শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে খাটো করেছেন


ইন্ডিয়া টুডে/টাইমস অব ইন্ডিয়া/ এনডি টিভি/ এবং টাইমসের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে রামের লঙ্কা বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকার। তিনি বলেছেন, লঙ্কা বিজয় করে রাম যেমন তা বিভীষণকে দিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ভারত তাই করেছে। সোজা কথায়, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের দয়ার দান। এই কথা বলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ কারো দয়ার দান নয়। ৩০ লক্ষ মানুষ শাহাদৎ বরন করে, ২ লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়ে, ১ কোটি লোক নয় মাসের জন্য বিদেশে আশ্রয় নিয়ে তারপর স্বাধীনতা হাসিল করেছেন। সেটিকে তিনি বিভীষণকে দেয়া রামের দানের সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তাচ্ছিল্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি আগরতলা এবং কলকাতার ক্যাম্পে ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা এবং শরনার্থীদের কষ্ট এবং যন্ত্রণা আমি আজও উপলব্ধি করি। তাই আমি এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি। সেই সাথে আপনাদের সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারাও অযুত কন্ঠে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। ভারত থেকে প্রায়শই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অসন্মান প্রদর্শণ করা হয় এবং একে খাটো করা হয়। ভারতের বিখ্যাত ছবি “গুন্ডেতে” ও মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা হয়েছে। গুন্ডে ছবিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে কেমন হেয় করা হয়েছে সেটি নিচে বর্ণনা করছি।
দুই
ছবিটি যে কতখানি আপত্তিকর সেটা আমি নিজে বোঝার জন্য এবং পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য এই ছবিটি আমি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করি। অন্যান্য ছবিতে যেভাবে দেখানো হয় এই ছবিতেও ঠিক সেভাবেই পর্দা জুড়ে লেখা বের হয় Yash Raj Films. অতঃপর ছবিটি শুরু হয়েছে এইভাবে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ততকালীন পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেঃ জেঃ এ এ কে নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইষ্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেঃ জেঃ অরোরা কাছে আত্মসমর্পন করছেন ঢাকার ততকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে)। এই দৃশ্যের সাথে সাথে ছবিটির ধারা বর্ননা শুরু হয়েছে এইভাবে,
“হিন্দুস্থান আওর পাকিস্তান কে বিচ মে তেসরা ইয়ুধ(যুদ্ধ) খতম হুয়া। সত্তর হাজার পাকিস্তানী সোলজার্স নে হিন্দুস্তানী আর্মিকে পাস সারেন্ডার কিয়া।” (প্রথম দৃশ্যে ভারতীয় কামানের গোলাবর্ষন এবং ঢাকার আকাশে মিগ-২১ জঙ্গী বিমানের চক্কর দেখানো হয়। অতঃপর দেখানো হয় জেঃ নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দৃশ্য। তারপর দেখানো হয় কয়েকটি লাশের ছবি)।
আবার শুরু হয় ধারা বিবরনী। বলা হয়, “দুসরে বিশ্ব ইয়ুধ (যুদ্ধ) কে বাদ কিসি ভি দেশ সারেন্ডার কিয়া উসমে ইয়ে সারেন্ডার সাবসে বড়া সারেন্ডার থা। আওর পয়দা হুয়া এক নয়া দেশ, বাংলাদেশ। যব হিন্দুস্থানী আর্মি ঢাকা ছোড় থা রাহি থি, তো কাঠিলে কি বাহার গেয়ারা ইয়া বারা সালকে (১১ বা ১২ বছরের) দো অনাথ দোস্ত, বিক্রম আওর বালা ইয়ে নাহি সামঝ পা কে উনকে সাথ জো হুয়া ও সাহি ইয়া গলত। কিয়া নয়া দেশ উনে নয়া জিন্দেগী দেগা? উনকে আঁখো মে সেরফ এহি সওয়াল থা”।
এরপর একটি গেটের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকটি জিপ প্রবেশ করে। ক্যামেরাটি জুম করলে দেখা যায়, গেটের ওপর উৎকীর্ণ হয়ে আছে, ‘জেনেভা রেফিউজি ক্যাম্প’। এরপর আবার ধারা বর্ননা শুরু হয়,
“যাব বাংলাদেশ বানা, তো উঁহা হিন্দুস্থানী মূল্ককে হাজারো লোগ থে জিনকি পাস খানেকো কোয়ি রোটি থি, না মাথে কি উপর কোয়ি ছাদ।” একটু দম নিয়ে, “আকছার হর দেশ বড়ি সমস্যা সুলঝানে কি চক্কর মে ইয়ে ভুল যাতা হ্যায় কে উনকি কিতনি বড়ি কিমত উতনি আপনি লোগে পার চুকানি পাড়তি হ্যায়। হাজারো লোক মওত কি আন্ধেরি মে গুম হো যাতি হ্যায়। বিক্রম আওর বালা কি তরফ ছে ভি ইয়ে আন্ধেরি তেজ ছে বাড় রাহা থা। য়ব হর তরফ ভূখ না রাহি থে তো এয়সে মে কোয়ি ছওয়াল কি কেয়া জওয়াব দেতা?”
কাহিনী এগিয়ে যায়। হরিহর আত্মার দুই বন্ধু বিক্রম এবং বালা অস্ত্র চোরা চালানীদের খপ্পরে পড়ে। এই পর্যায়ে কিশোর বিক্রমের পিস্তলে একজন অস্ত্র ব্যাবসায়ী খুন হয়। তখন একজন হৃদয়বান ব্যক্তির সহায়তায় ওরা দুই বন্ধু ঢাকায় একটি ট্রেনে ওঠে। ওই ট্রেনে করে তারা কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশানে নামে। ধীরে ধীরে ওরা বড় হয় এবং ধারা ভাষ্যকারের ভাষায় ‘হিন্দুস্তানী’ নাগরিকত্ব লাভ করে। অতঃপর তারা কলকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বড় এবং দুর্ধর্ষ গ্যাংষ্টারে পরিনত হয়। এরপর কাহিনীর অবশিষ্টাংশে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আর নাই।
তিন
এই সিনেমার সবচেয়ে বড় আপত্তিকর দিকটি হলো এই যে, ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধকে ভারত এবং পাকিস্তানের ৩য় যুদ্ধ হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে। সকলেই জানেন যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পূর্ববর্তি যে দুটি যুদ্ধ (১৯৪৯ এবং ১৯৬৫ সালে) সংঘঠিত হয়েছে সেটা ছিলো কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। এটি যদি পাক ভারতের মধ্যে সংঘঠিত ৩য় যুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে সেটি কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে? বলাবাহুল্য, এই বক্তব্যের এবং উপস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষের মা বোনের সম্ভ্রমহানি এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের কোরবানীকে অস্বীকার করা হয়েছে।
যে বিষয়টি বোধ্যগম্য নয় সেটি হলো, যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন নাকি এই দেশে হাজার হাজার হিন্দুস্তানী মানুষ ছিলো, যাদের এক বেলার খাবার ছিলো না এবং যাদের মাথার ওপর কোন ছাদ ছিলো না। এই হিন্দুস্তানীরা কারা? সেই লোক গুলিকে দেখানোর জন্য ক্যামেরা চলে গেলো জেনেভা ক্যাম্পের ওপর। আমরাতো জানি, বিভিন্ন জেনেভা ক্যাম্পে ছিলো হাজার হাজার নয়, কয়েক লক্ষ বিহারী। ওরা ছিলো পাকিস্তানী। এখনো ওদের কিয়দংশ মিরপুরের ক্যাম্পে আছে। গুন্ডের প্রযোজক যশ চোপড়ারা কি ওইসব বিহারীদেরকে হিন্দুস্তানী নাগরিক বলছেন? যদি তাই হয় তাহলে এখনো সময় আছে, ওদেরকে ভারতে নিয়ে যাক। বাংলাদেশের কোন আপত্তি নাই। বিক্রম এবং বালা ও ওই বিহারী ক্যাম্পেই ছিলো। একজন জালিমকে হত্যা করার পর ওরা ভারতে পালিয়ে যায়। তাহলে বাংলাদেশীরা বিভিন্ন ক্রিমিনাল অফেন্সে জড়িত আছে, তেমন অপবাদ দেওয়া হয়েছে কেন?
চার
এই সিনেমাটির প্রযোজক কোম্পানির নাম ‘যশো রাজ ফিল্মস’। তারা তাদের ব্লগে পরবর্তীতে এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে বলা হয় যে বাংলাদেশীদের প্রতি কোন অশ্রদ্ধা দেখানো হয়ে থাকলে আমরা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যশো রাজ ফিল্মসের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেভাবে কাহিনিটি উপস্থাপন করা হয়েছে সে ব্যাপারে অনেক বাংলাদেশী আমাদের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের প্রতি এই কাহিনীর মাধ্যমে কোন অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়ে থাকলে অথবা তাদের অনুভূতিতে আঘাত করা হয়ে থাকলে আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তবে আমরা বলতে চাই যে এটি একটি কল্প কাহিনী। সমাজের কোন অংশ অথবা কোন ব্যক্তি অথবা কোন জাতির প্রতি বিন্দু মাত্র অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্য আমাদের ছিলো না।
পাঁচ
ছবির নির্মাতা দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঠিকই। কিন্তু এই ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে ড্যামেজ হয়ে গেল সেটা কি আর রিপেয়ার করা সম্ভব? ড্যামেজ যা হবার তাতো হয়েই গেছে। এছাড়াও এই ছবিটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ফলে ভারতের কোটি কোটি মানুষ এবং ইউটিউবের মাধ্যমে বাংলাদেশেরও কোটি কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি ভুল বর্ণনা এবং তথ্য চিত্র দেখলেন।
গুন্ডে ছবিটি ভারতের বিভিন্ন সিনেমা হলে মুক্তি পায় ২০১৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। এই ছবিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভূলভাবে উপস্থাপন করার বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের প্রবাসী বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশের ভেতর থেকেও প্রতিবাদ উত্থিত হয়।২১শে ফেব্রুয়ারী একটি ইংরেজী দৈনিকে সর্বপ্রথম গুন্ডে ছবি নিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়। ওই খবরে বলা হয় যে পৃথিবী ব্যাপী বাংলাদেশীরা, বিশেষ করে তরুণরা আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত বলিউডের হিন্দি ছবি গুন্ডের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানায়। প্রবাসী বাংলাদেশীরা খেয়াল করেন যে এই ছবিতে বাংলাদেশের জন্মকে পাক ভারত যুদ্ধের ফসল হিসেবে ভূলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের একটি ইংরেজী দৈনিকের খবরে বলা হয়, এই ছবিতে দেখানো হয়েছে যে অস্ত্রের চোরা চালানসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে বাংলাদেশীরা জড়িত। ছবিতে দেখানো হয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে দুইটি বালক ভারতে পালিয়ে যায় এবং সেখানে তারা বড় হয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রতি কটাক্ষ করে বলা হয়েছে যে তারা নিজেদেরকে ভারতীয় হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। ঐ ইংরেজী পত্রিকার মতে, ঐ ছবির একস্থানে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তার অর্থ এই দাড়ায় যে “There is also insinuation that Bangladeshis prefer identifying themselves as Indians.” পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী গুন্ডেতে যা বলা হয়েছে তার অর্থ হল এই যে বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ১৩ দিনের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ফলশ্রুতি। যেসব বাংলাদেশী প্রতিবাদ করেছেন তাদের বক্তব্য হলো, ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ৮ মাস ধরে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো এবং যে ৮ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী শহীদ হয়েছেন সে যুদ্ধের কথা ছবিটিতে বিন্দু মাত্র উল্লেখ নাই।
২০১৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এই ছবিটি ভারতে মুক্তি পেয়েছে। যশো রাজ ফিল্মসের ভাইস প্রেসিডেন্ট যশো রাজের ইমেল আক্যাউন্টে প্রতিবাদ সম্বলিত অসংখ্য ইমেল পাঠানো হয়। বাংলাদেশীদের প্রতিবাদ লিপিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই বাংলাদেশীরা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে আসছে। ভারত সেখানে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে ৮ মাস পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর। যদিও ছবিটির প্রযোজক আদিত্য চোপড়া অথবা পরিচালক আলী আব্বাস জাফরের তরফ থেকে এই সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি তৎসত্বেও বাংলাদেশীরা দাবী করে আসছেন যে বাংলাদেশ সম্পর্কিত আপত্তিকর অংশটি ছবি থেকে বাদ দেয়া হোক এবং কোম্পানি কতৃপক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করুক।
এবার প্রগতিবাদীদের উদ্দেশ্যে দুটি কথা। আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মূখে ফেনা তোলেন। গন জাগরন মঞ্চ তো সেই চেতনার সোল এজেন্ট। এখন তারা মূখে গোমাই লাগিয়ে বসে আছেন কেন? ভারতের প্রভূত্বের মূখে আপনারা চুপসে যান কেন? আসলে স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ-এইসব কিছুই কি ভারত কেন্দ্রিক?
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads