বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৫

মূল্যস্ফীতির চাপ


আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে অথচ খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি- অভিজ্ঞতার আলোকে এমন অবস্থা কল্পনা করা যায় না। বস্তুত দলটির সরকারের বদৌলতে থলে ভরে বাজার করা অনেক আগেই গল্পের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও আজকাল বাজারে যাওয়ার কথায় রীতিমতো আঁতকে উঠছেন, আতঙ্কিত হচ্ছেন। এর কারণ সম্ভবত উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। লম্বা আশ্বাসের কথ শোনানো হলেও বাস্তবে বর্তমান সরকারের আমলে পণ্যের মূল্য সেই যে আকাশের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল তার আর নিচের দিকে নেমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। লোক দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল বলেই মন্ত্রীদের ধমকে কখনো কোনো কাজ হয়নি। বরং মন্ত্রীরা যতবার ধমক দিয়েছেন ততবার দাম বেড়ে গেছে আরো কয়েক দফায়। পরিণতিতে বাজারে গিয়ে জিহবা বেরিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের। এই পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে এখনো। মাঝখানে আবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। বিগত মাসে প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে বেশি হারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উদ্ধৃতি দিয়ে বৃহস্পতিবার  দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। পর্যালোচনায় পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালনি থেকে বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালী ও প্রসাধন সামগ্রী, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা উপকরণ এবং পরিবহনসহ সকল খাত-উপখাতেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। মানুষ বেশি চাপে পড়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায়। কারণ, সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ হারে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে। কৌতূহলোদ্দিপক বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতির এমন এক অনস্বীকার্য অবস্থার মধ্যেও ক্ষমতাসীনরা যথারীতি সত্য এড়িয়ে চলেছেন। যেমন পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, এই মূল্যস্ফীতি নাকি সাময়িক এবং এর কারণ নাকি গত মাসে উদযাপিত ঈদুল আযহা! ঈদ উপলক্ষে মানুষ নাকি সীমা ছাড়ানো ব্যয় করেছে এবং সেজন্যই ঘটেছে মূল্যস্ফীতি! উল্লেখ্য, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ২০ শতাংশÑ যদিও বিশ্বব্যাংক তার পূর্বাভাসে বলে রেখেছে, এই হার হবে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে মাত্র তিন মাসের মাথায় সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে যাওয়ায় মনে করা হচ্ছে, বছর শেষে পরিস্থিতির আরো মারাত্মক অবনতি ঘটবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মূল্যস্ফীতির বিষয়টি এরই মধ্যে জনমনে প্রবল ভীতি ও আশংকার সৃষ্টি করেছে। একথা সত্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় আহামরি কোনো পরিবর্তন এমনকি সাধারণ মানুষও আশা করেনি। তা সত্ত্বেও ধারণা করা হয়েছিল, যেহেতু ব্যাপকভাবে নিন্দিত-সমালোচিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন সেহেতু ক্ষমতাসীনরা সম্ভবত এবার অন্তত মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন। অন্যদিকে পরিস্থিতি সেই যাহা ৫২ তাহা ৫৩-ই রয়েছে। পণ্যের নাম ধরে ধরে পৃথকভাবে উল্লেখ করার পরিবর্তে এক কথায় বলা যায়, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দেখে বলার উপায় নেই যে, সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য কোনো চিন্তা করে। কারণ, কোনো পণ্যের দামই রাতারাতি বাড়েনি। বেড়ে আসছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। কিন্তু কোনো পর্যায়েই ধমক দেয়ার এবং লম্বা আশ্বাস ও গালগল্প শোনানোর বাইরে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বাস্তবসম্মত ও ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মন্ত্রীরা বড়জোর ধমকের পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং কখনো কখনো ‘কঠোর নজরদারি’ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তারা সেই সাথে সবকিছুর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করেছেন এবং প্রায় নিয়মিতভাবে ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ ওপর দোষ চাপিয়েছেন। কিন্তু বলেননি, এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের নিজেদের তথা সরকারের ‘অতি চমৎকার’ সম্পর্কের পেছনে ঠিক কোন বিষয়টি ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে ভূমিকা রেখে এসেছে। নাহলে কথিত ‘কঠোর নজরদারি’ তারা কখনো করেননি কেন? শুধু তা-ই নয়, অনেক উপলক্ষেই জানা গেছে, ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ জন্য মুনাফা লুণ্ঠনের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়েই মাঝে-মধ্যে সরকার এমনকি মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা উল্টো প্রত্যাহারও করেছে। এর সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ীরা আর সে কারণে দাম চলে গেছে মানুষের নাগালের বাইরে।
এভাবে পর্যালোচনায় অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো সফলতাই দেখাতে পারেনি সরকার। সুচিন্তিত ঔদাসীন্যের আড়ালে সরকারের প্রশ্রয় বরং ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া করে তুলেছে, যার মাশুল গুনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের তো বটেই, নাভিশ্বাস উঠছে এমনকি মধ্যবিত্তদেরও। আমরা মনে করি, টাউট ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এবং পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর যে প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে তা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এজন্যই বেতন বাড়ানোর আগে আরো কয়েকবার ভেবে দেখা দরকার ছিল। বর্তমান পর্যায়ে আমরা শুধু একটি কথাই বলতে চাইÑ কৃষকসহ গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হতে থাকলে ক্ষমতাসীনদের মুখের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না। সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা নেয়া দরকার জরুরি ভিত্তিতে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads