বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫

সামনে অপেক্ষার প্রহর


পৃথিবীর ইতিহাস আসলে ন্যায় এবং অন্যায়ের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। এ কারণেই হয়তো প্রতারণা ও প্রহসনে পূর্ণ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়ও কখনো কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। এবার প্রতিবাদদীপ্ত হয়েছেন যুক্তরাজ্যের শিক্ষাবিদরা। যুক্তরাজ্যের ৩৪৩ জন শিক্ষাবিদ ইসরাইলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনীদের প্রতি ইসরাইলের ‘অসহনীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ প্রতিবাদে তাঁরা ‘ফিলিস্তিনীদের অধিকার সমর্থনে যুক্তরাজ্যের শিক্ষানুরাগী সম্প্রদায়’ নামে গত ২৭ অক্টোবর দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। শিক্ষাবিদরা বলেন, তাঁরা ইসরাইলের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না। দেশটির অর্থে কোনো সম্মেলনেও অংশ নেবেন না। যতদিন ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন না মানবে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান না দেখাবে, ততদিন এই বর্জন অব্যাহত থাকবে। জানি না, শিক্ষাবিদদের এমন প্রতিবাদে ইসরাইল সরকারের মধ্যে কোনো বোধোদয় ঘটবে  কিনা।
আমরা জানি, মানব জাতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে, অনেক বিষয়ে পার্থক্যও আছে। তারপরও মানুষ তো মানুষই। মানুষ মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও মানুষ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের প্রতি মানবিক ও সভ্য আচরণে সক্ষম হচ্ছে না। মানুষ এখনো সভ্যতার সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এ কারণেই হয়তো ভারতের হরিয়ানায় দলিত সম্প্রদায়ের দুই শিশুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে পারলো স্থানীয় রাজপুত সম্প্রদায়ের লোকজন। ১৯ অক্টোবর রাত তিনটার দিকে রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর ফরিদাবাদের বল্লভগড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নিহত শিশু দু’টির বাবা-মা আগুনে দগ্ধ হয়। তাদের  নয়াদিল্লীর সফদর জং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় ফরিদাবাদে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। নিহত শিশু দু’টির বাবা জিতেন্দ্র বলেন, কিছুদিন ধরেই রাজপুত পরিবারের লোকজন আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল। তারা আমাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বলে। আমরা এলাকা ছেড়ে চলে না যাওয়ায় ঘটনার দিন রাতে তারা ঘরের জানালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে আমাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চালায়।
মানুষকে পুড়িয়ে মারার তৎপরতা কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, চমৎকার সব বিশেষণে বিশেষিত রাষ্ট্রগুলোতেও এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা। এমন ঘটনায় মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। ফরিদাবাদের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও। ওই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর খাত্রাকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যার মতো ঘটনা প্রতিরোধে সরকার ও প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তো সমাজ আর মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উগ্রতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা যেন বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে ভারতের লেখক সমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেক লেখক প্রাপ্ত পদক ও সম্মাননা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে ভারতে উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মুক্তমনা লেখকরা নিহত হচ্ছেন, গো-মাংস খাওয়ার কারণে নিহত হচ্ছেন সংখ্যালঘু মুসলমানরাও। লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্মল বিনোদন মাধ্যম অভিজাত ক্রিকেট অঙ্গনেও উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িক চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আম্পায়ার আলিম দারের পর ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার পঞ্চম ওয়ানডের আগেই ফিরে যেতে হচ্ছে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ওয়াসিম আকরাম ও শোয়েব আখতারকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার হুমকিতে ওই দুই ক্রিকেট তারকাকে দেশে ফেরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই)-এর কার্যালয়ে শিবসেনার আকস্মিকভাবে প্রবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনায় নিরাপত্তা ইস্যুতে ওয়াসিম আকরাম ও শোয়েব আখতারকে পঞ্চম ওয়ানডের আগেই পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় স্টার স্পোর্টস। এই চ্যানেলটির ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজ বিষয়ক বিশেষ প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে আসেন পাকিস্তানের সাবেক ওই দুই ক্রিকেটার। ভারতের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আনলে উপলব্ধি করা যায়, নানা কর্মকাণ্ডে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার তাদের সংবিধান সমুন্নত রাখার ব্যাপারে কতটা সক্ষম হয়।
প্রতারণাপূর্ণ বর্তমান বিশ্ব সভ্যতায় আশার তেমন কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান বিশ্বসভ্যতায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বরং হতাশার মাত্রা বেড়ে যায়। কখনও কখনও তাঁরা সুবচন উচ্চারণ করলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। আবার  কারো কারো বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবারও সাম্প্রদায়িকতার চেতনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা বর্তমান বিশ্ব বাতাবরণে অশান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। আলো ঝলমলে বর্তমান সভ্যতায় এটা বড় ধরনের এক অন্ধকার।
এপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, মার্কিন রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচার অভিযানকালে এক সংবাদ সংস্থায় এসে বলেছেন, নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সব মসজিদ বন্ধ করে দেবেন তিনি। এই বক্তব্যের ফলে নতুন করে এক বিতর্কের সৃষ্টি হলো। বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, নিজের ভোটব্যাংক বাড়াতে যা ইচ্ছে তাই বলছেন ডোনাল্ড। একই সঙ্গে তার এ বক্তব্য আমেরিকার পাশাপাশি বিশ্বের মুসলমানদের আঘাত করেছে। উল্লেখ্য যে, কেবল মসজিদ বন্ধ করাই নয়, গত বৃহস্পতিবার ডোনাল্ড তার নির্বাচনী প্রচারের সময় আরো বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মুসলমানদের আক্রমণ করেন। ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিষয়ে তিনি বলেন, আমেরিকার মুসলিমরা আইএস-এর প্রধান সমর্থক। তাদের আটকালেই আইএসকে আটকানো যাবে। ডোনাল্ড আরো বলেন, কোনো মুসলিম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে না।
আমেরিকার মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর বক্তব্য যদি এমন হয়, তাহলে বিশ্বশান্তির ব্যাপারে মানুষ আশাবাদী হবে কেমন করে? তিনি তো শুধু মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার কথাই বলেননি, তিনি তো আইএস-এর সাথে মার্কিন মুসলমানদের জড়িয়ে ফেলেছেন। অথচ বিশ্বের সচেতন মানুষ এখন একথা জানে যে, আইএস তৈরির কারিগর কারা? পশ্চিমা বিশ্লেষকরাও এখন এ কথা বলছেন যে, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি স্থায়ীভাবে সমরাস্ত্র উৎপাদনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অতএব, সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য যুদ্ধ প্রয়োজন। এমন বাস্তবতায় একের পর এক মুসলিম দেশ গৃহযুদ্ধ ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় বিপর্যস্তের পর বিশ্বের মানুষ এখন সিরিয়ায় বিপর্যয়ের দৃশ্য লক্ষ্য করছে। বিপর্যয়ের এমন প্রেক্ষাপটে মাঝে মাঝে বর্তমান সভ্যতার নায়করা প্রহসনময় দুঃখও প্রকাশ করছেন। এএফপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়, সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর সময় যেসব ভুল হয়েছিল তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ওই যুদ্ধের পরিণামেই আইএস-এর উত্থান হয় বলে তিনি স্বীকার করেন। গত ১২ অক্টোবর সিবিএস নিউজের এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, আমরা ১৩ বছর আফগানিস্তানে লড়াই করেছি কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানকার পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত কঠিন। এমন ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, তাহলে পরাশক্তিগুলো একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে হামলা চালাচ্ছে কেন? স্বার্থ ছাড়া তো তারা সেখানে  সৈন্য ও গোলাবারুদ পাঠাচ্ছেন না। বিশ্লেষকদের মতে, তাদের স্বার্থ খুবই স্পষ্ট এবং সেই স্বার্থ হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। ন্যায়নীতি বিবর্জিত ও স্বার্থান্ধ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, এমন নেতৃত্ব দিয়ে কি বিশ্বের কাক্সিক্ষত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব? বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এক নতুন সভ্যতা ও নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায় আছে। তবে তাদের অপেক্ষার প্রহর কতদিনে শেষ হবে সেটাই দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads