শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্তরায়


দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এর নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও ঘটছে বিলম্ব। হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। মামলাজটের সৃষ্টি হয় বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেও। আর আদালতে এভাবে মামলাজটের সৃষ্টি ন্যায়বিচারের পথে বাধাস্বরূপ। নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ও মামলাজটের কারণে ভোগান্তির শিকার হয় বিচারপ্রার্থীরা। জন্ম নেয় বিচারে আস্থাহীনতা। ব্যাহত হয় আইনের শাসনের উদ্দেশ্য। এভাবে বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করে মামলার এমন জট।
২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকলেও ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৮৩৯টিতে। আবার ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ২৬০টি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকলেও পরবর্তী কয়েক বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৮টিতে। এ সময়ে আট হাজার ৭৪৮টি মামলা বেড়েছে আপিল বিভাগে। সুপ্রিমকোর্টে মামলাজট বাড়ছে এভাবেই। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি। ওই বছর দায়ের হয় ৫৩ হাজার ১৫৫টি, নিষ্পত্তি হয় ২১ হাজার ৪৮৫টি। ২০১০ সালে মামলা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫টি। দায়ের হয় ৫৭ হাজার ৪৭০টি, নিষ্পত্তি হয় ৬৯ হাজার ৩০৬টি মামলা। ২০১১ সালে মামলা ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি। ওই বছর দায়ের হয় ৪৫ হাজার ৮৪টি এবং নিষ্পত্তি হয় ৬৮ হাজার ৯১২টি। ২০১২ সালে মামলা ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি। দায়ের হয় ৫৬ হাজার ৭৩২টি। নিষ্পত্তি হয় ৩৮ হাজার ৪৪৪টি। ২০১৩ সালে মামলা ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭২২টি। দায়ের হয় ৫০ হাজার ১০টি। নিষ্পত্তি হয় ২৪ হাজার ২৮৬টি।
আবার ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৫ হাজার ২৬০টি। ওই বছর দায়ের হয় চার হাজার ৪০৩টি। নিষ্পত্তি হয় ছয় হাজার ৩৫টি মামলা। ২০১০ সালে মামলা ছিল ৯ হাজার ১৪১টি। ওই বছর দায়ের হয় পাঁচ হাজার ৪৬৪টি মামলা, নিষ্পত্তি হয় এক হাজার ৫৮৩টি। ২০১১ সালে মামলা ছিল ১২ হাজার ৪৪১টি। ওই বছর দায়ের হয় ৪ হাজার ৭৪৯টি মামলা। নিষ্পত্তি হয় এক হাজার ৪৪৯টি। ২০১২ সালে মামলা ছিল ১২ হাজার ৪৪১টি। দায়ের হয় ৩ হাজার ৩৬টি। নিষ্পত্তি হয় দুই হাজার ৯২টি মামলা। ২০১৩ সালে ছিল ১৩ হাজার ৩৮৫টি। দায়ের হয় ৫ হাজার ৯৮৯টি, নিষ্পত্তি হয় ৫ হাজার ৩৬টি মামলা। এছাড়া সামগ্রিকভাবে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা তিন লাখ ৪২ হাজার ৮৩৯টি। ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৮টি। (সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪)
মামলা জট নিরসন ও দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ার পরিবর্তে তার বক্তব্য হলফনামা আকারে দাখিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। ৮ নবেম্বর ২০১৪ জুডিশিয়াল স্ট্রেনদেনিং প্রজেক্ট (জাস্ট) আয়োজিত ‘অধস্তন আদালতে মামলা ব্যবস্থাপনা কমিটি : কাজের ধরন, নীতিমালা ও সামনে এগিয়ে চলা’ শীর্ষক এক সেমিনারে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, সাক্ষী আদালতে হাজির হয়ে জবানবন্দী দিতে অনেক সময় অপচয় হয়। তাই সাক্ষীর জবানবন্দী হলফনামা আকারে আদালতে দাখিলের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। শুধু সাক্ষীর বক্তব্য হলফনামা আকারে নয় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় বেঁধে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের সময় এসেছে। মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসব দেশে হলফনামা আকারে আদালতে জবানবন্দী দাখিল করা হচ্ছে। শুধুমাত্র জেরার সময় সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক ও ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস বক্তব্য রাখেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বিরাট মামলার জট সামলাতে হচ্ছে। এটা ন্যায়বিচার পেতে বাধার সৃষ্টি করছে। মামলার জট বৃদ্ধির পেছনে সমন্বয়হীনতা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, সার্বক্ষণিক তদারকি ও সময় ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। আদালতের বিচারক ও আদালত কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজের মূল্যায়নেরও অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, দেওয়ানী মামলার জট কমাতে ‘মধ্যস্থতা’ একটি জরুরি নিয়ামক হতে পারে। এছাড়া ইলেক্ট্রনিক বিচার ব্যবস্থা (ই-জুডিশিয়ারি) গড়ে তুলতে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ৯ নবেম্বর ২০১৪)
হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে ঢাকার চারটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বহুল আলোচিত ৩৪টি হত্যা মামলার বিচার কাজ প্রায় ১০ বছর যাবত বন্ধ রয়েছে। আসামীপক্ষের করা রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কাজের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। কিন্তু এসব স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে সরকারপক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অধিকাংশ মামলাতে বিচার শুরুর ব্যাপারে বিচারিক আদালতের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন আসামীপক্ষ। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট দ্বৈত বেঞ্চগুলো স্থগিতাদেশ দেন। এছাড়া ওইসব মামলায় বিচারিক আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা করেছেন আসামীরা। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ১৪টি হত্যা মামলা, দুই নম্বর ট্রাইব্যুনালে ১৩টি, তিন নম্বর ট্রাইব্যুনালে ৫টি এবং চতুর্থ ট্রাইব্যুনালে ২টি হত্যা মামলার বিচার কাজ প্রায় দশ বছর যাবত বন্ধ রয়েছে।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২-এর ১০ এর ধারার ভাষ্যমতে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের তারিখ থেকে ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আসামীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া যে কোনো প্রকারের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করতে পারেন সরকারপক্ষ। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেন সরকারের আইন কর্মকর্তারা।
২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট রাষ্ট্র বনাম হেলেনা পাশা (ড্রাগ কেইস নং ৪/১৯৯৩) মামলাটি নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান সংক্রান্ত হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের ব্যাপারে আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক রুল ও স্থগিতাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি অহেতুক রুল জারি করাকে দৃঢ়ভাবে নিরুৎসাহিত করতে পারেন এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্থগিতাদেশ সংবলিত রুল দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘রুল জারি করা হলেও সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হওয়ার বিধান করা যেতে পারে। রুল জারি করার অর্থ একটি নতুন মামলা সৃষ্টি। তাই নতুন মামলা সৃষ্টির পরিবর্তে বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানে বিভিন্ন বেঞ্চ গঠন ও পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।’ (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর ১২ জুলাই ২০১৫)
দেশের সর্বোচ্চ আদালতে অনেক মামলার রায়ের কপি বিলম্বে প্রকাশ হচ্ছে। ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ শেষে করতে দেরি হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে মাস পেরিয়ে বছর শেষ হচ্ছে। এরপরও রায়ের কপি প্রকাশ হচ্ছে না। এতে বিচারপ্রার্থীরা সময়মতো বিচারের ফল ভোগ করতে পারছেন না। সর্বোচ্চ কতদিনের মধ্যে রায়ের কপি প্রকাশ করতে হবে- হাইকোর্ট রুলস ও আপিল বিভাগের রুলসেও বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই।
এমনিতেই মামলার জটসহ নানা কারণে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন বলে অভিযোগ আছে। রায়ের কপি প্রকাশে বিলম্বের বিষয়টি যোগ হয়ে সেই ভোগান্তিকে প্রলম্বিত করছে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেয়ার পর বিচার প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মামলাজট কমিয়ে আনাসহ নানা বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। রায়ের কপি বিলম্বে প্রকাশের বিষয়টি সব বেঞ্চের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
কিন্তু অনেক বেঞ্চেই রায় পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এর সমাধান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সর্বোচ্চ কতদিনের মধ্যে বিচারপ্রার্থীরা রায়ের কপি হাতে পাবেন। এই নির্ধারিত সময়সীমার বিষয়টি হাইকোর্ট রুলস এবং আপিল বিভাগের রুলসেও অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।
বিচারের সঙ্গে রায়ের কপি পাওয়ার ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রতা চলতে থাকলে বিচার বিভাগের প্রতি বিশেষত উচ্চ আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা হারানোর আশঙ্কা থাকে। কারণ নিম্ন আদালতে কিন্তু রায়ের কপি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দীর্ঘসূত্রতা নেই। কাজেই এই সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে হবে।
১৯৮৬ সালে তৈরি করা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিচারকদের অবস্থান অনেক নিচে থাকায় তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এতে বিচারকদের পদমর্যাদাক্রম ঠিক করে নতুনভাবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করতে বলা হয়। ওই রায়ে ৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। হাইকোর্টের এ রায় বাস্তবায়ন করলে প্রশাসনের মধ্যে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে- এমন দাবি করে সরকারপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। এর প্রায় ৫ বছর পর ৭ জানুয়ারি সরকারপক্ষের আপিলটি নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। রায় ঘোষণার পর কয়েক মাস সময় পার হয়েছে। রায়টি লেখার কাজ চলছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন রায়টি লিখছেন। রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে বিচারকদের অবস্থান কোথায় হবে তা ওই রায়ের কপির ওপর নির্ভর করছে।
এদিকে ২০১৪ সালের ১৯ জুন হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার বিধান সংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট খারিজ করে রায় দেন। দশম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ সংসদ সদস্যের নির্বাচিত হওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর এই রিটটি করা হয়েছিল। রিট খারিজের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি আপিল দায়েরের জন্য সংবিধান অনুযায়ী একটি সার্টিফিকেটের আবেদন জানিয়েছিলেন রিটকারীর আইনজীবী। কিন্তু সেই সার্টিফিকেটের আবেদনও খারিজ করে দেয়া হয়। এদিকে এখনও ওই রায়ের কপি প্রকাশিত হয়নি। এরই মধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। সার্টিফিকেট না দেয়ায় হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি রিটকারীপক্ষ।
সিভিল আপিল নম্বর ১২৫/২০০৪ মামলাটির বিষয়ে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন ২০১২ সালের ১২ জুন তারিখে। এই রায়টি লেখছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। কিন্তু এখনও রায়ের কপিতে স্বাক্ষর শেষ হয়নি। এছাড়া ২০১৫ সালের জুন মাসে ২০১২ সালে দেয়া অপর একটি রায়ের কপিতে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। এদিকে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে একজন বিচারপতি ২০১৩ সালের মার্চে আপিল বিভাগে নিয়োগ পান। বর্তমানে আপিল বিভাগের ওই বিচারপতির হাইকোর্টে থাকাকালে দেয়া কয়েকটি রায় লেখার কাজ এখনও বাকি আছে। এভাবে অনেক মামলার রায়ের কপি প্রকাশ হতে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরে সময় লাগছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, ‘আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ আমরা ২৩ জুলাই ২০১৫ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছি। সেখানে এই রায়ের কপি প্রকাশে বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছি। প্রধান বিচারপতিকে আমরা বলেছি, রায়ের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা তিন-চার বছরেও রায়ের কপি পাচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, রায় কারও পক্ষে যাওয়ার পরও শুধু এর কপি প্রকাশে দেরির কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওই রায়ের কোনো ফল ভোগ করতে পারছে না। ফলে উচ্চ আদালত সম্পর্কে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেভাবে প্রধান বিচারপতিকে বলেছি, আশা করছি তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।’
ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজীম বলেছেন, ‘অনেক সময় বিচারপতিরা ইচ্ছাকৃতভাবে রায়ের কপি দিতে বিলম্ব করেন না। কাজের অনেক চাপ থাকে। পাশাপাশি দক্ষ বেঞ্চ অফিসারসহ নানা লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব থাকে। ফলে রায়ের কপি দিতে বিলম্ব হয়।’ (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ২৯ জুলাই ২০১৫)
বিচার বিভাগে দুর্নীতি-অনিয়মের একটি অন্যতম জায়গা হচ্ছে মামলা দায়ের ও তা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে বেশ তদবিরের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে মামলা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম লক্ষ্য করা যায়। তদবির না করলে মামলার সিরিয়াল পেছনে পড়ে যায়। আর এক্ষেত্রে বিও, এবিওরা প্রায়ই অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বেঞ্চ অফিসারদের দৌরাত্ম্য থেকে বিচারপ্রার্থীদের রক্ষায় ১২ জুলাই ২০১৫ কঠোর নির্দেশনা জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বেঞ্চ অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মামলার সিরিয়াল আগে-পিছে করার জন্য চলে সীমাহীন তদবির। এক্ষেত্রে চলে অবৈধ লেনদেনও। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা।
বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘবে এ বিষয়ে তেমন কোনো দৃষ্টি ছিল না সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বিচার বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে বেঞ্চ অফিসারদের প্রতি চার দফা নির্দেশনা জারি করা হয়।
কার্যতালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বেঞ্চ অফিসার (বিও) ও সহকারী বেঞ্চ অফিসারদের (এবিও) প্রতি দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে-
১. রিট মামলার মোশন ও শুনানি তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মেনশন স্লিপগুলোয় উল্লিখিত মামলাগুলো মামলার নম্বর ও সন অনুযায়ী নিম্নক্রম থেকে ঊর্ধ্বক্রমে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আগে দায়েরকৃত রিট মামলার নম্বর পরে দায়েরকৃত রিট মামলার নম্বরের পরে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করে কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যাবে না।
২. সব ধরনের ফৌজদারি মামলার মোশন তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মেনশন স্লিপগুলোয় উল্লিখিত মামলাগুলো মামলার এফিডেভিটের তারিখ ও ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী নি¤œক্রম থেকে ঊর্ধ্বক্রমে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আগে সম্পাদিত এফিডেভিটযুক্ত মামলার আইটেম নম্বর পরে সম্পাদিত এফিডেভিটযুক্ত মামলার আইটেম নম্বরের পরে নির্ধারণ করে কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যাবে না।
৩. সব ধরনের ফৌজদারি মামলার শুনানি তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মেনশন স্লিপগুলোয় উল্লিখিত মামলাগুলো মামলার নম্বর ও সন অনুযায়ী নিম্নক্রম থেকে ঊর্ধ্বক্রমে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার নম্বর পরে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার নম্বরের পরে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করে কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যাবে না।
 ৪. এ নির্দেশাবলী কঠোরভাবে অনুসরণীয়। এ নির্দেশাবলীর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার্যতালিকা প্রস্তুত করলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বেঞ্চ অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। এটা বন্ধে প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগ একটি ভালো উদ্যোগ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলা শুনানির আর্জেন্সি (জরুরি) আছে। আর্জেন্ট বিষয়গুলো আদালতকে একটু বিবেচনায় নিতে হবে।
মামলা বৃদ্ধির কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে আগে। জট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে এরপর। মামলাজট নিরসনে দক্ষ ও যোগ্য বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ডিজিটালাইজড করতে হবে বিচার প্রশাসনকে। দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে আইনজীবীদেরও। প্রত্যেক আদালতকে মোশন ও শুনানির এখতিয়ার প্রদান এবং আইনজীবীর উদাসীনতা ও অনুপস্থিতির কারণে খারিজ হওয়া মামলা আবার কার্যতালিকায় উঠানোর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলেও কমবে জট।
কোনো কোনো আইনজীবীর অহেতুক সময় নেয়াও মামলাজট বাড়ার একটি কারণ। এক্ষেত্রে মক্কেলের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে আইনজীবীকে। তাছাড়া নিয়োগ করতে হবে দক্ষ ও যোগ্য বিচারক। সদিচ্ছা থাকতে হবে বিচারকদেরও। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে সদিচ্ছা সম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। 
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads