মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫

‘তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হবো’


‘আমি তোমার যাত্রীদলে রইব পিছে
স্থান দিও হে আমায় তুমি সবার নিচে,
সবার শেষে যা বাকি রয়, তাহাই লব,
তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হবো।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদেশের অনির্বাচিত জবরদখলকারী সরকারের অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে। জনগণ, দেশ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে বর্তমান সরকার যে ভারত তোষণ নীতি কংগ্রেস সরকারের আমলে গ্রহণ করেছিল, এখন চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এখনও ভারত সরকারের পদতলে নিজেদের নৈবেদ্য হিসেবে উপস্থাপনে মরিয়া হয়ে আছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দোসররা। ফলে আমরা কেবল ভারতকে উজাড় করে সব কিছু দিয়েই যাচ্ছি, বিনিময়ে পাচ্ছিনা বা চাইছি না কিছুই। এই সরকারের এক রাষ্ট্রঘাতী উপদেষ্টা তো বলে বসেছেন যে, ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া অসভ্যতা। এমন প্রকাশ্য রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী লোকও এদেশে এবং সরকারের ভেতরে আছে। সুতরাং জনগণ, সামনে আরও দুঃসময় অপেক্ষমাণ।
ভারতকে বিনা মাসুলে সব কিছু দিয়ে দেবার এই প্রক্রিয়ায় গত ১৬ অক্টোবর চালু হয়েছে নতুন এক করিডোর- আগরতলা-ঢাকা-কোলকাতা সড়কপথ। এই পথে এখন ভারতীয় নাগরিক ও পণ্য অবাধে যাতায়াত করতে পারবে। বাস সার্ভিস শুরু করার আগে ভারতীয় ভূমি দিয়ে যাতায়াত কোলকাতা থেকে আগরতলার দূরত্ব ছিল ১,৬৭৫ কিলোমিটার। সময় লাগতো ৩৬ ঘণ্টা। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এই পথের দূরত্ব মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার। ভাড়া মাত্র ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা। এ সাশ্রয় ভারতীয়দের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায়? এই সড়ক পথে ভারতীয় যান চলাচলে সড়কগুলোর যে বাড়তি ক্ষতি হবে, তা দেবে কে? কিংবা এই পথ ব্যবহারের জন্য ভারত বাংলাদেশকে কী মাসুল দেবে, তার উল্লেখ কোথায়ও নেই।
আবার এই পথ চালু হওয়ায় আমাদের কী সুবিধা হলো সেকথা কেউ উল্লেখ করছেন না। ঢাকা-কোলকাতা, ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস আগে থেকেই ছিল। আগেও একজন ভারতীয় নাগরিক  কোলকাতা থেকে ঢাকা এসে আবার ঢাকা থেকে আগরতলা যেতে পারতেন। এখন আর তাদের বাস বদলানোর দরকার হবে না। কিন্তু একই সঙ্গে এটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল যে, বাংলাদেশের নাগরিক, যারা চিকিৎসা, পর্যটন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারত যাবেন, তাদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে তোলা হবে। সরকারের ভেতরকার কোনো ‘সভ্য’ লোক এ প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি। পাছে মোদি যদি কিছু মনে করেন? সম্প্রতি দু’ দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ ভারত ভুটান নেপালের নাগরিকরা অবাধে সড়কপথে যাতায়াত করতে পারবে অন্য কোনো দেশে। করতে পারবেন পণ্য পরিবহনও। চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সে সুবিধা ভোগ করতে শুরু করলেও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য তা অধরাই রয়ে গেছে। ভারতীয় নাগরিকরা ছুটছে এখান থেকে সেখানে। আমরা আছি যেমন ছিলাম তেমনই। দ্বিতীয় কোনো দেশে আমাদের যেতে হবে ভারতের ওপর দিয়েই। কিন্তু বাংলাদেশীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের নীতি ইতরই রয়ে গেছে। এ বিষয়টি নিষ্পত্তি না করে কেন আগরতলা-কোলকাতা ট্রানজিট দেওয়া হলো সে প্রশ্ন নাগরিকদের আছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, দেশ সরকারের বাপ-দাদার তালুক-মুলুক নয়, দেশ জনগণের সম্পত্তি। শুধু নিজেদের ক্ষমতায় থাকার লিপ্সায় দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার এই খেলা জনগণ বরদাশত করবে না।
এদিকে আবার চার-দেশীয় উপআঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য তোড়জোর শুরু করেছে ভারত। এই চার দেশ হলো বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল। দৃশ্যত মনে হতে পারে, হোক এ ব্যবস্থা। এতে এই চার দেশই উপকৃত হতে পারবে। কিন্তু এর গূঢ় অর্থ তা নয়। এটাও সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় চালাকি ও চাল। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য যে কোনো দেশের যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতে হবে ভারতীয় ভূখণ্ড। সেটা কার্যত দুঃস্বপ্নই। তার প্রমাণ পাওয়া গেল ভারতের অঘোষিত নেপাল অবরোধের মধ্য দিয়ে। নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল বাণিজ্য খুব বেশি নয়। কিন্তু ভারতীয় অঘোষিত নেপাল অবরোধে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাকও আটকে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ভুটান যেতেও যে একই পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ বাংলাদেশ অবাধে এ সড়ক ব্যবহার করতে পারবে না।
এই কানেকটিভিটি চালের মূল লক্ষ্য, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের অবাধ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ভারত ঐ সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহন তো করবেই, সেই সঙ্গে সেখানকার দীর্ঘ দিনের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্য ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অবাধে নিয়ে যাবে সৈন্য, সামরিক সাজসরঞ্জাম ও রসদপত্র। ফলে খুব সাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ পরিণত হবে ঐ স্বাধীনতাকমীদের সাভাবিক টার্গেটে। আমরা ভারতের যুদ্ধ ডেকে আনবো নিজেদের ঘরে। উপরন্তু ভারতীয় চোরাই অস্ত্র ও মাদকে ছেয়ে যাবে বাংলাদেশ। যাতে ধ্বংস হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর সৃষ্টি হবে ব্যাপক সামাজিক বিশৃঙ্খলা। এছাড়াও এই কানেকটিভিটির ফলে বাংলাদেশের যেটুকু বাণিজ্য আছে ভারতের সঙ্গে, তাও মারাত্মকভাবে হোঁচট খাবে। কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে কিছু পণ্য রফতানির সুযোগ পায়। কানেকটিভিটির নামে বাংলাদেশের দুয়ার সম্পূর্ণ খুলে দিলে সে রফতানিও বন্ধ হয়ে যাবে। আবার দেশীয় শিল্পও এতে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। কারণ এ পথে চলাচলকালে ভারতীয় শত শত টন পণ্য যে ভারত বাংলাদেশে খালাস করে যাবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সেসব পণ্য প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্যকে বাজার থেকে হঠিয়ে দেবে। কানেকটিভিটির আগে এসব বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে।
গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীতে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা ধারণা দিয়েছেন যে, উপআঞ্চলিক যে কানেকটিভিটির কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো খাতে কমপক্ষে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ কোনো লাভের আশা ছাড়াই ভারতের সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো নির্মাণ করে দিতে হবে। এধরনের আবদার উপনিবেশগুলোর ওপর সা¤্রাজ্যবাদীরাই কেবল করতে পারত। এর আগে এই অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভারত বাংলাদেশকে চড়া সুদে ঋণ দিচ্ছে। তার শর্তও অসাধারণ। তার কংক্রিট খোয়া সিমেন্ট বালি পাথর শ্রমিক যানবাহন সবই আনতে হবে ভারত থেকে। এ জন্য কোনো আন্তর্জাতিক টেন্ডারও আহ্বান করা যাবে না। ভারত যা দর দাম হাঁকবে সেটাই মূল্য। তা আন্তর্জাতিক বাজার দর থেকে দশ গুণ বিশ গুণ বা এক শ’ গুণও বেশি হতে পারে। বাংলাদেশকে বিনা প্রশ্নে তাই মেনে নিতে হবে।
কিন্তু বাস্তবের নিরিখে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের এই কানেকটিভিটির কোনো প্রয়োজনই নেই। ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেটুকু যোগাযোগ অবকাঠামো আমাদের প্রয়োজন, তা আমাদের আছে। নিজেদের প্রয়োজনে আমরা ধারাবাহিকভাকে এসব সড়ক মেরামত করে সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তা কার্যকর রাখার জন্য আমাদের যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অবাধে ভারতীয় ভারী যানবাহন চলাচলের সুযোগ দিতে চাইলে আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়বে।
এদিকে আবার বৈদেশিক ঋণের জন্য সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার দরবারে হত্যা দিয়ে পড়ে আছে। বাজেট সহায়তার মাত্র ৫০ কোটি ডলার ঋণের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে নানা তদবিরে ব্যস্ত সরকার। সরকারের পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির রেকর্ডের কারণে সে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ভারতের স্বার্থে কানেকটিভিটির জন্য যদি ঋণ পেতে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করতে হয়, তবে সরকারের অবস্থা হবে ত্রাহি মধুসূদন। এক্ষেত্রেও অসম্মানজনক ভারতীয় লুটেরা চেতনা থেকেই দিল্লি আবার এগিয়ে আসতে পারে। সেটাও হবে ডাচ উপকথার ‘ফ্লাইং ডাচম্যানে’র মতো শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দেওয়ার শামিল। ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার হয়তো তাতেও কসুর করবে না। দেশবাসীর বিপদ সেখানেই। এক্ষেত্রে বর্তমান নতজান সরকার কোনোদিন নেপাল বা মালদ্বীপের মতো বুক চিতিয়ে বলতে পারবে না, সাবধান, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবেন না।
এত যেখানে ভারত-পীরিতি, এত কিছু যেখানে ভারতকে দেওয়া, তারপরও ভারত তার আধিপত্যবাদী চিন্তা- চেতনা থেকে এক চুলও সরে আসছে না। বরং অতি সংগোপনে বাংলাদেশের সীমান্তে এখনও যেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি, সেসব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে পাকা সড়ক নির্মাণের আয়োজন করেছে যেন, ঐ ন্যাংটার দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ একবারে মুখিয়ে আছে। কিন্তু ভারতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, ভাগ্যের অণ্বেষণে তাদের নাগরিকরা বাংলাদেশে পাড়ি জমায়, বাংলাদেশীরা ভারতে যায় না। ভারতীয় নাগরিকরা বিদেশে চাকরি করে তাদের দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
 বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও সড়ক নির্মাণের  জন্য কেন্দ্রীয় ভারতের সরকার বরাদ্দ দিয়েছে চার হাজার ৪০০ শ কোটি রূপি। এই উদ্যোগ বাংলাদেশকে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার নামান্তর। ভারত যদি ধারাবাহিকভাবে এরকম শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করতেই থাকবে, তারপরও আমাদের প্রেম দিয়েই যেতে হবে-এই দাস মনোবৃত্তি  থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ভারতের নিকৃষ্টতম লেজুড় হিসেবে উচ্ছিষ্টভোগী। এরা যাত্রীদলের পেছনে থেকে কেবলই ভারতের চরণ ধূলায় ধূসরিত হতে চায়। আর তাই অধিকার ও মর্যাদা জনগণকেই আদায় করে নিতে হবে, এই মুহূর্তে যেভাবে কষ্ট সহ্য করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন নেপালের জনগণ, সেভাবেই।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads