সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ প্রত্যাহার প্রসঙ্গ


গত কয়েকদিন ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্রছাত্রীদের মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বিরোধী আন্দোলনে রাজধানীতে বিরাট অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের মিছিল স্লোগান ও বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধের ফলে সারা মহানগরীর রাস্তাঘাট প্রায় যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। গণপরিবহন ছিল না বললেই চলে। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজির সংখ্যাও স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় এক-চতুর্থাংশে নেমে আসেও বলে মনে হয়। এই আন্দোলনকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আতঙ্ক যেমন কাজ করে তেমনি কেউ কেউ মনে করেছেন যে, এর ফলে প্রতিনিধিত্বহীন বর্তমান গণবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলনের একটি প্লাটফরমও সৃষ্টি হচ্ছে। অতি উৎসাহীদের অনেকে বলছেন যে লোহা লাল হয়েছে এখন বাড়ি দেয়ার উপযুক্ত সময়। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হচ্ছে একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী তথা আমাদের ছেলেমেয়েরা মাঠে নেমেছে। সরকারের উচিত অবিলম্বে সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করে তাদের ক্লাস রুমে ফিরিয়ে নেয়া। সরকার অবশেষে গতকাল শিক্ষার উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে।
সম্প্রতি সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজসমূহের টিউশন ফি-এর উপর সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। একটি জাতীয় দৈনিক হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হতো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে যারা পড়েন তাদের সকলেই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া ধনীর দুলাল নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের ব্যর্থতা ও অব্যাহত সেশন জটের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা আর্থিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে বাধ্য হন। এই অবস্থায় ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাবদ নতুন দায় তাদের অবস্থাকে আরো সঙ্কটাপন্ন করে তুলবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শিক্ষাবিদদের অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে শিক্ষা আদৌ কোনোও পণ্য নয়; ভোগ্য বা শিল্পপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার পর তার মানের যে অবস্থান্তরপ্রাপ্তির ঘটনা ঘটে তার অনেকেই মূল্য সংযোজন কর প্রযোজ্য হয়। শিক্ষা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার, পণ্য নয়। শিক্ষার Transition বা অবস্থান্তরপ্রাপ্তিও হয় না। এই অর্থে শিক্ষার উপর (যার সাথে নতুন কোনোও মূল্য সংযোজিত হয়নি) ভ্যাট আরোপ ছিল অযৌক্তিক এবং একটি জুলুম। এখানে টাকার অংকের চাইতে নীতির অংকটা বড়। যে ভ্যাট পণ্য ক্রেতার উপর চাপানো হয়, তা শিক্ষার উপর চাপানো ঠিক নয়। শিক্ষা পণ্য কোনোভাবেই নয়। এর অবসান ঘটায় শিক্ষার মান রক্ষা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি অদ্ভুত তথ্য দিয়েছিলেন। তার এই তথ্য অর্থনীতির কোনোও থিওরি প্রসূত নয়। তিনি বলেছিলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পকেট খরচ বাবদ দৈনিক এক হাজার টাকা তথা মাসিক ৩০ হাজার টাকা খরচ করে। তিনি তা থেকে মাত্র শতকরা সাড়ে সাত টাকা চেয়েছেন। অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের যুক্তি ও জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে আমি কোনোও মন্তব্য করতে চাই না। তিনি একজন প্রবীণ, জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তবে তিনি যে কাজটি করেছেন তা ভালো হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস। আমাদের দেশে একটি জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা হয়।
জাতীয় সংসদ প্রতি বছর জুন মাসে তা অনুমোদন করে এবং জুলাই থেকে স্বাভাবিক নিয়মে তা কার্যকর করা হয়। ভ্যাট-ট্যাক্স ঐ সময়েই নির্ধারিত হয়। এ বছর জুন মাসে অনুমোদিত বাজেটে শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপের কোনো প্রস্তাব ছিল না। তা হলে বাজেট অনুমোদনের তিন মাস পর SRO’র মাধ্যমে শিক্ষার উপর কর আরোপের এই নতুন সিদ্ধান্তটি সরকার কেন নিতে গেলেন? কিছুদিন আগে সরকার সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোনো কোনো অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এর ফলে সরকারের ২৪,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের আভাস দিয়েছেন। এই অর্থ কোথা থেকে আসবে? সম্ভবত সরকার এই অর্থ যোগানের জন্যই বিভিন্ন খাতে করারোপের নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের জাতীয় স্কেল ঘোষণার পর এবং তা বাস্তবায়নের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এরপর কি হবে তা গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। বর্ধিত মুদ্রা সরবরাহ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে এবং এতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সরকার এই বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করেন বলে মনে হয়নি। সম্ভবত তাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল সরকারি কর্মচারীদের সন্তুষ্ট রাখার মাধ্যমে অনুগত রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করা। এটি একটি কঠিন কাজ বলে মনে হয়। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৮/২০ লাখ বাদে আর সবাইকে অসন্তুষ্ট রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকা যে সম্ভব নয় ইতিহাসই তার সাক্ষী। আরেকটি কথা না বলে পারছি না। সরকারের দায়িত্বশীল অনেক মন্ত্রী অভিযোগ করছেন যে, ছাত্রদের এই আন্দোলনের জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী। সরকারের একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। এখানে বিএনপি, জামায়াত অথবা শিবিরের ভূমিকা কোথায়? জামায়াত-শিবির অথবা বিএনপি কি শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপে সরকারকে বাধ্য করেছিল? নিজের অপকর্ম ঢাকার জন্য অন্যদের দোষ দেয়ায় কোনো কল্যাণ নেই। এতে তাদের ইমেজ আরো নষ্ট হয়। কয়েকদিন আগে পুলিশ জামায়াতের দু’জন সাবেক এমপিসহ দলটির ৪১ জন নেতা-কর্মীকে একটি অনুষ্ঠান থেকে নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করে কাউকে রিমান্ডে দিয়েছেন আবার কাউকে জেলে পাঠিয়েছেন। রাজশাহী থেকে একই ধরনের অভিযোগে ৬ জন বিএনপি নেতা-কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশবাসী একে একটি অত্যাচার বলে মনে করেন এবং সরকারি ভাষ্যকে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করেন। আমার বিশ্বাস সরকার অনেক করেছেন তাদের নিজেদের স্বার্থে আর কিছু না করাই ভাল। শোনা যাচ্ছে, বৈদেশিক চাপ হোক বা অন্য কোনো কারণে কোনো কোনো মহল অগ্রিম নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করছেন এবং তার আগে দেশকে বিরোধী দলমুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। হামলা-মামলা জেল-জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টা যে সফল হয় না তার ভুরি ভুরি নজির আমাদের সামনে আছে। মানুষ যখন ক্ষেপে তখন বৈদেশিক শক্তি পালানোর দিশা পায় না।
পাকিস্তানের দোর্দ-প্রতাপ সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফকে অনেকেই ভুলেননি। তিনি ১৯৯৯ সালে সামরিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। রাজনীতিকদের সীমাহীন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কার ও গুণগত পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার লক্ষ্যে পৌঁছবার কৌশল হিসেবে তিনি বহুল আলোচিত মাইনাস টু থিওরির প্রবর্তন করেন এবং পাকিস্তানের দুটি জনপ্রিয় দল যথাক্রমে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ ও বেনজির ভুট্টোর পিপলস পার্টির সিনিয়র নেতাদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে জেল জরিমানা দেন। তিনি বিরোধী রাজনীতিকদের জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং নওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য করেন। তাদের সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও নির্বাসনে যান।
দীর্ঘ আট বছর ধরে জনাব মোশাররফ পাকিস্তানে একচ্ছত্র রাজত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য তিনি ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বুশের সহযোগী হন। অদৃশ্য লাদেনের খোঁজে বেছে বেছে পাকিস্তানের মাদরাসাগুলোর উপর বোমা বর্ষণ করে হাজার হাজার মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষক হত্যা করেন। বিচার ব্যবস্থাকে অনুগত রাখার জন্য তিনি বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, তাদের ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে নিক্ষেপ করেন। নিজের অনুকূলে বিচারের রায় না যাবার কারণে অথবা না যাবার আশঙ্কায় তিনি প্রধান বিচারপতিসহ বেশ কয়েকজন বিচারপতিকে বরখাস্ত করেন। এর বিরুদ্ধে সারা পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে এবং একটি প্রাদেশিক রাজধানীতে প্রধান বিচারপতির সমর্থনে আয়োজিত একটি সভায় ৪৯ জন লোক নিহত হয়।
সামরিক পোশাক পরে সেনাবাহিনীর পদ ও পদবীকে ব্যবহার করে তিনি একাধিক প্রহসনের নির্বাচনে জয়ী হন, সেনা ছাউনিগুলো তার পক্ষে কাজ করে। যখন তখন তিনি জরুরি আইনের অস্ত্রকে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। দিল্লীর আশীর্বাদ পাবার জন্য তিনি তার দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে (এমনকি কাশ্মীরকে ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়ে) ভারতের সাথে শান্তিচুক্তির চেষ্টা করেন, বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। পরাশক্তিগুলোকে সন্তুষ্ট করার জন্যও তিনি একের পর এক দেশ ও মিল্লাতের স্বার্থের পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন বলে অভিযোগ ওঠে। রাজনীতিকদের  গালি দিয়ে তিনি নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলে অন্তর্ভুক্ত নেতা-নেত্রীদের সততা ও চারিত্রিক সংহতি সম্পর্কে যদিও তার দেশবাসী সন্ধিহান ছিলেন। জনাব মোশাররফের ক্ষমতা লিপ্সায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ২০০৭ সালের শেষের দিকে তা চরম আকার ধারণ করে। অবস্থা আঁচ করতে পেরে তিনি অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বেনজির ভুট্টোর সাথে একটা সমঝোতা করে তাকে দেশে ফেরার সম্মতি দেন এবং পাশাপাশি নিজের ক্ষমতার মসনদও পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে সউদি আরবে নির্বাসিত আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এবং ফিরেও আসেন। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকেই আরেকটি বিমানে তাকে জনাব মোশাররফ ফেরত পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর বেনজির দেশে ফেরেন। পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠে। নওয়াজও ফিরে আসেন। বেনজির সমঝোতা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন এবং নির্বাচনের আগেই তাকে দুনিয়া থেকে সরে যেতে হয়। তার হত্যার সাথে মোশাররফ জড়িত ছিলেন কি-না একমাত্র আল্লাহতায়ালাই তা জানেন। কিন্তু এত কিছু করেও তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন এবং তাকে বেইজ্জত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। আমাদের দেশেও কেউ যদি এই চেষ্টা করেন তার পরিণতিও ভিন্ন হবার কথা নয়। আসলে রাজনীতি একটি কঠিন ব্যাপার। আবার রাজনৈতিক নেতাদের কী কী গুণ থাকা দরকার এ নিয়ে সম্ভবত ঐক্যে পৌঁছা আরো কঠিন ব্যাপার। কেননা এক্ষেত্রে মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। মহামানবদের জীবনের সফল সবল দিকগুলোই রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকে কামনা করেন। অনেকের দৃষ্টিতে রাজনীতিকদের কাজকর্ম কতটুকু জনপ্রিয় হবে, তার চেয়ে কতটুকু স্বীকৃতি পাবে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নেতৃত্বই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।
নেতার সংজ্ঞা খুবই ছোট, যেমন- One who leads is called a leader. এখানে Leading এর কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং সবাই তা পারেন না। জবরদস্তি কারোর ঘাড়ে নিজের নেতৃত্ব চাপিয়েও দেয়া যায় না। নেতার কাজ নিয়ে অনেক গল্প আছে। নেতৃত্বকে means of direction বলা হয়। ল্যাটিন আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্পটি আমি আগে একাধিকবার বলেছি। একটি বিশাল দ্বীপকে নিয়ে গল্পটি তৈরি। এই দ্বীপে প্রায় ৫ লাখ লোকের বাস। দ্বীপটির নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রকট। এশবার আকাশ থেকে এতে একজন ফেরেশতা নেমে আসলেন। দ্বীপবাসীরা দেখলো উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছেন। তারা তাকে অনুসরণ করলো এবং একটি কলেজের মাঠে এসে তা থামলো। আলোকবর্তিকাটি একজন ফেরশতার রূপ নিলো। চারদিকে হাজার হাজার মানুষ জমা হয়ে গেল এবং তার সাথে কথা বলতে চাইলো। ফেরেশতা বললেন, তোমাদের এতো লোকের সাথে কথা বলাতো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং তোমরা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দাও, আমি তাদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবো এবং তাদের সাথে কথা বলবো। যেমন বলা, তেমন করা। তারা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করলেন। একজন বৃদ্ধ শতায়ু, আরেকজন অত্যাধুনিক ফিটফাট কেতাদুরস্ত এক ব্যক্তি এবং তৃতীয় জন সাদাসিধে এক লোক দেখতে বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে হয়। ফেরেশতা তাদের আলাদা আলাদাভাবে তার খাস কামরায় ডাকলেন। প্রথমে আসলো বৃদ্ধ ব্যক্তি। ফেরেশতা তার সাথে কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলেন, এখন থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর তোমাদের এই দ্বীপে জলোচ্ছ্বাস হবে এবং বাড়িঘর, সহায়-সম্পদসহ তোমাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তুমি এখন কি করবে? বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, ‘আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, এখন বয়স হয়েছে, আর বেশি দিন বাঁচবো না। যে ৪৮ ঘণ্টা সময় পাবো তাকে আমি কাজে লাগাবো এবং খোদার দরবারে কান্নাকাটি করে মাফ চেয়ে নেবো যাতে পরকালে বেহেশতে যেতে পারি। ফেরেশতা তাকে বিদায় দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ডাকলেন এবং একই প্রশ্ন করলেন। তিনি উত্তর দিলেন এবং বললেন, জীবনকে আমি অনেক ভোগ করেছি। যা কিছু অবশিষ্ট আছে খাওয়া-দাওয়া, ফুর্তি করা, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমি তা সেরে নেবো। মৃত্যুর পরে কি পাবো না পাবো তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। ফেরেশতা তাকেও বিদায় করে তৃতীয় ব্যক্তিকে ডেকে একই প্রশ্ন করলেন, ৪৮ ঘণ্টা পর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তোমরা সবাই মরে যাবে, এখন তোমার করণীয় কী? দ্বীপবাসীর এই প্রতিনিধি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। ৪৮ ঘণ্টাকে মিনিট এবং মিনিটকে সেকেন্ডে রূপান্তর করে বললেন যে, আমার হাতে এখন ১,৭২,৮০০ সেকেন্ড সময় আছে। আমি আমার দ্বীপের পাঁচ লাখ লোককে সংগঠিত করে তাদের দশ লাখ হাতকে কাজে লাগাবো এবং জলোচ্ছ্বাস আসার আগেই দ্বীপের চারদিকে এমন বাঁধ নির্মাণ করবো যাতে জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে এবং একটি লোকেরও জানমালের কোনও ক্ষতি না হয়। ফেরেশতা তার কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার সাথে আছি।
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মধ্যে রাজনীতিকের সাফল্য। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিরোধী যে জলোচ্ছ্বাস তার মোকাবিলার জন্য বাঁধ তৈরিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা ও কাজে লাগানোও হচ্ছে রাজনীতিকের কাজ। এই দায়িত্ব পালনে কেউ বেশি সফল হন কেউ কম। তবে আমি নিশ্চিত যে কোনও ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কোনও কর্মচারীর এটা কাজ নয়, এটা তার দেশপ্রেমও নয়। তার দেশপ্রেম তার জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
লর্ড মন্টোগোমারীর নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। একজন সার্থক রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্টারিয়ান এবং লেখক হিসেবে তার সুনাম ছিলো এবং আছে। তিনি তার Path to Leadership পুস্তকে একজন রাজনৈতিক নেতাকে এভাবে বর্ণনা করেন-
One who can be looked upto, whose personal judgement is trusted, who can inspire and warm the hearts of those he leads gaining their trust and confidence and explaining what is needed in language which can be understood.
জনাব মন্টোগোমারীর এই সংজ্ঞাটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। আধুনিক বিশ্বে ব্যবসায়িক জগতেও টীমকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞায় বর্ণিত নেতার বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা এবং জামায়াত নেতারা লাখ লাখ মানুষের অন্তর জয় করেছেন। তাদের বিচার-বিবেচনা, যোগ্যতার ওপর তাদের আস্থা আছে। তারা লাখ লাখ লোককে উজ্জীবিত করতে এবং অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য লাখ লাখ লোক প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়। এটা অবৈধ কোনও সুবিধা পাবার কারণে নয় বরং আত্মিক ও আদর্শিক সম্পর্কের কারণে। আমি, আপনি বা বেতনভুক্ত কোনও আমলার পক্ষে কি এটা সম্ভব? আমি মনে করি না। আমরা মারতে পারি কিন্তু আমাদের জন্য মরতে কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি না।
ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী নিজের পেশাব খেতেন। প্রতিদিন সকাল বেলা খালি পেটে এক গ্লাস করে। আমরাও তাই খাবো? খাওয়া উচিত? যদি না হয় তাহলে অন্যকে অনুকরণ না করে সংযমী হলে কি ভালো হয় না?
আমি রাজনীতিকদের দুর্দিনের কথা বলছিলাম। এই দুর্দিনের জন্যই কি বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল? অনেকেই শাসকদলের চরিত্র উদ্ধৃত করে বলছেন, সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমি জানি না কোনটি ঠিক। তবে যে ঘটনাকে উপলক্ষ করে ওয়ান ইলেভেন এসেছে, রাস্তায় পিটিয়ে মানুষ হত্যা, তার বিচার প্রক্রিয়া কিন্তু থমকে আছে। যদি বিচার হতো, যেমন দ্রুত বিচারে অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে তাহলে মানুষের ধারণা অন্য রকম হতে পারতো। আমি ওদিকে যাচ্ছি না তবে রাজনীতিকদের এই দুর্দিন যে বেশি দিন থাকবে না সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। তবে সংঘাতের পরিবর্তে সমঝোতা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে এডভেঞ্চারিস্ট হয়ে কোনও লাভ নেই।
একটি ফারসী রুবাইয়াত দিয়েই আমি আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই, রুবাইয়াতটি হচ্ছে, “ইউসুম গুস গশতে বা’জ আরত কিনান
গম ম-খুর
কুল বয়ে ইহজান সওদ রোজী গুলিস্তা রোজী
গম ম-খুর
কবি নজরুল এর তরজমা করেছেন এভাবে
“দুঃখ করো না, হারানো ইউসুফ
কেনানে আবার আসিবে ফিরে
দলিত পুষ্প এ মরু পুনঃ
হয়ে গুলিস্তা হাসিবে ধীরে”
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads