মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কুরবানী নিয়ে কেন এই তামাশা


প্রায় আটচল্লিশ বছর ধরে এই ঢাকা শহরে আমার বসবাস। এই দীর্ঘ সময় ধরে নগরীর উৎসবগুলোতে আমি উপস্থিত থেকেছি। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, পহেলা বৈশাখ, পূজা-পার্বন সবই দেখে আসছি। কিন্তু কুরবানিবিরোধী এমন আজব কা- কোনোদিন দেখিনি। ঢাকায় কুরবানী হয়ে আসছে শত শত বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ীই। কোনোদিন এর ব্যতিক্রম দেখিনি। উৎসবে আনন্দে উদ্বেলিত হতে দেখেছি শিশু কিশোর তরুণ-তরুণী ও প্রবীণ নাগরিকদের। এক একটা কুরবানী ঘিরে ছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাস। শিশু-কিশোররা গরু কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত গরু ঘিরেই কাটিয়ে দিত পুরো সময়। অনেকেই কুরবানীর পশু নিজ হাতে কাটাকুটি করতেন। তার ভেতরেও ছিল এক ধরনের আনন্দ। যারা ভাগে কুরবানী দিতেন, সে রকম গরু ঘিরে বসত বেশ কয়েকটি পরিবার। সারা শহর জুড়ে এক ধরনের আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। অঘটন একেবারে কিছু ঘটতো না এমন নয়। কখনও কখনও রাতে চুরি হয়ে যেত কুরবানীর পশু। বাকি সবটাই ছিল আনন্দ।
আবার কুরবানী নিয়ে সঙ্কট যে একবারে ছিল না, এমনও নয়। সে সমস্যা ছিল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার। ফলে কুরবানী হয়ে যাবার পর প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে ঢাকা শহর একেবারে দুর্গন্ধময় হয়ে যেত। তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হতে থাকতো। এক সময় সে সমস্যাও দূর হয়ে যেত। তখন মিউনিসিপালিটির লোকবলও কম ছিল। যানবাহনের সঙ্কট ছিল। আর তাই বর্জ্য সরাতে সময় লেগে যেত অনেক বেশি। কিন্তু গত এক যুগ ধরে সে সমস্যা আর নেই। সাদেক হোসেন খোকা ঢাকার মেয়র হবার পর পরিস্থিতি একবারে পাল্টে যায়। এক-দেড় দিনের মধ্যে সমস্ত বর্জ্য পরিষ্কার করে ঢাকাকে একেবারে সাফসুতরো করে ফেলা হয়।
মানুষের সচেতনতাও বহু গুণ বেড়েছে। আগের দিনে দেখেছি, বাড়ির আশেপাশে যে যেখানে কুরবানী দিচ্ছেন, সেখানেই বর্জ্য ফেলে রেখে মাংস নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন নাগরিকরা। ফলে তা সংগ্রহ করে পরিষ্কার করতে সময় লেগে যেত অনেক বেশি। এখন সেরকম অবস্থা কেউ আর কল্পনাও করেন না। নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এখন দেখি কুরবানী শেষে বর্জ্য তারা ফেলছেন নির্ধারিত জায়গায়। রক্ত যেটুকু পড়ছে, তা পানি ঢেলে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন নাগরিকরা নিজেরাই। তারপর ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দুর্গন্ধ দূর করে দিচ্ছেন। ফলে সিটি কর্পোরেশনের কাজও বহুলাংশে কমে গেছে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গোটা শহর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন।
এদিকে দীর্ঘকাল ধরে গরুর হাট বসেছে নির্দিষ্ট জায়গায়। গরুর হাট কোথায় বসে নাগরিকরা তা জেনে গেছেন। সিটি কর্পোরেশনের ভোট ডাকাতির মেয়ররা খবরের কাগজে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেসব স্থান পরিবর্তন করে ফেলেছেন। হুট করে তাদের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেন প্রয়োজন হলো, সেটা বোঝা ভারি দুষ্কর। অনেকেই বলাবলি করছেন যে, আসলে তাদের অবস্থা হয়েছে, ‘নেই কাজ তাই খই ভাজ’। আর এ কারণেই তারা নবনিযুক্ত তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী অভিনেত্রী তারানা হালিমের মতো কিছু একটা কাজ দেখাবার চেষ্টা করছেন। কাজ দেখাতে গিয়ে শুরুতেই ফেঁসে গেছেন তারানা। মন্ত্রী হয়েছেন। কিছু একটা কাজ তো দেখানোই চাই। এসেই বলে বসলেন যে, দেশে যে ১৩ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে, তার সবই আবার নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। নইলে বন্ধ করে দেয়া হবে সকল সিম। এ কেমন তোঘলোকি কাণ্ড! দেশের অধিকাংশ সচেতন মানুষ নিয়ম মেনে চলেন এবং তারা সিম কেনার সময় তা নিবন্ধন করেই কিনেছেন। ধারণা করি, তারানা হালিম নিজেও তাই করেছেন। তাছাড়া এক সময় দোকানে গিয়ে চাইলেই সিম কেনা যেত। সরকার এ বিষয়ে আইনের শর্ত আরোপ করায় অনেক দিন ধরে সিম কিনতে দোকানিরাও নিবন্ধন করতে বলেন। স্বীকার করি, তারপরও হাজার হাজার সিম অনিবন্ধিত আছে। সেগুলো নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করলে কেউ নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। তা না করে এক বিরাট দুর্ভোগযজ্ঞের আয়োজন করে বসলেন তারানা। আর শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে তাকে পিছু হঠতেই হলো।
ভোট ডাকাতির দুই মেয়রও একই কাণ্ড করে বসলেন। খই ভেজে কাজ দেখাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে এদের দেখলাম, রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন। আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। যাক অন্য কিছু না করতে পারুক, এরা বোধকরি ঢাকা মহানগরীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারবেন। কিন্তু কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে পুরো শহর ডুবে গিয়ে ঢাকার যে করুণ অবস্থা দাঁড়ালো, তাতে বোঝা গেল, এরা কতটা জনবিচ্ছিন্ন ও অথর্ব। এদের একজন আনিসুল হক আবার এক স্টান্টবাজি করে বললেন, ঢাকা এখন আইসিইউতে। তাই যদি হয়, তা হলে আপনারা বিনা ভোটে ফাল দিয়ে গিয়ে গদিতে বসে পড়লেন কেন? আপনাদের তো দায়িত্ব এই আইসিইউ থেকে ঢাকাকে বের করে এনে সুস্থ সবল করে তোলা। সে দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে এখন নাগরিকদের সঙ্গে মশকরা করছের এরা দুজন। মশকরা পর্যন্ত হয়তো ঠিকই ছিল। সমাজে সব সময় কিছু ফাজিল লোকও থাকে, যারা সব বিষয় নিয়ে মশকরা করতে পছন্দ করে।
কিন্তু এই দুই ভোট ডাকাতির মেয়র আমাদের ধর্মীয় উৎসব পণ্ড করার জন্য যখন বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তখন তা আর মশকরায় সীমাবদ্ধ থাকে না। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব কুরবানীকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এই দুই ভোটডাকাতির মেয়র নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রথমত কুরবানীর পশুর হাটগুলো নগরীর বরাবরের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন একেবারে প্রান্তের দিকে। নাগরিকরা তা টেরও পাননি। হ্যাঁ, সিটি কর্পোরেশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেকথা জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু কোন নাগরিক সে বিজ্ঞপ্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে গেছে। ফলে বিভ্রান্তি বেঁধেছে সেখান থেকেই। গতকাল আগারগাঁওয়ে গিয়ে দেখলাম, বহু ক্রেতা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। এদের অনেকেই গত ১৫-২০ বছর ধরে আগারগাঁও পশুর হাট থেকে কুরবানীর পশু কিনে আসছেন। ওখানে গিয়ে শুনলেন, পশুর হাট আছে বসিলায়। গাবতলিতেও আছে। কিন্তু কাদায় কাদায় সয়লাব। বসিলায় গিয়ে দেখলেন, তার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানেও গোড়ালি পর্যন্ত কাদা। ক্রেতা নেই। ঢাকা দক্ষিণের কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়র কুরবানী নিরুৎসাহিত করতে পশুর হাট বসিয়েছেন শনির আখড়ায়। সে হাট জুড়ে গতকাল পর্যন্ত হাঁটুর ওপরে পানি ছিল। তার মধ্যেই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল কুরবানীর পশুগুলোকে। ক্রেতাদের সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই বৃষ্টির সময়ে ওখানে যে হাঁটু পানি হতে পারে, সে আক্কেল দক্ষিণের আনাড়ি মেয়রের আছে বলে মনে হল না। অর্থাৎ নাগরিকরা যাতে কুরবানীর জন্য পশু কিনতে না পারে, নির্বিঘ্নে কুরবানী দিতে না পারে, ভোট ডাকাতির এই দুই মেয়র সে ব্যবস্থা মোটামুটি পোক্ত করে তুলেছেন।
দ্বিতীয়ত কুরবানী কোথায় দেয়া যাবে, কোথায় দেয়া যাবে না, সে ব্যাপারে এক এলান জারি করে দিয়েছেন এই দুই ভোট ডাকাতির মেয়র। এসব স্থান কারও কারও বাড়ি থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে। সেখানে পশু নিয়ে যেতে হবে কুরবানীদাতাকেই। যেটা বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। কোনো কারণে গরুটি দৌড় দিলে তার পক্ষে আটকানো একেবারেই অসম্ভব। সেখানে জবাই করার জন্য মওলানা পাওয়া যাবে তো! চামড়াটা ন্যায্য দামে বিক্রি করা যাবে তো? নাকি কেড়ে নেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মাস্তানরা? মাংস ঘরে নিয়ে আসা যাবে তো? নাকি তিন ভাগের এক ভাগ ‘দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টনের জন্য’ রেখে দেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ? সেখানে বাচ্চাদের কীভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে? আবার কুরবানীর জন্য এমন সব স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হবে। তাহলে কুরবানির প্রক্রিয়া শুরু করতেই কমপক্ষে সকাল ১০টা বেজে যাবে। সে এলাকায়, যতটা কুরবানী হবে, তা ধরবে না ঐ মাঠে। ফলে কুরবানী করতে হবে দুই শিফটে। অর্থাৎ অনেককেই কুরবানীর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে দুপুর দুইটার পর। মানুষের এই ভোগান্তি সৃষ্টি করার অধিকার ঐ মেয়রদের কেউ দেয়নি। এমনি হাজারো সংশয় আছে নাগরিকদের মনে। অথচ নিজ বাসাবাড়ির নিচতলায় অথবা রাস্তায় ছেলেপেলে দারোয়ান নিয়ে কুরবানী দেওয়া আমাদের রেওয়াজ। তাতে কুরবানীর আনন্দে অংশ নিতে পারেন বাড়ির সকলেই। সবাই মিলেঝিলে কেটেকুটে দ্রুত মাংস তুলে নিতে পারেন ঘরে। সিটি কর্পোরেশন সে আনন্দ মাটি করে দিতে চাইছে কোন অধিকারে?
এই ঢাকা মহানগরীতে আগে পাঁচ-দশটা পূজাম-প তৈরি হতো। এখন পাঁচ-দশ হাজার হয়। এর সকল প্রতিমাই বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয় না। ঢাকার খাল-লেকসহ বিভিন্ন জলাশয়েও বিসর্জন দেওয়া হয়। ফলে এসব জলাভূমির তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেটা পরিষ্কার করার দায়িত্বও সিটি কর্পোরেশনের। কই এ বিষয়ে তো সিটি কর্পোরেশন কোনো উচ্চবাচ্য করে না। সেটাই যৌক্তিক। যে যার ধর্ম নির্র্বিঘ্নে পালন করুক সেটাই কাম্য। তাহলে মুসলানদের ধর্মীয় উৎসব বিঘ্নিত করার এই প্রয়াস কেন। ক্ষোভটা কিন্তু অপ্রকাশিত থাকেনি। আওয়ামী ওলামা লীগের নেতৃবৃন্দ বলেছেন যে, সকল গুরুত্বপূর্ণ চাকরি-বাকরিতে হিন্দুদের কেন অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে? প্রত্রিকায় যাদের নাম নানা কারণে ছাপা হয়, তাদের প্রায় সবাই হিন্দু। ওলামা লীগ বলেছে, হিন্দু মানেই আওয়ামী বান্ধব নয়। যোগ্যতা অনুযায়ী যে যেখানে দরকার বসুক। কিন্তু তা মুসলমানদের বঞ্চিত করে নয়। বিষয়টা দুই মেয়রেরও ভাববার দরকার আছে। তাদের আচরণ যেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মনোভাবের প্রতিফলন না হয় যে, বাংলাদেশের মানুষের গরু খাওয়া তিনি বন্ধ করে দেবেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads