ১লা মে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সংহতির প্রতীক হিসেবে মহান মে দিবস পৃথিবীর দেশে-দেশে যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করে, সেই থেকে মহান মে দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ যেন দিবস আছে রজনী নেই, শোষণ বঞ্চনা ও অমানুষিক নির্যাতন যেন শ্রমজীবীর মানুষের পিছু ছাড়ছে না। ১৮৮৬ থেকে ২০১৫ সাল কালের ব্যবধান ভিন্ন হলেও এখনও অভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের সেই দাবি অপূরণই থেকে গেল। কেবল দিবস আসলেই আমরা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলি কিন্তু বাস্তবে মজদুর মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শাসক, প্রশাসক ও মালিকগোষ্ঠি আদৌ আন্তরিক হতে পারিনি। যদিও সময়ের ব্যবধানে শ্রমজীবী মানুষের যান্ত্রিক বিপ্লবের কারণে কাজের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা অধরাই থেকে গেল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৮ ঘন্টা কাজের সেই দাবি এখনও দাবির মিছিলে শ্লোগান হয়ে আছে আজ ঐতিহাসিক মহান মে দিবস। এ উপলক্ষে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী বিশেষ বাণী প্রদান করেন। দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে মহান মে দিবসের বাণী যেন বাণী না হয়ে আশার বাণী হয়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় যদি বলতে হয়-
‘এই পৃথিবীর যা কিছু মহান-
যা কিছু কল্যাণকর
অর্ধেক তার গড়িয়েছে নারী
অর্ধেক তার নর।’
কিন্তু পোষাক শিল্পের বিকাশে নরের চেয়ে এই দেশে নারীর শ্রমিকের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় , যে নারী শ্রমিকের অবদানে দেশের জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে সেই নারী শ্রমিকের চলমান জীবনযাপন বড়ই দুর্বিষহ। বেতনের সাথে যাদের জীবনযাত্রার ব্যয় খাপ খায় না তারাই হলেন গার্মেন্টস শ্রমিক। যারা দিনের সূর্য উঠার আগে চোখে ঘুম নিয়ে বিছানা ছাড়ে সেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের দূর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ে না। একের পর এক ট্রাজেডি শিকার হচ্ছে দেশের পোষাকশিল্প শ্রমিক। বাংলাদেশের পোষাক শিল্পে শ্রমজীবী মানুষের দুঃসহ স্মৃতির তীব্র যন্ত্রণা রানা প্লাজা ট্রাজেডি। রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে নিখোঁজ ১০৫ জন শ্রমিকের সন্ধান দীর্ঘ তিন বছরেও মিলেনি। যে ট্রাজেডিতে ১১৩৫ জন মানুষকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। ঘটনার ৩ বছর  পূর্ণ হলেও অনেকের কপালে ক্ষতিপূরণের অর্থও জোটেনি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ধসে পড়ার আগে ভবনে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিলেও ভবন মালিক খামখেয়ালিপনার কারণে এই ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতিয়মাণ হয়। ভবন মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সারাদেশের মানুষ সোচ্ছার হয়ে উঠেছিল। সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য সোহেল রানার বিচারের জন্য দেশবাসী অপেক্ষার প্রহর গুনছে গত ৩ বছর থেকে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এই ঘটনার চার্টশিট এখনও দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ ৩ বছরেও অনেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি। এই ব্যর্থতার দায় কার? শ্রমিকের ক্ষতি পূরণ পাওয়া করুণা নয়- অধিকার। আমরা কি পেরেছি রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে? রানা প্লাজার ঘটনায় স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদের   আহাজারী এখন চলছে। এর আগে ২০১২ সালে নবেম্বর মাস ঢাকার তাজরীন ফ্যাশনে ১১২ জন পোষাক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের অনেক দুর্ঘটনা ঢাকা চট্টগ্রামের পোষাক শিল্পের দুঃসহ যন্ত্রণার ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে পোষাক শ্রমিকের পর নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যাদের রক্ত ও ঘাম মিশে আছে সেই তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনা অনেক সময় পায় না। শ্রম দিয়ে যারা শ্রমের মূল্য পায় না তারাই জানে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াই কত কষ্টের?
শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও ) এবং দেশের শ্রম আইন সংবিধান অনুসারে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার যেন কিতাবে আছে গোয়ালে নেই। বরাবরই এই দেশের দিনমজুর শ্রেণীর মেহনতি মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত। শুধু গার্মেন্টস শিল্পে নয় ওয়ার্কসপ বিভিন্ন মিল, ফ্যাক্টরি ও ব্রিকফিল্ড শ্রমিকের পর সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার হয় ঘরের গৃহকর্মীরা। গায়ে কেরোসিন ঢেলে গরম ইস্ত্রির সেকা দিয়ে পিট ঝলসিয়ে দেওয়া ঘটনা অহরহ। শুধু তাই নয় গৃহ কর্মীদের উপর বর্বর নির্যাতনের পাশাপাশি খুন ধর্ষণও করা হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে গৃহকর্মী নির্যাতনে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি এগিয়ে। নারী হয়ে নারীর উপর বর্বরতা নষ্ট সমাজের নিদর্শন। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা অনেক বেশি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই সব মানুষকেই বেশি ভালবাসেন যারা সৎ এবং মেহনত করে। তাই শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই ন্যায্য পাওনা পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। এই দেশের মজদুর মানুষের জীবনসংগ্রামের অব্যক্ত কাহিনী আর নয় এবারের মহান মে দিবস মজদুর মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন হোক এই প্রত্যাশার দেশের সকল মেহনতি মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করছি। লাল সালাম সকল শ্রমজীবী মানুষের প্রতি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads