বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য জাতীয় ঐক্য


বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়েও ক্ষমতাসীন দল অপরাজনীতি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনীতিক ও বিশিষ্টজনদের অভিমতসহ বৃহস্পতিবার দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুই বিদেশী নাগরিকের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দেশের সুনাম ও নিরাপত্তার স্বার্থে দরকার যখন ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা তেমন এক জটিল সময়েও ক্ষমতাসীনরা জাতিকে বিভক্ত করার কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে এমনভাবে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের এই অপরাজনীতি ও একগুঁয়েমির পরিণতিতে এরই মধ্যে পর্যটন খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, বিদেশী উন্নয়ন সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে জাতীয় অর্থনীতির ওপরও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে নতুন নতুন আরো হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে, দেশ এমনকি আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের বিভিন্ন আশংকার কারণেই প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অপরাজনীতি পরিত্যাগ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, নিছক সংকীর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিশেষ দল বা নেতাদের দিকে আঙুল ওঠানোর পরিবর্তে দেশের স্বার্থে, জননিরাপত্তার স্বার্থে এবং জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সকলের-বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের উচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশিষ্টজনদের এই অভিমত, আশংকা ও আহ্বানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। বস্তুত সরকারের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি করার অভিযোগ অকারণে ওঠেনি। গুরুতর সন্দেহ নেই কিন্তু অভিযোগ অস্বীকারও করা যাবে না। সে পথ ক্ষমতাসীন দলই বন্ধ করেছে।  এর কারণ, দেখা যাচ্ছে, ইতালী ও জাপানের দুই নাগরিকের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনরা আবারও প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অশুভ তৎপরতায় নেমে পড়েছেন। তারা বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নাম ধরে বক্তব্য রাখছেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, কোনো রকম তদন্তের আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রচারণা ও আক্রমণের এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন। এখনো সে অভিযানে ক্ষান্ত দেয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা মাত্র এবং ক্ষমতাসীনরা এ কাজটি অতীতে অনেক উপলক্ষেই করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হলে এবং হত্যাকা-ের মতো কোনো ভয়ংকর অপরাধ ঘটলেই তারা সব দোষ প্রতিপক্ষের ওপর চাপানোর এবং নিজেরা দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। দুই বিদেশী নাগরিকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান নিয়েছেন তারা। অথচ বিদেশীদের তো বটেই, কোনো হত্যাকা-েরই দায় এড়াতে পারে না সরকার। প্রসঙ্গক্রমে জঙ্গিবাদের প্রশ্ন এসেছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি বিশিষ্টজনেরাও বলেছেন, জঙ্গিবাদ নিয়ে মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রেখে চলেছেন। ব-দিন ধরে জঙ্গিবাদ নিয়ে শোরগোল করার পর সাম্প্রতিক হত্যাকা-ের পর কেউ বলছেন দেশে জঙ্গিবাদী সংগঠন আছে আবার কেউ বলছেন নেই। গত বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছেন যে, দুই বিদেশীর হত্যাকাণ্ডে আইএস-এর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে আইএস-এর অস্তিত্ব নেই বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 
আমরা মনে করি, দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে বিশিষ্টজনদের যে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে তার প্রতিটি অংশ নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কেউই সামান্য বাড়িয়ে বলেননি বরং প্রত্যেকের বক্তব্যেই রয়েছে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। যেমন মূলকথায় তারা বলেছেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা যা করছেন তাকে রাজনীতির পরিভাষায় ব্লেমগেম বলা হয়। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এমনকি তদন্ত সম্পন্ন হওয়ারও আগে তারা প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অশুভ অভিযানে নেমে পড়েছেন। এটা তাদের কৌশল সন্দেহ নেই কিন্তু বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি আমরাও উদ্বিগ্ন এজন্য যে, এর ফলে সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। পর্যটন খাতের কথা বিশিষ্টজনেরাই উল্লেখ করেছেন, ওদিকে রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টও এরই মধ্যে নেতিবাচক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তৈরি পোশাকের অর্ডার দেয়ার জন্য বিদেশী ক্রেতারা এখন আর বাংলাদেশে আসছেন না, গার্মেন্ট মালিকদেরই উল্টো বিদেশে দৌড়াতে হচ্ছে। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর হাত গুটিয়ে নেয়া এবং জাপানের মতো কোনো কোনো দেশের নাগরিকদের প্রত্যাহার করার কার্যক্রমও আতংকিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি কেমন হবে এবং বাংলাদেশকে কতভাবে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে- সময় থাকতেই সেসব ভেবে দেখা দরকার। আর এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। আমরা তাই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি বন্ধ করার এবং তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এর-ওর দিকে আঙুল না ওঠানোর আহ্বান জানাই। একথা অনুধাবন করা জরুরি যে, ক্ষমতাসীনদের অপরাজনীতি, প্রমাণ ছাড়া উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থানের কারণেই দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে চলেছে। সত্যিই সততার সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চাইলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিতে হবে। বলা দরকার, গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির যেমন উন্নতি ঘটবে তেমনি দ্রুত কমে আসবে সব ধরনের অপরাধও। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা এবং অর্থনীতি ও নিরাপত্তাসহ জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়ারও কোনো কারণ থাকবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads