বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৫

লাশের মিছিলে আতঙ্কের জীবনযাত্রা


গত কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ করেই গুপ্ত হত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ঘটনার ধরণ ও প্রকৃতি প্রায় অভিন্ন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর কয়েকদিন পর ওইসব ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় বিভিন্ন ঝোপঝাড়, ডোবা, বেরিবাঁধ বা নির্জন স্থানে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তি ‘নিখোঁজ’ই থেকে যাচ্ছেন, তার লাশও উদ্ধার হচ্ছে না।
র‌্যাব ও ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা এখন আর এ ধরনের অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না। নিরুপায় আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে  প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নীরব ভূমিকায় সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রশ্ন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩০তম অধিবেশনের শুনানিতে এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজাপেয়ারেন্সেস বিষয়ে যৌথ বিবৃতি প্রদান করেছে এশিয়ান লীগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি), এফআইডি এইচ ও এএফএডি। বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের অব্যাহত ঘটনাগুলো অবিলম্বে বন্ধ করার বিষয়ে এ বিবৃতি দেয়া হয়।
যৌথ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজাপেয়ারেন্সেস’র কর্মকাণ্ডের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে দ্য এশিয়ান লীগ্যাল রিসোর্স সেন্টার, এফআইডিএইচ ও এশিয়ান ফেডারেশন আগেনস্ট ইনভলান্টারি ডিজাপেয়ারেন্সেস।
একই সঙ্গে বাংলাদেশে চলমান বলপূর্বক গুম, দায়মুক্তি এবং এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত দমননীতির ব্যাপারে ওয়ার্কিং গ্রুপের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
২০০৯ সালের জানুয়ারি ও ২০১৫ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশে কমপক্ষে ২১২ জনের জোরপূর্বক গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।
এ ঘটনাগুলোতে বহু প্রত্যক্ষদর্শী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অপহরণের ধরন ও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির প্রোফাইল ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কণ্ঠরোধ করতেই সরকার গুমের পথ বেছে নিচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ বা ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করছে পুলিশ ও আদালতসমূহ।
সম্প্রতি পরিবারের গুম হওয়া প্রিয়জনদের নিয়ে স্মরণসভা আয়োজন করার প্রয়াসও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বাক স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের ওপর বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের আপনজনদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আমরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের তাদের পরিবারে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডসমূহের ঘটনায় পুর্ণাঙ্গ তদন্তের ব্যাপারে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতে তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাগিদ জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ স্বাক্ষরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাচুর প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছে। সে কারণে দেশটি বৈধভাবে বলপূর্বক গুমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বাধ্য। অধিকন্তু ১৯৯২ সালের প্রোটেকশন অব অল পার্সন্স আগেনস্ট ইনভলান্টারি ডিজাপেয়ারেন্সেস-এর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার এখতিয়ারভুক্ত অঞ্চলের আওতায় থাকা যে কোন স্থানে জোরপূর্বক গুমের কর্মকান্ড-সমূহ প্রতিরোধ করতে ও ইতি টানতে কার্যকর আইনগত, প্রশাসনিক, বিচারিক বা অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বলপূর্বক গুম অবসানের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া ও দোষীদের শাস্তি প্রদানের বিষয়গুলো নিশ্চিতে দায়বদ্ধ। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারসমূহের অধিকার এবং মানবাধিকার কর্মীদের কথা বলা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে অবশ্যই শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণ করতে হবে। আমরা ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে দেশটি সফরের অনুরোধ জানাতে এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জরুরি ক্ষেত্রে এ ধরনের সফর অনুমোদনের আহ্বান জানাচ্ছি। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫)
একই সময় লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি প্রবন্ধ দেশে এবং বিদেশের বিভিন্ন মহলে বেশ ভালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। হাসিনা এবং সজীব জয় দুজনেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছেন। শেখ হাসিনা বিশেষভাবে ব্রিটেনে এই মৌলবাদী জঙ্গিদের শক্ত ঘাঁটি থাকার উল্লেখ করে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘আনমাস্কিং টেরোরিস্ট ইন বাংলাদেশ’ বা বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের মুখোশ উন্মোচন। এই প্রবন্ধে জয় জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থানের জন্য জামায়াত দায়ী।’ জয় স্পষ্টই বলেছেন, ‘আল কায়দাকে সহায়তাদানকারী জামায়াতকে একটি বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা থাকা উচিত নয়।’ (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫)
লন্ডনে গার্ডিয়ানকে দেয়া শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং প্রায় একই সময়ে একটি মার্কিন দৈনিকে প্রকাশিত শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের নিবন্ধটি প্রকাশের আলোচনার মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বাংলাদেশের গুলশানে ইতালির নাগরিক তারাই সিজারি তাভেল্লা খুন হয়েছেন। জঙ্গি সংগঠন আইএস রাতেই দাবি করে তাভেল্লাকে খুন করেছে।
এরপর থেকে বিদেশীদের নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিদেশীরা জঙ্গি হামলার টার্গেট বলে আশংকা ব্যক্ত করেছে প্রভাবশালী একাধিক দেশ। দেশগুলো দাবি করছে, তাদের কাছে হুমকির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট খবর আছে। কিন্তু তারা সরকারকে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই দিচ্ছে না। ইতালির নাগরিক খুন হওয়ার পর থেকে প্রভাবশালী দেশগুলো দূতাবাস ও মিশন থেকে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের আশংকার কথা প্রচার করছে।
মার্কিন দূতাবাস ২৯ সেপেপ্টম্বর ঐচ্ছিক ছুটি ছিল। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আমেরিকান ক্লাব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ইতালির নাগরিক খুনের সঙ্গে আইএসের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিদেশী নাগরিক ও তাদের স্বার্থের ওপর জঙ্গি হামলা বিষয়ে কোনো হুমকি ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। সম্প্রতি জঙ্গি হামলার আশংকায় বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল তাদের সফর স্থগিত করে। তাদের কাছ থেকে এ ধরনের হামলার বিষয়ে বাংলাদেশ কিছু জানতে পেরেছে কিনা প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, তাদের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা কিছুই জানাতে চায়নি।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থে জঙ্গিরা হামলা করতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র দফতর। এরপরই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আসে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দল। তারা ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন-শৃংখলা বাহিনী ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডসহ (বিসিবি) বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। প্রতিনিধি দলটি এ বিষয়ে তাদের মত জানাবে এমন ধারণা করা হচ্ছিল। ঠিক এমন সময় ইতালির সাহায্যকর্মী সিজারি তাভেল্লা খুন হন। এরপর দলটি কোনো সিদ্ধান্ত না জানিয়েই বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
এদিকে ইতালির এই সাহায্যকর্মী নিহত হওয়ার পর যুক্তরাজ্য বলেছে, বাংলাদেশে পশ্চিমা স্বার্থে হামলা হতে পারে। এমন নির্ভরযোগ্য তথ্য তাদের হাতে আছে। ইতালির নাগরিক হত্যার ঘটনায় কূটনৈতিক মহলে নিন্দার ঝড় বইছে। ইইউ ও যুক্তরাজ্য এ বর্বর হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ বাংলাদেশে তাদের দেশের নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি করেছে। 
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads