মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

খালেদা জিয়ার আশংকা


বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাকেও মেরে ফেলা হবে কি না তা তিনি বলতে পারেন না। তিনি নিজে এবং বিরোধী দলের অন্য নেতা-কর্মীরা কতদিন বেঁচে থাকতে পারবেন সে ব্যাপারেও সংশয় রয়েছে তার। দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হচ্ছে। সে কারণে সরকারের কাছে গুম-খুনের তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়ে লাভ নেই বলে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি চান দেশে ঘটে যাওয়া সকল গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করে তদন্ত করা হোক। কথাগুলো খালেদা জিয়া বলেছেন গত ৩০ আগস্ট। সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক গুম দিবস। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দুটি সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের সকল দেশে দিনটি ‘এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ডে’ বা গুম দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশে যাদের জোর করে সরিয়ে ফেলা বা গুম করা হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনাই দিবসটির লক্ষ্য। অন্যদিকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যটি হলো, বাংলাদেশের জনগণকে সরকার এবার আন্তর্জাতিক গুম দিবস সম্পর্কে জানতে পর্যন্ত দেয়নি। এজন্যই বেগম জিয়া জাতিসংঘের অধীনে তদন্ত দাবি করেছেন। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেদিনের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে গুম হয়ে যাওয়াদের স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
আমরা মনে করি, বেগম খালেদা জিয়ার অভিযোগ, আশংকা ও দাবিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। গণতান্ত্রিক সব রাষ্ট্রেই গুম, গুপ্তহত্যা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ডকে মানবতাবিরোধী ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে দেখা হয়। গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গুম করা হবে এবং পরে এখানে-সেখানে তাদের লাশ পাওয়া যাবে এমনটা কল্পনা করা যায় না। বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে। সঙ্গে তার ড্রাইভারও ছিল। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও এখনো ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ মেলেনি। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন। আমিনুল ইসলামের লাশ টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে পাওয়া গিয়েছিল। আরো অনেকের লাশও দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী বা খালের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের মতো বেশিরভাগেরই এখনো কোনো হদিস নেই। মূলত এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়েইন সম্প্রতি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলে গেছেন, বাংলাদেশে চলমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এবং শাস্তি দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তিনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ধরনের সব অপরাধের তদন্ত ও বিচার করার দায়িত্ব যে সরকারের সে কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী।
আমরা মনে করি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকারের উচিত অবিলম্বে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং অন্তরালে সক্রিয় দোষীদের কঠোর শাস্তি দেয়া। সরকারকে বুঝতে হবে, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অংশীদার। ঋণ ও সাহায্যেরও বিরাট একটি অংশ আসে এই দেশগুলো থেকে। সুতরাং তাদের কথা নিয়ে হেলাফেলা করা যায় না। এসব দেশ সত্যি সহযোগিতা বন্ধ করলে দেশকে সর্বব্যাপী বিপদে পড়তে হবে। তাছাড়া দেশগুলো কোনো প্রসঙ্গেই সামান্য বাড়িয়ে বলেনি। দুর্নীতির পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খেসারত দিতে হয়েছে সমগ্র জাতিকে। যেমন প্রধানত শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে গুম ও হত্যা করার কারণে গার্মেন্ট শিল্পের নানা দিক দিয়ে ক্ষতি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ সিদ্ধান্তেও বাংলাদেশকে জিএসপির সুবিধা দেয়নি। অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে জনশক্তি রফতানিও কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন চাকরি হারাচ্ছে হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনেও রয়েছে একই কারণ। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বেগম খালেদা জিয়ার ভীতি ও আশংকাকে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ মনে করি। আমরাও জাতিসংঘের অধীনে সকল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের দাবি জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads