টিভির টকশোর আলোচকদের মতে নীতিজ্ঞান বিসর্জন দেয়া দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, তেলবাজ, চাদাবাজ, প্রতারক, চোর, ডাকাত, লুটেরা, দুর্বৃত্ত, দুর্জন, স্বজনপ্রীতিবাজ, আগ্রাসী মানসিকতার কিছু ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে ১৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় পার্টিকে। সরকারের দালালি ও তোষামোদি করে প্রচুর অর্থকড়ির মালিক হওয়া এই নেতারা জাতীয় পার্টির আদর্শ নীতি, নৈতিকতার কাছে দায়বদ্ধহীন। তারা দায়বদ্ধ আওয়ামী লীগের কাছে। এরশাদকে কখনো ভুল বুঝিয়ে কখনোবা জেলের ভয় দেখিয়ে এবং রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে পাপেট বানিয়ে রেখে দলকে পরিচালিত করছেন ইচ্ছামতো।
১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি সাত্তার যখন সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন, সেদিন কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কথায় কথায় ইতিহাস চলে আসে কিনা। কারো মনোক্ষুণ্ন হবার কারণ নেই। এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় নিজের করে দল চালিয়েছেন। দল ক্ষমতায় থাকার সময় পার্টির ভিতরে নেতাদের মধ্যে তেমন মতভেদ দেখা যায়নি। কখনও কখনো হলেও তা বেশিদূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো না। আর দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এরশাদ তা মিটিয়ে বলতেন। মন্ত্রিত্ব হারানোর ভয়েই এরশাদের সকল সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির নেতারা মেনে নিতেন।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠনের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার দড়ি টানাটানি পর্ব শেষ হলে ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এ নিয়ে আবারও নেতৃত্ব নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। প্রফেসর এমএম মতিন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও কাজী জাফর আহমদ-এ পদের জন্য প্রকাশ্য লবিং শুরু করেন। এরশাদ বর্ষীয়ান নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বাকি তিনজন উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। কিন্তু এর পরেও জাপায় এই অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়নি কখনোই।
প্রকৃতপক্ষে গোড়াতেই গলদ ছিল জাতীয় পার্টির মধ্যে। এই গলদ হচ্ছে দলছুট নেতাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ভিন্নতা। ক্ষমতায় থাকার সময়ও জাতীয় পার্টির ভেতরে ছিল এই ভাঙার খেলা। কিন্তু ক্ষমতার ভারে সকল অনৈক্য তখন আড়ালে ছিল। দলের ভেতরে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক উপাদানের ক্যাটালিস্ট ছিলেন এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জাতীয় পার্টিতে নেমে আসে অন্ধকারের ঘনঘটা। এরশাদসহ সিনিয়র অনেক নেতাই কারাগারে যান। ১২ ডিসেম্বর এরশাদ চলে যান জেলে। কাণ্ডারিহীন এই দলটিতে শুরু হয় নতুন করে দ্বন্দ্ব।
প্রবীণ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পার্টিকে নতুনভাবে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পার্টিতে উপদলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়। দলের প্রবীণ নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. এম এ মতিন দলের ভিতরে উপদল সৃষ্টি করেন। এক সময় তারা পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
এরশাদ পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। সেখানে নানা রকম তথ্য তার কাছে পৌঁছাতো। এ সময় জাতীয় পার্টি পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো জিনাত হোসেনের মাধ্যমে। শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা তথ্য তখন এরশাদের কাছে পৌঁছতো। ফলে কারাগার থেকে নীতি-নির্ধারণের ব্যাপারে সঠিক কর্মকৌশল দিতে পারেন নি। দেখা গেছে, রওশন এরশাদ, মিজান চৌধুরী, কাজী জাফর বা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ভিন্ন ভিন্ন মতের কারণে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলে এ সময় তৈরি হয়েছে বহু বিতর্ক। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে এ পদ থেকে বিদায় দেয়ার পর বেশ কয়েকজনের কাছে হাত বদল হয়েছে এ পদের। এবিএম শাহজাহান, শ্রমিক নেতা হাসানউদ্দিন সরকার, যশোরের খালেদুর রহমান টিটোর মতো নেতারাও এ পদে স্থির থাকতে পারেননি। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জুর, রহুল আমিন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন বাবলু মহাসচিব নিযুক্ত হলেও জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করাতে সক্ষম হননি।
১৯৯০-২০১৬ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি থেকে মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং চট্রগ্রামের জনপ্রিয় নেতা মাহমুদুল হাসানের মতো মানুষও দলত্যাগ করে চলে গেছেন। পরে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এমপি নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদের স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে মাহমুদুল হাসান দল ত্যাগের পর বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। এ পার্টি থেকে দলত্যাগীদের মধ্যে রয়েছেন আনোয়ার জাহিদ, মোর্শেদ খান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মওদুদ আহমদ ও ঢাকার এক সময়ের মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। এরা প্রত্যেকেই এখন বিভিন্ন দলের নেতা। নাজিউর রহমান মঞ্জু দীর্ঘ দিন বিদেশে পলাতক থাকার পর দেশে ফিরে কোর্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তার নামে মামলা থাকায় কোর্ট তাকে জেলে প্রেরণ করেন।
তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কারণে জেল থেকে ছাড়া পান। প্রেসিডেন্ট তাকে ক্ষমা করার পর নাজিউর রহমান মঞ্জুর উপদল গঠন করেন। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার অর্থের কাছে পরাজিত হয়ে সবাই নাজিউরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
জেল থেকে বের হয়ে এসে দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বড় ধরনের ভাঙনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। মাঝখানে জাতীয় পার্টি জিনাত সিনড্রোমে ভুগেছেন দীর্ঘ দিন। পরে বিদিশার জ্বরে বেশ কয়েকবছর আক্রান্ত ছিল। আবার জিনাত হোসেন- বিদিশারা সরে গেছেন দূরে। এ ইস্যুতে রওশন এরশাদও জাপা ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন। এরশাদের ব্যক্তিজীবন হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। এভাবেই একদল নেতা-নেত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে লবি তৈরি করে জাতীয় পার্টির মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছেন ফলে এই গৃহবিবাদের চিত্র সেখানে নিত্যদিনের।
ক্ষমতাসীন বিএনপির বাধার কারণে ১৯৯১ সালের পর জাতীয় পার্টিকে ঢাকায় কোনও সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হতো না। এরই এক পর্যায়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সরদার আমজাদ হোসেন, শেখ শহীদুল ইসলাম আওয়ামী বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি বিরোধিতা করায় সুকৌশলে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
তখনই জাতীয় পার্টির ভিতরে জিনাত মোশারফ, কাজী জাফর আহমদ, রওশন এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে চারটি উপদলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জিনাত কারাবন্দী এরশাদের নাম ভাঙ্গিয়ে দলের ভিতরে সমর্থক গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আওয়ামী বলয়ের লোকজনকে নিয়ে উপদলের জন্ম দেন। কাজী জাফর আহমেদ ১৯৭৪ সালের ১৭ নভেম্বর মওলানা ভাসানী ন্যাপ ভেঙ্গে গঠিত ইউনাইটেড পিপলর্স পার্টি (পিপিপি), বাম ও জাতীয়তাবাদী ধারায় বিশ্বাসী নেতাদের সমন্বয়ে উপদল গঠন করেন। ফলে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। কারাবন্দী এরশাদ সেসব বুঝতে পেরে নিজ পরিবারের সদস্য, ছোট দুই ভাই জি.এম কাদের, গোলাম মোহাম্মদ লালু, বোন মেরিনা রহমান ও এক-বোন জামাই ডাঃ আসসাদুর রহমানকে দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। দলের ভিতরের উপদলীয় কোন্দল আর এরশাদের কিছু স্ববিরোধী সিদ্ধান্তের কারণে অনেক পরীক্ষিত নেতা দলত্যাগ করেন। অনেকেই নিষ্ক্রীয় হয়ে যান।
এক পর্যায়ে জিনাত মোশারফ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীর ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন। ফলে দলে তীব্র কোন্দল ও মতভেদের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গ্রুপ। মঞ্জু ক্ষমতাসীন বিএনপি ও প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে পার্টিতে নিজ গ্রুপকে শক্তিশালী করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লিগের সঙ্গে আঁতাত করে মন্ত্রী হন এবং এক পর্যায়ে পৃথক জাতীয় পার্টি গড়ে তোলেন।
এরশাদ যখন কারাগারে ছিলেন তখন গোটা দলের চালিকাশক্তি ছিল মিজান চৌধুরীর হাতে। কিন্তু নেতা কারামুক্ত হবার পর গোটা দৃশ্যপট বদলে যায় দ্রুত। দেখা যায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কোন ধরনের দায়িত্ব তাকে দেয়া হচ্ছে না। কর্তৃত্বহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। এরশাদ কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর দলে যেসব রদবদল ঘটে তাতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মিজান চৌধুরী।
দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক মিজান চৌধুরী গ্রুপের লোক হিসেবে পরিচিত থাকায় তাদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেয়া হয় এবং পদ দুটি বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক সেল ও প্রচার সেল। এ দুই সেলের দায়িত্ব পান জিনাত হোসেনের আশীর্বাদপুষ্ট দুজন সাবেক সেনা অফিসার। মিজান চৌধুরীর সমর্থক বলে পরিচিত দপ্তর সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বাবুল বাদ পড়েন। তার জায়গায় বসানো হয় এক সময়ে জাসদ নেতা ও আসম রবের ঘনিষ্ঠজন হুমায়ুন কবীর হিরুকে। এসব সিদ্ধান্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে তো দূরের কথা মহাসচিবকেও জানানো হয়নি।
১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি সাত্তার যখন সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন, সেদিন কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কথায় কথায় ইতিহাস চলে আসে কিনা। কারো মনোক্ষুণ্ন হবার কারণ নেই। এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় নিজের করে দল চালিয়েছেন। দল ক্ষমতায় থাকার সময় পার্টির ভিতরে নেতাদের মধ্যে তেমন মতভেদ দেখা যায়নি। কখনও কখনো হলেও তা বেশিদূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো না। আর দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এরশাদ তা মিটিয়ে বলতেন। মন্ত্রিত্ব হারানোর ভয়েই এরশাদের সকল সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির নেতারা মেনে নিতেন।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠনের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার দড়ি টানাটানি পর্ব শেষ হলে ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এ নিয়ে আবারও নেতৃত্ব নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। প্রফেসর এমএম মতিন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও কাজী জাফর আহমদ-এ পদের জন্য প্রকাশ্য লবিং শুরু করেন। এরশাদ বর্ষীয়ান নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বাকি তিনজন উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। কিন্তু এর পরেও জাপায় এই অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়নি কখনোই।
প্রকৃতপক্ষে গোড়াতেই গলদ ছিল জাতীয় পার্টির মধ্যে। এই গলদ হচ্ছে দলছুট নেতাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ভিন্নতা। ক্ষমতায় থাকার সময়ও জাতীয় পার্টির ভেতরে ছিল এই ভাঙার খেলা। কিন্তু ক্ষমতার ভারে সকল অনৈক্য তখন আড়ালে ছিল। দলের ভেতরে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক উপাদানের ক্যাটালিস্ট ছিলেন এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জাতীয় পার্টিতে নেমে আসে অন্ধকারের ঘনঘটা। এরশাদসহ সিনিয়র অনেক নেতাই কারাগারে যান। ১২ ডিসেম্বর এরশাদ চলে যান জেলে। কাণ্ডারিহীন এই দলটিতে শুরু হয় নতুন করে দ্বন্দ্ব।
প্রবীণ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পার্টিকে নতুনভাবে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পার্টিতে উপদলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নেয়। দলের প্রবীণ নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. এম এ মতিন দলের ভিতরে উপদল সৃষ্টি করেন। এক সময় তারা পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
এরশাদ পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। সেখানে নানা রকম তথ্য তার কাছে পৌঁছাতো। এ সময় জাতীয় পার্টি পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো জিনাত হোসেনের মাধ্যমে। শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে উল্টা-পাল্টা তথ্য তখন এরশাদের কাছে পৌঁছতো। ফলে কারাগার থেকে নীতি-নির্ধারণের ব্যাপারে সঠিক কর্মকৌশল দিতে পারেন নি। দেখা গেছে, রওশন এরশাদ, মিজান চৌধুরী, কাজী জাফর বা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ভিন্ন ভিন্ন মতের কারণে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলে এ সময় তৈরি হয়েছে বহু বিতর্ক। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে এ পদ থেকে বিদায় দেয়ার পর বেশ কয়েকজনের কাছে হাত বদল হয়েছে এ পদের। এবিএম শাহজাহান, শ্রমিক নেতা হাসানউদ্দিন সরকার, যশোরের খালেদুর রহমান টিটোর মতো নেতারাও এ পদে স্থির থাকতে পারেননি। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জুর, রহুল আমিন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন বাবলু মহাসচিব নিযুক্ত হলেও জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করাতে সক্ষম হননি।
১৯৯০-২০১৬ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি থেকে মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং চট্রগ্রামের জনপ্রিয় নেতা মাহমুদুল হাসানের মতো মানুষও দলত্যাগ করে চলে গেছেন। পরে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এমপি নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদের স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে মাহমুদুল হাসান দল ত্যাগের পর বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। এ পার্টি থেকে দলত্যাগীদের মধ্যে রয়েছেন আনোয়ার জাহিদ, মোর্শেদ খান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মওদুদ আহমদ ও ঢাকার এক সময়ের মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। এরা প্রত্যেকেই এখন বিভিন্ন দলের নেতা। নাজিউর রহমান মঞ্জু দীর্ঘ দিন বিদেশে পলাতক থাকার পর দেশে ফিরে কোর্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তার নামে মামলা থাকায় কোর্ট তাকে জেলে প্রেরণ করেন।
তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কারণে জেল থেকে ছাড়া পান। প্রেসিডেন্ট তাকে ক্ষমা করার পর নাজিউর রহমান মঞ্জুর উপদল গঠন করেন। দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার অর্থের কাছে পরাজিত হয়ে সবাই নাজিউরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
জেল থেকে বের হয়ে এসে দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বড় ধরনের ভাঙনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। মাঝখানে জাতীয় পার্টি জিনাত সিনড্রোমে ভুগেছেন দীর্ঘ দিন। পরে বিদিশার জ্বরে বেশ কয়েকবছর আক্রান্ত ছিল। আবার জিনাত হোসেন- বিদিশারা সরে গেছেন দূরে। এ ইস্যুতে রওশন এরশাদও জাপা ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন। এরশাদের ব্যক্তিজীবন হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। এভাবেই একদল নেতা-নেত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে লবি তৈরি করে জাতীয় পার্টির মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছেন ফলে এই গৃহবিবাদের চিত্র সেখানে নিত্যদিনের।
ক্ষমতাসীন বিএনপির বাধার কারণে ১৯৯১ সালের পর জাতীয় পার্টিকে ঢাকায় কোনও সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হতো না। এরই এক পর্যায়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সরদার আমজাদ হোসেন, শেখ শহীদুল ইসলাম আওয়ামী বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি বিরোধিতা করায় সুকৌশলে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
তখনই জাতীয় পার্টির ভিতরে জিনাত মোশারফ, কাজী জাফর আহমদ, রওশন এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে চারটি উপদলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জিনাত কারাবন্দী এরশাদের নাম ভাঙ্গিয়ে দলের ভিতরে সমর্থক গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আওয়ামী বলয়ের লোকজনকে নিয়ে উপদলের জন্ম দেন। কাজী জাফর আহমেদ ১৯৭৪ সালের ১৭ নভেম্বর মওলানা ভাসানী ন্যাপ ভেঙ্গে গঠিত ইউনাইটেড পিপলর্স পার্টি (পিপিপি), বাম ও জাতীয়তাবাদী ধারায় বিশ্বাসী নেতাদের সমন্বয়ে উপদল গঠন করেন। ফলে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। কারাবন্দী এরশাদ সেসব বুঝতে পেরে নিজ পরিবারের সদস্য, ছোট দুই ভাই জি.এম কাদের, গোলাম মোহাম্মদ লালু, বোন মেরিনা রহমান ও এক-বোন জামাই ডাঃ আসসাদুর রহমানকে দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। দলের ভিতরের উপদলীয় কোন্দল আর এরশাদের কিছু স্ববিরোধী সিদ্ধান্তের কারণে অনেক পরীক্ষিত নেতা দলত্যাগ করেন। অনেকেই নিষ্ক্রীয় হয়ে যান।
এক পর্যায়ে জিনাত মোশারফ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীর ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন। ফলে দলে তীব্র কোন্দল ও মতভেদের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গ্রুপ। মঞ্জু ক্ষমতাসীন বিএনপি ও প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে পার্টিতে নিজ গ্রুপকে শক্তিশালী করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লিগের সঙ্গে আঁতাত করে মন্ত্রী হন এবং এক পর্যায়ে পৃথক জাতীয় পার্টি গড়ে তোলেন।
এরশাদ যখন কারাগারে ছিলেন তখন গোটা দলের চালিকাশক্তি ছিল মিজান চৌধুরীর হাতে। কিন্তু নেতা কারামুক্ত হবার পর গোটা দৃশ্যপট বদলে যায় দ্রুত। দেখা যায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কোন ধরনের দায়িত্ব তাকে দেয়া হচ্ছে না। কর্তৃত্বহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। এরশাদ কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর দলে যেসব রদবদল ঘটে তাতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মিজান চৌধুরী।
দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক মিজান চৌধুরী গ্রুপের লোক হিসেবে পরিচিত থাকায় তাদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেয়া হয় এবং পদ দুটি বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক সেল ও প্রচার সেল। এ দুই সেলের দায়িত্ব পান জিনাত হোসেনের আশীর্বাদপুষ্ট দুজন সাবেক সেনা অফিসার। মিজান চৌধুরীর সমর্থক বলে পরিচিত দপ্তর সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বাবুল বাদ পড়েন। তার জায়গায় বসানো হয় এক সময়ে জাসদ নেতা ও আসম রবের ঘনিষ্ঠজন হুমায়ুন কবীর হিরুকে। এসব সিদ্ধান্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে তো দূরের কথা মহাসচিবকেও জানানো হয়নি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন