মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৫

কী ভয়ঙ্কর, ছেলেটি সব জানে


আমাদের বাহাদুর পুলিশ শেষ পর্যন্ত এক অসাধ্য সাধন করেছে। যখন সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত মন্ত্রীরা তারস্বরে বলে যাচ্ছেন যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই, তখন অতি করিৎকর্মা পুলিশ আইএস সন্দেহে দশম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রকে আটক করেছে। শুধু আটক করেই ক্ষান্ত হয়নি, সে নাকি কী একটা লিফলেট বিতরণ করছিল। তখন ঐ স্কুলের অতি উচ্চ শিক্ষিত কিংবা মূর্খ শিক্ষকরা তাকে একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। এই শিক্ষকদের বাহবা না দিয়ে উপায় কী! আমি ততোধিক অযোগ্য বা সুযোগ্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করছি, রাষ্ট্রকে জঙ্গিবাদমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য এই শিক্ষকদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্বর্ণ বা প্লাটিনামের পদক প্রদান  করা হোক।
ঘটনার যে বিবরণ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, আমরা সেটুকুই জানতে পেরেছি। তাতে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারোবাড়ি ইউনিয়নের ফতেনগর গ্রামের জহুরুল ইসলামের ছেলে ও আঠারোবাড়ি উচ্চ বিদ্যালযের দশম শ্রেণীর ছাত্র মোহাম্মদ ফাহিম আর ফয়সাল ইবনে মুসা বিন জুলকারনাইন। সে উপজেলার সোহাগী স্কুল অ্যান্ড কলেজে কোচিংয়ে আসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ডাক’ শিরোনামে একটি লিফলেট বিতরণ করছিল। কী সাংঘাতিক! মধ্যপ্রাচ্য মানেই জঙ্গি। আর সেই জঙ্গিদের ডাক? মাথার ওপর যে আকাশ ভেঙে পড়েনি, এই যা রক্ষা। যদিও এই মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানিতে সরকারের কত না কোশেশ।  তবে এই শিক্ষক আর পুলিশদের কাণ্ডজ্ঞান অবাক করার মতো। কারণ যা সে বিলি করছিল, তা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পত্রিকায় ছবি তুলে প্রচারের জন্য মিডিয়ায় দেয়া হয়েছে। সেটি কোনো লিফলেট নয়, আসলে একটি কবিতা। পুলিশের না হয় কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োজন নেই, কিন্তু স্কুল কলেজে যারা পড়ান, তাদের কাছ থেকে আরও একটু কা-জ্ঞান আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেরকম কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় তারা দিতে পারেননি।
আটক ফয়সাল কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে। সে বলেছে, ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের খবর শুনে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মে তার। মুসলমানদের ওপর ইহুদিদের নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতেই সে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ডাক’ নামে একটি কবিতা লিখে প্রচার করছিল। আর অবিশ্বাস্য গৎবাঁধা কথা বলেছে পুলিশ। তারা বলেছেন, ফয়সাল আইএস সমর্থক বলে স্বীকার করেছে; সে ‘সুদীর্ঘ’ ছয় মাস ধরে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনকে সমর্থন করে আসছে। তার অপরাধ ভয়ঙ্কর।
একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক অত্যন্ত দায়িত্বশীলভাবে এই ঘটনার রিপোর্ট করেছেন। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার থানা পুলিশ ছাত্রশিক্ষক সবার সঙ্গেই কথা বলেছেন। আর রিপোর্টার সম্ভবত কথা বলেছেন ঐ স্কুলের কোনো শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি সম্ভবত নিজের ‘নিরাপত্তার জন্য’ ক্যামেরার সামনে তার চেহারা উন্মোচন করতে চাননি। আর তাই তার চেহারা ঢেকে দিয়ে সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়। রিপোর্টার তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ক্লাস টেনের একটা বাচ্চা ছেলে, সে আইএস-এর কী বোঝে? শিক্ষকটি যেন একবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। বললেন, না, না, ও সব বোঝে। আমেরিকা বোঝে। মধ্যপ্রাচ্য বোঝে। ইহুদি বোঝে, মুসলমান বোঝে। এ বিষয়ে ও অনেক কিছু জানে। যেহেতু ও অনেক কিছু জানে, ও ঐ শিক্ষকটির মতো মূর্খ নয়, অতএব সে আইএস জঙ্গি না হয়েই যায় না। সাব্বাস শিক্ষক!
কিন্তু নিরাপত্তা সঙ্কটের কারণে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার পর থেকেই (২৬ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলেছেন বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। তারপরই গুলশানের নিরাপত্তা জোনে গত ২৮ সেপ্টেম্বর খুন হন ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার। তখনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস জঙ্গি নেই। সিজার হত্যাকাণ্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তারপরও কেউ কেউ এই বলে পুলক অনুভব করছিলেন যে, সিজারকে আইএসই হত্যা করেছে। কোথাকার কোন ওয়েবসাইটে নাকি আইএস সেরকম দাবি করেছে। কিন্তু যে আইএস-এর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, তারা তাতে আইএসকে লিখেছে, ইসলামিক স্টার্ট, ইসলামিক স্টেট নয়।
এরপর গত ৪ অক্টোবর রংপুরে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে আসা এক জাপানি নাগরিক হোসি কোনিও। তিনি রংপুরে দু বিঘা জমি নিয়ে তাতে গোখাদ্যের উপযোগী উন্নত মানের ধানের চাষ করছিলেন। তার জন্মও হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে ১৯৪৯ সালে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি জন্মস্থানের জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। রংপুরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি বসবাস করছিলেন। এলাকার সকল মানুষ বলেছেন, তিনি ভাল ও অমায়িক লোক ছিলেন। যাচ্ছিলেন সাধারণ মানুষের মতোই রিকশায় করে। তখন তিনজন লোক একটি মোটর সাইকেলে করে এসে তাকে গুলী করে চলে যায়। হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি প্রাণ হারান। সিজারের মতো প্রায় একই কায়দায় তাকে হত্যা করে আইএস বলে কেউ দাবি করেছে, তারাই তাকে হত্যা করেছে।
এরপরও গত ২৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুনরায় বলেন যে, বাংলাদেশে আইএস বা আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে আইএস পরিচয়ে যাদের আটক রাখা হয়েছে, তার ভিত্তি কী? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে এদের গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। এরপর গত ৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবারও বলেছেন যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস বা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। এরকম একটা সময়ে ঈশ্বরগঞ্জের এক গ-গ্রামের দশম শ্রেণীর ছাত্র ফয়সালকে কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ আইএস সাজিয়ে বসেছেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ ও শিক্ষক নামের কলঙ্ক কিছু মতলববাজ লোক। আমরা আশা করি অকারণে হয়রানি করে এই সৃষ্টিশীল সম্ভাবনাময় ছাত্রটির জীবন যেন নষ্ট করে না দেয়া হয়।
এবার ফয়সালের মতো আমার স্কুলজীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রালী’র দাম ছিল আট আনা। আমরা চার বন্ধু দু’ আনা করে চাঁদা দিয়ে পত্রিকাটি কিনে গোপনে পড়ি। ছাত্র খারাপ ছিলাম না। আবৃত্তি গান নাটক খেলাধূলা সব কিছুতেই আমি ছিলাম সামনে। আমাকে ছাড়া যেন এসব অনুষ্ঠান কল্পনাও করা যেত না। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকতেন শিক্ষকরা। তখন লাইব্রেরির সকল থ্রিলার পড়া শেষ। দস্যু বাহরাম থেকে কালো ভ্রমর পর্যন্ত। ততোদিনে পড়ে ফেলেছি মাও সেতুং-এর কবিতা ও লাল বই। পড়েছি মার্কসবাদের অ-আ-ক-খ, লেনিনের কিছু লেখা। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, যে গল্পের শেষ নেই প্রভৃতি আরও বহু বই। এছাড়া বড়দের বইও পড়ছি নিয়মিত। আকবর হোসেন, বেদুইন সামাদ, ফাল্গুুনী মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ,অবধূত, জরাসন্ধ, এমন কি নজিবর রহমানের আনোয়ারা পর্যন্ত।
আমাদের শিক্ষকগণ এতে উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন। এর মধ্যে নিজেও গোপনে গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করেছি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সেগুলো গোপনে পড়াই। সকল শিক্ষকের অপরিমেয় ¯েœহ পেয়েছি। বলতেই হবে, আমার শিক্ষক ভাগ্য খুব ভালো। কিন্তু নাইন থেকে টেনে ওঠার বার্ষিক পরীক্ষার সময় ধরা খেয়ে গেলাম। সেদিনই পরীক্ষা শেষ। আর সেই সপ্তাহে চিত্রালীত বের হয়েছিল মাহফুজ সিদ্দিকীর গল্প ‘এত ঢং যে মেয়ের’। সে গল্পটি ছিল পত্রাকারে। বন্ধুরা বলল, চমৎকার গল্প। বললাম, ধুর, এরকম গল্প আমিই লিখতে পারি। বাজি হলো, যদি পারি, তা হলে ওরা আমাকে কালই টাঙ্গাইল নিয়ে সিনেমা দেখাবে।
শেষ পরীক্ষা ছিল পদার্থবিদ্যার। বইয়ে আছে, অথচ পারি না, এটা আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই আমার পরীক্ষা শেষ। কিন্তু সহপাঠী হিরুর পরীক্ষা শেষ হয় না। আমিও ধৈর্য হারিয়ে ওর দিকে রওয়ানা হলাম। গল্পটা ওকে দিয়ে চলে যাব। ভাঁজ করা কাগজে গল্পটা হাতে নিয়ে হিরুকে ডাক দিলাম। এগিয়ে এলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক মাহফুজ স্যার। বললেন, কিরে, ওকে ডাকছিস কেন? আমি হাতের কাগজটা দেখিয়ে বললাম, স্যার এটা ওকে দেব। স্যার বললেন, নকল? আমি বললাম, না স্যার, অন্য একটা লেখা। স্যার বললেন, আমাকে দে। আমি ওকে দিচ্ছি। প্রেমের গল্প। স্যারের  হাতে কীভাবে দেই। এক পর্যায়ে স্যার গল্পটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন। নিয়েই খুললেন। প্রিয় সুলতানা, সম্বোধনটা দেখেই তো স্যারের চক্ষু ছানাবড়া। পড়লেন। বললেন, তুই যাস না, বসে থাক। তারপর আমার কাছে এসে আবার বললেন, কোন মেয়ের সর্বনাশ করছিস? আমি বললাম, স্যার এটা চিঠি নয়, গল্প।
আমি বসে থাকলাম। পরীক্ষা শেষ। কিন্তু গোটা স্কুলের গেল না কেউ। সবাই মাঠে বসে রইল। আমার বিচারের জন্য চার সদস্যের কমিটি হলো। বাংলা শিক্ষক আমিন স্যার, ইংরেজি শিক্ষক মোহাম্মদ আলী স্যার আর দুজন মৌলবী স্যার। আমি বিচারকদের সামনে হাজির হলাম। প্রথমেই মুখ খুললেন মোহাম্মদ আলী স্যার। বললেন, আমি এই বিচারের ঘোর বিরোধী। ও একটি চমৎকার গল্প লিখেছে। এজন্য আমাদের উচিত আগামী বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ওকে সেরা পুরস্কার দেয়া। অন্যরা চুপ করে থাকলেন। মোহাম্মদ আলী স্যার রাগ করে চলে গেলেন। রাখেন আপনাদের এইসব মূর্খতা। এবার জুনিয়র মৌলবী স্যার বললেন, তোকে রাস্টিকেট করা উচিত। আমি তো রাস্টিকেট মানে জানি না। চুপ করে রইলাম। বাংলা স্যার বললেন, আর কোনোদিন এসব লিখবি না স্বীকার করলে তোকে চারটি বেতের বাড়ি দিয়ে ছেড়ে দেব। আমি বললাম, স্যার, স্বীকার না করলে কী করবেন? স্যার বললেন, চুপ, বেআদব, হাত পাত। আমি হাত পাতলাম। স্যার বেশ জোরে জোরে চারটি বাড়ি দিলেন। আমার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার আমি আবারও লিখব। একদিন আপনারা পত্রপত্রিকায় আমার গল্প পড়বেন।
রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর সিনিয়র জুনিয়র ছাত্ররা আমাকে কাঁধে তুলে বিশাল স্কুল মাঠ ঘুরলো। নানা স্লোগান দিল। আমি দুঃখ ভুলে গেলাম। খাল পাড় হয়ে দেখি, গাছের নিচে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছেন মোহাম্মদ আলী স্যার। বললেন, দুঃখ করিস না। ওগুলো অশিক্ষিত। আজকালকার কোনো খবর রাখে না। তুই আবারও লিখবি। আর লেখা হলেই আমাকে দেখাবি। এখন ওঠ আমার সাইকেলের সামনে। উঠলাম। উনি আমাকে আমার বাড়ির পাশে নামিয়ে দিলেন।
১৯৭২ সালে আহসান হাবীবের সম্পাদনায় দৈনিক বাংলায় বের হলো আমার প্রথম ছাপা গল্প ‘অন্ধকারের প্রত্যাশা’। এক কপি কাগজ আমি আমিন স্যারের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। এরপর মাসে আমার দু’ একটি গল্প ঢাকার কাগজে ছাপা হতো। আর ছাপা হতো ফিচার-উপসম্পাদকীয়। আমি প্রত্যেকটা লেখা আমিন স্যারকে ডাকে পাঠিয়ে দিতাম। অনেক দিন ধরে দিয়েছিলাম। মনে আছে।
ফয়সালের জন্য প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহতায়ালা যেন তাকে একসময় বড় লেখক করে তোলেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads