বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কূটনৈতিক পাড়ায় আতঙ্ক এবং বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা


গত সোমবার দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইতালীর নাগরিক তাবেলা সিসারে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি-আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশেষ করে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ তাদের কূটনীতিক এবং নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে। চলাচল করার এবং অনুষ্ঠান ও সমাবেশে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আরোপ করেছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। বিষয়টি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জানাজানি হতে বেশি সময় লাগেনি। ফলে বাংলাদেশে কথিত জঙ্গিবাদের উত্থান ও হত্যাকাণ্ডের মতো জঙ্গিদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ড নিয়েও দেশে দেশে আলোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর পর্যন্ত এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর তো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছেই। সব মিলিয়ে বলা চলে, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশ জঙ্গিদের আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এমন অবস্থার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সঙ্গত কারণেই দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও মহলগুলো উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছেন না। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমদ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, কথিত জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে সরকার ও তার সমর্থক এক শ্রেণীর মিডিয়া বিরামহীন প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে। এভাবে এক শ্রেণীর মিডিয়ার সমর্থনে সরকারের পক্ষ থেকেই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল বাংলাদেশে না আসার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করেছেন। জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিতে, ক্ষমতাসীনরা যাতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচন দিতে এবং পদত্যাগ করে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের অস্বীকৃতির পাশাপাশি রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানে ইতালীয় নাগরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে তো বটেই, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে পড়ার কারণেও বাংলাদেশকে এক কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। বস্তুত জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর যথার্থই বলেছেন। আসলেও সবকিছুর পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার সমর্থক মিডিয়ার অনস্বীকার্য ভূমিকা। অন্য কারো প্রসঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে যদি কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকেই লক্ষ্য করা যায় তাহলেও জানা যাবে, বাংলাদেশের বর্তমান কুখ্যাতির জন্য ঠিক কোন গোষ্ঠী দায়ী। উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০১৩ সালে একই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ভাষণের কথা স্মরণ করা যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সন-তারিখের উল্লেখ করে সে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মদতে ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে নাকি জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছিল! জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা নাকি জোট সরকারের মদতেই একের পর এক বোমা হামলা চালিয়েছিল! তার সরকারই যে জঙ্গিবাদকে নির্মূল করেছে সে তথ্যটিও প্রধানমন্ত্রী গলা উঁচিয়েই জানান দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। বিভিন্ন দলের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সকল মহলও অভিন্ন সুরে বলেছিলেন, কথাগুলোর মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসলে তার নিজের দেশকেই ছোট করেছেন। কারণ, ওটা আওয়ামী লীগের সমাবেশ ছিল না। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘে বিএনপি-জামায়াত ও চারদলীয় জোট সরকারের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনো কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান নালিশ জানান না, এতটা চিৎকার করে তো বলেনই না। প্রধানমন্ত্রীর সম্ভবত খেয়ালই ছিল না যে, যাদের উদ্দেশে বলা তাদের প্রায় সবারই বাংলাদেশে দূতাবাস রয়েছে। রয়েছেন রাষ্ট্রদূতসহ অসংখ্য কূটনীতিক ও গোয়েন্দাও। তারা সকলেই বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকার সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন। কথিত জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তো সুনির্দিষ্টভাবেই জানেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত ছিল, জঙ্গি নেতাদের ঠিক কোনজন ঠিক কোন দলের নেতাদের ভগ্নিপতি সে তথ্যের সঙ্গে বিদেশীরা একথাও জানেন, চারদলীয় জোট সরকারই শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইদের গ্রেফতার করেছিল। কথিত জঙ্গিবাদকে নির্মূল করার কার্যকর অভিযানও জোট সরকারের সময়ই শুরু হয়েছিল। সুতরাং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে ফায়দা হাসিল করার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
বলা দরকার, সর্বাত্মক প্রচারণা চালিয়েও সরকার যে কোনো ফায়দাই হাসিল করতে পারেনি সে-কথাটা এতদিনে বোঝা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, জঙ্গি জঙ্গি বলে শোরগোল তুলতে গিয়ে বাস্তবে সরকার নিজেই এখন নিজের ফাঁদে আটকে পড়েছে। এমন অবস্থা কৌতূহলোদ্দীপক সন্দেহ নেই কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু জাতীয় স্বার্থ জড়িত রয়েছে সেহেতু আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। আমরা একই সঙ্গে মনে করি, ক্ষমতায় টিকে থাকার সংকীর্ণ স্বার্থে রাষ্ট্র ও জাতি বিরোধী মিথ্যা ও ধ্বংসাত্মক প্রচারণা চালানোর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা এবং আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads