হারবার্ট ছবির একটি দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল হিন্দুদের কালীদেবী এবং সশস্ত্র কমিউনিস্ট-নকশালিস্ট চারু মজুমদারের সহাবস্থান। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র আন্দোলনে নিহত সুদীপ্তের মৃত্যুর ঘটনা দেখেও অনেকের মনে হয়েছিল, এই কোলাজ কি কলকাতার বাঙালির মানস জগতের এক চিরায়ত প্যাকেজ? পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় এসব নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা লক্ষ্য করেছিলাম। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক হিংসার চক্রাকার ধারা দেখে এসব কথা মনে পড়ল। প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে কথায় কথায় জেলায় জেলায় খুনোখুনির খবর কাগজে দেখি। কলকাতায় ষাটের দশকে যা চরম আকারে হয়েছে, তা আজো হচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে ততই নাকি বাড়ে রাজনৈতিক হিংসা আর অন্য সময় চলতেই থাকে থেমে থেমে। রাজনীতির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হামলাও এসে যুক্ত হয়। বাংলাদেশে যেমন, পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের বাড়-বাড়ন্ত। কেন? বাঙালি কি হিংসাশ্রয়ী? অনেকের সঙ্গে আলাপে এ ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করেছি।
সমস্যাটির উত্তর এক কথায় পাওয়া যায় নি। কেউ উদাহরণ দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন বড় আকারের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। একটি উদাহরণ এমন: বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বিজেপি সরকারের মন্ত্রীসভায় লালকৃষ্ণ আদভানী তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে জাতপাতের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি, পশ্চিমবঙ্গে তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে স্বাভাবিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু এত বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই একই কথা বলছে। আজো রাজনৈতিক হিংসার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ফার্স্ট বয়; কলকাতাই সেরা! এখানে হিংসা মানে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সুসংহত এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ণ বা আংশিক ‘রেনেসাঁ নগরী’তে কেন এত হিংসা? রাজনৈতিক উন্মত্ততা? অসহিষ্ণু পুলিশ? বিতর্কিত লেখক নীরদ চৌধুরী একদা বলেছিলেন, “বাঙালি বৈষ্ণব নয়, আসলে শাক্ত”। বলাই বাহুল্য, শাক্ত বা কালীর উপাসনাকারী হিসাবে তিনি বিলক্ষণ বাঙালি হিন্দুদেরই বুঝিয়েছেন এবং সেটাও গান্ধির সঙ্গে সুভাষ বসুর সংঘাতের প্রেক্ষাপটকে দেখানোর প্রয়োজনে। সেসব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কথা। তখনকার সচিবালয় বা রাইটার্স বিল্ডিং বা আজকের ‘মহাকরণ’-এ গিয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণ ঐতিহাসিকভাবে নগর স্মারকে পরিণত করা হয়েছে পাশেই ধর্মতলায় তিন বীরের মূর্তি বানানোর মাধ্যমে। জায়গাটির নামও হয়েছে বীরত্রয়ীর নামে ‘বি-বা-দী বাগ’। কলকাতায় গিয়ে এক্সপ্লানেড ও ডালহৌসি স্কোয়ারের পাশে মূর্তিমান পরিস্থিতি সকলেরই চোখে পড়বে।
অতএব সেইসব অনুপ্রেরণা নগর-জীবন থেকে মুছে যাওয়ার বিষয় নয়। হাল আমলে তেজস্বী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঙ্কার থেকে, কমিউনিস্ট বিরোধী লড়াই, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন, কলকাতার সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা মানেই আবশ্যিকভাবেই ‘সহিংস আন্দোলন’। সুদীর্ঘ বাম শাসনাধীন কলকাতার রাজনৈতিক সহিংসতা প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় এক মার্কসবাদী রাজনীতি বিজ্ঞানী হারবার্ট আপতেকার’কে, যিনি বলেছিলেন, “হিংসা হল একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে ভাল লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়। আবার অন্তিম বা লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাই যখন হিংসার ফসল, তখন সেই হিংসার মোকাবিলা করতেও পাল্টা হিংসার আমদানি হয়। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে হিংসা, যাকে বলা যায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও এক বিপরীতমুখী ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।” পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত এমনই এক সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স সার্কেল বা চক্রের আবর্তে আটকে গেছে।
অথচ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু সামাজিক বা সঙ্ঘজীবনে আত্মস্বার্থরক্ষা বাঙালির কাছে যতই বড় হয়ে ওঠে, পরমতসহিষ্ণুতা ততই কমে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাবনা অনুসারে আত্মপরিচয়ের আধিপত্য কায়েমের জন্য অন্য মত বা অন্য পরিচয়ের প্রতি আস্থা না রাখাই হিংসার উৎস। আর তাই বাঙালি হয় হিন্দু নয় মুসলিম, হয় বাঙাল নয় ঘঁটি, হয় ইস্টবেঙ্গল নয় মোহামেডান নচেৎ মোহনবাগান, হয় কাবাব নয় চিংড়ি কিংবা ইলিশ, হয় তৃণমূল নয় সিপিএম। ঠিক এমন একটা কালো বা সাদার দ্বৈততায় চরমভাবে আক্রান্ত। উগ্রতার পাশে মধ্যপন্থা বলে আসলেই কিছু একটা আছে বলে কোনো প্রজাতির বাঙালিরই রাজনৈতিক জীবনে মনে করা হয় না। অথচ অভিধানের ভাষায় দ্বৈততা মানেই দ্বৈরথ নয়। ভাত বনাম রুটি না ভেবে, ভাত এবং রুটি মর্মেও যে একত্রে ভাবনার সুযোগ আছে, তা উন্মত্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে কেউই স্বীকার করতে চায় না।
১৯৪৭ সালের পর দুই বাংলার ইতিহাস ভিন্ন খাতে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ রাজের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কাহিনী প্রায় আড়াই শতকের ইতিবৃত্ত। সঙ্গে ভারতের অধীনে আরো ৭০ বছর। এই বাঙালির মনোজগতের আর সমাজ বিন্যাসের কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, “বঙ্গসমাজে প্রাধান্যকারী সংস্কৃতিই মূলধারার সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে আর মূলস্রোতই চাপা পড়ে হয়ে গিয়েছে প্রান্তিক। বাংলার গ্রামীণ মধ্য শ্রেণী ও নাগরিক মধ্য শ্রেণীও বহু ভাবে একত্রীভূত হয়েছে সংস্কৃতির বাঙালি ধারায়।” এভাবেই কলকাতাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর ভারতের কাঠামোয় গড়ে ওঠেছে কলকাতার বাঙালি মানস।
বিনয় ঘোষ আরো বলেছিলেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নতুন জমিদার শ্রেণীর অধীনে মধ্যস্বত্ব ভোগীর উদ্ভব হয়।” বহু বছর পর যখন বামফ্রন্ট জমানায় ‘কেরানি কমিউনিজম’-এর উদ্ভব হল, তখনো মনে করা হল সেই প্রবাহই বয়ে চলেছে। কিন্তু সেই আপাত নিরীহ বাবু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যেও আছে আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি। আর পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। বহু ক্ষেত্রে সেই লড়াইয়ে যতটা যুথবদ্ধতা দেখা যায়, তা আপাতদৃশ্য। আসলে বহু ক্ষেত্রেই তাতে আছে নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা এবং ক্ষমতার লালসা।
সুদীর্ঘ বাম জমানায় যে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলায় জেলায়, সেই সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার। শুরু হয় ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন। একে বলা যায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, এখনো যা বহাল হয়ে সহিংসতাকেই পুষ্টি যোগাচ্ছে সমাজ ও রাজনীতির সর্বস্তরে। রূপ নিচ্ছে কখনো রাজনৈতিক কিংবা কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়।
পশ্চিমবঙ্গে একদা শাসক কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলনে মুখর হয়েছিলেন। সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল পুলিশের দমননীতির বিরুদ্ধে পাল্টা-হিংসাও। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের পর দেখা গেল মমতার জঙ্গি আন্দোলন। কেশপুর-গড়বেতা থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে হিংসা এসেছে বার বার। এমনকী, রাজ্যে যে দলটি দুর্বল সেই বিজেপি-র রাজ্য শাখাও বন্ধ-হরতাল, এমনকী, বাস পুড়িয়ে সফল আন্দোলনের দাবিদার সেজেছে; সাম্প্রদায়িকতাকে নতুনভাবে পুষ্টি যোগাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজ্য থেকে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেওয়ার দাবিতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্দোলনও সহিংস রূপ ধারণ করে। সেনাবাহিনী নামিয়ে তবেই সেটা থামানো হয়েছিল।
জঙ্গি ইমেজের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো করে তুলেছে। ব্রিটিশ পুঁজি প্রথমে বিদায় নিয়েছে। ‘ফ্লাইট অফ ক্যাপিটাল’, সেখান থেকে সিঙ্গুরে টাটার বিদায়, রাজ্যে এক দিকে রাজনৈতিক হিংসা, অন্য দিকে শিল্প ও বাণিজ্যের বিদায়। এই হলো হিংসার রাজনীতির প্রাথমিক ফলাফল।
ইতিহাস বলছে, বঙ্গ সংস্কৃতিবাদ মানেই কালীর আরাধনা করে সশস্ত্র হওয়া নয়; আবার সকলের মিশে যাওয়াও নয়। একটা মুক্তির পথের কথা অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘প্লুরাল মোনোকালচারালিজম’ (বহু-এক-সংস্কৃতিবাদ)। বিভিন্ন সংস্কৃতি যখন রাতের অন্ধকারে জাহাজের মতো পরস্পরের পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তখন তারা এক জায়গায় বসবাস করলেও তা বহু সংস্কৃতিবাদের সার্থক নিদর্শন নয়।
ফলে বিভক্তিতে পূর্ণ নিজস্ব পরিচয়বোধের এই ক্ষুদ্রায়ন পশ্চিমবঙ্গকে আরো হিংসার পথে ঠেলে দিয়েছে। ‘বিশ্বাসকে যোগে যেথায় বিহারো’, অধুনা তা শুধু একটা গানের লাইন মাত্র; সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব কাঠামোতে অর্থহীন।
এ কথা সত্য, যেকোনো গোষ্ঠীজীবনে সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি ইত্যাদি নানা ভাবে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এই সব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়; তৈরি হয় ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’র বলয়। এই মনোভাবের মধ্যেই আছে হিংসার সবচেয়ে বড় ও জ্বলন্ত উৎস। এখানে সিপিএম, তৃণমূল একাকার। বামপন্থীরাও হিংসাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছেন। আজ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন বটে, কিন্তু সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। দল ও আদর্শের বাইরে হিংসার জ্বলন্ত অগ্নিকু-টিই সকল কিছুর উৎসস্থল হয়ে থেকেই যাচ্ছে।
হিংসার বিরুদ্ধে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের আওয়াজ ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সকলের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের আওয়াজও অর্থপূর্ণ হয় না। কারণ, যে প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে এই হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে, সেটাই প্রকৃত অবয়বে আবির্ভূত হয় না বহুবিধ মতাদর্শিক ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার কারণে। মানুষের মনে, সমাজের সাংস্কৃতিক পাটাতনে, রাজনীতির কাঠামোতে নোংরা লেপ্টে থাকলে সেটা দুর্গন্ধে ও কুশ্রীতে প্রকাশিত হবেই। হিংসার রাজনীতি হলো সেই নোংরা, যা ললাট লিপির মতোই অমোচনীয় হয়ে পুরো ব্যবস্থার চেহারা জুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পোষণকারী দুর্বল ও সংখ্যালঘুরা আইন ও সুশাসনের আওতায় প্রাপ্ত সুরক্ষায় নয়, পৌনঃপুনিক শাসিত হচ্ছে সন্ত্রাসের অধীনে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের এই হলো চক্রাকার-নিয়তি।
সমস্যাটির উত্তর এক কথায় পাওয়া যায় নি। কেউ উদাহরণ দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন বড় আকারের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। একটি উদাহরণ এমন: বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বিজেপি সরকারের মন্ত্রীসভায় লালকৃষ্ণ আদভানী তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে জাতপাতের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি, পশ্চিমবঙ্গে তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে স্বাভাবিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু এত বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই একই কথা বলছে। আজো রাজনৈতিক হিংসার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ফার্স্ট বয়; কলকাতাই সেরা! এখানে হিংসা মানে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সুসংহত এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ণ বা আংশিক ‘রেনেসাঁ নগরী’তে কেন এত হিংসা? রাজনৈতিক উন্মত্ততা? অসহিষ্ণু পুলিশ? বিতর্কিত লেখক নীরদ চৌধুরী একদা বলেছিলেন, “বাঙালি বৈষ্ণব নয়, আসলে শাক্ত”। বলাই বাহুল্য, শাক্ত বা কালীর উপাসনাকারী হিসাবে তিনি বিলক্ষণ বাঙালি হিন্দুদেরই বুঝিয়েছেন এবং সেটাও গান্ধির সঙ্গে সুভাষ বসুর সংঘাতের প্রেক্ষাপটকে দেখানোর প্রয়োজনে। সেসব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কথা। তখনকার সচিবালয় বা রাইটার্স বিল্ডিং বা আজকের ‘মহাকরণ’-এ গিয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণ ঐতিহাসিকভাবে নগর স্মারকে পরিণত করা হয়েছে পাশেই ধর্মতলায় তিন বীরের মূর্তি বানানোর মাধ্যমে। জায়গাটির নামও হয়েছে বীরত্রয়ীর নামে ‘বি-বা-দী বাগ’। কলকাতায় গিয়ে এক্সপ্লানেড ও ডালহৌসি স্কোয়ারের পাশে মূর্তিমান পরিস্থিতি সকলেরই চোখে পড়বে।
অতএব সেইসব অনুপ্রেরণা নগর-জীবন থেকে মুছে যাওয়ার বিষয় নয়। হাল আমলে তেজস্বী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঙ্কার থেকে, কমিউনিস্ট বিরোধী লড়াই, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন, কলকাতার সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা মানেই আবশ্যিকভাবেই ‘সহিংস আন্দোলন’। সুদীর্ঘ বাম শাসনাধীন কলকাতার রাজনৈতিক সহিংসতা প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় এক মার্কসবাদী রাজনীতি বিজ্ঞানী হারবার্ট আপতেকার’কে, যিনি বলেছিলেন, “হিংসা হল একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে ভাল লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়। আবার অন্তিম বা লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাই যখন হিংসার ফসল, তখন সেই হিংসার মোকাবিলা করতেও পাল্টা হিংসার আমদানি হয়। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে হিংসা, যাকে বলা যায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও এক বিপরীতমুখী ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।” পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত এমনই এক সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স সার্কেল বা চক্রের আবর্তে আটকে গেছে।
অথচ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু সামাজিক বা সঙ্ঘজীবনে আত্মস্বার্থরক্ষা বাঙালির কাছে যতই বড় হয়ে ওঠে, পরমতসহিষ্ণুতা ততই কমে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাবনা অনুসারে আত্মপরিচয়ের আধিপত্য কায়েমের জন্য অন্য মত বা অন্য পরিচয়ের প্রতি আস্থা না রাখাই হিংসার উৎস। আর তাই বাঙালি হয় হিন্দু নয় মুসলিম, হয় বাঙাল নয় ঘঁটি, হয় ইস্টবেঙ্গল নয় মোহামেডান নচেৎ মোহনবাগান, হয় কাবাব নয় চিংড়ি কিংবা ইলিশ, হয় তৃণমূল নয় সিপিএম। ঠিক এমন একটা কালো বা সাদার দ্বৈততায় চরমভাবে আক্রান্ত। উগ্রতার পাশে মধ্যপন্থা বলে আসলেই কিছু একটা আছে বলে কোনো প্রজাতির বাঙালিরই রাজনৈতিক জীবনে মনে করা হয় না। অথচ অভিধানের ভাষায় দ্বৈততা মানেই দ্বৈরথ নয়। ভাত বনাম রুটি না ভেবে, ভাত এবং রুটি মর্মেও যে একত্রে ভাবনার সুযোগ আছে, তা উন্মত্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে কেউই স্বীকার করতে চায় না।
১৯৪৭ সালের পর দুই বাংলার ইতিহাস ভিন্ন খাতে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ রাজের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কাহিনী প্রায় আড়াই শতকের ইতিবৃত্ত। সঙ্গে ভারতের অধীনে আরো ৭০ বছর। এই বাঙালির মনোজগতের আর সমাজ বিন্যাসের কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, “বঙ্গসমাজে প্রাধান্যকারী সংস্কৃতিই মূলধারার সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে আর মূলস্রোতই চাপা পড়ে হয়ে গিয়েছে প্রান্তিক। বাংলার গ্রামীণ মধ্য শ্রেণী ও নাগরিক মধ্য শ্রেণীও বহু ভাবে একত্রীভূত হয়েছে সংস্কৃতির বাঙালি ধারায়।” এভাবেই কলকাতাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর ভারতের কাঠামোয় গড়ে ওঠেছে কলকাতার বাঙালি মানস।
বিনয় ঘোষ আরো বলেছিলেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নতুন জমিদার শ্রেণীর অধীনে মধ্যস্বত্ব ভোগীর উদ্ভব হয়।” বহু বছর পর যখন বামফ্রন্ট জমানায় ‘কেরানি কমিউনিজম’-এর উদ্ভব হল, তখনো মনে করা হল সেই প্রবাহই বয়ে চলেছে। কিন্তু সেই আপাত নিরীহ বাবু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যেও আছে আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি। আর পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। বহু ক্ষেত্রে সেই লড়াইয়ে যতটা যুথবদ্ধতা দেখা যায়, তা আপাতদৃশ্য। আসলে বহু ক্ষেত্রেই তাতে আছে নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা এবং ক্ষমতার লালসা।
সুদীর্ঘ বাম জমানায় যে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলায় জেলায়, সেই সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার। শুরু হয় ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন। একে বলা যায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, এখনো যা বহাল হয়ে সহিংসতাকেই পুষ্টি যোগাচ্ছে সমাজ ও রাজনীতির সর্বস্তরে। রূপ নিচ্ছে কখনো রাজনৈতিক কিংবা কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়।
পশ্চিমবঙ্গে একদা শাসক কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলনে মুখর হয়েছিলেন। সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল পুলিশের দমননীতির বিরুদ্ধে পাল্টা-হিংসাও। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের পর দেখা গেল মমতার জঙ্গি আন্দোলন। কেশপুর-গড়বেতা থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে হিংসা এসেছে বার বার। এমনকী, রাজ্যে যে দলটি দুর্বল সেই বিজেপি-র রাজ্য শাখাও বন্ধ-হরতাল, এমনকী, বাস পুড়িয়ে সফল আন্দোলনের দাবিদার সেজেছে; সাম্প্রদায়িকতাকে নতুনভাবে পুষ্টি যোগাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজ্য থেকে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেওয়ার দাবিতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্দোলনও সহিংস রূপ ধারণ করে। সেনাবাহিনী নামিয়ে তবেই সেটা থামানো হয়েছিল।
জঙ্গি ইমেজের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো করে তুলেছে। ব্রিটিশ পুঁজি প্রথমে বিদায় নিয়েছে। ‘ফ্লাইট অফ ক্যাপিটাল’, সেখান থেকে সিঙ্গুরে টাটার বিদায়, রাজ্যে এক দিকে রাজনৈতিক হিংসা, অন্য দিকে শিল্প ও বাণিজ্যের বিদায়। এই হলো হিংসার রাজনীতির প্রাথমিক ফলাফল।
ইতিহাস বলছে, বঙ্গ সংস্কৃতিবাদ মানেই কালীর আরাধনা করে সশস্ত্র হওয়া নয়; আবার সকলের মিশে যাওয়াও নয়। একটা মুক্তির পথের কথা অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘প্লুরাল মোনোকালচারালিজম’ (বহু-এক-সংস্কৃতিবাদ)। বিভিন্ন সংস্কৃতি যখন রাতের অন্ধকারে জাহাজের মতো পরস্পরের পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তখন তারা এক জায়গায় বসবাস করলেও তা বহু সংস্কৃতিবাদের সার্থক নিদর্শন নয়।
ফলে বিভক্তিতে পূর্ণ নিজস্ব পরিচয়বোধের এই ক্ষুদ্রায়ন পশ্চিমবঙ্গকে আরো হিংসার পথে ঠেলে দিয়েছে। ‘বিশ্বাসকে যোগে যেথায় বিহারো’, অধুনা তা শুধু একটা গানের লাইন মাত্র; সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব কাঠামোতে অর্থহীন।
এ কথা সত্য, যেকোনো গোষ্ঠীজীবনে সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি ইত্যাদি নানা ভাবে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এই সব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়; তৈরি হয় ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’র বলয়। এই মনোভাবের মধ্যেই আছে হিংসার সবচেয়ে বড় ও জ্বলন্ত উৎস। এখানে সিপিএম, তৃণমূল একাকার। বামপন্থীরাও হিংসাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছেন। আজ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন বটে, কিন্তু সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। দল ও আদর্শের বাইরে হিংসার জ্বলন্ত অগ্নিকু-টিই সকল কিছুর উৎসস্থল হয়ে থেকেই যাচ্ছে।
হিংসার বিরুদ্ধে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের আওয়াজ ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সকলের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের আওয়াজও অর্থপূর্ণ হয় না। কারণ, যে প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে এই হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে, সেটাই প্রকৃত অবয়বে আবির্ভূত হয় না বহুবিধ মতাদর্শিক ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার কারণে। মানুষের মনে, সমাজের সাংস্কৃতিক পাটাতনে, রাজনীতির কাঠামোতে নোংরা লেপ্টে থাকলে সেটা দুর্গন্ধে ও কুশ্রীতে প্রকাশিত হবেই। হিংসার রাজনীতি হলো সেই নোংরা, যা ললাট লিপির মতোই অমোচনীয় হয়ে পুরো ব্যবস্থার চেহারা জুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পোষণকারী দুর্বল ও সংখ্যালঘুরা আইন ও সুশাসনের আওতায় প্রাপ্ত সুরক্ষায় নয়, পৌনঃপুনিক শাসিত হচ্ছে সন্ত্রাসের অধীনে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের এই হলো চক্রাকার-নিয়তি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন