শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৬

মন্ত্রী সংবিধান লংঘন ও আইন প্রণয়ন


দেশের সর্বোচ্চ আদালত গত ২৭ মার্চ শেখ হাসিনা সরকারের দুই মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত করেছেন। এই দণ্ডপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রী হলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। তাদের উভয়কে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে ৭ দিন করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। ইতিমধ্যে এই দুই দণ্ডপ্রাপ্ত মন্ত্রী জরিমানার সে টাকা পরিশোধও করেছেন। অর্থাৎ আইনের দৃষ্টিতে তারা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। এই অপরাধীরা এখনও মন্ত্রী হিসেবে বহাল আছেন। তাই কেউ যদি বলেন যে, বর্তমান মন্ত্রিসভা অপরাধীদের মন্ত্রিসভা, তবে তাকে বোধকরি দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হওয়ার পর এই দুই অপরাধী কোনো বিবেচনায়ই আর মন্ত্রী পদে বহাল থাকতে পারেন না।
সাজাপ্রাপ্ত এই দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একদিকে যেমন আদালত অবমাননা করেছেন, একই সঙ্গে তারা তাদের শপথও ভঙ্গ করেছেন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি যেসব মন্তব্য করেছেন, তার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে ঐ মামলার পুনরায় শুনানি করার আহ্বান জানান দুই মন্ত্রী। কামরুল ইসলাম সেই শুনানি থেকে এটর্নি জেনারেলকেও বাদ দেয়ার আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীও একই ধরনের বক্তব্য দেন। এতে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন। এই মামলার প্রথম শুনানিতে তারা তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করলেও কেন তারা ও ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তার একটা ব্যাখ্যা দেন। তাতে তারা বলেন যে, আবেগের বশবর্তী হয়ে তারা এই কাজ করেছেন। সেখানেও একটা ফাউল করেন তারা। কারণ মন্ত্রীরা অনুরাগ ও আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করবেন না বলে শপথ নিয়েছেন। ফলে ঐ ব্যাখ্যায় তারা তাদের শপথও ভঙ্গ করেন। এ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, কেউ ডাকাতি করে যদি ক্ষমা চায়, তবে কি তাকে ক্ষমা করা হবে? এই দুই মন্ত্রী সে বিবেচনায় ফৌজদারি অপরাধ করেছেন তাদের ব্যাখ্যাও ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
দুই মন্ত্রীকে এই দণ্ডের রায় দিতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু আদালত তাদের ক্ষমার আবেদন গ্রহণ করতে অপারগ। তারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। কিন্তু যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তাতে প্রধান বিচারপতির দফতর ও বিচার বিভাগকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। তাই তাদের আবেদন খারিজ করা হলো। শুরুতেই তারা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় তাদের সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছি। তাই দুজনকে দোষী সাব্যস্ত করে এই দণ্ড দেওয়া হলো। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা দেখবেন মীর কাসেম আলীর রায়ে কার কাছ থেকে কারা টাকা নিয়েছেন। টাকা নিয়ে খেলা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের ডিগনিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা কারও সঙ্গে কোনো আপোস করি না। আমরা চাইলে জনকণ্ঠে প্রকাশিত অন্যদেরকেও ডাকতে পারতাম। কিন্তু আপনারা দুজন সাংবিধানিক পদ ধারণ করেন। আপনাদের মাধ্যমে পুরো জাতিকে মেসেজ দিচ্ছি, কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে তাহলে আদালত কতো কঠোর হতে পারে।
এদের দণ্ড নিয়ে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি শপথ ভঙ্গ করলে তারা ঐ পদে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েন। সাংবিধানিক পদে যারা থাকেন তাদের শপথ নিতে হয়। আর এই শপথের মূলমন্ত্র হলো, ‘আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করব।’ আর এই শপথ যখন ভঙ্গ হয়, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ যদি শপথ ভঙ্গ করেন, তাহলে তিনি ঐ পদে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েন। সর্বোচ্চ আদালতে দুই মন্ত্রীর এই দণ্ড বিষয়ে ডেপুটি স্পীকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি বলেছেন, অনৈতিক কারণে সাজা হলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত এই দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, এই দুজনের মন্ত্রিত্ব থাকবে কিনা সেটা নৈতিকতার বিষয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রিসভা। সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের বিদায়ী সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আদালত অবমাননার অপরাধে সর্বোচ্চ আদালত দোষী সাব্যস্ত করে দুই মন্ত্রীকে সাজা দিয়েছেন। নৈতিকতার বিষয় থাকায় তাদের মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত। যদি তারা পদত্যাগ না করেন তবে প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ বলেছেন, আদালত অবমাননার দায়ে দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব থাকা না থাকার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। 
কিন্তু সব কিছুই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। দেশের সংবিধান, আইন-আদালতেরও একটি ব্যাপার আছে। নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে বর্তমান সরকার সব সময়ই উদাসীন। সরকারের কোনো পর্যায়েই এখন আর নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। তবে দেশে ‘দ্য পাবলিক সার্ভেন্ট (ডিসমিজাল অন কনভিকশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫’ নামের একটি আইন আছে। এই আইনে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি কোনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা হয়, তা হলে ঐ কর্মকর্তা-কর্মচারী আপনা আপনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন। কিন্তু ঐ দুই মন্ত্রীর জরিমানা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক হাজার টাকার পঞ্চাশ গুণ বেশি। ঐ আইন অনুসারে তো তারা আপনা আপনি ইতিমধ্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে গেছেন। তা হলে কীভাবে তারা গিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসছেন, অফিসে যাচ্ছেন, ফাইলপত্রে সই করছেন? এর সবই তো সেক্ষেত্রে অবৈধ হয়ে যাবার কথা।
কিন্তু না, দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরা এখনও মন্ত্রী হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন। শুধু এই দুই অপরাধীকে নিয়েই মন্ত্রিসভা নয়। আরও একজন ইতিমধ্যেই বেশ নাম করেছেন। তিনি ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। গত ১লা এপ্রিল গভীর রাতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ডিসি নার্সারী সংলগ্ন এলাকায় এই মন্ত্রী আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক মলয় কুমার সাহাকে মারধর করেন, লাথি মারেন ও গালিগালাজ করেন। সেখানে উপস্থিত আরো এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন জয়। সে সময় তিনি অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। তার পুরো আচরণ ছিল অস্বাভাবিক। এ নিয়ে মলয় কুমার আশুলিয়া থানায় একটি জিডি করেছেন। পুলিশ প্রশাসন ঘটনাটি গত শনিবার সরকারের নীতি নির্ধারণের পর্যায় জানিয়েছেন। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, উপমন্ত্রী জয় রাত পৌনে ২টার দিকে তার ব্যক্তিগত গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-১০৮৩) নিয়ে আশুলিয়া এলাকা অতিক্রম করছিলেন। এ সময় নিয়ম অনুযায়ী তাকে ভিআইপি প্রটোকল দিতে আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল মহাসড়কে অবস্থান করে। জয়ের ব্যক্তিগত গাড়ি এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারের উপরে উঠে পড়ে। ঐ এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আশুলিয়া থানার এসআই মলয় কুমার এগিয়ে গেলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন উপমন্ত্রী। এ সম্পর্কিত জিডিতে মলয় বলেছেন, ‘তুই কেন আমাকে নিরাপত্তা দিতে এসেছিস? আমি কি তোর কাছে নিরাপত্তা চাইছি? তুই আমাকে কি নিরাপত্তা দিবি? তুই কয়টা গুলী করতে পারিস? আর আমি কয়টা গুলী করতে পারি তুই দেখবি।’ পুলিশ কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালন করার কথা জানালে জয় উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমি তোর চাকরি খেয়ে ফেলব। তার পর তিনি গাড়ি রেখে নবীনগরের দিকে একাই দৌড়াতে থাকেন। নবীনগর ফ্লাইওভারের কাছাকাছি গিয়ে জয় রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী দূরপাল্লার খালেক এন্টারপ্রাইজের একটি নৈশ কোচে (ঢাকা মেট্রো-১১-৬৮৪২) উঠে পড়েন। পুলিশও নিরাপত্তার স্বার্থে ওই বাসে উঠে গেলে জয় বাসের মধ্যে তাকে মারধর করেন। এক পর্যায়ে লাথি মেরে বাস থেকে ফেলে দেন। এতে হতভম্ব হয়ে পড়েন বাস যাত্রীরাও। মলয় হাতজোড় করে অনুরোধ করেনÑস্যার প্রয়োজনে আমাদের পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করুন। আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। উপমন্ত্রী ধমক দিয়ে নাইট কোচের চালককে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলেন। পুলিশের গাড়িটি ভিআইপি নিরাপত্তার স্বার্থে উপমন্ত্রীকে অনুসরণ করে। পরে উপমন্ত্রী গাবতলি পৌঁছে বাস থেকে নেমে দ্রুত সিএনজি অটোরিকশায় মিরপুর মাজার রোডে চলে যান। অটোরিকশাটি গলির ভিতর চলে গেলে গাড়ি সেটি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। পুলিশের দলটি আশুলিয়ায় ফিরে যায়। জয়ের কেলেঙ্কারি এটাই প্রথম নয়, এর আগে তিনি নিজ মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম-সচিবের কক্ষ ভাঙচুর করেন, খেলার মাঠে প্রকাশ্যে পিস্তল নিয়ে মহড়া দেন। আবার খেলোয়াড়ের নামে আদম পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অর্থাৎ মন্ত্রিসভায় একদিকে যেমন সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত ব্যক্তিরা রয়েছেন, অপরদিকে রয়েছেন উপমন্ত্রী জয়ের মতো অপরিশীলিত অভব্য লোকজন।
কয়েকদিন আগে প্রধান বিচারপতি জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার  বৈঠকে বলেন, কিভাবে আইন প্রণয়ন হয় উনি (প্রধান বিচারপতি) জানেন কিনা জানি না। কোন আইন তৈরির উদ্যোগ মন্ত্রণালয়ে নেয়ার পর তা মন্ত্রিসভার আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং, সচিব কমিটির পর্যবেক্ষণ, মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াও সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক, যাচাই-বাছাই, সংশোধনী, দফাওয়ারি সংশোধনী সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিবেচনাসহ কয়েক ধাপে পর্যালোচনা হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ধোপে টেকে না। কারণ, সংবিধানের রক্ষক হিসাবে আইন কীভাবে প্রণীত হয় প্রধান বিচারপতি তা ভালোভাবেই জানেন। সংসদের আলোচনাও আমরা শুনি। তাতে দেখা গেছে সংসদ সদস্যরা বা মন্ত্রীরা তাদের বৃক্ততায় সংসদে অনুপস্থিত বিরোধী দল বিএনপি ও তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমান সম্পর্কে নানা ধরনের কটূক্তিতে সময় পার করেন। বাকিটা করেন সরকারের প্রশংসা। আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে তাদের সাধারণত দেখা যায় না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads