রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

রাজনৈতিক ঘৃণা ও হিংসার রাজনীতি


সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তা বন্ধনকে কখনওই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের আসল রূপ; প্রধান পরিচিতি চিহ্ন। সেই পরিচয়ের বন্ধনই পরিবারে-পরিবারে এবং মানুষে-মানুষে মৈত্রী গড়েছে; মানব-জীবন-প্রবাহকে ছন্দে ও গতিতে বেঁধে রেখেছে। এর বাইরে রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয় বড় জোর মানুষের দ্বিতীয় পরিচয় হতে পারে। কিন্তু এই দ্বিতীয় পরিচয়কেই আজকাল বড় করে দেখা হচ্ছে। এরই ভিত্তিতে মানুষকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। (কম মেধার স্বপক্ষকে মাথায় আর বেশি মেধার প্রতিপক্ষকে পায়ের নিচে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।) ব্যক্তি স্রেফ কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক পার্টি করে বলেই ঘৃণিত, বঞ্চিত এবং পরিত্যাজ্য- এই আজব সূত্র সত্যিই মর্মান্তিক; অভিনব ও হিংস্রাত্মক। প্রয়োজনে কারও নীতি বা মতাদর্শকে অপছন্দ করা যেতেই পারে, অনেকেই সেটা করেও থাকেন, কেউ কেউ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করেন; কেউ কেউ সমাজতন্ত্রকে পছন্দ করেন না। তাই বলে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক সত্তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। এটাও তো ভুলে থাকা যায় না যে, পবিত্র বাইবেলই বলেছে যে, ‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর’।
অতএব ঘৃণা কোথায়, কতটুকু, কার বিরুদ্ধে করা হবে, সেটারও একটি মানদ- থাকা দরকার। অন্ধভাবে ঘৃণায় আকীর্ণ হওয়ার নাম মনুষ্যত্ব নয়। সবাইকে মনে রাখতে হয় যে, দলের কর্মী বা সমর্থকের খোলসটার ভেতরের একজন মানুষ কারও ছেলে বা মেয়ে বা পিতা বা স্বামী বা শিক্ষক বা প্রতিবেশি বা অন্য কিছু। রাজনৈতিক মোড়কে কোনও মানুষকে আগাগোড়া মুড়ে ফেলে তাকে বিবেচনা করা একদেশদর্শিতা। এমনটি করা হলে সেটা হবে মূঢ়তা ও মনুষ্যত্বের অপমান। রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে প্রতিপক্ষকে বয়কট করা হলে বা তার প্রতি ঘৃণা ছড়ালেই কি নিজেদের শক্তিশালী করা সম্ভব হবে? এতে সমাজজীবনের সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও সৌজন্য অতি নিচের তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। এমন সমাজে মুক্ত চিত্তে মানব বসবাস কি করে সম্ভব হবে?
হাল আমলে ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’- এই বিভাজন করে বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে যে ঘৃণা ও হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছে, সেটা শুভতার লক্ষ্যণ নয়। ঘৃণা থেকে হিংসা থেকে ক্রমে ক্রমে সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হতে সময় লাগে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ সমাজের বৃষবৃক্ষ উৎপাটন; রোপণ নয়। একদা ‘শ্রেণীশত্রু’ খতমের নামে অতি-উগ্র কমিউনিস্টদের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ নিধনের যে রাজনৈতিক-সামাজিক রক্তলীলা শুরু হয়েছিল বিশ্বের কোথাও কোথাও, পরে প্রমাণ হয়েছে, সেই হিংসাদর্পী আচরণ ছিল আদর্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দিক থেকে মহাভুল। এখন বিশ্বে সকলের জন্যে হিতকর গণতন্ত্র  দেশে দেশে নিজের স্থান করে নিয়েছে। গণতন্ত্রের কাঠামো ও বিধি-ব্যবস্থায় পরমত ও অন্যদলের প্রতি ঘৃণ্য অস্ত্র ও হিংস্র কার্যাবলির প্রয়োগ আরও আত্মঘাতী। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অমানবিক ও অসৌজন্যমূলক কোনও আচরণ করা হলে সেটা ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে; শক্তি ও মহত্ত্ব প্রদর্শন করে না।
‘মুখে মধু হৃদে বিষ’ বড় নেতার চারিত্রধর্মও নয়। রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আনুগত্যকে ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজন বা বিভক্ত করা আরও বিষস্পর্শী অপকর্ম। ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ ভিত্তিক বিষাক্ত-বিভেদ তৈরি করা হলে, এরই ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন ও শাস্তি বিধান করা হলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার কোথায় থাকবে? কেবলমাত্র রাজনৈতিক তুল্যমূল্যের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন করা হলে মানুষের মৌলিক সত্তা ও পরিচয় খণ্ডিত হবে; বহুমতের বিনাশ ঘটবে; মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব নিহত হবে; গণতন্ত্র, সুস্থতা ও সুশীল শাসন ভূলুণ্ঠিত হবে। এই অবস্থায় ঘৃণা ও হিংসা আরও বাড়বে এবং একদল অসৎ, দুর্নীতিবাজ বিদ্যমান পরিস্থিতি উৎতপ্ত ও উত্তেজক করে ফাঁক তালে সুবিধা লুটে নেবে।
ঘৃণা ও হিংসার আগুনকে  লেলিহান দাবানলে পরিণত করে প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখার পন্থাও আদিম, অবৈজ্ঞানিক ও অকার্যকর। হিটলারের কথা মনে করিয়ে আজকের ঘৃণা-বিস্তারী এবং হিংস্রতা-পিয়াসীদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতেই পারে। বলা বাহুল্য, এমনটি মনে করিয়ে দেয়ার সঙ্গত কারণ ঘটেছে। যাদের চোখ-কান খোলা, তারা চারপাশেই এমন অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছেন। এর ফলে সভ্যতা, মনুষ্যত্ব ও শুভতার বিনাশের কথাও আতঙ্কের সঙ্গে ভাবছেন বিবেকী মানুষজন। এমন অবস্থা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সমান্তরালে লাগসই নয়। ইতিহাসের মুখ চেপে সেই সত্যকথাটি দমিয়ে রাখা যাবে না।
প্রতিটি কাজের পিছনেই একটি দর্শন থাকে। থাকে নৈতিকতার একটি বিষয়। কিন্তু যে বা যেসব কাজ কেবল ঘৃণা ও হিংসার বশবর্তী হয়ে এবং ক্ষমতার দম্ভে করা হয়, তার পেছনে দার্শনিকতা বা নৈতিকতা নামে আসলেই কি কিছু থাকতে পারে? একদলীয় স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ইত্যাদি মানববিরোধী মতবাদেরও একটি দর্শন বা প্রণোদনা রয়েছে। কিন্তু ঘৃণা আর হিংসার দর্শন কি? এটা তো ফ্যাসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট।
ঘৃণা ও হিংসার মনস্তত্ত্ব লুকায়িত রয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকৃতিতে, হীনম্মন্যতায়, ক্ষুদ্রতায়, খলতায় এবং অসুস্থতায়। ঘৃণ্য ও হিংস্র রূপ কখনওই কোনও সুস্থতার পরিচায়ক নয়। এজন্যে প্রয়োজন শরীর-বৃত্তিয় পরিচর্যা। ব্যক্তিগত জীবনে কোনও নর বা নারীর এহেন সমস্যার সমাধান ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে সুরাহা করা যায়। কিন্তু সেই অসুস্থ নর বা নারী যদি ব্যক্তিগত আড়াল ছিঁড়ে সমাজে বের হয়ে এসে সমাজ ও রাজনীতিতে এহেন ঘৃণা উৎপাদনকারী ও হিংসা উদ্রেগকারীতে পরিণত হয়, তাহলে তার বা তাদের ব্যাপারে কি করা যায়?
সবারই জানা যে, সমাজের অধিকাংশ মানুষই শান্তিকামী এবং এরা ঘৃণা ও হিংসা চায় না। যখন ঘৃণা-হিংসার পূজারীরা সকলের মাথার উপরে বসে যায়, তখন সেটারও তো একটি প্রতিবিধান থাকা দরকার। সুনাগরিকদের মিলিত চিন্তায় প্রতিষেধক বের করাই কাম্য।
বাংলাদেশ বহু দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এতটুকু পথ অতিক্রম করতে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, রক্তপাতের বহু অধ্যায়কেও অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। এগুলো অতীতের কালো দাগ। এ রকম অনেক কালো অধ্যায়, দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্রের পর আজ যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সেটা এদেশবাসী প্রতিটি নাগরিকের সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনের গ্যারান্টি হওয়া বিধেয়। কোন ব্যক্তি, দল বা নেতা মানুষের এই মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না ঘৃণা ও হিংসার আশ্রয় নিয়ে। ব্যক্তি বা দলের হিংসা ও ঘৃণার কাছে জনমানুষ জিম্মি হতে পারে না। প্রতিপক্ষও অন্যায় আচরণের শিকার হতে পারে না। অতএব রাজনৈতিক ঘৃণা ও হিংসার চর্চাকারীদের ভাবতে হবে, পক্ষ বা প্রতিপক্ষের কেউই এ সমাজ এবং সমাজ সংহতির বাইরের কেউ নন। পারিবারিক-সামাজিক আত্মীয়তায় আবদ্ধ আমরা সকলেই। নানা মত ও পথের মাধ্যমে ভিন্নমত ও পার্থক্য সত্ত্বেও সবাইকে নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হয় এবং সবাইকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’ নামের কোনও বিভাজনের সুযোগ নেই।
মনে রাখা ভালো, তিনটি তীক্ষ্ণ আবেগ মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে- ভালোবাসার প্রত্যাশা, জ্ঞানুসন্ধান ও মানুষের প্রতি মমতা। সকলকেই ব্যক্তিমানুষ হিসাবে ভালোবাসার সন্ধান লাভের চেষ্টা করতে হয়; কারণ তা সুখ এনে দেয়। এই সুখ এত বড় যে, সুখের জন্যে জীবনের বৃহৎ অংশও জলাঞ্জলি দিতে হয়। জ্ঞানুসন্ধান করতে হয় সত্যে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনে। আর মানুষের প্রতি মমতা লালন করতে হয় মানব জাতির সদস্য রূপে নিজ দায়িত্ব পালনের স্বার্থে। ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা এমন সুশিক্ষাই দেয়। কদাচ ঘৃণা ও হিংসার তালিম দেয় না। মহামানবগণের জীবনেও বিধৃত ইতিবাচক মহত্ত্ব; নেতিবাচকতা কদাপি নয়। স্বয়ং বার্টান্ড রাসেলে মতো পন্ডিত (১৮৭২-১৯১৪) আত্মজীবনীতে বলেছেন: ‘পরিশেষে আমি খুঁজেছি, ভালোবাসার সংযুক্তিতে আমি অতীন্দ্রিয় কল্পনায় স্বর্গের রূপরেখার ছবি এঁকেছি, যা দরবেশ ব্যক্তি ও কবিরা কল্পনা করেন।’ ফলে ভালোবাসা ও মানবপ্রেমের গুরুত্ব সহজেই প্রণিধানযোগ্য। কারণ মানুষই পারে ভালোবাসা জাগাতে-নিজের জন্যে এবং অপরের জন্যও। কিন্তু মানুষ নামে পরিচয় দেবো আর ঘৃণা ও হিংসার মাধ্যমে বিকৃত ও পাশবিক উল্লাসে মদমত্ত হয়ে নৃত্য করবো-মানব পরিচয়ের সঙ্গে এর চেয়ে অসঙ্গতি আর কি হতে পারে! সম্ভবত এখন সময় এসেছে মানুষকে নিজের মানব-সত্তার দিকে তাকিয়ে দেখার এবং নিজের মানবিক সত্তাকে পবিত্রতার সঙ্গে রক্ষা করার জন্য মানবচর্মে-আবৃত্ত ঘৃণাকামী ও হিংস্রাশ্রয়ীদের চরমভাবে পরিত্যাগ করার। ঘৃণায় প্রজ¦লিত ও হিংস্রায় উন্মত্ত পরিস্থিতিতে নিজের ঐতিহাসিক মানব-অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কিছুটা তৎপর তো প্রকৃত মানুষদের হতেই হবে? নইলে সব কিছু ঘৃণার আগুনে আর হিংসার বিষবাষ্পে ছারখার হয়ে যাবে। এমন আত্মঘাতী পথ কোনও বিবেকবান মানুষেরই কাম্য হতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads