বুধবার, ২১ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

খাদ্যের মজুদ ও চালের মূল্য

দেশে খাদ্যের মজুদ যে কমতে কমতে অত্যন্ত আশংকাজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে- এ সম্পর্কে জানানো হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পরিসংখ্যানসহ একথাও জানানো হয়েছে যে, মজুদ একেবারে তলানিতে ঠেকেছে এবং দেশ এখন মারাত্মক খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একই সঙ্গে আশা ও ধারণা করা হয়েছিল, সরকার নিশ্চয়ই বিষয়টির প্রতি যথোচিত গুরুত্ব দেবে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত রাখা ছাড়া আর কোনো প্রচেষ্টাই লক্ষ্য করা যায়নি। সরকার এমনকি লাভজনক তথা আকর্ষণীয় মূল্য দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সম্প্রতি ওঠানো বোরো ধান সংগ্রহের জন্যও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। 
ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে লাভজনক মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা গ্রামীণ মহাজন এবং মিলারদের কাছেই সব ধান বিক্রি করেছে। সীমান্ত দিয়েও পাচার হয়ে গেছে হাজার হাজার মণ ধান। সব মিলিয়েই সরকারি গুদামের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এক মণ ধানও গুদামে আসেনি। সর্বশেষ বুধবার প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, চালের মজুদ এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশে কম পক্ষে ১০ লাখ টন খাদ্যের মজুদ থাকা জরুরি। গত বছরের ৩০ এপ্রিলও সরকারি গুদামগুলোতে চাল ও গমের মজুদ ছিল ১০ লাখ ২২ হাজার টনের বেশি। অন্যদিকে চলতি বছরের একই সময়ে মজুদের পরিমাণ কমতে কমতে প্রথমে চার লাখ ৭৭ হাজার টনে নেমে এসেছিল। সরকার তখনও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। যার ফলে মজুদ নেমে এসেছে মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টনে।
এমন অবস্থার কারণ হিসেবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং দফতর-অধিদফতরের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছেন বলেই নাকি মজুদ কমে গেছে। সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে কর্মকর্তারা নাকি খাদ্যের আপৎকালীন মজুদ থেকেও সাড়ে সাত লাখ টন চাল বের করে এনেছেন। ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা ছাড়াও ওই সব চাল ভিজিএফ এবং ওএমএস ও কাবিখা ধরনের কিছু অপরিকল্পিত কর্মসূচিতে বিলি-বন্টন করা হয়েছে। এরই পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকার দলীয় নেতা-কর্মী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী টাউট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন বা দ্বিতীয় কোনো ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাওর অঞ্চলের আকস্মিক বন্যা। ভারত থেকে নেমে আসা পানির ঢলে সুনামগঞ্জের ছয়টি উপজেলার সম্পূর্ণ ফসল পচে গেছে। দেশের অন্যসব এলাকাতেও বোরোর আবাদ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষকদের লাভজনক মূল্য দেয়া হলে তারা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী হয়ে উঠতো। এর ফলে সরকারি গুদামগুলো অনেকাংশে পূর্ণ হতে পারতো। অন্তত এখনকার মতো ভয়ংকর বিপদে পড়তে হতো না। 
কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগই সরকারের পক্ষে নেয়া হয়নি। তাছাড়া চাল আমদানির ব্যাপারেও সরকারকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। আমদানির নীতি-কৌশল নির্ধারণ করার নামে আসলে একটি ব্যাপারেই কর্তা ব্যক্তিরা বেশি ব্যস্ত থেকেছেনÑ আমদানির সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব যাতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের হাতে থাকে। এর ফলে আমদানির ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়েছে সরকার। ওদিকে পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি রেখেছে অতি মুনাফাখোর টাউট ব্যবসায়ীরা, যাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দহরম-মহরম রয়েছে। চাল সহজে আমদানি করা হচ্ছে না মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই ওই টাউট ব্যবসায়ীরা রাতারাতি চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। ফলে পবিত্র রমযান শুরু হতে না হতেই সব ধরনের চালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়ে গেছে পাঁচ-সাত থেকে ১০-১৫, এমনকি ২০-২৫ টাকা পর্যন্তও। এখনো চালের দাম শুধু বাড়ছেই। অন্যদিকে চার থেকে ছয় লাখ টন পর্যন্ত চাল আমদানি করার কথা শোনানো হলেও তার কোনো শুভ প্রভাব পড়ছে না বাজারের ওপর। একই কারণে একদিকে মজুদের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, অন্যদিকে চালের দাম কমবে বলেও আশা করা যাচ্ছে না। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, খাদ্য মজুদের বর্তমান অবস্থার জন্য সরকারের পক্ষে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, শিল্পায়নসহ বাস্তবসম্মত বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির পাশাপাশি কাবিখা, ওএমএস ও ভিজিএফ ধরনের এমন কিছু কর্মসূচি সরকার গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, যেগুলোর কারণে খাদ্যের মজুদই শুধু কমেছে। ধান-চাল সংগ্রহ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যও সরকারকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। চাল আমদানির ব্যাপারেও একই কথা সত্য। এসবই দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়েই ব্যবসায়ীরা যথেচ্ছভাবে দাম বাড়িয়ে চলেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, বিশেষজ্ঞদের অনেকে এমনকি দুর্ভিক্ষের আশংকাও প্রকাশ করেছেন। বাস্তবেও অত্যধিক এবং অনিয়ন্ত্রিত দামের কারণে  ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ এখন পেট ভরে ভাত খেতে পারছে না। দেশে চাকরির সুযোগ নেই, হু হু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। প্রতিটি জিনিসের দাম চলে গেছে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। কিন্তু সরকার এখনো ভুল ও বানোয়াট তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। 
আমরা মনে করি, সত্য এড়ানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে প্রায় নিশ্চিত দুর্ভিক্ষের কবল থেকে দেশকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নেয়া। এ লক্ষ্যে দলীয় লোকজনকে দিয়ে খাদ্য আমদানি করালে এবং মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও টাউট ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিলে চলবে না, অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে লাভজনক মূল্য দিয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান কেনার পদক্ষেপ নিতে হবে। টাউট ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে বাজারও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে চালের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। এভাবে খাদ্যের মজুদ বাড়ানোও সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আদম টিজিং বন্ধ না হলে ইভটিজিং বন্ধ হবে না

আমরা জানি প্রথম মানব হচ্ছেন হযরত আদম এবং প্রথম মানবী  হাওয়া (আ.)। এ নাম আল কুআনুল কারীম ও হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে। তবে খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেল তথা ইনজিলে হাওয়া (আ.)কে ইভ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইভ বলতে সমগ্র নারী জাতিকেই বুঝানো হচ্ছে। এর বিপরীতে আমরা আদম বলতে সমগ্র পুরুষ জাতিকে বুঝাতে পারি।
টিজ শব্দের অর্থ হল বিরক্ত করা, জ্বালাতন করা, উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি। পরিভাষায় পুরুষ কর্তৃক নারীকে অশালীন কথাবার্তা বলা, প্রেমপত্র, মোবাইল ফোনে শ্রুতিকটূ আলাপ, জনতার ভিড়ে ইচ্ছাকৃত ধাক্কাধাক্কি করা, স্পর্শ করা, চোখের ভাষায় অশুভ ইঙ্গিত করা, তাকে বশে আনার জন্য ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা ইত্যাদি যে কোন ধরনের নারীর কাছে আপত্তিকর কথা-বার্তা, অঙ্গ-ভঙ্গি, চাহনি, ইশারা-ইঙ্গিত ইভটিজিং হিসেবে গণ্য। এটি এক ধরনের যৌন আগ্রাসন।
বর্তমানের সমাজে ইভটিজিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কন্যা সন্তানের মাতা-পিতা অশান্তিতে ভোগছে। স্কুেল পাঠিয়ে ফিরে না  আসা পর্যন্ত তাদেরকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। না জানি কোন খারাপ খবর আসে কি না। তার কারণ পুরুষ শাসিত সমাজে সব দোষ নারীর। ছেলে-মেয়ের মধ্যে কিছু ঘটলে মেয়েরা অচ্ছুত হয়ে যায়। তাদেরকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আর ছেলেরা হয় তুলসি পাতায় ধোয়া। এক অসৎ চরিত্রের ছেলেও মেয়ের চরিত্র খুঁজে, কিন্তু সে তার নিজের চরিত্রের দিকে তাকায় না। কন্যাপক্ষও ছেলের চরিত্রের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান করে না। বরং সে দেখে ছেলে বড় চাকরি করে কি না, তারা বড় লোক কি না ইত্যাদি।
সভ্যতা বিবর্জিত আরব সমাজে নারীরা কতটা অসহায় ও নিরাশ্রয় ছিল তা সহজেই অনুমেয়। পুত্র সন্তান তাদের জন্য ছিল গর্বের বিষয়। পক্ষান্তরে কন্যা সন্তান ছিল তাদের জন্য লজ্জাজনক, লাঞ্ছনাকর ও অমর্যাদাকর। আল কুরআনুল কারীমের সূরাতুন নাহলের ৫৭-৫৮ নম্বর আয়াতে সে অবস্থার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন - “ওয়া ইযা বুশশিরা আহাদুহুম বিল উনসা জল্লা ওয়াজহুহু মুসওয়াদ্দান ওয়াহুয়া কাযীম ইয়াতাওয়ারা মিনাল কাওমি মিন সু-ই-মা বুশশিরা বিহি আ ইউমসিকুহু আলা হূনিন আম ইয়াদুসসুহু ফিত তুরাবি আলা মা সা-আ মা ইয়াহকুমুন” অর্থাৎ তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে এবং মনোকষ্টে তার হৃদয় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। লোকচক্ষু থেকে সে নিজেকে আড়াল করে চলতে থাকে। কারণ এ সুসংবাদ লাভের পর কি করে সে মানুষকে মুখ দেখাবে। সে তখন ভাবতে থাকে, লাঞ্ছনা বহন করে তাকে জীবিত রেখে দিবে, না মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে? তাদের ফয়সালা কতই না নিকৃষ্ট! বর্তমান সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের ন্যায় পুুুরুষের মুখ কালো হয় না বটে কিন্তু বয়প্রাপ্ত হলেই তাদেরকে বড় ভাবনায় পড়তে হয় এই চিন্তায় যে, কখন কি যেন ঘটে যায়। তারা কোন একটি ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচে। ইভটিজিং এ ভয়ে স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা রাস্তাঘাটে নিরাপত্তার অভাববোধ করে। মেয়েদের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরা আত্মহত্যাও করে।
বর্তমানে ইভটিজিং প্রকট আকার ধারণ করার কারণ হল আমাদের যুব সমাজের নৈতিক অধপতন। নারী পুরুষের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ সহজাত প্রবৃত্তি তথা এটি সৃষ্টিগত স্বভাব। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিবেক ও নৈতিকতা দিয়ে। একটি শিশু এই পৃথিবীতে চক্ষু মেলেই প্রথমত তার পরিবার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। যত বড় হয় ততই তার শিক্ষার ক্ষেত্র বড় হতে থাকে। পরিবার ছাড়িয়ে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকমন্ডলী, সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সে প্রভাবিত হয়। এ সমস্ত পরিবেশের সবকিছুই নৈতিক চরিত্র বিধ্বংসী উপাদানে ভরপুর। যে দিকেই সে তাকাবে সে দেখতে পাবে যৌন উম্মাদনা সৃষ্টিকারী উপকরণ, যা আদমকে (পুরুষকে) সদা প্ররোচিত করছে।
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন খুবই কলুষিত। চলচিত্র বলি, আর নাটকই বলি সেগুলোর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যাই হোক না কেন, নায়ক-নায়িকার প্রেম থাকতেই হবে। একজন নায়ক কি করে একজন নায়িকার মন ভুলাবে, কি করে তাকে খুশী করবে, কি করে তাকে বশে আনবে, এ জন্য যত ধরনের উন্নত অঙ্গভঙ্গি করতে হয়, প্রেম বিষয়ক যত উন্নত ভাষা ব্যবহার করতে হয়, তা সবই করে থাকে। এসব দেখে একজন যুবক আদম এগুলো রপ্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর চলচিত্র ও নাটক থেকে লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। সেও একজন মেয়ের নিকট ঐ ধরনের অভিনয়, কথা-বার্তা, অঙ্গ-ভঙ্গি শুরু করে । এটিই ইভটিজিং হিসেবে পরিগণিত হয়।
চলচিত্রে যখন নায়ক নায়িকারা একে অপরে জড়িয়ে ধরে প্রেম নিবেদন করে, যখন একে অপরে চুমু খায়, যখন একে অপরের উপর গড়া-গড়ি করে, যখন স্পর্শকাতর কয়েক ইঞ্চি জায়গায় মাত্র কয়েক টুকরা কাপড় পরিহিত অবস্থায় অশ্লীল ড্যান্স আরম্ভ করে, বিশেষত যখন চলচিত্রে ধর্ষণের চিত্র প্রদর্শিত হয় তখন একজন যুবক আদমের মনোজগতে কি ঘটে? তখন একজন যুবক আদমের মনে কিসের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে?  সংস্কৃতির অন্যতম একটি অর্থ হল উৎকর্ষ সাধন। তখন একজন যুবক আদমের কোন  জিনিসের উৎকর্ষ সাধন হয়? নিশ্চয়ই তখন একজন  যুবক আদমের যৌন উম্মাদনার উৎকর্ষ সাধিত হয়, যৌন পাগলামীর উৎকর্ষ সাধিত হয়, কামনা-বাসনার আগুন জ্বলে উঠে। এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে? অনেকে বলেন - সিনেমায় অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। এটা আমিও অস্বীকার করি না। কারণ সিনেমায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক বিষয় উপজীব্য হয়ে ফুটে উঠে। শুধুমাত্র রুচিশীর পরিবেশ বহাল থাকলে সেগুলো অবশ্যই সকলের উপকারে আসত। এমন রুচিশীল পরিবেশ বহাল থাকা উচিত ছিল যেখানে পিতা-পুত্র-কন্যা একই সাথে বসে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু যখন অশ্লীল কার্যকলাপ আরম্ভ হয় তখন পিতা-পুত্র-কন্যার মধ্যে কে বসে থাকবে আর কে লজ্জায় মুখে রুমাল দিয়ে উঠে পালাবে? টিনেজ বয়সের যুবক যুবতীরা কি সামাজিক জ্ঞান অর্জনের জন্য চলচিত্র দেখে, নাকি অশ্লীলতা দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে এবং সেগুলো দেখে নাকি নায়ক নায়িকা সাজতে চায়? সাম্প্রতিক কালের বস- ২ সিনেমায় নুসরাত ফারিয়ার ড্যান্স যে আদমের দেখার সৌভাগ্য হবে তার মনের যে কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। কি চমৎকার! গানের প্রথম শব্দও আল্লাহ এবং বস-২ সিনেমার বাংলাদেশ অংশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধানের নামের শেষাংশও আল্লাহ। ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশে এ ধরনের নাচ প্রদর্শিত হলে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে আইন করা এবং আদমদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। 
 বাল্য বিবাহ নিশ্চয়ই ভাল কাজ নয়। কিন্তু এই সমস্ত চলচিত্র ও নাটক দেখে কি যুবক-যুবতীরা বাল্য বিবাহের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে না বা ইভটিজিং এ জড়িয়ে পড়ছে না? এই সমস্ত চলচিত্র চালু থাকলে বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ নয় বরং বাল্য বিবাহ ফরজ করা দরকার এবং লেখা-পড়ার কোর্স এমনভাবে ডিজাই করা দরকার যাতে করে একজন যুবক-যুবতী ১৫/১৬ বছরে পদার্পন করেই সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতে পারে এবং চাকরি পেয়ে যায়। ফলে সে বিয়ে করে ঘরসংসার করতে পারে। তাহলে ইভটিজিং বন্ধ সম্ভব।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সচিত্র খবর দেখার জন্য টিভির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সে খবর দেখতে গিয়েও স্বস্তি নেই। বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। খবরের ফাকে ফাকে খবর নয়, মনে হয় যেন বিজ্ঞাপনের ফাকে ফাকে খবর। সে বিজ্ঞাপনগুলোও অশ্লীলতায় ভরপুর। একজন সুন্দরী রমণীকে পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এক কোম্পানীর সুরেষ খাঁটি সরিষার তেল যে খুব ভাল, তা নাকি একজন সুন্দরী নারীর উথাল-পাথাল ড্যান্স ছাড়া বুঝা যাবে না। তার তেলের ভাল গুণ বুঝাবার আর কোন ভাষা নেই বা অন্য কোন প্রক্রিয়া নেই। লাক্স সাবানের কি গুণ, তা একজন রমনী শরীর অনাবৃত করে শরীরে না মাখলে এবং মাখার শেষে একজন পুরুষ তার শরীরে শরীর ভিড়িয়ে জড়িয়ে না ধরলে এবং তার শরীর থেকে ঘ্রাণ না নিলে নাকি বুঝা যাবে না। হায়রে নারী জাতি! তারাকে আজ পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে পরিণত করা হয়েছে, তারাকে আজ ভোগের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। এটা কি নারীর অধিকার? এটা কি নারীর মর্যাদা? এ সমস্ত চিত্র দেকে কি একজন যুবক আদম ইভটিজিং এর দিকে ধাবিত হচ্ছে না?
আমরা যদি মনে করি যে, টিভিতে অশ্লীলতা প্রদর্শিত হচ্ছে কাজেই পেপার-পত্রিকা পড়ব। সেখানেও কি আমি নিরাপদ? হায়রে সভ্য সমাজ। পেপারের বিরাট একটি অংশ জুড়ে নায়ক-নায়িকাদের ছবি ও বন্দনা। নায়ক-নায়িকাদের কে কার সাথে প্রেম করছে, কিভাবে প্রেম করছে, কোথায় গিয়ে প্রেম করছে ইত্যাকার বিষয়ে খুব ছড়াছড়ি। অনেক সময় মনে হয় এগুলো কি খবরের পেপার নাকি প্রেমের পেপার তা বুঝা মুশকিল। অনলাই পত্রিকার তো অবস্থা আরো খারাপ। আমি না চাইতেই অনেক কিছু এসে হাজির। একটি প্রবন্ধ পড়ার জন্য বের করলাম। দেখা গেল প্রবন্ধটির চতুর্দিকে সুন্দরী রমনীদের অশ্লীল ছবি শোভা পাচ্ছে। এ সমস্ত পেপার পড়ে আমাদের আদমেরা (যুবক ভাইয়েরা) কি প্রেমের দিকে ধাবিত হবে না? একজন ছেলে একজন মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেতো তা ইভটিজিং।
গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই যাত্রাপালা বিস্তার লাভ করেছে। যাত্রাপালায় যে কাহিনীটি মঞ্চস্থ হবে তাতে অবশ্যই অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকতে পারে। কিন্তু যাত্রার মূল কাহিনী অভিনয়ের আগেই যুবকদেরকে পাগল করা ড্যান্স প্রদর্শিত হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানের ভ্যারাইটি সো এর নামে অশ্লীলতার এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। এগুলো কি আদমকে ইভটিজিং করতে উৎসাহিত করছে না?
উপন্যাস মানেই প্রেমের কাহিনী। সেগুলো পড়ে যুবক-যুবতীরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্রে যারা ছিল তাদের মত আচরণ করার চেষ্টা করে, ইহাই ইভটিজিং এ পরিণত হয়। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, এমনকি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকরাও অনৈতিক আচরণের জড়িয়ে পড়ছে।
দেশের বিভিন্ন পার্ক স্থাপন করা হয়েছে বিনোদনের জন্য। কিন্তু বর্তমানের কাদের বিনোদন হয় সেখানে? সেখানে যুবক-যবতীদের প্রেম নিবেদন হয় ও যৌন বিনোদন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে সময় কাটায়? তাদের নির্লজ্জতা আইয়ামে জাহিলিয়্যাতকে ছাড়িয়ে গেছে। এগুলো কি ইভটিজিংকে উৎসাহিত করে না? ফেসবুক নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম! কিন্তু বর্তমানে দেখি ফেসবুক অশ্লীলতা ও বেহায়পনার এক কৃষ্ণ সাগর। ফেসবুকের অশ্লীলতা দেখে কি একজন অবিবাহিত আদমের মাথা ঠিক থাকতে পারে? এগুলোই কি ইভটিজিং এর মূল কারণ নয়?
বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুুক্তির যুগ। তথ্য প্রযুুক্তি উন্নয়নের ফলে গোটা বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজ তথা বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। এর সুবাদে সমগ্র বিশ্বের ভাল খবর যেমন মুহূর্তের মধ্যে আমাদের কাছে এসে হাজির হচ্ছে তেমনি, খারাপ খবরও এসে হাজির হচ্ছে। যুবসমাজের নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংসকারী হিসেবে সবচেয়ে যেটি বেশি সর্বগ্রাসী তা হল পর্নোগ্রাফি। অমুসলিমরা বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব পর্নোগ্রাফিকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাভিচারের চিত্রসমূহ সহলভ্য করে দেয়া হয়েছে। মোবাইলে ইচ্ছা করলেই একজন যুবক সেগুলো দেখতে পায়। ব্যাভিচারের চিত্র দেখে একজন অবিবাহিত আদম কি করে নিজেকে সংবরণ করবে? সে তো ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য। এটি হচ্ছে ব্যাভিচারের প্রথম ধাপ। সে কারণেই আজকাল চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণ, চলন্ত বাসে ধর্ষণ ইত্যাকার বহুঘটনা বিস্তার লাভ করেছে। অতীব দুঃখের বিষয় হল একটি মুসলিম প্রধান দেশে কেন পর্নোগ্রাফি অবাধে দেখার সুযোগ থাকবে? শুধু কি তাই কেই যদি ভাল থাকতে চায় তার সে সুযোগও নেই। অনলাইনে একটি ভাল জিনিস খুজতে গিয়ে এমনিতেই খারাপ জিনিস বেরিয়ে চলে আসে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষা অন্তর্র্ভুক্ত করেছেন। সে জন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। দেশে ইভটিজিং বিরোধী আইন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ইভটিজারদের শাস্তি ব্যবস্থা করা হচ্ছে এটিও খুব ভাল খবর। কিন্তু সাথে সাথে পর্নোগ্রাফিকে চালু রাখা হয়েছে, এটি অতীব দুঃখের বিষয়। উক্ত উদ্যোগগুলো নেয়ার সাথে সাথে পর্নোগ্রাফি বন্ধ করা উচিত ছিল। পর্নোগ্রাফি চালু রেখে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অশ্লীলতা বহাল রেখে ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি এমন যে, একজন ব্যক্তি একটি ক্ষুধার্ত ছাগলের সামনে এক হাতে তাজা কষকষে শামার ঘাস ধরে আছে, আর অপর হতে লাঠি নিয়ে উঁচু করে ধরে আছে যে, সে খেলেই তাকে প্রহার করবে। আমাদের দেশের অবস্থা এইরূপ।
আমরা বিনোদনের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলা দেখে থাকি। বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হল ক্রিকেট। এই খেলা দেখতে গিয়েও আমরা ফাকে ফাকে অশ্লীল নাচ দেখতে পাই। বিশেষত আন্তর্জাতিক মানের কোন খেলা উদ্বোধনের শুরুতে যে ধরনের অশ্লীলতা প্রদর্শিত হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এগুলো দেখে একজন যুবক আদমের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে সে ইভটিজিং এর দিকে ঝুকে যায়।
সুতরাং ইভটিজিং বন্ধ করতে হলে প্রথমে আদম টিজিং এর সমস্ত পথ রুদ্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফিকে পুরাপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে এবং পরিমার্জিত, পরিশীলিত ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ আইন করে বা আদমদেরকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব হবে না। পরিশেষে বলতে চাই আদম টিজিং বন্ধ না হলে ইভটিজিং বন্ধ হবে না।

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংবাদ মাধ্যমের কালোদিবস

আজ ঐতিহাসিক ১৬ জুন। বাংলাদেশে দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে সংবাদপত্রের তথা গণমাধ্যমের কালোদিবস হিসেবে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় দেশের চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়েছিল। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস- এই চারটি দৈনিককে টিকিয়ে রেখেছিল সরকার। কিন্তু সরকারের মালিকানায় নেয়ার ফলে এসব দৈনিকে ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির গুণকীর্তন ছাড়া অন্য কোনো খবর পাওয়া যেতো না। সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার এই পদক্ষেপের ফলে বেকার হয়ে পড়েছিলেন শত শত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী। জাতি বঞ্চিত হয়েছিল সঠিক সংবাদ জানার মৌলিক অধিকার থেকে। 
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক ও স্বৈরশাসকদের কায়দায় স্বাধীন বাংলাদেশেও সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে একদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা দমন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, অন্যদিকে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশও। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ নানা নামের বাহিনীকে বিরোধী দলকে দমনের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিল সরকার। পল্টন ময়দানের জনসভায় বিরোধী দলের ওপর ‘লাল ঘোড়া দাবড়ায়া’ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। দলের কর্মীদের ‘সুন্দরী কাঠের লাঠি’ হাতে নেয়ার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে, প্রথম আওয়ামী লীগ এবং বাকশাল সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। 
রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সংবাদপত্রের ওপরও সরকার প্রচ- দমনের অভিযান চালিয়েছিল। জেনারেল আইয়ুব খান প্রবর্তিত ১৯৬০ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স নামের কালাকানুনটিকেই ১৯৭৩ সালে সে ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা একদিকে সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছেন, অন্যদিকে নিষিদ্ধ করেছেন একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা। ১৯৭২ সালেই নিষিদ্ধ হয়েছিল মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’, সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’, ‘লাল পতাকা’, ‘নয়াযুগ’, মুখপত্র’ ও ‘স্পোকসম্যান’ এবং চট্টগ্রামের দৈনিক ‘দেশবাংলা’। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের মূল দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। ‘হক-কথা’ সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী এবং ‘গণকণ্ঠ’ সম্পাদক কবি আল মাহমুদসহ কয়েকজন সম্পাদককেও গ্রেফতার করেছিল সরকার। এ পর্যন্ত এসেও যথেষ্ট মনে করেননি ক্ষমতাসীনরা, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সব সংবাদপত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন তারা। 
সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে নেয়া এই পদক্ষেপ ছিল প্রথম সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী সামগ্রিক নীতি ও কর্মকাণ্ডের অনিবার্য অংশ। সীমাহীন লুণ্ঠন, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, আওয়ামীকরণ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিণতিতে দেশ ততদিনে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। ১৯৭৪ সালের সে দুর্ভিক্ষে কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অমন এক পরিস্থিতিতে দরকার যখন ছিল সব দলকে সঙ্গে নিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা ও উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো তখন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ আড়ালে প্রধান নেতার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সরকার বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদকে দিয়ে প্রথমে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়, সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় দেশের একমাত্র দল বাকশাল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে চেয়ারম্যান করে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। এরই ধারাবাহিকতায় চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয় ১৬ জুন। 
বলা হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও প্রথম সরকারের পথেই এগিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমও। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এখনো দৈনিকটিকে প্রকাশ করতে দেয়া হচ্ছে না। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কয়েকবার শুধু গ্রেফতার করা হয়নি, রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনও চালানো হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দু’বার নির্বাচিত সভাপতি শওকত মাহমুদসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকেও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নানা কৌশলের আড়ালে চাপানো হচ্ছে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের আড়াল নিয়ে অনলাইন পত্রিকাগুলোর ওপরও খবরদারি চালানো হচ্ছে।
অর্থাৎ বর্তমান সরকারও বাকশাল সরকারের মতোই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই কারণে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাকশালের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, 

শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভাত খাওয়া কমছে!

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ বলে বছর কয়েক আগে পর্যন্তও যে প্রবাদ বাক্যটি বাংলাদেশে চালু ছিল সেটা এখন ইতিহাসের বিষয় হতে চলেছে। কারণ, মাছ বহু বছর আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে। খুব কম সংখ্যক মানুষই আজকাল মাছ খাওয়ার সুযোগ পায়। রুই-কাৎলা ধরনের বড় বড় মাছের তো প্রশ্নই ওঠে না, সাধারণ মানুষ এমনকি ছোট কোনো মাছও সহজে কিনে খেতে পারে না। কই ও বোয়ালের মতো মাছগুলোও মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এতকিছুর পরও মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভাত- তা সে ভাত যতো মোটা ও কম দামের চালেরই হোক না কেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের নয় বছরে সে চালও সাধারণ মানুষের নাগালের তথা ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সে কারণে বাধ্য হয়ে মানুষ চাল কেনা এবং ভাতের পরিমাণ কমাতে শুরু করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকের খবরের শিরোনামেই জানানো হয়েছে, ‘ভাত কম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ’। বেশ কয়েকজন চাকরিজীবী নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, কারো বেতন যদি বছরে দেড় হাজার টাকা বেড়ে থাকে তাহলে অন্যদিকে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল এবং বাড়ি ভাড়া বেড়ে গেছে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এসবের সঙ্গে রয়েছে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য। সবকিছুর দাম শুধু বাড়ছেই। 
এ প্রসঙ্গেই এসেছে চালের দামের কথা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা গেছে, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কোনো কোনো চালের দাম বেড়েছে এমনকি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশÑ টিসিবিও স্বীকার করেছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশের বেশি। গত বছর যে চাল ৩০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যেতো সেটাই এখন ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে মোটা চাল মানভেদে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫০ থেকে ৫৪ টাকা এবং সরু চাল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল দীর্ঘদিন পর্যন্ত ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সে মিনিকেটের দামই বাড়তে বাড়তে এখন ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায় উঠে গেছে। আরো উন্নত মানের নাজিরশাইলের দাম এখন ৬০ টাকার বেশি। 
এমন অবস্থায় আয় যেহেতু বাড়েনি এবং বাড়ার সম্ভাবনাও নেই, সে কারণে বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষ নিজেরাই রেশনিং তথা খাদ্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। তারা ভাতের পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আগে যারা দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতো এখন তারাই এক বেলা আধাপেটা খেয়ে থাকছে। কারণ, এ ছাড়া উপায় নেই তাদের। ওদিকে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল ও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না হওয়ায় এবং মাঝখানে হাওর এলাকায় বিষাক্ত ভারতীয় ইউরেনিয়ামযুক্ত পানিতে ফসল ও জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চালের মজুদ কমে যাওয়ার বিষয়টি। শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সরকার কাবিখা ধরনের কর্মসূচির পাশাপাশি ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করার ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলেও চালের মজুদ তলানিতে এসে ঠেকেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়েই চালের সরবরাহ বাড়ার যেমন সম্ভাবনা নেই তেমনি নেই দাম কমার সম্ভাবনাও। একই কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে ভাতের পরিমাণ বাড়ানোও সম্ভব হবে না। মানুষ এমনকি এক বেলাও পেট ভরে ভাত খেতে পারবে কি না তা নিয়েও এরই মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। 
আমরা মনে করি, এমন অবস্থা সকল বিচারেই অত্যন্ত ভীতিকর এবং এ ব্যাপারে সরকারের জন্য দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। কারণ, চালসহ কোনো পণ্যের দামই রাতারাতি বাড়ায়নি ব্যবসায়ী-মহাজনরা। দাম বেড়ে আসছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু কোনো পর্যায়েই লোক দেখানো ধমক দেয়ার এবং লম্বা আশ্বাস শোনানোর বাইরে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি বলেই একদিকে দাম শুধু লাফিয়ে বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। তারা এমনকি ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিতেও বাধ্য হয়েছে। বলা দরকার, অবস্থা এমন হতে পারতো না, সরকার যদি সময় থাকতে এ বিষয়ে তৎপর হতো। অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য হলো, চাঁদা ও কমিশনসহ সহজবোধ্য কিছু কারণে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সাধারণত নেয়ও না। একই কারণে ব্যবসায়ী-মহাজনরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যথেচ্ছভাবে। এবারও করতে শুরু করেছে রমযানের আগে থেকেই। একই কারণে দামও চলে যাচ্ছে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। সব কিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের প্রশ্রয়। অতীতেও একই কারণে মানুষকে কষ্ট ও ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়েছে। সাধারণ মানুষের তো বটেই, নাভিশ্বাস উঠেছে এমনকি মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্তের মানুষদেরও। 
আমরা মনে করি, অসৎ ও মুনাফাখোর টাউট ব্যবসায়ী-মহাজনদের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত এখনই জরুরি ভিত্তিতে এবং কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা ও চালসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া। আমদানি করে হলেও বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো দরকার। না হলে এক বেলা ভাত খাওয়ার মতো অবস্থাও থাকবে না মানুষের।

বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচন প্রশ্নে শুভাকাঙ্খী দেশগুলোর আহ্বান

সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও এরই মধ্যে জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচনকেন্দ্রিক জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তো বটেই, এমনকি যে দলটিকে ঘিরে এখনো নানা সংশয় রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান সেই দল বিএনপির নেতা-কর্মীরাও নির্বাচনী কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতাও লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিশেল বার্নিকাট প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন। বৈঠকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বৈঠক ও আহবান নিয়ে রাজনৈতিবক অঙ্গনে আলোচনা জমে ওঠার আগেই গত মঙ্গলবার (৬ জুন) সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করতে গিয়েছিলেন ব্রিটেনের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। তিনি একা যাননি, তার সঙ্গে ছিলেন আরো তিনজন উচ্চ পদস্থ কূটনীতিক। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনও সব দলের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও তার সঙ্গে যাওয়া প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার সারাসরি জবাব না দিলেও বৈঠকে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে জানা গেছে নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সিইসির প্রতি আহবান জানিয়েছেন। হাইকমিশনার বলেছেন, ব্রিটেন চায় আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক এবং দেশের সব রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক আরো বলেছেন, তারা বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করতে এবং যারা এ লক্ষ্যে কাজ করছেন তাদের প্রতি সমর্থন জানাতে এসেছিলেন। কমিশনের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তিনি একই সঙ্গে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে অনুষ্ঠিত কর্মকান্ডের নেতিবাচক বিভিন্ন দিকেরও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ব্রিটেন আবারও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনা সম্পর্কে না জানালেও ব্রিটিশ হাইকমিশনার অল্প কথায় তার মূল কথাগুলো ঠিকই জানিয়ে গেছেন। এসবের প্রধান কথাটুকু হলো, দেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং সে নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে।  কথাটার অর্থ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত একদলীয় এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের উদাহরণ উল্লেখ করার মধ্য দিয়েও হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্রিটেন আর অমন নির্বাচন দেখতে চায় না। এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, ব্রিটেন এবারই প্রথম এমন মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালেও বিভিন্ন উপলক্ষে ব্রিটেন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থার মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত হিসেবে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর একাধিকবার ঢাকা সফরকালেও ব্রিটেন মহাসচিবের উদ্যোগের প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিল। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গেও ব্রিটেন তৎপরতা চালিয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, জাতিসংঘ মহাসচিব তথা তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথেরিন অ্যাশটন যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, ব্রিটেন তার সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতিসংঘ মহাসচিবের পাঠানো দূতের প্রচেষ্টাসহ নানাভাবে বহু উদ্যোগ নেয়ার পরও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মতো পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি তারা। এসব কারণেই নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ইইউ। 
বিবৃতিতে সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল, যাতে ভোটাররা তাদের পছন্দ বেছে নিতে ও পছন্দের প্রার্থী ও দলকে ভোট দিতে পারে। উল্লেখ্য, এই বিবৃতিরও অনেক আগে থেকে ইইউ নির্বাচনের ব্যাপারে একই তাগিদ দিয়ে এসেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্রিটেন এবং ইইউ-এর অন্য প্রতিনিধিরা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। তারা এ কথাও জানিয়েছিলেন, সব দল অংশ না নিলে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে পারে। শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ইইউ। এর সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল ব্রিটেন। উল্লেখ্য, ইইউ-এর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ৫ জানুয়ারির সে নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। 
এভাবেই আন্তর্জাতিক সকল মহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা খুইয়েছিল। সেই থেকে প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার এখনো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি। এখনো বরং কথা উঠলেই ওই নির্বাচনের উদাহরণ টেনে আনা হয়। যেমনটি এনেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মাত্র সেদিনের এই অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই আমরা মনে করি, বর্তমান পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দরকার সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করা। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই। আমরা আশা করতে চাই, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সরকার সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিকে নিশ্চিত করবে। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে অবিলম্বে সকল প্রকার দমন-নির্যাতন এবং মামলা ও গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে দেশে যেমন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, অন্যদিকে তেমনি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর আহবান ও পরামর্শের প্রতিও যথাযথ সম্মান দেখানো যাবে। সরকারের উচিত, গণতন্ত্রসম্মত এ পথটিকেই অগ্রাধিকার দেয়া।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সমাবেশের অনুমতি না দেয়া প্রসঙ্গে

দৃশ্যমান ও যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই সরকার তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। গত ২০ মে দলের চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে পুলিশের হানা ও তল্লাশির প্রতিবাদে বুধবার বিএনপি এই সমাবেশ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি দলটি সাংগঠনিকভাবেও সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু সরকারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা সত্ত্বেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি। জবাবে পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বৃহস্পতিবার সারা দেশে প্রতিবাদ দিবস পালন করেছে বিএনপি। এই কর্মসূচিকেও পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে দেয়নি। দেশের বিভিন্নস্থানে বিএনপির মিছিলকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটি অভিযোগ করেছে, প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোনো রকম মামলা না থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। বিএনপি একই সঙ্গে চট্টগ্রামের একজন নেতাসহ অনেককে সাদা পোশাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার এবং গুম করারও অভিযোগ তুলেছে। বিএনপি বলেছে, সব মিলিয়েই দেশে নতুন পর্যায়ে দমন-নির্যাতনের অভিযান মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ভীতি-আতংক ছড়িয়ে পড়েছে নেতা-কর্মীসহ সমর্থক সাধারণ মানুষের মধ্যে।  
আমরা বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। কারণ, বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান ও ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল। এর চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি দু’বার সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন। অমন একজন সম্মানিত ও জনপ্রিয় জাতীয় নেত্রীর রাজনৈতিক অফিসেই পুলিশ আচমকা হানা দিয়েছে এবং তল্লাশির নামে অফিসটিকে তছনছ করেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর গণতান্ত্রিক অধিকার অবশ্যই রয়েছে বিএনপির। তাছাড়া দলটি আইনসম্মত পন্থাতেই প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিল। এজন্যই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার নিয়েছে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে মাঠে নামানো হয়েছে। সরকারের নির্দেশেই পুলিশ গ্রেফতারের অভিযান শুরু করেছে। বিএনপিকে দেশের কোথাও মিছিল-সমাবেশও করতে দিচ্ছে না পুলিশ। স্মরণ করা দরকার, এবারই প্রথম নয়, বাস্তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাধাহীনভাবে মিছিল-সমাবেশ করতে পারছে না। বিএনপির পাশাপাশি নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির শীর্ষ নেতাদের একদিকে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়েছে, অন্যদিকে চাপানো হয়েছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। নির্বিচার গ্রেফতারের পাশাপাশি জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ধাওয়ার মুখেও রেখেছে সরকার। অবস্থা এমন হয়েছে যে, নেতারা দূরে থাকুন, জামায়াতের কর্মী ও সমর্থকরা পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। তাদের প্রায় সকলকে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। সেদিক থেকে বিএনপি কিছুটা নিরাপদে রয়েছে বলে এতদিন মনে করা হলেও চেয়ারপার্সনের অফিসে তল্লাশি চালানোর এবং সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার পাশাপাশি দমন-নির্যাতন শুরু করার সর্বশেষ দুটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, সরকার আসলে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে মোটেও ইচ্ছুক বা আগ্রহী নয়। 
ঘটনাপ্রবাহে সঙ্গত কারণেই বাকশালের কথাও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকসহ বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত তার মরহুম পিতার পথেই এগোতে চাচ্ছেন। এমন অনুমান বা মন্তব্যকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, বাকশাল অর্থ এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার অধীনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দল থাকতে পারবে না। ভিন্নমতাবলম্বী কোনো রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী মাত্র সাড়ে তিন বছরে হাজারের অংকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূল করা এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে সেকালের মুজিব সরকারের প্রচ- দমন-নির্যাতনে বিরোধী দলের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। কোনো দলই ফলপ্রসূ বিরোধিতা করার মতো অবস্থায় ছিল না। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়েই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নতুন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হয়ে সব দল নিষিদ্ধ করে তিনি সর্বময় ক্ষমতা নিয়েছিলেন নিজের হাতে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই আশংকা করা হচ্ছে, শেখ হাসিনাও পিতার পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন আরো একটি একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে। সে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যেই তিনি একের পর এক সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এভাবেই শেখ হাসিনা জাতিকে নতুন চেহারার বাকশাল দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা অবশ্য মনে করি, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। কারণ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বে দেশে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা অন্য কারো পক্ষে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা সহজে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। কথাটা সরকার যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবে ততই সরকারের জন্য শুধু নয়, দেশ ও জাতির জন্যও মঙ্গল। আমরা আশা করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী দ্রুত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসবেন এবং সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়ার জন্য অবিলম্বে সভা-সমাবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। বর্তমান পর্যায়ে এটা বিশেষ একটি কারণেও দরকার। সে কারণ সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন। ক্ষমতাসীনরা অনেক আগেই তাদের নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু করেছেন। এমন অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল দলের জন্যও সমান সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত বলে আমরা মনে করি। এটাই সংবিধান এবং গণতন্ত্রেরও নির্দেশনা।

বুধবার, ২৪ মে, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নজরুলের চেতনায় উঁচু হোক জাতির শির

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলাদেশের মহান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। বাংলাদেশসহ ভারত দখলকারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বলিষ্ঠ ভূমিকা, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, গ্রেফতার ও কারাবাস থেকে দারিদ্র্য, বিয়ে ও পারিবারিক জীবন পর্যন্ত কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিচিত্র জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি। কাব্য-সাহিত্যের সব শাখাতেই অতুলনীয় অবদান রয়েছে তার। কিন্তু নানা বিষয়ে অসংখ্য রচনা থাকলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে নজরুল পরিচিতি পেয়েছিলেন একজন কবি হিসেবে। আজও তার প্রধান পরিচয়, তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবি। তার এই বিদ্রোহ ছিল দখলদার তথা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। ‘আমি দুর্বার/আমি ভেঙে করি চুরমার’ ঘোষণা করেই থেমে যাননি কবি, ইংরেজদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এদেশ ছাড়বি কিনা বল/নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল’। 
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সেই দিনগুলোতে এ ছিল এক দুর্দান্ত সাহসী উচ্চারণ। তার মূল্যও তাকে ব-বার চুকাতে হয়েছে। দণ্ডিত হয়ে বারবার কারাগারে গেছেন তিনি। কিন্তু মাথা নোয়াতে জানতেন না কবি, মাথা তিনি নতও করেননি কখনো। তার সংগ্রাম ছিল সব ধরনের শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আইনের নামে দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আজীবন সোচ্চার থেকেছেন তিনি। দরাজ গলায় গেয়েছেন সাম্যের গান। ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ থেকে ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’ ও ‘প্রলয় শিখা’ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে তার এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। 
ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের ব্যাপারে কবি কাজী নজরুলের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। প্রধানত ফার্সী ও উর্দুতে রচিত গজলের অনুকরণে বাংলায় অসংখ্য গজল লিখেছেন তিনি। গোলাপের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই ফুল নবীর তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পায়ে চুমু খেয়েছিল বলেই তাঁর খুশবু আজও গোলাপের তৈরি আতরে পাওয়া যায় কি না? বুলবুলিকে জিজ্ঞেস করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাম জপেছিল বলেই তার কণ্ঠও এত মধুর কি না? পবিত্র আল-কোরআন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), নামায, রোজা, হজ্ব ও জাকাত প্রভৃতি এসেছে নজরুলের প্রধান বিষয় হিসেবে। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) প্রমুখকেও নজরুলই ইতিহাসের আলোকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তুর্কী বীর কামাল পাশা, মিসরের জগলুল পাশা এবং জামাল আফগানীর বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে পরাধীন ভারতীয়দের তিনি উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন।
নজরুল তাই বলে ধর্মান্ধতার বা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হননি বরং পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘টিকি’ রাখলে যেমন হিন্দু পন্ডিত হওয়া যায় না, তেমনি ‘দাড়ি’ রাখলেই মুসলমান মোল্লাও হওয়া যায় না। নজরুল একই সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ ও খৃস্টানসহ ভারতীয়দের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলমান কবি নজরুলকে তাই বলে রেহাই দেয়া হয়নি। কবি বিয়ে করেছিলেন আশালতা সেনগুপ্তাকে, পরবর্তীকালে যিনি প্রমীলা নজরুল নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তারা যার যার ধর্ম পালন করেছেন। ধর্ম পরিবর্তন না করার কারণে নজরুল ও প্রমীলাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। রক্ষণশীল হিন্দুরা এমনকি এ চেষ্টাও করতো, যাতে কোনো হিন্দু মালিক তাদের বাড়ি ভাড়া না দেয়। সে কারণে নজরুলকে -গলী ও কৃষ্ণনগরের মতো বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। কলকাতায়ও তিনি এক বাড়িতে বেশিদিন বসবাস করতে পারেননি। অভাব ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি ধর্মের বিষয়টি তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াতো। এভাবে অবশ্য নমনীয় বা পরাজিত করা যায়নি নজরুলকে। তিনি শেষ পর্যন্তও সাম্যের গানই গেয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
কবি নজরুল অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিদায় পর্ব এবং ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাকশক্তি হারিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ইন্তিকালের সময় পর্যন্তও তিনি আর হারানো বাকশক্তি ফিরে পেতে পারেননি। জাতি হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য, অনেক দেরিতে হলেও আমাদের জাতীয় কবিকে আমরা বাংলাদেশে আনতে পেরেছিলাম। তিনি শুয়ে আছেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মসজিদের পাশে। উল্লেখ্য, নজরুল নিজেই তাকে ‘মসজিদের পাশে’ কবর দিতে বলেছিলেন এক কবিতায়। 
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরো একবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং অনুসরণীয় হয়ে উঠেছেন। স্মরণ করা দরকার, একবার মহররম সংখ্যা ‘ধুমকেতু’র সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, ‘যে শির আল্লাহর আরশ ছাড়া আর কোথায়ও নত হয় না, সে শিরকে জোর করে সেজদা করাচ্ছে অত্যাচারী শক্তি, আর তুমি করছ সেই শহীদদের ধর্মের জন্য, স্বাধীনতার জন্য শহীদদের মাতমের অভিনয়।...’ আহ্বান জানাতে গিয়ে নজরুল আরো বলেছিলেন, ‘তোমার স্বাধীনতাকে, তোমার সত্যকে, তোমার ধর্মকে যে এজিদের বংশধররা নিপীড়িত করছে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের ভূ-অবলুণ্ঠিত শির উঁচু হয়ে উঠুক’। আমরাও আশা করতে চাই, কবি নজরুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের দমন-নির্যাতন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ শির উঁচু করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠবে। তাহলেই জাতীয় কবির জন্মদিনে তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে বলে আমরা মনে করি।

শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নিশ্চিন্তে নেই ক্ষমতাসীনরাও

সভা-সমাবেশের মতো রাজনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ না থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে রসিকতা, এমনকি ব্যঙ্গ-তামাশাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে চলেছে। তাই বলে রাজপথে দাঁড়িয়ে কারো পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই মানুষ এখানে-সেখানে, অফিসে, ক্লাবে এবং চায়ের দোকানে নিজেদের বক্তব্য ও মন্তব্য ঝেড়ে বেড়াচ্ছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর প্রসঙ্গে তার নিজের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, তিনি ‘কিছু’ অর্জন করতে পারেননি। কারণ প্রধানমন্ত্রী তো ‘কিছু’ চাইতে যাননি! তা সত্ত্বেও তিনি নাকি ‘কিছু একটা’ পেয়েছেন! সেই ‘কিছু একটা’ যে ঠিক কি এবং কোন ধরনের ‘কিছু’ তা নিয়েও জনগণের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। 
ওদিকে মন্তব্য ও আলোচনার নতুন নতুন খোরাক যুগিয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নিজের দলকে প্রথমে ‘কাউয়া লীগ’ বলার পরপর ক’দিনের মধ্যেই ওবায়দুল কাদেরের মুখ দিয়ে অতি কঠিন এক সত্য কথা বেরিয়ে এসেছে। গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামে দলের প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে এগিয়ে চলছি এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিএনপি আমাদের প্রতিপক্ষ হবে না। আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হবে আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ হলে আওয়ামী লীগকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’ একই বক্তৃতায় ‘বেপরোয়া’ ছাত্রলীগকে নিজেদের স্বার্থরক্ষার ‘পাহারাদার’ না বানানোর জন্যও আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদেরের কথা শুনলে মনে হতে পারে অসীম ক্ষমতা রয়েছে তার। অন্যদিকে রাজধানীতে গেটলক ও সিটিং সার্ভিস নামের বাসের চলাচল নিষিদ্ধ করতে গিয়ে তাকে কিন্তু যারপর নাই নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী বলেই মানুষের দুর্ভোগ কমানোর জন্য তার কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। নিজে যথেষ্ট দাপটের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ১৮ এপ্রিল ওবায়দুল কাদের কিছুটা ঘুরিয়ে বলেছিলেন, বাসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এবং পরিবহন নেতারা এতটাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর যে, সরকারও তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না! সরকার ‘বাঁধন-কষণ’ শুরু করলেই নাকি ‘ফসকা গেরো’ লেগে যায়! কারা এই ‘গেরো’ লাগায় ওবায়দুল কাদের তাদের নাম-পরিচয় না জানালেও জনগণ যা বোঝার তা ঠিকই বুঝে নিয়েছে। 
অনুসন্ধানেও জানা গেছে, রাজধানীতে বাসের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে জনভোগান্তির পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের। এসব নেতা একদিকে নিজেরাই অসংখ্য বাসের মালিক, অন্যদিকে তাদের কেউ কেউ আবার পরিবহন শ্রমিকদের ডাকসাঁইটে নেতাও। ঘটনাপ্রবাহে অন্য কিছু তথ্যও বেরিয়ে এসেছে। যেমন বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের এই নেতাদের উদ্যোগে এরই মধ্যে কয়েকশ’ এসিযুক্ত বিলাসবহুল বাস আমদানি করা হয়েছে। নানা নামে তারা কয়েকটি কোম্পানিও খুলে বসেছেন। এখন চলছে এসব কোম্পানির বাসগুলোকে রাজধানীতে নামানোর পাঁয়তারা। টাউন সার্ভিস হিসেবে চলাচল করলেও প্রতিটি বাসই যেহেতু এসিযুক্ত এবং বিলাসবহুল সে কারণে ভাড়া আদায় করা হবে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি হারে। অমন খবরে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের আলোচ্য নেতাদের নেয়া কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, প্রচলিত আইন অনুসরণ করে লাইসেন্স-পারমিটসহ বাস নামানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে গেটলক ও সিটিং সার্ভিস নামে চলাচলকারী বাসগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, জিম্মি হয়ে পড়া মানুষ যাতে বেশি ভাড়ার বাসের ব্যাপারেও আপত্তি না জানায়। তারা যাতে সংকট কেটে গেলেই খুশি হয়।। মূলত সে কারণেই বলা হয়েছে, সব কিছুর পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন দলের একই গোষ্ঠীর সুচিন্তিত পরিকল্পনা। মন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন কি নাÑ সে প্রশ্নও উঠেছিল একযোগে। 
এগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনের এক পক্ষ সম্পর্কিত তথ্য ও আলোচনা। মাঝখানে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে নির্বাচনী হিসাব পাল্টে ফেলার নাটকীয় কান্ডকারখানা করা হলেও অন্যদিকে রয়েছে বিএনপিÑদেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত যে দলটিকে কোনোভাবেই হিসাবের বাইরে ঠেলে দিতে পারছেন না ক্ষমতাসীনরা। এক পা দুই পা করে ক্ষমতার দিকে এগিয়ে চলা বিএনপির পক্ষ থেকে সম্প্রতি কঠোর একটি হুশিয়ারি ঘোষিত হয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল বিএনপির সিলেট অঞ্চলের নেতা ও সাবেক এমপি ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত একাধিক সমাবেশে বিএনপির নেতারা বলেছেন, দলটি ক্ষমতায় এলে ‘আন্তর্জাতিক মানদন্ডে’ সরকারের সকল গুম ও খুনের বিচার করা হবে! সেদিনের এক সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হিসাব দিয়ে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের আমলে দলটির পাঁচ শয়ের বেশি নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে, যাদের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মির্জা আলমগীরের দেয়া হিসাব অবশ্য সম্পূর্ণ নয়। কারণ, তিনি জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের অন্য কোনো দলের গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করেননি।  
এ পর্যন্ত এসে পাঠকরা বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হতে পারেন। না, হিসাবের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা নয়, উদ্দেশ্য আসলে গুম ও খুনের মতো ভয়ংকর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কিছু বলা। কারণ, সব দেশেই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ডকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, একই সঙ্গে দেখা হয় অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গেও। গণতান্ত্রিক কোনো দেশে রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা বা কর্মীকে গুম করা হবে এবং পরে এখানে-সেখানে, নদী ও খাল-বিলের পাশে তার লাশ পাওয়া যাবে- এমনটা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন হয়ে পড়া বাংলাদেশে গুম শুধু হচ্ছেই না, মাঝেমধ্যে গুমের রীতিমতো ধুমও পড়ে যাচ্ছে। বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে। সঙ্গে তার ড্রাইভারও ছিল। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ মেলেনি। মাঝখানে বছর তিনেক আগে তার ছোট ভাই অভিযোগ করেছিলেন, ইলিয়াস আলীকে নাকি কলকাতার আশপাশে ভারতের কোনো কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য কোনো দেশ হলে সরকার সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠতো এবং ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এমনকি টুঁ শব্দটিও করেনি। এজন্যই ইলিয়াস আলীর এখনো কোনো খবর নেই। গুম হয়ে যাওয়া আরো অনেকেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে না।  
কথা শুধু এটুকুই নয়। দায়িত্ব যেখানে ছিল গুম-খুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, সরকার সেখানে এ সংক্রান্ত খবর যাতে প্রকাশিত না হতে পারে সে ব্যাপারেই বেশি তৎপরতা দেখিয়ে চলেছে। কিন্তু সরকারের এই চেষ্টায় কোনো ত্রুটি না থাকলেও দেশের ভেতরে যেমন, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তেমনি গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়টি ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও আলোচিত হয়েছে। এখনো যে হচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট। রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ মার্চ। এতে বাংলাদেশে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ‘উচ্চ হারে’ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। এরও আগে কমিশন বিষয়টি নিয়ে শুনানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপি)-এর এক উন্মুক্ত অধিবেশনের আয়োজন করেছিল। গত ৬ ও ৭ মার্চ জেনেভায় অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মাধ্যমে সরকার নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। কিন্তু সে বক্তব্য বা কৈফিয়ৎ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি জাতিসংঘের সংস্থা। পর্যবেক্ষণ আকারে প্রকাশিত রিপোর্টে বরং সরকারের বক্তব্যের ভিত্তিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। 
পর্যবেক্ষণে আইসিসিপি সনদের উল্লেখ করে জাতিসংঘ কমিশন বলেছে, আইসিসিপি সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে ও বলবত রাখতে পারে না, যেসব আইন ওই সনদের পরিপন্থী। প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের উল্লেখ করেছে কমিশন। বলেছে, এ দুটি আইনের ব্যাখ্যা এতই ব্যাপক যে, যে কোনো সরকারই তার স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে ব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করতে পারে। আইন দুটির অপপ্রয়োগ যে ঘটেছে ও ঘটে চলেছে এবং সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরাও যে তার শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন- তারও উল্লেখ রয়েছে পর্যবেক্ষণে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে জাতিসংঘ কমিশন বলেছে, আইনশৃংখলা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকায় দোষীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না, অন্যদিকে ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোও ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। দেশের আইনে  অপরাধ হিসেবে গুমের স্বীকৃতি না থাকার কারণেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ কমিশন। পর্যবেক্ষণের সুপারিশে কমিশন বলেছে, সকল বাহিনীর জন্যই আইনে জবাবদিহিতার এবং দোষীদের শাস্তির বিধান যুক্ত করতে হবে। আটক অবস্থায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং কারা হেফাজতে মৃত্যুর ব্যাপারেও নিন্দা জানানো হয়েছে পর্যবেক্ষণে। 
মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার অধিকারসহ আরো কিছু বিষয়েও প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বক্তব্য রেখেছে জাতিসংঘ কমিশন, কিন্তু বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সরকারের চালানো দমন-নির্যাতনের নানাদিক। বলা বাহুল্য, কোনো একটি প্রসঙ্গেই পর্যবেক্ষণে সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়নি। কারণ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অন্য কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো রিপোর্টে একথা পর্যন্তও বলা হয়েছে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন মামলা দায়ের করার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, হত্যা ও গুম হওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা প্রসঙ্গও রয়েছে প্রায় সব রিপোর্টে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার যে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি- এমন মন্তব্যও করেছে বিভিন্ন বিদেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজও অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছে। বড় দলগুলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মনে হচ্ছে, সংসদের বাইরেও কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না সরকার। 
আরো অনেক তথ্য ও অভিমতও রয়েছে বিভিন্ন বিদেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে। সেদিক থেকে বলা যায়, জাতিসংঘ কমিশন আসলে নতুন কিছুই বলেনি। বস্তুত সরকার স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার কারণে বাংলাদেশে একদিকে বিরোধী গণতান্ত্রিক দলগুলো আন্দোলন দূরে থাকুক এমনকি সাধারণ কোনো কর্মসূচিও পালন করতে পারছে না, অন্যদিকে এসব দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি আক্রান্ত অন্য সকলের জন্যও ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানতেই হবে, জাতিসংঘ কমিশনের পর্যবেক্ষণে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য সঠিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী তথা নিরাপত্তাবাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে, যাদের পেছনে রয়েছে সরকারের সমর্থন ও মদদ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের, প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার, গ্রেফতারের পর রিম্যান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো বিভিন্ন প্রসঙ্গেও পর্যবেক্ষণে সঠিক তথ্য ও চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। 
বলা বাহুল্য, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এই পর্যবেক্ষণ সরকারের জন্য সুখবর হয়ে আসেনি। সে কারণে কেবলই প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে সরকারের উচিত পর্যবেক্ষণের মূলকথাগুলো অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করা। বিষয়টি জরুরি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালীসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশই বিভিন্ন সময়ে গুম-খুনের কঠোর বিরোধিতা করেছে। এখনো করছে। দেশগুলো বেশ কিছু উপলক্ষে জানিয়ে দিয়েছেন, ইলিয়াস আলীসহ বিভিন্নজনের গুম ও হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি কঠিন হয়ে পড়বে। 
বলা দরকার, বিদেশীদের হুমকির কারণে শুধু নয়, দেশের ভেতরে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে সরকারের উচিত কঠোর অবস্থান নেয়া। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যার পেছনে তাদের ইন্ধন ও ভূমিকার বিষয়টি কারো কাছেই আর গোপন নেই। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও যখন অভিযোগ উত্থাপন করে তখন বোঝা দরকার, দেশের ভাবমর্যাদা তো ক্ষুণ্ন হয়েছেই, এমন অবস্থা কোনো সরকারের ভবিষ্যতের জন্যও শুভ হওয়ার নয়। সুতরাং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মামলা ও গ্রেফতারসহ বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন বন্ধ করার পাশাপাশি সরকারের উচিত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেও সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একযোগে সচেষ্ট হয়ে ওঠা। উচিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনই উদ্যোগী হওয়া।

আশিকুল হামিদ 

মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জঙ্গি তত্ত্ব ও চাণক্য বচন!!!


আগে জঙ্গীরা রাতের অন্ধকারে পুলিশের গুলিতে নিহত হতো। যেদিন থেকে আমরা প্রশ্ন করলাম - কেন জঙ্গীদের জীবিত ধরা হচ্ছে না, সেদিন থেকে সব জঙ্গীরা আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হতে লাগল।
তারপর যখন সেই নিহত জঙ্গীর আসল পরিচয় ও অতীত আমরা উদ্ঘাটন করতে চাইলাম, সেদিন থেকে তাদের চেহারা এতই বিকৃত হতে শুরু করল যে, তাদের পরিচয় সনাক্ত করা কঠিন হয়ে গেল। সাংবাদিকরা নিহতদের ছবিও প্রকাশ করতে পারল না। অন্যান্য রাষ্ট্রের জঙ্গীরা ঘরের বাহিরে যুদ্ধ করে। কেউ কোমরে কিংবা গাড়িতে বোমা নিয়ে জনবহুল এলাকা, সেনা/পুলিশ ঘাঁটিতে গিয়ে বিষ্ফোরণ ঘটায়। আর আমাদের দেশের জঙ্গীরা নিজের ঘরে নিজের ছোট বাচ্চা স্ত্রীসহ নিজেরাই মরে যাচ্ছে।

পৃথিবীর কোন দেশে এমন আজব জঙ্গী আছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখেন। যত বড় জঙ্গীই হোক না কেন নিজের পরিবারে বোমা সরঞ্জাম রাখবে কেন? যখন আমরা প্রশ্ন করলাম জঙ্গীরা সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত গ্রেনেড পেল কিভাবে?
তখন উত্তর আসল, তারা সেনাবাহিনীর ছোঁড়া গ্রেনেড ক্যাচ ধরে সেটা আবার ছুঁড়ে মেরেছে। জনগণ কি চদু নাকি যে এধরনের আজগুবি কথা বিশ্বাস করবে...। আমাদের সবচেয়ে এলিট ফোর্স সোয়াতকে বলেন তো ছোঁড়া গ্রেনেড ক্যাচ ধরে আবার ছুঁড়ে দেখাতে পারবে কিনা? হলিউডের টোয়াইলাইট মুভিতে ভাম্পায়ার নিয়ে কহিনী সাজিয়েছে, আর বাংলার টোয়াইলাইটও এক ভাম্পারনীর রচিত কাহিনী।
এই সেনা অভিযানের সময় সারাদেশের অন্যান্য জঙ্গীরা চুপ করে বসে থাকল কেন? তাদের সঙ্গীরাও তো এই যুদ্ধে শরীক হয়ে শহীদ হওয়ার সূবর্ন সুযোগ নিতে পারত। নিজে নিজে আত্মহত্যা করে শহীদ হওয়া আর শত্রুর গুলিতে শহীদ হওয়া কোনটায় বেশী সওয়াব মনে করে জঙ্গীরা? অবশ্যই শত্রুর গুলি। তাহলে কেন তারা নিজেরাই আত্মহত্যা করল? যখন সিলেটে এত আলোচিত জঙ্গী অভিযান চলছে, তখন কেন পার্শ্ববর্তী জেলার জঙ্গীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে নিজেদের ডেরায় আরমছে ঘুমিয়ে থাকল?? কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর???
দোহাই লাগে, এই ভয়ঙ্কর খেলা বন্ধ করুন। দেশ বিধ্বংসী এই ষড়যন্ত্র থেকে সরে আসুন। নইলে নিজেদের খোঁড়া গর্তে একদিন নিজেরাই পড়বেন। সেদিন চিৎকার করলেও বাঁচানোর কেউ থাকবে না।

আবুল বাসার মানিক 

রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা প্রসঙ্গ

 প্রধানমন্ত্রী দিল্লী সফরে যাচ্ছেন। সেজন্য দুই দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তার পর তার এই সফরের ওপর বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইতঃপূর্বে দুইবার এই সফরের সময় নির্ধারিত হয়। কিন্তু দুইবারেই অনিবার্য কারণবশত প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে আগামী ৭ এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রীর তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফর চূড়ান্ত হয়েছে। গতবারে যেমন বলেছিলাম এবারেও তেমনি বলছি যে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লী সফরের সময় যে বিষয়টি নিয়ে আগেভাগেই তুমুল আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো- প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি। আসলে এটি কি হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বাংলাদেশ থেকে বলতে গেলে কিছুই বলা হচ্ছে না। তবে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় এ সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য এই যে, মানুষ বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা পড়ে কোনো ধারণাই পায়নি। কূটনৈতিক পরিভাষায় যেমন আছে- Diplomatic Jugglery, তেমনি প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে চলছে কূটনৈতিক Jugglery. আসলে প্রতিরক্ষা খাতে যেটি হবে বলে শোনা যাচ্ছে সেটি হলো একধরনের চুক্তি। ইংরেজিতে এই ধরনের চুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘Treaty’, আবার কোনো কোনো সময় বলা হচ্ছে ‘Pact’। তার পরেও কূটনৈতিক পরিভাষা থেমে নেই। কেউ কেউ বলেছেন যে, এটি হলো- ‘Memorandum of Understanding’, অর্থাৎ একটি সমঝোতা স্মারক। আবার কেউ কেউ বলেছেন প্রতিরক্ষা সম্পর্কে কোনো ‘Pact’ বা ‘Treaty’ হবে না। যেটি হবে সেটি হলো- ‘Deal’। আবার অন্য একটি মহল বলেছেন যে, এটি হবে এক ধরনের Agreement. এটি যে হবে একটি ডিফেন্স Deal বা Agreement সেটি কিন্তু আমরা ভারতীয় সূত্র অর্থাৎ ভারতীয় রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে জানতে পেরেছি। এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম খবর দেয় ভারতের একটি প্রিন্ট মিডিয়া। সেই খবরও ছিল ছোট্ট এবং ভাসা ভাসা। বাংলাদশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নতুন করে কিছু বলেনি। বরং ভারতীয় মিডিয়াতে যেভাবে এগুলো এসেছে সেগুলো তারা লুফে নিয়েছে।
আমরা ঠিক জানি না যে, চুক্তি বা (MOU) যেটাই হোক না কেন সেটি কোন ধরনের হবে? তার মধ্যে কি থাকবে? ভারতের পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে যে, এটি হবে একটি ‘Comprehensive Defense Deal’. এসব Diplomatic পরিভাষা ব্যবহার করে তারা কি বোঝাতে চাচ্ছে সেটি তারাই ভালো জানেন। একটি ভারতীয় ইংরেজি পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে, এই Comprehensive Defense Agreement-এ অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রশ্ন উঠেছে যে, সামরিক ক্ষেত্রের সহযোগিতার এই বিষয়টিতে কি কোনো সময়সীমা থাকবে? নকি ঐ ধরনের কিছুই থাকবে না। তবে সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে যে এর ভেতরে সামরিক সহযোগিতা বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবগুলোই ঐ চুক্তি বা Agreement-এ থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, এর মধ্যে থাকবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং প্রদান, সমরাস্ত্র ক্রয় এবং মিলিটারি টু মিলিটারি কো-অপারেশন। এই মিলিটারি টু মিলিটারি কো-অপারেশনের জন্য দিল্লী বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতেও রাজি হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সামরিক খাতে এই ঋণ দেয়ার জন্য দিল্লী যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, সেটি দিল্লী ইতঃপূর্বে আর কোথাও কাউকে দেয়নি। ভারত বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনছে এবং সেই অস্ত্র ক্রয় বাবদ শত শত কোটি রুপি ঋণও নিচ্ছে বিদেশ থেকে। সেখানে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে বাংলাদেশের জন্য সমরাস্ত্রের আয়োজন করা বিস্ময়কর বৈকি। তবে শর্ত হলো এই যে, অস্ত্র খাতে ভারত যে ঋণ দেবে সেই ঋণের টাকা দিয়ে বাংলাদেশকে শুধুমাত্র ভারত থেকে যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করতে হবে।
॥ দুই ॥
কেন ভারত এসব করবে? ভারতের ইংরেজি পত্র-পত্রিকাতেই বলা হচ্ছে যে, এই ধরনের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে নাকি গাঁইগুঁই করছে। শেষ পর্যন্ত যদি বাংলাদেশ মোচড়ামুচড়ি করে তাহলে ভারত নাকি বলছে যে, অন্তÍত একটি সমঝোতা স্মারক সই হোক। দরকার লাগলে ঐ স্মারকটি বাধ্যতামূলক নাও হতে পারে। এমনকি সেখানে কোনো সময়সীমা নাও থাকতে পারে। তবুও বাংলাদেশ একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করুক। ভারতীয় সূত্র থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ঠিক এই মুহূর্তে ঐ ধরনের কোনো চুক্তি করতে চাচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশ বলছে যে, আগামী বছরের ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে এখন যদি প্রতিরক্ষা চুক্তি বা ঐ ধরনের কোনো চুক্তি হয় তাহলে বাংলাদেশের বিরোধী শিবির বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হাতে একটি নির্বাচনী অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। ঐ অস্ত্র প্রয়োগ করে তারা আগামী ইলেকশনে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে বধ করবে। তবে এই নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের আরও ৫ বছর সময় থাকবে। সেক্ষেত্রে চুক্তির ফলে যদি বাংলাদেশে জনমত কিছুটা প্রতিকূলে যায়, তাহলে তারা সেটা ম্যানেজ করতে পারবে। 
বাংলাদেশের একশ্রেণীর নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন যে, বাংলাদেশ যদি এই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করে তাহলে সেটি সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যান্য অপশনকে সীমিত করে ফেলবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ এই ধরনের চুক্তির কোনো আবশ্যকতা অনুভব করে না। কিন্তু ভারত করে। বাংলাদেশের একধরনের মিডিয়া, যারা সেক্যুলার এবং আওয়ামী লীগের প্রতি কিছুটা দুর্বল বলে পরিচিত, তারাও এখন মনে করছেন যে, ভারত এখন এই ধরনের একটি চুক্তি করতে চাচ্ছে একটি বিশেষ কারণে। আর সেটি হলো সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা। চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন সংগ্রহের পর ভারতের উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে। হিন্দুস্থান টাইমসসহ একাধিক ভারতীয় পত্র-পত্রিকা লিখছে, যেখানে বাংলাদেশের সাথে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পন্ন হয়ে গেছে এবং যেখানে ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধেরও ফয়সালা হয়ে গেছে, সেখানে বাংলাদেশের জন্য দুইটি সাবমেরিন কেনার কি যুক্তি থাকতে পারে?
॥ তিন ॥
এই ধরনের স্পর্শকাতর চুক্তিতে অবশ্যই জনগণের অনুমোদন দরকার। সেজন্য প্রয়োজন প্রকাশ্য আলোচনার ব্যবস্থা। এই চুক্তিটি যদি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেটির ওপর ব্যাপক পাবলিক ডিবেট হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এমন গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে যে, পাবলিক ডিবেট তো দূরের কথা, সরকার এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। তারপরেও দেশপ্রেমিক জনসাধারণ গভীর উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লী সফরে কি ঘটে? বর্তমান সংসদ প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। তবুও সেখানেও যদি এই চুক্তি সর্বসাধারণের অবগতির জন্য উত্থাপন করা হতো এবং সংসদে প্রকাশ্য বিতর্কের ব্যবস্থা করা হতো তাহলেও জনগণ কিছুটা জানতে পারতেন।
কতগুলো ব্যাপার মানুষকে জানতেই হবে। যেমন, চুক্তিতে নাকি এমন একটি ধারা থাকবে যেখানে বলা হবে যে, এমন কিছু বিষয় আছে যেটিকে দুই দেশই মনে করবে যে, সেটি তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিন্ন হুমকি বা পারস্পারিক হুমকি, তাহলে সেটি মোকাবিলা করার জন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এখন কথা হলো যে, ভারত যেটাকে মিউচুয়াল থ্রেট মনে করে বাংলাদেশ সেটিকে তো তার সার্বভৌমত্বের প্রতি থ্রেট মনে নাও করতে পারে। এমন ক্ষেত্রে তাহলে কি হবে?
সবশেষে একটি কথা। ভারতের জন্য অনেক বড় মাথাব্যথা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ দমনে বর্তমান সরকার যে অবদান রেখেছে সেটা কোনো মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। আওয়ামী সরকার ভারতের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এতবড় অবদান রেখেছে। কিন্তু কোনো চুক্তি ছাড়াই। ঐ জায়গায় যদি কোনো চুক্তির প্রয়োজন না হয়, তাহলে এখন কেন প্রয়োজন হচ্ছে? ভারত ছাড়া বাংলাদেশের তো এমন কোনো প্রতিবেশী নেই যার সাথে তার যুদ্ধ লাগতে পারে। যদি কোনো সময় মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ লাগে তাহলে তার জন্য কি ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে?


আফিস আরসালান 

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি

হোসাইন আনোয়ার : নতুন নতুন সংঘটিত ঘটনাবলী যা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রকাশিত, প্রচারিত, উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত হয় এবং যা জানতে জনগণ আগ্রহী ও কৌতূহলী তাই সংবাদ বা খবর। যে মাধ্যমে তা প্রচারিত বা প্রকাশিত হয় তাকে সংবাদমাধ্যম বলে। যারা এই সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত তাদেরকে সাংবাদিক বলা হয়। সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। সাংবাদিকরা সমাজের খুটিনাটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরেন। বর্তমান সময়ে সংবাদপত্র বা মিডিয়াকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়। মিডিয়ার একটি মাধ্যমের নাম টেলিভিশন। বিশ্বের প্রায় ৮০% মানুষ টেলিভিশন দেখে। অতএব মিডিয়া বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৪০০ শত বছর আগে সাংবাদিকতা বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. যে গাইড লাইন দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অনন্য। ইসলামে সাংবাদিকতা এক ধরনের আমানত। এই আমানত হচ্ছে, যে কোনো তথ্য ও সংবাদকে অবিকৃত অবস্থায় সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা। নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মতের রং লাগিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উল্টোভাবে পরিবেশন না করা। মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়। যে খবরটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তা আদৌ সত্য কিনা তা যাচাইয়ের নিয়ম আছে সংবাদপত্র জগতে। তথ্য যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনেও রয়েছে চমৎকার দিক-নির্দেশনা। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা যাচাই-বাছাই করে নাও; যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হও।’ (সূরা আল-হুজুরাত: ০৬)
সাংবাদিকদের জন্য এই আয়াতটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদকর্মীরা যদি কোনো তথ্য সঠিকভাবে যাচাই না করে মিডিয়ায় প্রচার করে দেন, তাহলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। যার মাসুল ঐ সংবাদকর্মী দিতে পারবেন না। যাচাই বাছাই ছাড়াই সংবাদ প্রকাশের অনেকগুলো মাধ্যমের মধ্যে একটি মাধ্যমের নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে এধরনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম  ফেসবুক থেকে শুরু করে সবখানে বিদ্যমান। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই না করে সংবাদ গ্রহণ ও পরিবেশন নিষেধ করেছেন। অনেক সংবাদকর্মী লোকমুখে যা শুনেন তাই মিডিয়ায় প্রচার করে দেন। এটিও ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘একজন ব্যক্তি মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়’। (মুসলিম : ১/১০৭)
ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা দলীয়স্বার্থ বিবেচনা করে অনেক সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেন। এ কাজটি করাও অন্যায়। জনস্বার্থে আসল তথ্য গোপন না করে তা প্রকাশ করা উচিত। মানুষ তথ্য জানার জন্য অধীর আগ্রহে পত্রিকা পড়েন কিংবা টিভির পর্দায় চোখ রাখেন। জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করা সম্পর্কে পবিত্র হাদীসে কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করল কিয়ামতের দিন আল্লাহতাআলা তাকে আগুনের লাগাম পড়াবেন।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান : হা. ৯৬) 
অনেকে আবার কাউকে হেয় করার মানসে তার ব্যক্তিগত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেন। যেমন গত ৩১ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলীতে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন আহত হয়ে মেডিকেলে নেয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই সরকারের পক্ষ থেকে জামাত শিবিরকে দোষারোপ করা হয়েছে এবং মিডিয়াও এ সংবাদটি ঢালাওভাবে প্রচার করেছে। অথচ পরবর্তীতে যখন জাতীয় পার্টি (জাপা-এরশাদ) সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) এ কাদের খানকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো তখন বের হয়ে আসে আসল খুনির পরিচয়। 
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা জামায়াতকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপায় যার শিরোনাম ছিল ‘এবার ঘর পুড়ছে জামায়াতের’। এ খবরটি পরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকা ঢালাওভাবে ছাপায়। অথচ জামায়াতের পক্ষ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটিকে মিথ্যা খবর হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এ ধরনের অসংখ্য সংবাদ যাচাই বাছাই না করে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে যা ঠিক নয়।
কারো গোপন বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করে তাকে খাটো করা ইসলাম পছন্দ করে না। এক্ষেত্রে বরং ঐ ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করাই উত্তম। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন রাখল আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (বুখারি : ২/৮৬২ হা.২৩১০) 
তবে কারো দোষ যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় তখন তা উন্মুক্ত করে তার আসল চেহারা বের করা দরকার, যাতে সে আর মানুষের ক্ষতি না করতে পারে। আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা তাদের লেখনীতে বিরুদ্ধমতাদর্শের লোকদের শক্তভাবে তিরস্কার কিংবা চরিত্রহনন করেন, যা একেবারে কাম্য নয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেন না, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেন না, সে উপহাসকারীনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে, তারাই জালিম।’ (সূরা আল হুজুরাত: ১১)
খবরের সত্যতা যাচাইয়ের ব্যপারেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও সভ্যতাই মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে শিখায় না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না?’ কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘হে আল্লহর রাসুল! হ্যাঁ, অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া।’ এরপর হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসে রাসুল (সা.) বললেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা’- (বুখারি)। তাই সংবাদের তথ্য যাচাই ও সত্যতা নিরূপণ করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য।
ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ কিংবা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বিরোধী হওয়ায় অনেকে প্রাপ্ত তথ্য গোপন করে থাকে। শোনা যায়, নিউজ রুমে অনেক নিউজ ‘কিল’ করা হয়। এমনটি কিছুতেই কাম্য নয়। সত্য গোপন করাকে ইসলাম পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী’ - (সুরা বাকারা : ২৮৩)। 
প্রিয় নবী সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন; যে আমার কথা শুনে অতঃপর তা হুবহু ধারণ করে অবিকল অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়’- (তিরমিজি শরিফ)। এ কাজটি অনেক কঠিন। কারণ সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব যখনই যার বিপক্ষে গেছে বা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও এলিট শ্রেণির স্বার্থে আঘাত লেগেছ তখনই তাদের ওপর নেমে এসেছে বর্ণনীয় নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের জীবন দিয়েও প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছে। আর সংখ্যাটাও একেবারে নগণ্য নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যানুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ১১৭ জন গণমাধ্যম কর্মী নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলা ও নানাবিধ হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন ৩৭ জন, ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন ২১ জন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৯ জন। মামলার শিকার হয়েছেন ৯ জন। আর ২০১৫ সালে গোটা বিশ্বে ১১০ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কোনো শক্তির কাছে মাথা নত না করে ভয়শূন্য চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করাই ইসলামের দাবি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ’। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত মুয়াজ (রা.) বললেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, হে মুয়াজ, তুমি সত্য বলতেই থাকো, যদিও তা তিক্ত হয়।’ মূলত সত্য প্রকাশে আপসহীনতা একজন আদর্শ সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। সাংবাদিকরা নতজানু হয়ে কাজ করলে গণমাধ্যমের কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলাম সাংবাদিকের সত্য বলার অধিকার আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই ‘সত্য প্রকাশে আপসহীন’ এটিই হোক সাংবাদিক সমাজের স্লোগান আর এই স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তবেই সাংবাদিকরা সমাজের জাগ্রত বিবেকে পরিণত হতে পারবেন।




হোসাইন আনোয়ার 

রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনৈতিক হিংসার চক্রাকার ধারা

হারবার্ট ছবির একটি দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল হিন্দুদের কালীদেবী এবং সশস্ত্র কমিউনিস্ট-নকশালিস্ট চারু মজুমদারের সহাবস্থান। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র আন্দোলনে নিহত সুদীপ্তের মৃত্যুর ঘটনা দেখেও  অনেকের মনে হয়েছিল, এই কোলাজ কি কলকাতার বাঙালির মানস জগতের এক চিরায়ত প্যাকেজ? পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় এসব নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা লক্ষ্য করেছিলাম। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক হিংসার চক্রাকার ধারা দেখে এসব কথা মনে পড়ল। প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে কথায় কথায় জেলায় জেলায় খুনোখুনির খবর কাগজে দেখি। কলকাতায় ষাটের দশকে যা চরম আকারে হয়েছে, তা আজো হচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে ততই নাকি বাড়ে রাজনৈতিক হিংসা আর অন্য সময় চলতেই থাকে থেমে থেমে। রাজনীতির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হামলাও এসে যুক্ত হয়। বাংলাদেশে যেমন, পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের বাড়-বাড়ন্ত। কেন? বাঙালি কি হিংসাশ্রয়ী? অনেকের সঙ্গে আলাপে এ ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করেছি।
সমস্যাটির উত্তর এক কথায় পাওয়া যায় নি। কেউ উদাহরণ দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন বড় আকারের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। একটি উদাহরণ এমন: বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বিজেপি সরকারের মন্ত্রীসভায় লালকৃষ্ণ আদভানী তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে জাতপাতের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি, পশ্চিমবঙ্গে তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে স্বাভাবিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু এত বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই একই কথা বলছে। আজো রাজনৈতিক হিংসার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ফার্স্ট বয়; কলকাতাই সেরা! এখানে হিংসা মানে  কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সুসংহত এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ণ বা আংশিক ‘রেনেসাঁ নগরী’তে কেন এত হিংসা? রাজনৈতিক উন্মত্ততা? অসহিষ্ণু পুলিশ? বিতর্কিত লেখক নীরদ চৌধুরী একদা বলেছিলেন, “বাঙালি বৈষ্ণব নয়, আসলে শাক্ত”। বলাই বাহুল্য, শাক্ত বা কালীর উপাসনাকারী হিসাবে তিনি বিলক্ষণ বাঙালি হিন্দুদেরই বুঝিয়েছেন এবং সেটাও গান্ধির সঙ্গে সুভাষ বসুর সংঘাতের প্রেক্ষাপটকে দেখানোর প্রয়োজনে। সেসব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কথা। তখনকার সচিবালয় বা রাইটার্স বিল্ডিং বা আজকের ‘মহাকরণ’-এ গিয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণ ঐতিহাসিকভাবে নগর স্মারকে পরিণত করা হয়েছে পাশেই ধর্মতলায় তিন বীরের মূর্তি বানানোর মাধ্যমে। জায়গাটির নামও হয়েছে বীরত্রয়ীর নামে ‘বি-বা-দী বাগ’। কলকাতায় গিয়ে এক্সপ্লানেড ও ডালহৌসি স্কোয়ারের পাশে মূর্তিমান পরিস্থিতি সকলেরই চোখে পড়বে।
অতএব সেইসব অনুপ্রেরণা নগর-জীবন থেকে মুছে যাওয়ার বিষয় নয়। হাল আমলে তেজস্বী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঙ্কার থেকে, কমিউনিস্ট বিরোধী লড়াই, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন, কলকাতার সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা মানেই আবশ্যিকভাবেই ‘সহিংস আন্দোলন’। সুদীর্ঘ বাম শাসনাধীন কলকাতার রাজনৈতিক সহিংসতা প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় এক মার্কসবাদী রাজনীতি বিজ্ঞানী হারবার্ট আপতেকার’কে, যিনি বলেছিলেন, “হিংসা হল একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে ভাল লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়। আবার অন্তিম বা লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাই যখন হিংসার ফসল, তখন সেই হিংসার মোকাবিলা করতেও পাল্টা হিংসার আমদানি হয়। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে হিংসা, যাকে বলা যায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও এক বিপরীতমুখী ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।” পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত এমনই এক সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স সার্কেল বা চক্রের আবর্তে আটকে গেছে।
অথচ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু সামাজিক বা সঙ্ঘজীবনে আত্মস্বার্থরক্ষা বাঙালির কাছে যতই বড় হয়ে ওঠে, পরমতসহিষ্ণুতা ততই কমে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাবনা অনুসারে আত্মপরিচয়ের আধিপত্য কায়েমের জন্য অন্য মত বা অন্য পরিচয়ের প্রতি আস্থা না রাখাই হিংসার উৎস। আর তাই বাঙালি হয় হিন্দু নয় মুসলিম, হয় বাঙাল নয় ঘঁটি, হয় ইস্টবেঙ্গল নয় মোহামেডান নচেৎ মোহনবাগান, হয় কাবাব নয় চিংড়ি কিংবা ইলিশ, হয় তৃণমূল নয় সিপিএম। ঠিক এমন একটা কালো বা সাদার দ্বৈততায় চরমভাবে আক্রান্ত। উগ্রতার পাশে মধ্যপন্থা বলে আসলেই কিছু একটা আছে বলে কোনো প্রজাতির বাঙালিরই রাজনৈতিক জীবনে মনে করা হয় না। অথচ অভিধানের ভাষায় দ্বৈততা মানেই দ্বৈরথ নয়। ভাত বনাম রুটি না ভেবে, ভাত এবং রুটি মর্মেও যে একত্রে ভাবনার সুযোগ আছে, তা উন্মত্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে কেউই স্বীকার করতে চায় না।
১৯৪৭ সালের পর দুই বাংলার ইতিহাস ভিন্ন খাতে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ রাজের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কাহিনী প্রায় আড়াই শতকের ইতিবৃত্ত। সঙ্গে ভারতের অধীনে আরো ৭০ বছর। এই বাঙালির মনোজগতের আর সমাজ বিন্যাসের কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, “বঙ্গসমাজে প্রাধান্যকারী সংস্কৃতিই মূলধারার সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে আর মূলস্রোতই চাপা পড়ে হয়ে গিয়েছে প্রান্তিক। বাংলার গ্রামীণ মধ্য শ্রেণী ও নাগরিক মধ্য শ্রেণীও বহু ভাবে একত্রীভূত হয়েছে সংস্কৃতির বাঙালি ধারায়।” এভাবেই কলকাতাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর ভারতের কাঠামোয় গড়ে ওঠেছে কলকাতার বাঙালি মানস।
বিনয় ঘোষ আরো বলেছিলেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নতুন জমিদার শ্রেণীর অধীনে মধ্যস্বত্ব ভোগীর উদ্ভব হয়।” বহু বছর পর যখন বামফ্রন্ট জমানায় ‘কেরানি কমিউনিজম’-এর উদ্ভব হল, তখনো মনে করা হল সেই প্রবাহই বয়ে চলেছে। কিন্তু সেই আপাত নিরীহ বাবু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যেও আছে আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি। আর পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। বহু ক্ষেত্রে সেই লড়াইয়ে যতটা যুথবদ্ধতা দেখা যায়, তা আপাতদৃশ্য। আসলে বহু ক্ষেত্রেই তাতে আছে নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা এবং ক্ষমতার লালসা।
সুদীর্ঘ বাম জমানায় যে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলায় জেলায়, সেই সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার। শুরু হয় ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন। একে বলা যায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, এখনো যা বহাল হয়ে সহিংসতাকেই পুষ্টি যোগাচ্ছে সমাজ ও রাজনীতির সর্বস্তরে। রূপ নিচ্ছে কখনো রাজনৈতিক কিংবা কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়।
পশ্চিমবঙ্গে একদা শাসক কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলনে মুখর হয়েছিলেন। সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল পুলিশের দমননীতির বিরুদ্ধে পাল্টা-হিংসাও। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের পর দেখা গেল মমতার জঙ্গি আন্দোলন। কেশপুর-গড়বেতা থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে হিংসা এসেছে বার বার। এমনকী, রাজ্যে যে দলটি দুর্বল সেই বিজেপি-র রাজ্য শাখাও বন্‌ধ-হরতাল, এমনকী, বাস পুড়িয়ে সফল আন্দোলনের দাবিদার সেজেছে; সাম্প্রদায়িকতাকে নতুনভাবে পুষ্টি যোগাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজ্য থেকে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেওয়ার দাবিতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্দোলনও সহিংস রূপ ধারণ করে। সেনাবাহিনী নামিয়ে তবেই সেটা থামানো হয়েছিল।
জঙ্গি ইমেজের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো করে তুলেছে। ব্রিটিশ পুঁজি প্রথমে বিদায় নিয়েছে। ‘ফ্লাইট অফ ক্যাপিটাল’, সেখান থেকে সিঙ্গুরে টাটার বিদায়, রাজ্যে এক দিকে রাজনৈতিক হিংসা, অন্য দিকে শিল্প ও বাণিজ্যের বিদায়। এই হলো হিংসার রাজনীতির প্রাথমিক ফলাফল।
ইতিহাস বলছে, বঙ্গ সংস্কৃতিবাদ মানেই কালীর আরাধনা করে সশস্ত্র হওয়া নয়; আবার সকলের মিশে যাওয়াও নয়। একটা মুক্তির পথের কথা অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘প্লুরাল মোনোকালচারালিজম’ (বহু-এক-সংস্কৃতিবাদ)। বিভিন্ন সংস্কৃতি যখন রাতের অন্ধকারে জাহাজের মতো পরস্পরের পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তখন তারা এক জায়গায় বসবাস করলেও তা বহু সংস্কৃতিবাদের সার্থক নিদর্শন নয়।
ফলে বিভক্তিতে পূর্ণ নিজস্ব পরিচয়বোধের এই ক্ষুদ্রায়ন পশ্চিমবঙ্গকে আরো হিংসার পথে ঠেলে দিয়েছে। ‘বিশ্বাসকে যোগে যেথায় বিহারো’, অধুনা তা শুধু একটা গানের লাইন মাত্র; সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব কাঠামোতে অর্থহীন।
এ কথা সত্য, যেকোনো গোষ্ঠীজীবনে সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি ইত্যাদি নানা ভাবে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এই সব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়; তৈরি হয় ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’র বলয়। এই মনোভাবের মধ্যেই আছে হিংসার সবচেয়ে বড় ও জ্বলন্ত উৎস‌। এখানে সিপিএম, তৃণমূল একাকার। বামপন্থীরাও হিংসাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছেন। আজ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন বটে, কিন্তু সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। দল ও আদর্শের বাইরে হিংসার জ্বলন্ত অগ্নিকু-টিই সকল কিছুর উৎসস্থল হয়ে থেকেই যাচ্ছে। 
হিংসার বিরুদ্ধে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের আওয়াজ ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সকলের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের আওয়াজও অর্থপূর্ণ হয় না। কারণ, যে প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে এই হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে, সেটাই প্রকৃত অবয়বে আবির্ভূত হয় না বহুবিধ মতাদর্শিক ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার কারণে। মানুষের মনে, সমাজের সাংস্কৃতিক পাটাতনে, রাজনীতির কাঠামোতে নোংরা লেপ্টে থাকলে সেটা দুর্গন্ধে ও কুশ্রীতে প্রকাশিত হবেই। হিংসার রাজনীতি হলো সেই নোংরা, যা ললাট লিপির মতোই অমোচনীয় হয়ে পুরো ব্যবস্থার চেহারা জুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পোষণকারী দুর্বল ও সংখ্যালঘুরা আইন ও সুশাসনের আওতায় প্রাপ্ত সুরক্ষায় নয়, পৌনঃপুনিক শাসিত হচ্ছে সন্ত্রাসের অধীনে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের এই হলো চক্রাকার-নিয়তি।

শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এখন নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই

অনেকগুলো টপিক জমা হয়ে আছে। কোনটা লিখব? এসব ভাবতে ভাবতে সামনে এসে গেল নতুন নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন গঠনের ঘোষণা হতে কি না হতেই শুরু হয়েছে বিতর্ক, কমিশন নিয়ে বিতর্ক, চীফ ইলেকশন কমিশনার নূরুল হুদাকে নিয়ে বিতর্ক। মঙ্গলবার থেকেই বিতর্কটি চলছিল। বুধবার সেটি প্রকাশ্যে চলে আসে। বুধবার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০ দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ২০ দলের মতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রীর মতামতেরই প্রতিফলন ঘটেছে। বিতর্কিত একজন সাবেক কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না। তাই কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকেও বলা যায় যে, অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম বাছাই করবে তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। তাদের জীবনবৃত্তান্ত, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেটা না করে অবিশ্বাস্য এবং রূদ্ধশ্বাস দ্রুততার সঙ্গে কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই তাড়াহুড়ো, এই লুকোচুরি একরাশ সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এখন আর এটি বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না যে, এসব নাম আগেই ঠিক করা ছিল। বাছাই কমিটি গঠন, বিভিন্ন দলের সাথে বৈঠক, নাগরিক সমাজের ১৬ জনের সাথে বৈঠক, ১০ জনের নাম বাছাইÑ সবই ছিল সাজানো নাটক। কে চীফ ইলেকশন কমিশনার হবেন, কারা কমিশন সদস্য হবেন, সেগুলো সবই ছিল সরকারের মনের মধ্যে। তাই বাছাই কমিটির সাথে সন্ধ্যায় বৈঠকের সাথে সাথেই আস্তিনের ভেতর থেকে ৫টি নাম বের করা হয় এবং সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়।
নূরুল হুদা যখন যুগ্ম সচিব ছিলেন তখনই তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় বিএনপি সরকার। এরপর হাইকোর্ট বা সুপ্রীম কোর্ট নয়, আওয়ামী সরকার গঠিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। তাকে যুগ্মসচিব থেকে সচিব পদে পুনর্বহাল করা হয়। মাঝখানে অতিরিক্ত সচিব পদটি ডিঙিয়ে যাওয়া হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে তিনি একদিনও কাজ করেননি। সচিব পদে পুনর্বহাল করে সাথে সাথেই তাকে অবসর দেয়া হয়। সুতরাং চাকরি জীবনে তার অভিজ্ঞতা ঐ যুগ্ম সচিব পর্যন্তই। এসব ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও সব গুরুতর অভিযোগ আছে। তিনি যখন কুমিল্লার ডিসি ছিলেন তখন তিনি নাকি তার অফিস থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি নামিয়ে ফেলেন। তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং নূরুল হুদাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নূরুল হুদা সব সময় বিএনপি তথা ২০ দল বিরোধী লোক এবং আওয়ামী লীগের খাস লোক। সুতরাং নূরুল হুদা কমিশন যে আরেকটি রকিব কমিশন হবে তার আলামত এখনই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে।
এখানে আরো কয়েকটি বিষয় সন্দেহকে ঘনীভূত করে। বাছাই কমিটির সাথে প্রেসিডেন্টের মিটিং এবং কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি- মাঝখানে সময় ছিল মাত্র দু’ঘণ্টা। এই দুই ঘণ্টায় বাছাই কমিটির ১০ জন সদস্যের জীবনবৃত্তান্ত পড়া এবং তাদের খোঁজ-খবর নেয়া ও মূল্যায়ন করতেই তো ২৪ ঘণ্টা লেগে যাওয়ার কথা। সেখানে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে এসব যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করার অর্থই হলো, সব কিছুই আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। নাহলে কেন এই তাড়াহুড়ো? আরো কথা আছে। নূরুল হুদা, রফিকুল ইসলাম এবং ব্রিগেডিয়ার শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর নাম কে বা কারা প্রস্তাব করেছিলেন? কোত্থেকে এলো এই তিনটি নাম? তরীকত ফেডারেশন নামক একটি স্বল্প পরিচিত দল নাকি এসব নাম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র মত দল, যারা বছরের পর বছর সরকার চালিয়েছে, তাদের হাত দিয়ে এসব নাম এলো না, আর এলো তরীকত ফেডারেশন নামক একটি দলের মাধ্যমে, যাদের কোনোদিন একটি ইউনিয়ন পরিষদ চালানোরও অভিজ্ঞতা নাই, তাদের হাত দিয়ে এলো এই তিনটি নাম এবং সেসব নাম প্রেসিডেন্ট গ্রহণও করলেন, সে কথাই কি আজ বিশ্বাস করতে হবে? নাকি নিজেরা না দিয়ে অন্যের হাত দিয়ে এসব নাম টেবিলে আনা হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে?
॥ দুই ॥
কথা ছিল, সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি তাদের বাছাই করা ১০ জনের নাম পূর্বাহ্নে জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন তাহলে বোঝা যাবে, এরা কারা, এদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা এবং এদের সততা ও নৈতিকতা অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল কিনা? সেটি করা হলে সমগ্র বিষয়টি স্বচ্ছ থাকত। এরপর প্রেসিডেন্ট যখন ঐ ১০ জনের ভেতর থেকে ৫ জনের নাম চূড়ান্ত করতেন তখন আর কারো কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকত না। কিন্তু এবার সেটি করা হল না। বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন যে, চাঁদ উঠলেই সকলে দেখতে পাবেন। তাই নাম প্রকাশের কোনো দরকার নাই। তার কথাই বর্ণে বর্ণে মেনে নেয়া হলো। অন্য কমিশনারদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কবিতা খানম, ব্রি: জে: শাহাদৎ হোসেন এবং রফিকুল ইসলাম কঠিন আওয়ামী লীগার। মাহবুব তালুকদারের নাম যদিও নাকি বিএনপি দিয়েছে, তবুও বিএনপি কোন বিবেচনায় এই নামটি দিয়েছে সেটি মোটেই আমার বোধগম্য নয়। তিনি বাংলার ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের একজন এ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। চাকরি জীবনেও আওয়ামীপন্থী আমলা ছিলেন। তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে যান। তাকে সচিব না করায় তার ক্ষোভ ছিল। এজন্য অবসর পরবর্তী জীবনে তিনি আওয়ামী সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই ক্ষুব্ধতা তার আওয়ামীপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটায়নি।
এখন প্রশ্ন হলো অন্যত্র। বিএনপি আওয়ামী সরকারের নিকট থেকে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আশা করেছিল কিভাবে? একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের জন্য তারা প্রেসিডেন্টের ওপর অনেকখানি ভরসা করেছিল। কেন এমন ভরসা তারা করে তার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা ভুলে যায় কিভাবে যে, জনাব আব্দুল হামিদ কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কয়েকদশক ধরে। তিনি শেখ মুজিবের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মী ছিলেন। কিশোরগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনাই তাকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার বানান। শেখ হাসিনাই তাকে জাতীয় সংসদের স্পিকারও বানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বানান। এমন একটি পটভূমি এবং পরিস্থিতিতে বিএনপি কেমন করে আশা করে যে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ এমন একটি নির্বাচন কমিশন বানাবেন যেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দসই হবে না? বিএনপি তথা বিরোধী দলকে ভুললে চলবে না যে, ৭০ বছরের বেশি বয়স- এই ধুয়া তুলে সাবেক সচিব জনাব আসাফউদ্দৌলাকে বাতিল করা হয়েছে। তাহলে ৭৬ বছর বয়সী মাহবুব তালুকদারকে কমিশনার করা হলো কোন যুক্তিতে? একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য বিএনপি অনেক এনার্জি খরচ করেছে। দুই মাস ধরে তাদের প-িতরা পড়াশোনা ও গবেষণা করে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছে এবং জনগণের মাঝে সেটি প্রকাশও করেছে। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিগত ৬ দশক ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন তারা তখনই ভেবেছিলেন যে, বিএনপি এসব রিসার্চ ও ব্রেন স্টর্মিং সবই অরণ্যেরোদন। আওয়ামী লীগ কোন্ ধরনের ইলেকশন কমিশনার বানাবে সেটি তারা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিল। অনেকটা সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত। শিশু তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মা আমি কোথায় ছিলেম? কিভাবে এলেম আমি?’ মা বলছেন, ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি তুই মনের মাঝারে।’ তেমনি নূরুল হুদা কমিশনও ইচ্ছে হয়েছিল সরকারের মনের মাঝারে। বাছাই কমিটির মাধ্যমে সেটির প্রসব হয়েছে মাত্র। সেই কমিশন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, তেমন আশা যদি কেউ এখনও পোষণ করে থাকেন তাহলে বলতে হবে, ‘ধন্য আশা কুহকীনি।’
॥ তিন ॥
আবার একটি রকিব কমিশন গঠিত হলো। বিএনপি এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তাতে কি লাভ? একটি প্রেস কনফারেন্স করে প্রত্যাখ্যান করলেই কি ঐ কমিশন বাতিল হয়ে যাবে? সকলেই জানেন, বাতিল হবে না। হুদা কমিশন বাতিল করতে হলে প্রয়োজন হবে প্রবল গণআন্দোলনের। বিএনপি আমলে বিচারপতি এমএ সাত্তারকে চীফ ইলেকশন কমিশনার করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেই কমিশন কাজ করতে পারেনি। প্রবল গণআন্দোলনের ফলে ঐ কমিশন বাতিল হয়েছিল। এসেছিল এটিএম শামসুল হুদা কমিশন। সেই ধরনের গণআন্দোলন কি বিএনপি করতে পারবে? গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে বিএনপি’র সামনে তথা সমস্ত বিরোধী দলের সামনে আর কোনো অপশন কি খোলা আছে?
॥ চার ॥
ইতোমধ্যেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং পত্র-পত্রিকায় বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বিশিষ্টজনরা বলছেন যে, আগামী নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে হলে সেটি অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। সেই সরকারকে আপনি যে নামেই ডাকুন না কেন, সেটি কেয়ারটেকার সরকার হতে পারে বা অন্য যে কোনো নামের সরকার হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকার হতে পারবে না। তাদের মতে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারই বিজয়ী হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে, বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের অধীনে গঠিত সমস্ত নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। হুদা কমিশন নামে যে আওয়ামী কমিশন গঠিত হলো তার ফলে আগামী নির্বাচনে ঐ কমিশন নয়, সরকারের ভূমিকাই মুখ্য হবে। রকিব কমিশন সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাকেই নষ্ট করে গেছে। নষ্ট করার এই প্রক্রিয়ায় সরকারের মদত ছিল এবারও তেমন একটি কমিশনই গঠিত হলো এবং এই সরকারই সেটি গঠন করলো। নতুন সিইসি হুদা বলেছেন, তিনি কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। প্রশ্ন হলো, এই চাপ তাকে কে দেবে?  নিশ্চয়ই বিরোধী দল নয়। কারণ চাপ দেয়ার মতো ক্ষমতা কি তাদের আছে? তারা তো বড়জোর কোনো ইস্যু বা দাবি নিয়ে কমিশনের কাছে যাবেন এবং একটি দাবিনামা বা স্মারকলিপি পেশ করবেন। এর বেশি কিছু তারা কি করবেন? চাপ এলে সিটি আসবে সরকারী দল থেকে। অতীতেও, বিশেষ করে আওয়ামী আমলে চাপ এসেছে সরকারী দল থেকে। এসব চাপের কাছে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করেছিল রকিব কমিশন। নতি স্বীকার করে তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ে ইউপি নির্বাচন-প্রতিটি স্তরে ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, সহিংসতা, হত্যা, খুন জখম, এসব অপকর্মের ফলে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনই নয়, সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থার ওপরেই জনগণের অনাস্থা জন্মেছে।
হুদা কমিশনের প্রধান কাজ হবে, এই বিশাল অনাস্থা দূর করা এবং জনগণের আস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনা। প্রো-গভর্নমেন্ট ইলেকশন কমিশন দিয়ে সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এটি ফিরিয়ে আনতে হবে সরকারকে। এই সরকার সেই কাজটি করবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সেটি করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে বিরোধী দলকে। জনগণকে সাথে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, হুদা কমিশন গঠনের পর সেই আন্দোলনের আর কোন বিকল্প পথ সরকার খোলা রাখলো না।

Ads