সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভারতে সালাহউদ্দিনের বিচার অমানবিক ও অবৈধ


ঢাকার  উত্তরা থেকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী পরিচয়ে সাদা পোশাকধারীদের হাতে অপহৃত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ অপহৃত হবার দুঃখজনক ব্যাপারটি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন ধরনের তাচ্ছিল্য ও টিটকারীমূলক মন্তব্য করলেও তাকে লুকিয়ে রাখার পেছনে যার হাত ছিল তার মুখোশ একদিন উন্মোচিত হবেই। সরকার টিটকারীর মধ্যে তার দায়িত্ব সীমিত রেখে তাকে উদ্ধার করার সামান্যতম আগ্রহ কিংবা সহানুভূতিমূলক তৎপরতাও চালায়নি। তিনি কি বেঁচে আছেন, না কি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে সে ব্যাপারে সরকারি মহলে সামান্যতম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়নি। এ ব্যাপারে মনে হয়েছিল সরকারের যেন কোনো দায়-দায়িত্বই নেই। সরকারের এই আচরণ জনমনে নানাবিধ সন্দেহ ও প্রশ্নের অবতারণা করে, যা কোন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের জন্য মোটেই কাম্য হতে পারে না।
এমন পটভূমিতে অপহৃত হবার ৬২ দিন পর বিস্ময়কর ও রহস্যজনকভাবে সালাহউদ্দিনকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত-সংলগ্ন মেঘালয়ের রাজধানী শিলং-এ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। সালাহউদ্দিনের ভাষ্যমতে তিনি জানতেন না কারা তার চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে  সাত-আট ঘণ্টা যাবত গাড়ি চালিয়ে গাড়ির পর গাড়ি বদল করে তাকে  অজানা-অচেনা স্থানে ফেলে রেখেছিল। স্থানীয় জনগণ পুলিশে খবর দিলে বিশ্ববাসী জানতে পারেন বাংলাদেশের এই সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেঁচে আছেন।
৬২ দিন যাবত নির্যাতনের শিকার উদ্ভ্রান্ত অসুস্থ সালাহউদ্দিন বেঁচে থাকলেও তার সামনে যে আরো মারাত্মক দুর্দিন অপেক্ষা করছে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে ছিল। নির্যাতিতের প্রতি মানুষের সহানুভূতি এমনিতেই জাগরিত হয়। শেখ হাসিনা সরকারের মুরুব্বী ও প্রধান খুঁটি ভারত পুরোপুরি অসুস্থ সালাহউদ্দিনের প্রতি চরম অমানবিকতা দেখিয়ে তাকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে।
৬২ দিন নিখোঁজ থেকে অপহৃত চোখবাঁধা অবস্থায় অজানা কোন অপশক্তির কারসাজির শিকার সালাহউদ্দিনকে ভারতীয় ভূখণ্ডে ফেলা যাওয়া তার ক্ষেত্রে কোনভাবেই অনুপ্রবেশের আওতায় পড়ে না। অনুপ্রবেশ হলো পরিকল্পিত এবং স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে কোন ভূখণ্ডে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া প্রবেশ করা। কিন্তু সালাহউদ্দিন স্বেচ্ছায় কিংবা পরিকল্পিতভাবে কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভারতে প্রবেশ করেন নি। তিনি জানতেনও না যে তিনি কোথায় আছেন, কোন দেশের ভূখণ্ডে আছেন। তিনি এটাও জানতেন না যে, কারা কেন তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছে। সুতরাং তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বিচার করার কোন সুযোগ নেই। কোন মানবিক আইনেই এটা অপরাধের আওতায় পড়ে না। সালাহউদ্দিন স্বেচ্ছায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে যদি ভারতে প্রবেশ করতেন তাহলে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিচার করার সুযোগ থাকতো।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো সালাহউদ্দিন যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীই হয়ে থাকেন তাহলে তিনি কিভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন? অপহরণকারীরা তাকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই তাকে পাওয়া যেত। অপহরণকারীরাই তাকে তার অজান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে ফেলে রাখে। সুতরাং তার ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ তার অজান্তে এবং অনিচ্ছায় হয়েছে। ভারতে প্রবেশের জন্য তিনি দায়ী নন। অপহরণ ও পাচারকারীদের চিহ্নিত না করে তাদেরকে পাকড়াও এবং বিচার না করে অপহরণের নির্মম শিকার সালাহউদ্দিনের বিচার কোনভাবে মানবিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।
তৃতীয়ত গাড়িতে করেই সালাহউদ্দিনকে মেঘালয়ের মতো পর্বতাকীর্ণ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কোন গাড়িই চোরাপথে মেঘালয়ে প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মেঘালয়সহ পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে স্বাধীনতাকামী  গেরিলারা সক্রিয় থাকায় গাড়ি তল্লাশি আবশ্যিক। আর বাংলাদেশ থেকে প্রবেশকারী প্রতিটি গাড়ি, এমনকি যাত্রীর তল্লাশি অনিবার্র্য।  চোখবাঁধা অবস্থায় সালাহউদ্দিনকে বহনকারী গাড়ি কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তাকে শিলং-এর রাস্তায় ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেল তা কেবল রহস্যময়ই নয়, প্রশ্নবিদ্ধও বটে। 
ভারতে কোন সুবিচার কিংবা স্বচ্ছতা থাকলে ভারত সরকার সাথে সাথে তদন্তের ব্যবস্থা করতো কিভাবে স্বদেশ থেকে অপহৃত একজন বিদেশী রাজনীতিক ভারতের মাটিতে প্রবেশ করলেন, কারা কখন কেন তাকে ভারতে নিয়ে যায়, সীমান্তের যে সড়ক এবং চৌকি দিয়ে ঐ গাড়ি ভারতে প্রবেশ করে তার নম্বর কতো, কারা কারা ঐ গাড়িতে ছিল, তাদের পাসপোর্ট নম্বর কতো ইত্যাদি তদন্ত করে প্রকৃত অনুপ্রবেশকারী তথা অপরাধীদের বের করা হতো, কিন্তু ভারত সরকার তেমন কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। উল্টা সালাহউদ্দিনকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার ঘোষণা দিয়েছে।
মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তের পুরোটাই পাহাড়ী-পার্বত্যাঞ্চল, সমতল নয় যে, গাড়ি যেকোন ধানক্ষেত্র দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং অপহরণকারীরা তাকে পাকাসড়ক বাদ দিয়ে কোন চোরাপথে মেঘালয়ে নিয়ে যায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশ হতে গাড়িযোগে কেবল মেঘালয় নয় ভারতের যেকোন রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই সীমান্ত চৌকি অতিক্রম করতে হয়েছে এবং সীমান্তে সবারই পাসপোর্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করে গাড়ি বা পদব্রজে গমনকারীদের ভারতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। বিদেশীরা কোন দেশে প্রবেশ করার আগে সেই দেশের বিমানবন্দরে যে প্রক্রিয়ায় তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় সীমান্ত চৌকিগুলোতেও একই কায়দা অনুসরণ করা হয়।
সালাহউদ্দিন বলেছেন, তার চোখ বেঁধে ৬/৭ ঘণ্টা গাড়ির পর গাড়ি বদলিয়ে শিলং-এর রাস্তায় কে বা কারা ফেলে যায়। তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশের কোন চক্র তাকে হয়তো সীমান্ত নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা অন্যকোন কর্তৃপক্ষীয় চক্রের কাছে হস্তান্তর করেছে কিংবা ভারতীয় গোয়েন্দারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে ভারতের নিয়ে গেছে। তবে ভারতীয় গোয়েন্দারা তাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেলে গাড়ি না বদলিয়ে সরাসরি ভারতে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। যেভাবেই তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় চোখবাঁধা একজন মানুষকে গাড়িতে  বসে থাকতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় পুলিশ কিংবা নিরাপত্তাকর্মীরাই নন, যেকোন সাধারণ মানুষও অতিমাত্রায় কৌতূহলী হবেন এবং গাড়ির প্রতিটি যাত্রীর ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিবেন। চোখবাঁধা লোকটা কে, কেন তার চোখ বাঁধা হয়েছে, সে কোন দেশের নাগরিক, তাকে কোথা কেন নেয়া হচ্ছে ইত্যাদি হাজারো রকমের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন। আর সাথে সাথে বিষয়টি ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে। এ নিয়ে তোলপাড় হবে। এ ধরনের একটি গাড়ি এবং গাড়ির সব যাত্রীকে সাথে সাথে আটক করা হবে।  কিন্তু তেমন কিছুই করা হয় নি। কেন করা হয়নি, তার একাধিক সহজ সম্ভাব্য এবং বাস্তব জবাব হবে: (১) এই ধরনের একটি গাড়ি যে বাংলাদেশ হতে ভারতে প্রবেশ করবে তা আগেই সীমান্ত চৌকির পাহারাদের ঊর্ধ্বতনমহল থেকে হয়তো জানিয়ে দেয়া হয়েছিল; (২) গাড়িতে এমন কেউ ছিলেন এবং তার কাছে এমন উঁচুমানের পরিচয়পত্র ছিল যে, চৌকির প্রহরীরা পরিচয়পত্র দেখামাত্র সালাম দিয়ে গাড়িকে ভারতে প্রবেশ করতে দেয়; (৩) বাংলাদেশের কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা সংস্থা সালাহউদ্দিনকে সীমান্তে নামিয়ে যথাযথ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যেখানে চৌকি প্রহরীদের কোন প্রশ্ন করার কিংবা তথ্যাদি সংগ্রহ করার প্রয়োজন ছিল না, যে কারণে অপহরণকারী কিংবা তাদের সহযোগীরা  নির্বিঘেœ সীমান্ত অতিক্রম করে সালাহউদ্দিনকে বাংলাদেশ সীমান্ত হতে প্রায় ৫০ মাইল দূরবর্তী শিলং নিয়ে ফেলে রাখতে কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি।
ধরে নিলাম সালাহউদ্দিনের অপহরণের পিছনে বাংলাদেশ কিংবা ভারত সরকার কোনভাবেই জড়িত নয়। সরকারের কেউ কেউ যেমনটি বলে বেড়িয়েছেন বিএনপিই সালাহউদ্দিনকে লুকিয়ে রেখেছে। তাদের এই কল্পিত অভিযোগকে সত্যি হিসেবে মেনে নিলেও প্রশ্ন উঠে পাসপোর্টবিহীন চোখবাঁধা একজন ভিন্দেশী কিভাবে ভারতীয় সীমান্ত চৌকিতে পাহারারত বিএসএফ’এর চোখ এড়িয়ে নির্বিঘ্নে ভারতের ৫০ মাইল ভিতরে চলে গেলেন  এবং যারা তাকে ঐ সীমান্তে নিয়ে যায়, এমনকি গাড়িসহ ভারতের ৫০ মাইল প্রবেশ করে তারাও বা কোথায় গেল? ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আমি দেখেছি কীভাবে ভারতীয়দের প্রতিটি গাড়ি ভারতীয় সেনাবাহিনী তল্লাশি করে। বাংলাদেশ হতে মেঘালয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে হলে চোরাই পথে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। এমনকি সীমান্ত চৌকি না হয়ে সাধারণ সড়ক দিয়ে প্রবেশ করলেও অবশ্যই বিএসএফ এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঐ সাধারণ সীমান্ত সড়কে থাকবেই।
একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। বাংলাদেশের হাজার হাজার চোর-ডাকাত, সামাজিক অপরাধী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি, ব্যাংক ডাকাতরা অপরাধ করেই ভারতে পালিয়ে যায়। কালা জাহাঙ্গীর, সুব্রত বাইন, বিকাশদের মতো অসংখ্য সমাজদ্রোহী-চাঁদাবাজ-খুনি-ছিনতাইকারীরা ভারতে অবস্থান করে সেদেশে বিয়ে-শাদি করে ব্যবসা করছে। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশে দুষ্কর্ম চালায়। এদের অনেকেই এখনো ভারতে আছে। প্রতিদিন অনেক  ভারতীয় এবং বাংলাদেশী বিনা পাসপোর্টে অবৈধ পন্থায় সীমান্ত অতিক্রম করে । ভারত কয়জনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করেছে? ২০০১ সনে নির্বাচনে পরাজিত হবার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী ভারতে পাড়ি জমায়। এমনকি কালিদাস বৈদ্য, সন্তু লারমাদের মতো নিরাপদ আশ্রয়দাতা হলো ভারত। ভারত তাদেরকে গ্রেফতার করে কখনোই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি।
সালাহউদ্দিনকে বিচাররের কাঠগড়ায় উঠানোর কোন নৈতিক এমনকি আইনগত ভিত্তি নেই। অপহৃত হবার পর ৬২ দিন পর অপহরণকারীরাই তাকে ভারতে রেখে আসে। এখানে সালাহউদ্দিনের অপরাধ কোথায়? অবৈধ অনুপ্রবেশের আইন কোনভাবেই সালাহউদ্দিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। ভারতের উচিত ছিল তাকে উদ্ধার করার সাথে সাথে তার ইচ্ছামাফিক তিনি যেখানে থাকতে চান কিংবা যেতে চান সেখানে থাকতে দেয়া কিংবা যেতে দেয়া। কিন্তু ভারত তা না করে তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ভারতের এই আচরণ তথা দ্বৈত ভূমিকা প্রমাণ করে ভারত বিশেষ উদ্দেশ্যে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে  অবৈধ অনুপ্রবেশের খড়গ ব্যবহার করছে। সুতরাং এ বিচার কোনভাবেই মানবিক ও  গ্রহণযোগ্য নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
এই বিচার হচ্ছে ভারতীয় আইনের অপপ্রয়োগ এবং বিচারের নামে প্রহসন। এ রকম আরো বহু ইলিয়াস আলী সালাহউদ্দিনরা ভবিষ্যতে অন্য কোন ভিন্নতর নির্মম নাটকের শিকার হবেন, নির্যাতিত হবেন, জীবন দিবেন। এমন আশংকা আর আতঙ্কের মধ্যেই আমাদেরকে সামনের দিনগুলো গুনতে হবে।
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads