বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫

সংবিধান সমুন্নত না থাকলে মানুষের দুঃখ বাড়ে


পৃথিবীর সব দেশেই এখনো কিছু বিবেকবান মানুষ আছেন। তাইতো প্রতারণাপূর্ণ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়ও আমরা হতাশ নই। পড়শি ভারতে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে গত কয়েকদিনে ৪১ জন লেখক-সাহিত্যিক সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার ও সম্মাননা ফেরত দিয়েছেন। এ নিয়ে ভারতজুড়ে চলছে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক। এ ব্যাপারে চুপ থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এবার মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, বিজেপি এ ধরনের ঘটনা সমর্থন করে না। বিরোধীরা এসব ঘটনাকে সামনে এনে মেরুকরণের রাজনীতি করছেন। অতীতেও এই বিতর্ক হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে এই বিতর্কের নিরসন সম্ভব।
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারজয়ী যুক্তিবাদী কন্নড় লেখক এমএম কুলবর্গি কর্ণাটকে নিজের বাড়ির কাছে সম্প্রতি খুন হন। এর আগে খুন হয়েছেন যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসার ও নরেন্দ্র দাভোলকর। সনাতন সংস্থা নামে এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এসব হত্যার পেছনে জড়িত রয়েছে বলে তদন্তকারী সংস্থার সন্দেহ। সংগঠনটির একাধিক সদস্যকে এজন্য গ্রেফতারও করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, শুধু লেখক হত্যার কারণেই নয়, দেশের সার্বিক অসহিষ্ণু ও উগ্র পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই লেককদের প্রতিবাদ। লেখক-লেখিকারা মনে করছেন- বিজেপি আসলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে, বহুত্ববাদী চরিত্র নষ্ট হয়ে দেশ হিন্দুত্ববাদী হওয়ার পথে এগুচ্ছে। তারা আরো বলেন, গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণ, গোমাংস খাওয়ার অপরাধে মুহম্মদ ইকলাখকে হত্যা, যুক্তিবাদী লেখকদের হত্যা, পাকিস্তানীদের অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান, সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপে দেওয়াÑ এগুলো আদৌ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতকে ক্রমশ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার সার্বিক ছকের অঙ্গ এসব ঘটনা।
ভারতের লেখক-লেখিকারা দেশের সার্বিক অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের এই প্রতিবাদ ভারতের সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরাতো জানি, ভারত একটি ধর্মনিরক্ষে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্রে যুক্তিবাদী লেখকরা কেন খুন হবেন, গো-মাংস খাওয়ার কারণে কেন মুসলমানদের হত্যা করা হবে? এসব ঘটনায় উপলব্ধি করা যায় যে, ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তবুদ্ধির লেখকদের জীবন নিরাপদ নয়। অথচ আমরা জানি, নাগরিকদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালিত হচ্ছে না বলেই ভারতের লেখকরা প্রতিবাদ হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা ফেরত দিয়েছেন। এটি ভারতের সরকার ও শাসনব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা জ্ঞাপন। আমরা মনে করি, ভারতের সরকার ও প্রশাসন বিষয়টি উপলব্ধি করবেন এবং সংবিধানের আলোকে দেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমরা জানি, এই অঞ্চলে ভারত একটি বড় দেশ। দেশটির আচরণ ও ঘটনাপ্রবাহ প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কর্মকা-ের প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পড়তে পারে। তাই এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে আমরা ভারতে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ চাইবো।
বর্তমান পৃথিবীতে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাও কম নয়। অবশ্য এর পেছনে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক কারিগর। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে এক নারী এসেছিলেন সহিংস ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। তার বিবেচনায় মুসলিমরা হলো খুনি আর শিরñেদকারী। কী করে যেন কী হলো, তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হয়ে গেলেন মুসলমানদের বন্ধু। মুসলমানদের সাথে তিনি কোলাকুলি করলেন, মসজিদে গিয়ে তাদের সাথে নাস্তা করলেন, সেলফি পর্যন্ত তুলে ফেললেন। ঘটনাটি যেমন নাটকীয়, তেমনি কৌতূহল উদ্দীপকও বটে।
আলোচ্য ঘটনাটি ঘটেছে মিশিগানের নূর মসজিদ এলাকায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ওই নারীর সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল আরো কয়েকজনের। কিন্তু অন্যরা তখনও আসেনি। তাই বলে তৎপর এই মহিলা তো থেমে থাকার মানুষ না। তিনি একাই দুই হাতে দু’টি প্ল্যাকার্ড নিয়ে মসজিদের সামনে অবস্থান নিলেন। এবং খুনিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকলেন। তার স্লোগান শুনে মসজিদ থেকে কয়েকজন বের হয়ে এলেন। একজন তার কাছে এসে জানতে চাইলেন, তিনি তার সাথে বিক্ষোভের বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি আছেন কিনা? প্রতিবাদকারী নারী বললেন, শয়তানদের সাথে তিনি কথা বলবেন না। এ সময় উক্ত নারী দেখলেন স্কার্ফ পরা কয়েকজন নারীও তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের একজন তাকে বললেন, আপনি এসে আমাদের সাথে নাস্তায় যোগ দিতে পারেন। প্রতিবাদকারী বললেন, এটা তো স্রেফ, আরেকটি প্রতারণা হতে পারে। কথাবার্তার এই পর্যায়ে স্কার্ফ পরা এক নারী বললেন, তিনি মেক্সিকো থেকে এসেছেন। সেখানে ড্রাগ-লর্ডরা প্রতিদিন খুন করে ধর্ষণ করে। তারা আবার ক্যাথলিক খ্রিস্টানও। আরেকজন বললেন, হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তারাও ছিল খ্রিস্টান। মসজিদের মুসল্লিরা তাকে বললেন, নাৎসিরা যেমন খ্রিস্টান নন, তেমনি আইএস সদস্যরাও মুসলিম নন। এসব হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ফসল। এ পর্যায়ে মুসলিমরা আবারও প্রতিবাদকারী নারীকে মসজিদে এসে তাদের সাথে নাস্তা করতে বললেন। ওই নারী আর অন্য সবাই একমত হলেন যে, তারা সবাই খুন ও হত্যার বিরোধি। তারা সবাই আমেরিকার স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করবে। এই পর্যায়ে প্রতিবাদকারী ওই নারী মসজিদে যান। সেখানকার সবাই তাকে স্বাগত জানান। সবার উষ্ণতায় চমৎকার এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের বিরোধিতা করতে এসে ওই মহিলা মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেলেন।
আলোচ্য ঘটনাটি যেন বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির একখণ্ড চিত্র। মুসলিম নামধারী কিছু ব্যক্তির সন্ত্রাসী তৎপরতায় শুধু অন্যরা নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহও ক্ষুব্ধ। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পথভ্রষ্ট কিছু মুসলিমের অপতৎপরতা নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালানো হলেও, ওই অপতৎপরতার পেছনে কারা রয়েছে তা খুঁজে বের করার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। ফলে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হচ্ছে না। এই সুযোগে সন্ত্রাসের পরিকল্পনাকারী গডফাদাররা নিরাপদে থেকে একের পর এক তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অথচ সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের প্রকৃত হোতাদের চিহ্নিত করার কাজে বিশ্ব সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলে প্রকৃত দোষীদের মুখোশ উন্মোচিত হতো এবং তখন মানুষ সহজেই উপলব্ধি করতো, সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের সাথে প্রকৃত মুসলিম ও ইসলামের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। যেমনটি উপলব্ধি করেছেন মিশিগানের নূর মসজিদে এসে সংক্ষুব্ধ এক মহিলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথা বিশ্ব রাজনীতি প্রকৃত সত্য উদঘাটনে আদৌ উৎসাহ দেখাবে কী?
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার মসনদে যারা বসে আছেন, তাদের নৈতিক মেরুদ- খুবই দুর্বল। ফলে সত্য উদঘাটনে কিংবা সত্য উচ্চারণে তাদের কাছ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক কিছু আশা করা যায় না। আর পরিতাপের বিষয় হলো, এরা যখন ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন তখন কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকার শপথই উচ্চারণ করে থাকেন। কিন্তু মসনদে বসার পরেই তারা শপথের বিপরীত কাজ করে চলেন। কায়েমী স্বার্থ রক্ষা এবং ভাগাভাগির রাজনীতিকে উসকে দিয়ে তারা মানুষের জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তোলেন। একের পর এক যার শিকার হয়ে চলেছে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো।
মুসলমানদের ধর্মকর্ম নিয়ে আজকাল অনেক আলোচনা হয়, সমালোচনাও হয়। তবে জেনে সমালোচনার ধরন এক রকম, না জেনে সমালোচনার ধরন আবার অন্যরকম। আর উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনার ধরন হয় সবচাইতে নিকৃষ্ট। এমন সমালোচনা উত্তাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হলেও মানুষের, সামজের কল্যাণসাধনে একেবারেই অক্ষম। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ভারতসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের জীবনযাপন বিশেষ করে হিজাব ও নিকাব নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক আলোচনা ও কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেছি। তবে সব দেশ অসহিষ্ণু ও উগ্র মানুষের অসদাচরণ থেকে মুসলমানদের রক্ষায় সঙ্গত ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়নি। ফলে তারা নিজেদেরকে উদার, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করলেও বাস্তব কারণে তা সচেতন মানুষের কাছে গ্রহণীয় বলে বিবেচিত হয়নি। এটা বর্তমান পৃথিবীর প্রহসনমূলক এক চেহারা, যা অমানবিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
বর্তমান বিশ্বের এমন বাতাবরণে কানাডার আদালতের প্রশংসা করতে হয়। কানাডার ক্ষমতাসীন কনজারবেটিভ পার্টির সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার মুসলিম মহিলাদের নিকাব পরা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আদালতে আরেক দফা হেরে গেলেন। ৫ অক্টোবর ফেডারেল কোর্ট অব আপিল যে রুলিং দিয়েছেন তার অর্থ হলো, কানাডার ধর্মানুরাগী মুসলিম মহিলারা নাগরিকত্ব শপথ নেয়ার সময় মুখ নিকাবে আবৃত রাখতে পারবেন এবং ১৯ অক্টোবর কানাডার সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। উল্লেখ্য যে, নিকাবের বিষয়টি নিয়ে কানাডার বর্তমান সরকারের সাথে লড়ে যাচ্ছিলেন জুনেরা ইসহাক নামের এক মুসলিম মহিলা। ২৯ বছর বয়সী এই মহিলা ২০০৮ সালে পাকিস্তান থেকে অভিবাসী হয়ে কানাডায় আসেন। তিনি অন্টারিওতে বসবাস শুরু করেন। ২০১১ সালে হারপার সরকার এক নির্দেশ জারি করে যে, যে সব মহিলা মুখ আংশিক কিংবা পুরা আবৃত করে চলে, নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণ করার সময় তাদের মুখকে অবশ্যই অনাবৃত করতে হবে। জুনেরা ইসহাক তার মুখকে অনাবৃত করে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এই বিধান কানাডার সংবিধানে ‘চার্টার অব রাইটস’ তাকে যে অধিকার দিয়েছে তার পরিপন্থী। তিনি তার অধিকারের পক্ষে আদালতে আর্জি পেশ করেন এবং আদালত জুনেরা ইসহাকের পক্ষে রায় দেন। আদালতের এই রায় মানুষের অধিকারকে এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখে বর্তমান বিশ্বে এক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করলো।
এই ঘটনায় উপলব্ধি করা গেল, কানাডার আদালত মানবাধিকার রক্ষায় কতটা নিষ্ঠাবান। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় দিতে আদালত মোটেও কম্পিত হননি। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন উদাহরণ লক্ষ্য করা যায় না। যেসব দেশে প্রশাসন, জাতীয় সংসদ ও আদালত সংবিধানকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে সরকারের কাছে মাথানত করে, সেইসব দেশে জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সংবিধানের আলোকে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে সরকার কিংবা রাজনীতিবিদদের মুখের কথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না, মানবাধিকার রক্ষিত হবে না, সমাজে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতাও লক্ষ্য করা যাবে না। বর্তমান সময়ে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই এমন সংকটের মধ্যে  রয়েছে। তবে কানাডার উদাহরণ থেকে শিক্ষার নিলে ওইসব দেশেও কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। বিষয়টি আমাদের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads