শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৬

নির্বাচন এবং খুনের রাজনীতি


শিরোনাম দেখে পাঠকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু না, কথাটা বাংলাদেশে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়নি। না বলার কারণ, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে এত বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে যে, খুন বলুন আর হত্যাকা-ই বলুন সবই এখন ডাল-ভাতের মতো সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। খুব বেশি আগ্রহী যারা, তারা বরং এখন খুনের ‘সেঞ্চুরির’ জন্য অপেক্ষা করছেন। একই কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। শিরোনামের কথাটা এসেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। গত ৪ এপ্রিল থেকে ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। ছয় ধাপের এ নির্বাচন শেষ হবে আগামী ৩০ এপ্রিল। ওই নির্বাচনে দলের পক্ষে প্রচারণা চালাতে এসে গত ২১ এপ্রিল পশ্চিম বঙ্গের হাওড়ার এক জনসভায় মিস্টার মোদি বলেছেন, ‘নির্বাচনে যারা হারে তারাই খুনের রাজনীতি করে। কিন্তু নির্বাচনে সহিংসতা কাম্য নয়।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির কথাটুকু শুনলে যে কারো মনে হতে পারে যেন পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভা নির্বাচনে বাংলাদেশের মতোই ডজনে ডজনে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। আহতও হচ্ছে শত শত মানুষ। অন্যদিকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, মারপিট, বুথ দখল এবং প্রতিপক্ষের লোকজনকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনার সংখ্যা অনেক হলেও হত্যাকা- কিন্তু তেমন ঘটেনি। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্তরই একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে কঠোর মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেই সাথে ক্ষতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসকে খোঁচা দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে যারা হারে তারাই খুনের রাজনীতি করে। মূল কথায় মিস্টার মোদি বলতে চেয়েছেন, এবারের নির্বাচনে হেরে যাচ্ছে বলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল খুনের রাজনীতি শুরু করেছে।
আসলেও কি তা-ই? মুখ্যমন্ত্রী মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস কি সত্যিই হেরে যাচ্ছে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই; কিন্তু তেমন কোনো জল্পনা-কল্পনায় যাওয়ার আগে অন্য কিছু কথা সেরে নেয়া দরকার। পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভার এ নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশেও আলোচনা যথেষ্টই হচ্ছে। এর কারণ, পশ্চিম বঙ্গকে বাংলাদেশের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ বলে প্রচার চালানো হয়Ñ যদিও সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত সকল ক্ষমতাসীনই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা বাংলাদেশকে শুধু ব্যবহার করতে চান এবং পশ্চিম বঙ্গের কাছে বাংলাদেশের কিছুই পাওয়ার বা আশা করার নেই। তা সত্ত্বেও ‘এপার বাংলা-ওপার বাংলা’ বলে চামাচামো করার এবং কলকাতায় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরার মতো লোকজনের সংখ্যা এদেশে নিতান্ত কম নয়। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে জানানো দরকার, ৩০ এপ্রিলের পর এদেশের কারো কারো ‘দিদিমনি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তার দল তৃণমূল কংগ্রেস আবারও ক্ষমতায় যেতে পারবে কি না সেটাও জানা যাবে। পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, কথাটার মধ্যে সংশয়ের আভাস রয়েছে। কেন- তার একটি বড় কারণ হলো, ২০১১ সালের নির্বাচনে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে বিরাট বিজয় অর্জন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার কিন্তু তার উল্টোটি ঘটেছে। কংগ্রেস জোট বেঁধেছে সেবার বিতাড়িত বামফ্রন্টের সঙ্গে। এ এক অচিন্ত্যনীয় ব্যাপারÑ যদিও ভারতের সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের জন্য এটাই স্বাভাবিক।
এদিকে এককালের তুখোড় বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচারের অভিযান তুঙ্গে উঠেছে। কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে এটা চলছে কয়েক মাস ধরে। ভারতীয় গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক বিভিন্ন খবরেই এমন অবস্থার কারণ জানা যাচ্ছে। মমতা বিরোধী প্রচারণার সবচেয়ে বড় ইস্যু এখন ঘুষ ও অর্থ কেলেংকারিসহ সর্বব্যাপী দুর্নীতি। বলা হচ্ছে, ২০১১ সালের মে মাসে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেয়ার সময় এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। সাধারণ সুতি শাড়ি ও ঘরে পরার চপ্পল পরে গোটা রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। শুধু নির্বাচনের আগের দিনগুলোতে নয়, তার আগের কয়েক বছর আগে থেকেই আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো থেকেছেন তিনি। কমিউনিস্ট নামধারীদের মতো বাবুয়ানা ও ফুটানি করতে দেখা যায়নি তাকে। পশ্চিম বঙ্গের মানুষও তাই মমতাকে নিজেদের কাছের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মমতা সবার ‘দিদি’ বা বোন হয়ে উঠেছিলেন। সেবারের নির্বাচনে দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টদের বামফ্রন্ট সরকারকে রীতিমতো ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন মমতা। ওই নির্বাচনে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট শুধু হেরে যায়নি, হেরেছিলও লজ্জাকরভাবে। মমতার তৃণমূল কংগ্রেস ও সোনিয়া গান্ধীর ন্যাশনাল কংগ্রেসের জোট যেখানে ২২৫টি আসন পেয়েছিল সেখানে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক দল সিপিএম জিতেছিল মাত্র ৪১ আসনে। সব মিলিয়ে বামফ্রন্টের আসন হয়েছিল ৬১। সেটা ছিল একটি নির্বাচনী রেকর্ড। কেন এত বিরাট ব্যবধানে অমন পরাজয় ঘটেছিল, তার কারণ নিয়ে দেশে-বিদেশে যথেষ্ট অলোচনা হয়েছিল।
বামফ্রন্টের ভরাডুবি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট বিজয়ের একটি বড় কারণ হিসেবে বহুদিন পর সেবার প্রাধান্যে এসেছিলেন নির্যাতিত ও বঞ্চিত মুসলমানরা। শতকরা হিসাবে প্রায় ২৫ শতাংশ ভোট থাকলেও পশ্চিম বঙ্গে তারা ‘সংখ্যালঘু’। সেবারের নির্বাচনে মুসলমানরাই নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে কারণে মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অতি হাস্যকর প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল। মুসলমানদের উন্নতি-সমৃদ্ধির নানা ধরনের অঙ্গিকারের ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা। প্রতিটি দলই কয়েকজন করে মুসলমান প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন হাতে মুসলমানদের ‘দোয়া’ চেয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। তৃণমূলের নারী কর্মীরা গায়ে বোরখা চাপিয়েছিলেন, পুরুষরা মাথায় টুপি পরেছিলেন। মুসলমানদের নিয়ে বামফ্রন্টকে ঠ্যালা-ধাক্কাও কম দেননি মমতা। মমতার এই ঠ্যালা-ধাক্কা খেয়ে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিএম ও বামফ্রন্ট নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আবার ক্ষমতায় এলে তারা মুসলমানদের জন্য শিক্ষা-চাকরি ও ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ রিজার্ভেশন বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। এমন ঘোষণার কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদৌলতে এই সত্য ফাঁস হয়ে পড়েছিল যে, জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ হলেও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এক শতাংশ মুসলমানও শিক্ষা-চাকরি ও ব্যবসা পাননি। এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘প্রগতিশীল’ এই কমিউনিস্টরা! প্রমাণিত হয়েছিল, তৎকালীন কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরাও মনে-প্রাণে কট্টর হিন্দুত্ববাদীর ভূমিকা পালন করে এসেছেন। স্মরণ করা দরকার, বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই কলকাতাসহ পশ্চিম বঙ্গে মাইকে আযান দেয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
অন্যদিকে মমতা নিয়েছিলেন খুবই চাতুরিপূর্ণ কৌশল। বঞ্চিত ও নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য তার ছিল অনেক প্রতিশ্রুতি। কমিউনিস্ট ও বামফ্রন্ট বিরোধী জনমত গঠন করার জন্য যেখানে যা কিছু বলা দরকার তার কোনো কিছুই বাদ দেননি এই বুদ্ধিমতী নেত্রী। কট্টর হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম প্রধান এলাকায় যাওয়ার আগে তিনি পবিত্র কোরআন শরীফ হাতে নিয়েছেন, মুসলমান নারীদের মতো গায়ে ওড়না জড়িয়েছেন এবং মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। অর্থাৎ অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে পক্ষে টেনে আনার এবং বিভ্রান্ত করার জন্য সবই করেছিলেন তিনি। এতে কাজও হয়েছিল। নির্বাচনে অবিশ্বাস্য বিজয় অর্জন করেছিলেন তিনি। সে বিজয়ের পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল মুসলমান ভোটারদের। এসবের বাইরে এক বছরের মধ্যে ১০ লাখ বেকারকে চাকরি দেয়া, জেলায় জেলায় শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং সাধারণ স্কুল-কলেজের পাশাপাশি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠার মতো অসংখ্য প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিধানসভার নতুন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই স্বাভাবিক নিয়মে হিসাব-নিকাশও শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিগত পাঁচ বছরে প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গিকার কতটুকু পূরণ করেছেন মমতা, তা নিয়ে চলছে জোর পর্যালোচনা। এতে কিন্তু মমতা এগিয়ে থাকতে পারছেন না। কারণ, ৭২ লাখ বেকারকে চাকরি দিয়েছেন বলে ঘোষণা দিলেও কথাটার পক্ষে এ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা। দুই টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর বিষয়টিও মিথ্যাচার হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে মুসলমান ‘সংখ্যালঘু’দের উন্নতি সম্পর্কে। বলা হচ্ছে, রমযান মাসে মুসলমানদের বাসাবাড়িতে ঘোমটা দিয়ে ইফতার খাওয়া ছাড়া এমন কিছুই তিনি করেননি, যার ফলে ২৫ শাতংশ মুমলমানের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে। তাদের জন্য না তিনি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, না অন্য ভারতীয়দের মতো মুসলমানরা পেয়েছেন ব্যবসা ও শিক্ষার সুযোগ। অর্থাৎ মুসলমানরা যে তিমিরে ছিলেন সে তিমিরেই রয়ে গেছেন। মাঝখান দিয়ে মমতা বেশি সাফাই গাইতে গিয়ে বিপদ বাড়িয়েছেন মুসলমানদের। হিন্দুরা এখন ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। ছোট-বড় দাঙ্গা থেকে অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেই বিপন্ন হয়ে পড়ছেন তারা।
মুসলমানদের কথিত উন্নয়নের মতো অন্য সব ক্ষেত্রেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রতারণার অভিযোগেই বেশি অভিযুক্ত হতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ কেলেংকারির অসংখ্য বিষয়। নারদ স্টিং নামের অপারেশনে একের পর এক তৃণমূল মন্ত্রী ও নেতার ঘুষ নেয়ার ভিডিও বেরিয়ে এসেছে। এতে দেখা গেছে, তৃণমূলের মন্ত্রী ও নেতারা খুশি মুখে লাখ লাখ টাকার বান্ডিল হাতে নিচ্ছেন, কেউ তোয়োলেতে জড়িয়ে নিচ্ছেন কেউ আবার  নিয়ে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছেন। প্রথমে অস্বীকার করলেও ইদানীং মমতা বলে বেড়াচ্ছেন, যদি কিছু ভুল হয়েই থাকে তাহলে ভোটাররা যেন ক্ষমা করে দেন। তাদের আশীর্বাদের হাত যেন তৃণমূলের ওপর থেকে সরিয়ে না নেন। এরপর এসেছে সারদা ও রোজভ্যালি নামের দুটি চিট ফান্ডের সঙ্গে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের সচিত্র রিপোর্ট। সংস্থা দুটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতে স্বয়ং মমতা নাকি উত্তরবঙ্গের ডেলো ডাকবাংলোতে গিয়েছিলেন। সেখানে লেনদেনও হয়েছিল বিশাল অংকের। এসবের ভিডিও প্রকাশ করেছে মমতাবিরোধীরা। জনগণও তা বিশ্বাস করেছে। সবশেষে প্রাধান্যে এসেছে কলকাতার বাণিজ্যিক এলাকা বড় বাজারে নির্মাণাধীন একটি ফ্লাইওভার ধসে পড়ার এবং তার কারণে ২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা। এর সূত্র ধরে প্রমাণিত হয়েছে, তৃণমূল সরকারের আমলে যত নির্মাণের কাজ হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতেই নি¤œ মানের সামগ্রী ব্যবহার করেছে ঠিকাদাররা। কারণ, ঠিকাদাররা না চাইলেও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের দোকান ও প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। এভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মমতার দল।
অর্থাৎ সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে মমতার ব্যর্থতা এবং ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ কেলেংকারির ঘটনাগুলোকে পুঁজি বানিয়েছে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের বিচিত্র জোট। তাই বলে বিশেষ করে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল  কংগ্রেসের আশা করার তেমন কিছু নেই। এর একটি কারণ, পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেস কখনোই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীর মতো ডাকসাঁইটে একজন প্রধানমন্ত্রীও কংগ্রেসকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেননি- এমনকি ‘এপার বাংলা’ বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেয়ার কৃতিত্ব দাবি করার পরও। পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেসের অবস্থা সম্পর্কে বোঝানোর জন্য একটি মাত্র তথ্যের উল্লেখ করাই যথেষ্ট। ১৯৮৪ সালে  প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সমগ্র ভারতেই কংগ্রেসের পক্ষে জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল। সব রাজ্যে বিরাট ব্যবধানে জিতলেও এবং কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে পারলেও পশ্চিম বঙ্গে ‘বামেরাই’ জিতেছিলেন।
জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সরকারও গঠন করেছিলেন তারাই।
এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের সম্ভাবনা না থাকার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে রয়েছেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এ পদটিতে মনোনয়ন পাওয়ার জন্যও ‘বাঙালী’ নেতা প্রণব মুখার্জিকে দীর্ঘ ৬৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। উল্লেখ্য, নামে রাষ্ট্রপ্রধান হলেও ভারতে রাষ্ট্রপতিকে আসলে অলংকারের মতো রাখা হয়। সব ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আরেক ‘বাঙালী’ কমিউনিস্ট নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ব্যর্থ হওয়ার পর প্রণব মুখার্জি নিজেও বহুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করে দেখেছেন। কিন্তু পারেননি। সবশেষে রাষ্ট্রপতি বানানোর নামে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রিত্বের রেস বা দৌড় থেকেই সুকৌশলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা সে সময় বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে গান্ধী পরিবারের অতি বিশ্বস্ত সেবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে এলেও প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসের জন্য ‘বার্ডেন’ তথা বোঝা হয়ে উঠেছিলেন। সোনিয়া গান্ধী না তাকে গিলতে পারছিলেন, না পারছিলেন উগলে ফেলতে। অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এবং সুযোগ পেলেই প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আবদার জানিয়ে বসছিলেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখেও আরো একবার তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রণব মুখার্জির বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-বিরোধী তৎপরতা চালানোর অভিযোগও এসেছে।
তাছাড়া যতো বিশ্বস্ত সেবকই হোন না কেন, একদিকে তিনি ‘বাঙালী’ অন্যদিকে আবার চেষ্টা চলছিল রাজিব ও সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য। সে কারণেই কংগ্রেসের ঘাড় থেকে প্রণব নামের বোঝাটিকে ঝেড়ে ফেলে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সেটাই করেছে কংগ্রেস। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়েছে। এই ‘বাঙালী’ নেতা যাতে এদিক-সেদিক করতে না পারেন সেজন্য স্বয়ং সোনিয়া গান্ধী তার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি বানানোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভারতের রাজনীতি থেকেই প্রণব মুখার্জিকে বিদায় করেছেন সোনিয়া গান্ধী। এটা ছিল কংগ্রেসের জন্য সাময়িক বিজয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কংগ্রেস একই সঙ্গে নস্যাৎ করেছিল পশ্চিম বঙ্গে দলটির সম্ভাবনাকেও। কারণ, সরকার গঠন করার মতো সাধ্য না থাকলেও রাজ্যে বহু বছর ধরে কংগ্রেসের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন প্রণব মুখার্জি। সে তিনিই রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার ফলে তার পক্ষে আর কংগ্রেস বা অন্য কোনো দলের জন্য কাজ করার বা প্রচারণা চালানোর সুযোগ নেই। অন্যদিকে প্রণব মুখার্জি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নেতাও পশ্চিম বঙ্গে এখনো তৈরি হননি, যিনি কংগ্রেসকে ক্ষমতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। 
কংগ্রেসের পাশাপাশি বামফ্রন্টের জন্যও এবারের বিধানসভা নির্বাচন আশাবাদী হওয়ার মতো কারণ এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। এর কারণ, দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও কমিউনিস্টরা রাজ্যের জন্য কিছু করেননি। যা করেছেন সবই নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। একই কারণে ২০১১ সালের নির্বাচনে মমতা তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া বিগত পাঁচ বছরেও সরকারের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে প্রচারণা চালানো ছাড়া এমন কোনো কাজই বামফ্রন্ট করেনি, যার কারণে ভোটাররা আবারও কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আনবে। এখানে অবশ্য একটি কথা বলে রাখা দরকার। কথাটা মুসলমানদের সম্পর্কে। বলা হয়, পশ্চিম বঙ্গের নির্যাতিত ও বঞ্চিত মুসলমানরা নাকি কংগ্রেসের ভোটার। সে জন্যই তৃণমূল গতবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল, জিতেও গিয়েছিল। এবার কংগ্রেস যেহেতু বামফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধেছে সেহেতু মুসলমানদের ভোটও তারা পেয়ে যেতে পারে। তেমনটি ঘটলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপর্যয়ের কবলে পড়তে হবে। তা সত্ত্বেও সব মিলিয়ে বলে রাখা যায়, পশ্চিম বঙ্গের ভোটার জনগণ এবারই সম্ভবত মমতার ওপর থেকে ‘আশীর্বাদের হাত’ উঠিয়ে নেবে না। একেবারে বিমুখ করবে না তৃণমূল কংগ্রেসকে। অর্থাৎ স্বল্প ভোটের ব্যবধানে হলেও মমতাই আবার মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দায়ী থাকবে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট তথা কমিউনিস্টরা। তাছাড়া কংগ্রেসের সুবিধাবাদী রাজনীতিকেও জনগণ ভালো চোখে দেখছে না। এরই সুফল পেয়ে যেতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads