আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলাদেশের মহান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। বাংলাদেশসহ ভারত দখলকারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বলিষ্ঠ ভূমিকা, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, গ্রেফতার ও কারাবাস থেকে দারিদ্র্য, বিয়ে ও পারিবারিক জীবন পর্যন্ত কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিচিত্র জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি। কাব্য-সাহিত্যের সব শাখাতেই অতুলনীয় অবদান রয়েছে তার। কিন্তু নানা বিষয়ে অসংখ্য রচনা থাকলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে নজরুল পরিচিতি পেয়েছিলেন একজন কবি হিসেবে। আজও তার প্রধান পরিচয়, তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবি। তার এই বিদ্রোহ ছিল দখলদার তথা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। ‘আমি দুর্বার/আমি ভেঙে করি চুরমার’ ঘোষণা করেই থেমে যাননি কবি, ইংরেজদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এদেশ ছাড়বি কিনা বল/নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল’।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সেই দিনগুলোতে এ ছিল এক দুর্দান্ত সাহসী উচ্চারণ। তার মূল্যও তাকে ব-বার চুকাতে হয়েছে। দণ্ডিত হয়ে বারবার কারাগারে গেছেন তিনি। কিন্তু মাথা নোয়াতে জানতেন না কবি, মাথা তিনি নতও করেননি কখনো। তার সংগ্রাম ছিল সব ধরনের শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আইনের নামে দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আজীবন সোচ্চার থেকেছেন তিনি। দরাজ গলায় গেয়েছেন সাম্যের গান। ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ থেকে ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’ ও ‘প্রলয় শিখা’ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে তার এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।
ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের ব্যাপারে কবি কাজী নজরুলের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। প্রধানত ফার্সী ও উর্দুতে রচিত গজলের অনুকরণে বাংলায় অসংখ্য গজল লিখেছেন তিনি। গোলাপের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই ফুল নবীর তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পায়ে চুমু খেয়েছিল বলেই তাঁর খুশবু আজও গোলাপের তৈরি আতরে পাওয়া যায় কি না? বুলবুলিকে জিজ্ঞেস করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাম জপেছিল বলেই তার কণ্ঠও এত মধুর কি না? পবিত্র আল-কোরআন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), নামায, রোজা, হজ্ব ও জাকাত প্রভৃতি এসেছে নজরুলের প্রধান বিষয় হিসেবে। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) প্রমুখকেও নজরুলই ইতিহাসের আলোকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তুর্কী বীর কামাল পাশা, মিসরের জগলুল পাশা এবং জামাল আফগানীর বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে পরাধীন ভারতীয়দের তিনি উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন।
নজরুল তাই বলে ধর্মান্ধতার বা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হননি বরং পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘টিকি’ রাখলে যেমন হিন্দু পন্ডিত হওয়া যায় না, তেমনি ‘দাড়ি’ রাখলেই মুসলমান মোল্লাও হওয়া যায় না। নজরুল একই সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ ও খৃস্টানসহ ভারতীয়দের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলমান কবি নজরুলকে তাই বলে রেহাই দেয়া হয়নি। কবি বিয়ে করেছিলেন আশালতা সেনগুপ্তাকে, পরবর্তীকালে যিনি প্রমীলা নজরুল নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তারা যার যার ধর্ম পালন করেছেন। ধর্ম পরিবর্তন না করার কারণে নজরুল ও প্রমীলাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। রক্ষণশীল হিন্দুরা এমনকি এ চেষ্টাও করতো, যাতে কোনো হিন্দু মালিক তাদের বাড়ি ভাড়া না দেয়। সে কারণে নজরুলকে -গলী ও কৃষ্ণনগরের মতো বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। কলকাতায়ও তিনি এক বাড়িতে বেশিদিন বসবাস করতে পারেননি। অভাব ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি ধর্মের বিষয়টি তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াতো। এভাবে অবশ্য নমনীয় বা পরাজিত করা যায়নি নজরুলকে। তিনি শেষ পর্যন্তও সাম্যের গানই গেয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
কবি নজরুল অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিদায় পর্ব এবং ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাকশক্তি হারিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ইন্তিকালের সময় পর্যন্তও তিনি আর হারানো বাকশক্তি ফিরে পেতে পারেননি। জাতি হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য, অনেক দেরিতে হলেও আমাদের জাতীয় কবিকে আমরা বাংলাদেশে আনতে পেরেছিলাম। তিনি শুয়ে আছেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মসজিদের পাশে। উল্লেখ্য, নজরুল নিজেই তাকে ‘মসজিদের পাশে’ কবর দিতে বলেছিলেন এক কবিতায়।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরো একবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং অনুসরণীয় হয়ে উঠেছেন। স্মরণ করা দরকার, একবার মহররম সংখ্যা ‘ধুমকেতু’র সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, ‘যে শির আল্লাহর আরশ ছাড়া আর কোথায়ও নত হয় না, সে শিরকে জোর করে সেজদা করাচ্ছে অত্যাচারী শক্তি, আর তুমি করছ সেই শহীদদের ধর্মের জন্য, স্বাধীনতার জন্য শহীদদের মাতমের অভিনয়।...’ আহ্বান জানাতে গিয়ে নজরুল আরো বলেছিলেন, ‘তোমার স্বাধীনতাকে, তোমার সত্যকে, তোমার ধর্মকে যে এজিদের বংশধররা নিপীড়িত করছে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের ভূ-অবলুণ্ঠিত শির উঁচু হয়ে উঠুক’। আমরাও আশা করতে চাই, কবি নজরুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের দমন-নির্যাতন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ শির উঁচু করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠবে। তাহলেই জাতীয় কবির জন্মদিনে তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে বলে আমরা মনে করি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সেই দিনগুলোতে এ ছিল এক দুর্দান্ত সাহসী উচ্চারণ। তার মূল্যও তাকে ব-বার চুকাতে হয়েছে। দণ্ডিত হয়ে বারবার কারাগারে গেছেন তিনি। কিন্তু মাথা নোয়াতে জানতেন না কবি, মাথা তিনি নতও করেননি কখনো। তার সংগ্রাম ছিল সব ধরনের শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আইনের নামে দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আজীবন সোচ্চার থেকেছেন তিনি। দরাজ গলায় গেয়েছেন সাম্যের গান। ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ থেকে ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’ ও ‘প্রলয় শিখা’ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে তার এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।
ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের ব্যাপারে কবি কাজী নজরুলের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। প্রধানত ফার্সী ও উর্দুতে রচিত গজলের অনুকরণে বাংলায় অসংখ্য গজল লিখেছেন তিনি। গোলাপের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই ফুল নবীর তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পায়ে চুমু খেয়েছিল বলেই তাঁর খুশবু আজও গোলাপের তৈরি আতরে পাওয়া যায় কি না? বুলবুলিকে জিজ্ঞেস করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাম জপেছিল বলেই তার কণ্ঠও এত মধুর কি না? পবিত্র আল-কোরআন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), নামায, রোজা, হজ্ব ও জাকাত প্রভৃতি এসেছে নজরুলের প্রধান বিষয় হিসেবে। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) প্রমুখকেও নজরুলই ইতিহাসের আলোকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। তুর্কী বীর কামাল পাশা, মিসরের জগলুল পাশা এবং জামাল আফগানীর বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে পরাধীন ভারতীয়দের তিনি উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন।
নজরুল তাই বলে ধর্মান্ধতার বা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হননি বরং পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘টিকি’ রাখলে যেমন হিন্দু পন্ডিত হওয়া যায় না, তেমনি ‘দাড়ি’ রাখলেই মুসলমান মোল্লাও হওয়া যায় না। নজরুল একই সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ ও খৃস্টানসহ ভারতীয়দের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলমান কবি নজরুলকে তাই বলে রেহাই দেয়া হয়নি। কবি বিয়ে করেছিলেন আশালতা সেনগুপ্তাকে, পরবর্তীকালে যিনি প্রমীলা নজরুল নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তারা যার যার ধর্ম পালন করেছেন। ধর্ম পরিবর্তন না করার কারণে নজরুল ও প্রমীলাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। রক্ষণশীল হিন্দুরা এমনকি এ চেষ্টাও করতো, যাতে কোনো হিন্দু মালিক তাদের বাড়ি ভাড়া না দেয়। সে কারণে নজরুলকে -গলী ও কৃষ্ণনগরের মতো বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। কলকাতায়ও তিনি এক বাড়িতে বেশিদিন বসবাস করতে পারেননি। অভাব ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি ধর্মের বিষয়টি তাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াতো। এভাবে অবশ্য নমনীয় বা পরাজিত করা যায়নি নজরুলকে। তিনি শেষ পর্যন্তও সাম্যের গানই গেয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
কবি নজরুল অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিদায় পর্ব এবং ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাকশক্তি হারিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ইন্তিকালের সময় পর্যন্তও তিনি আর হারানো বাকশক্তি ফিরে পেতে পারেননি। জাতি হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য, অনেক দেরিতে হলেও আমাদের জাতীয় কবিকে আমরা বাংলাদেশে আনতে পেরেছিলাম। তিনি শুয়ে আছেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মসজিদের পাশে। উল্লেখ্য, নজরুল নিজেই তাকে ‘মসজিদের পাশে’ কবর দিতে বলেছিলেন এক কবিতায়।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরো একবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং অনুসরণীয় হয়ে উঠেছেন। স্মরণ করা দরকার, একবার মহররম সংখ্যা ‘ধুমকেতু’র সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, ‘যে শির আল্লাহর আরশ ছাড়া আর কোথায়ও নত হয় না, সে শিরকে জোর করে সেজদা করাচ্ছে অত্যাচারী শক্তি, আর তুমি করছ সেই শহীদদের ধর্মের জন্য, স্বাধীনতার জন্য শহীদদের মাতমের অভিনয়।...’ আহ্বান জানাতে গিয়ে নজরুল আরো বলেছিলেন, ‘তোমার স্বাধীনতাকে, তোমার সত্যকে, তোমার ধর্মকে যে এজিদের বংশধররা নিপীড়িত করছে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের ভূ-অবলুণ্ঠিত শির উঁচু হয়ে উঠুক’। আমরাও আশা করতে চাই, কবি নজরুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের দমন-নির্যাতন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ শির উঁচু করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠবে। তাহলেই জাতীয় কবির জন্মদিনে তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে বলে আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন