ক’দিন আগে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম প্রধান দিশারী আতাউস সামাদের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে জীবনের শেষদিনগুলোতেও দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন এই পরিশ্রমী সাংবাদিক। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগেও দৈনিকটির অফিসে এসে কাজ করে গেছেন তিনি। টেলিফোনে যোগাযোগ তো রেখেছেনই। তবে অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি বিবিসি’র সংবাদদাতা হিসেবে। ১৯৫৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করার পর আতাউস সামাদকে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছিল সামরিক ও স্বৈরশাসনের অধীনে- প্রথমে (১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত) পাকিস্তানের তথাকথিত ‘লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এবং পরবর্তীকালে (১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে।
শ্বাসরুদ্ধকর সেই বছরগুলোতে দুর্দান্ত সাহসী ছিল আতাউস সামাদের ভূমিকা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দারা বিরামহীনভাবে তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছে, প্রলোভনও কম দেখানো হয়নি। কিন্তু ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে এবং প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন চালিয়েও তাকে সত্য প্রকাশ করা থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি এমনকি গ্রেফতারও বরণ করেছেন। ১৯৮০-র দশকের ওই দিনগুলোতে মানুষ আতাউস সামাদের পাঠানো খবর শোনার জন্য সাগ্রহে বিবিসি রেডিও খুলে বসে থাকতো। তার নিজের কণ্ঠেও অনেক খবর শোনা যেতো। সে সময় মোবাইল দূরে থাকুক, সাধারণ বা ল্যান্ড টেলিফোনও খুব কম মানুষেরই ছিল। ফলে স্বৈরশাসকের প্রচণ্ড দমনমূলক পদক্ষেপের মুখে দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন। আন্দোলনের কর্মসূচী সম্পর্কেও তারা জানার সুযোগ পেতেন না। এ ধরনের পরিস্থ’তিতে আতাউস সামাদই প্রধান ভরসা হয়ে উঠতেন। বিবিসিতে প্রচারিত তার খবরই নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও উজ্জীবিত করতো। সেদিক থেকে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে আতাউস সামাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। জীবনের শেষদিনগুলো পর্যন্তও গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি তার এই অবস্থানকে বজায় রেখেছিলেন। প্রয়োজনের সময়ে প্রত্যক্ষ কাণ্ডও পালন করেছেন তিনি।
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ছিল আতাউস সামাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি ঘটনা ও তথ্যকে। কোনো বিষয়ের সঙ্গে ভিন্নমত থাকলেও সে সংক্রান্ত সঠিক তথ্য বা খবর প্রকাশের ব্যাপারে তিনি সৎ থাকতেন। কোনো তথ্যেরই বিকৃতি ঘটাতেন না। তার সঙ্গে বা অধীনে যারা সাংবাদিকতা করেছেন তাদেরও তিনি সঠিক তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সততা বজায় রাখার তাগিদ দিতেন। অনুসন্ধান বা খবর খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার দৃষ্টি ছিল খুবই তীক্ষ্ণ। এমন অনেক বিষয়েই তিনি রিপোর্ট করেছেন ও অন্যদের দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছেন- যেগুলো সহজে কারো চোখেই পড়তো না। এরকম অনেক খবরই পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসবের মাধ্যমে দেশ ও জাতিও যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে।
সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের যে কোনো সংকট ও দুঃসময়ে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। ১/১১-এর অবৈধ অভ্যুত্থান এবং জেনারেল মইন-ফখরুদ্দিনদের অসাংবিধানিক স্বৈরশাসনের দিনগুলোতে দৈনিক আমার দেশকে বাঁচিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন, চরম বিপদের মুখেও সাংবাদিকদের আগলে রেখেছেন পরম আদরে। হুমকির তিনি পরোয়াই করেননি কখনো। মইন-ফখরুদ্দিনদের সময় দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার ও অর্থনৈতিক অবরোধসহ বিভিন্ন কারণে আমার দেশ-এর অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল তখনও আতাউস সামাদই এগিয়ে এসেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমানকে তিনি শুধু আমার দেশ-এর সঙ্গে যুক্তই করেননি, তাকে সাংবাদিকতায়ও এনেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমার দেশ যখন দফায় দফায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মিথ্যা মামলার আড়ালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সরকার যখন কারাগারে ঢুকিয়েছে তখনও অভয়ের বাণীমুখে দুর্দান্ত সাহসে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। বস্তুত তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বই আমার দেশকে প্রায় নিশ্চিত ধ্বংসের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছিল। বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভিও আতাউস সামাদের নেতৃত্ব পেয়েছিল বলেই সে সময় টিকে থাকতে পেরেছে।
অতুলনীয় ছিল তার দেশপ্রেম। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং সীমান্তে হত্যাকা- থেকে ফারাক্কা বাঁধের কুফল ও পানি আগ্রাসন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি আপসহীন দেশপ্রেমিকের কাণ্ড পালন করেছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় স্বার্থেই ভারতকে করিডোর দেয়ার কঠোর বিরোধিতা করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন আতাউস সমাদ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোতে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এজন্যই দলনির্বিশেষে সবাই তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়েছিলেন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আতাউস সামাদ ছিলেন খোলা মনের মানুষ। ওয়াক্তিয়া নামায আদায় করতেন তিনি নিয়মিতভাবে। রোযাও রাখতেন, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করতেন না। সংস্কৃতির নামে জাতীয় জীবনের বহু কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় তিনি ছিলেন নির্ভীক ও দ্বিধাহীন। বিবিসি’র সাংবাদিক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা আতাউস সামাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি রয়েছে। অসাধারণ ছিল তার দেশপ্রেম। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তো বটেই, সব সরকারও তাকে যথেষ্ট সমীহ করতো। অনেকেই পরামর্শের জন্য তার কাছে যেতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি বর্তমানে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্তিকালের কয়েকদিন আগেও তিনি কলাম লিখেছেন।
দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে আতাউস সামাদ কতটা আন্তরিক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে একটি ঘটনা থেকে। এটা ২০১১ সালের কথা। সেবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সম্পাদকীয় লেখার ব্রিফিং দেয়ার সময় আতাউস সামাদ সেই বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয়ে বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, পহেলা বৈশাখে যারা ইলিশ দিয়ে পান্তা খাওয়ার মাধ্যমে উৎসব করেন, আনন্দ-স্ফূর্তিতে মেতে ওঠেন। আতাউস সামাদ তাদের ‘ফিলদি রিচ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশের কৃষক এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন এই গোষ্ঠীর লোকজন আসলে নোংরা রকমের ধনীÑ‘ফিলদি রিচ’। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রঙিন কাপড়-চোপড় পরা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া এবং গান-বাজনা করাসহ যা কিছু তারা করেন সে সবের সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাঙালিয়ানার নামে তারা আসলে অর্থ-বিত্ত প্রদর্শনের নোংরা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। বিষয়টিকে আতাউস সামাদ সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে কৃষকদের সঙ্গে তামাশা বলে মনে করতেন। সম্পাদকীয় লিখতেও বলেছিলেন সেভাবে। তার অভিমতেরই প্রতিফলন ঘটেছিল ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল সংখ্যা দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদকীয়তে। যিনি লিখেছিলেন তার কাছেই ঘটনাটি শুনেছি।
বস্তুত সাংবাদিক আতাউস সামাদ সামান্যও বাড়িয়ে বা অসত্য বলেননি এবং তার ব্যাখ্যায়ও কোনো ভুল ছিল না। পহেলা বৈশাখের উৎসব-আনন্দের দিকে লক্ষ্য করলে পাঠকরাও বুঝতে পারবেন, কেন তিনি এই ঢাকার পার্টিকে ‘ফিলদি রিচ’ বা নোংরা রকমের ধনী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, বাংলা সনের প্রথম দিন বলে পহেলা বৈশাখে যারা মাটির শানকিতে পান্তা-ইলিশ খেয়ে ‘ঐতিহ্যবাহী’ ও ‘সর্বজনীন উৎসব’ করেন, নাচ-গানের মধ্য দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন, লাল-হলুদসহ নানা রঙের কাপড় পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় অংশ নেন এবং প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দিনভর বৈশাখী মেলায় ঘুরে বেড়ান, তাদের সঙ্গে গ্রামের গরীব কৃষকসহ সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আসলে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে উপহাসের পাশাপাশি ফাজলামোই করেন। সাম্প্রতিক কোনো বছরই এর ব্যতিক্রম হয়নি। সব মিলিয়েই ফিলদি রিচদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ বিশেষ করে শহুরে অবস্থাপন্নদের জন্য নোংরা আনন্দের একটি দিনে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে জনগণ বলতে যাদের বোঝায় সেই সাধারণ মানুষের পক্ষে কিন্তু এই আনন্দ উপভোগ করার কোনো সুযোগই থাকে না। তারা যথারীতি বঞ্চিতই থেকে যায়।
ইতিহাসের পর্যালোচনা করলেও বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বঙ্গাব্দ তথা বাংলা বর্ষের ইতিহাস জানাতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন, বাংলা এই সালের সূচনা করেছিলেন মুসলিম মুঘল সম্রাট আকবর। উদ্দেশ্য ছিল ফসলের ঋতুর ভিত্তিতে খাজনা আদায় করা। এর ফলে কৃষকের পক্ষে খাজনা দেয়ার সময় অর্থাৎ কখন খাজনা দিতে হবে তা মনে রাখা সহজ হতো। সরকারও বছরের বিশেষ সময়ে কম ঝামেলায় খাজনা আদায় করতে পারতো। নববর্ষের উৎসবও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। ঐতিহাসিক এই তথ্যের আলোকে বলা যায়, নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ সম্পূর্ণরূপেই ছিল কৃষিভিত্তিক একটি দিন। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল সেটাও ছিল কৃষিভিত্তিকই। এদেশের মানুষের জীবনেও এর রয়েছে নানামুখী প্রভাব। দিনটিকে শুভ মনে করা হয় বলে অনেক কৃষক পহেলা বৈশাখে জমিতে হাল দেয়। অনেকে ফসলের বীজ বোনে, রোপণ করে শস্যের চারা। দোকানদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীরা হালখাতার মাধ্যমে পুরনো হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাবের সূচনা করে। গ্রাম থেকে শহর-নগর-বন্দর পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে আয়োজিত হয় বৈশাখী মেলা। এসব মেলায় হরেক রকমের পণ্য নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসে কামার-কুমার ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। মেলায় থাকে মাটির পুতুলসহ খেলনা এবং দই ও মুড়ি-মুড়কির মতো উপাদেয় নানা খাবার। মেলা পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়। এখানে গ্রামীণ অর্থনীতিই প্রধান হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ‘ফিলদি রিচ’ তথা নোংরা রকমের ধনীদের উদ্যোগে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে রাজধানী ও বড় বড় কিছু শহরের বৈশাখী মেলা ও অনুষ্ঠানমালা নববর্ষের এই মূল চেতনা ও অবস্থান থেকে অনেকটাই এবং বহু দূরে সরে গেছে। বলা চলে, সুচিন্তিতভাবেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যেমন রাজধানীতে নববর্ষের উৎসব শুরু হয় রমনার বটমূলে। সেখানে পান্তা-ইলিশ ভোজনের মধ্য দিয়ে বাঙালিয়ানা দেখানোর বিলাসিতা করেন ওই নোংরা রকমের ধনীরা। তারা পহেলা বৈশাখকে বেছে নিয়েছেন টাকা দেখানোর এবং বিলাসিতা করার উপলক্ষ হিসেবে। অথচ পান্তা-ইলিশ খাওয়া কখনো গ্রাম বাংলার তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ছিল না। এটা চালু করেছেন ফিলদি রিচেরা। বিষয়টিকে বাংলা নববর্ষের মূল চেতনার সঙ্গেও মেলানোর উপায় নেই। কারণ, গ্রাম বাংলার কোনো অঞ্চলেই বছরের এই সময়ে ইলিশ পাওয়া যায় না। এটা ইলিশের মওসুমও নয়। সরকার তো বরং জাটকা ইলিশ নিধন বন্ধ করার জন্য এ সময় ইলিশ শিকারই নিষিদ্ধ করে থাকে। তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ বিশেষ করে ওই ‘ফিলদি রিচ’ তথা নোংরা রকমের ধনীরা নিষিদ্ধ সে ইলিশকে নিয়েই মেতে ওঠেন। সঙ্গে আবার খান পান্তা ভাত! অথচ গ্রাম বাংলার মানুষ কখনো ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারে না। তারা পান্তা খায় নুন-পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচ দিয়ে। সেটাও খায় বাধ্য হয়ে- ভালো কিছু খাওয়ার উপায় নেই বলে। একটু অবস্থাপন্নরা হয়তো সঙ্গে সবজি ও ছোট মাছ খায়। কিন্তু কেউই ইলিশ খায় না, পায় না বলে খেতেও পারে না।
এখানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কেও বলা দরকার। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নামে যেসব জীব-জন্তুর কুৎসিত মূর্তি এবং বীভৎস নানান প্রতিকৃতি নিয়ে রাজধানীতে মিছিল করা হয় সেগুলোর সঙ্গে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। এগুলো বরং মূর্তি পূজার কথাই মনে করিয়ে দেয়- ইসলাম যার বিরোধিতা করে। এজন্যই নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমানদের চিন্তা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটানো দরকার। এটাই ছিল আতাউস সামাদের মূল কথা। তিনি মনে করতেন, একই দেশে নববর্ষ উদযাপনের এই বৈষম্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার এবং নববর্ষ উদযাপনের মূল অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সময় এসেছে।
মানুষের ‘মঙ্গল’ সত্যি কাম্য হলে নতুন বছরের শুরুতে বরং জাতীয় জীবনের অন্যসব দিকে দৃষ্টি ফেরানো উচিত। হত্যা-গুম ও রাজনৈতিক দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি লোডশেডিং এবং গ্যাস ও পানির সংকট মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুনের তথা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যেন মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলার বিষয়! কথায় কথায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের জীবন ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আইনের চোখে প্রতিটি মানুষেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। এজন্যই বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংস্থাই শুধু নিন্দা-সমালোচনা করছে না, সর্বোচ্চ আদালতও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আতাউস সামাদও মনে করতেন, অপরাধ দমন ও নির্মূল করা সত্যি উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে যদি বিরোধী দলকে দমনের কাজে ব্যস্ত না রাখা হয় এবং পুলিশ যদি সরকারদলীয় গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পায় তাহলে দেশে হত্যা-সন্ত্রাসসহ অপরাধ দমন ও নির্মূল করাটা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
অন্যদিকে সব মিলিয়ে দেশের অবস্থা এখন শোচনীয়। এজন্যই নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে কেবলই উৎসব আনন্দ না করে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও নতুন করে অঙ্গিকার করা এবং উদ্যোগী হওয়া দরকার। প্রকৃতির প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ, সামনে থাকে কাল বৈশাখীর পালা। ওদিকে ভারতের পানি আগ্রাসনের পরিণতিতে বাংলাদেশের নদ-নদী খাল-বিল সব শুকিয়ে গেছে। দেশ মরুভূমি হওয়ার পর্যায়ে এসে গেছে। আর কিছুদিন পর ‘সাধের’ ইলিশও হয়তো পাওয়া যাবে না। অথচ ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরোধিতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো লক্ষণ ও প্রস্তুতিই কখনো লক্ষ্য করা যায় না। ভারতের পানি আগ্রাসন প্রতিহত করার এবং ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চেষ্টাও করছে না সরকার। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করনেওয়ালারাও ভারতের ব্যাপারে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকেন। কারণ অবশ্য সহজবোধ্য। এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। এজন্যই ভারতের কাছে নতজানু থাকার এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আড়ালে ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলমানদের মূর্তিপূজারী বানানোর কৌশলী কিন্তু ভয়ংকর প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে গেছেন আতাউস সামাদ। বস্তুত সব দিক থেকেই তার কাণ্ড ছিল আপসহীন এক দেশপ্রেমিকের। মুসলমান হিসেবেও তার অবস্থান ছিল বলিষ্ঠ। সে কারণেই যারা দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী তাদের উচিত ফ্যাসিস্ট শাসন এবং ভারতের সম্প্রসারণবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান এই দিশারী পুরুষের দেখিয়ে যাওয়া পথে এগিয়ে যাওয়া। মরহুম আতাউস সামাদকে বাঁচিয়ে রাখা।
শ্বাসরুদ্ধকর সেই বছরগুলোতে দুর্দান্ত সাহসী ছিল আতাউস সামাদের ভূমিকা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দারা বিরামহীনভাবে তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছে, প্রলোভনও কম দেখানো হয়নি। কিন্তু ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে এবং প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন চালিয়েও তাকে সত্য প্রকাশ করা থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি এমনকি গ্রেফতারও বরণ করেছেন। ১৯৮০-র দশকের ওই দিনগুলোতে মানুষ আতাউস সামাদের পাঠানো খবর শোনার জন্য সাগ্রহে বিবিসি রেডিও খুলে বসে থাকতো। তার নিজের কণ্ঠেও অনেক খবর শোনা যেতো। সে সময় মোবাইল দূরে থাকুক, সাধারণ বা ল্যান্ড টেলিফোনও খুব কম মানুষেরই ছিল। ফলে স্বৈরশাসকের প্রচণ্ড দমনমূলক পদক্ষেপের মুখে দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন। আন্দোলনের কর্মসূচী সম্পর্কেও তারা জানার সুযোগ পেতেন না। এ ধরনের পরিস্থ’তিতে আতাউস সামাদই প্রধান ভরসা হয়ে উঠতেন। বিবিসিতে প্রচারিত তার খবরই নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও উজ্জীবিত করতো। সেদিক থেকে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে আতাউস সামাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। জীবনের শেষদিনগুলো পর্যন্তও গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি তার এই অবস্থানকে বজায় রেখেছিলেন। প্রয়োজনের সময়ে প্রত্যক্ষ কাণ্ডও পালন করেছেন তিনি।
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ছিল আতাউস সামাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি ঘটনা ও তথ্যকে। কোনো বিষয়ের সঙ্গে ভিন্নমত থাকলেও সে সংক্রান্ত সঠিক তথ্য বা খবর প্রকাশের ব্যাপারে তিনি সৎ থাকতেন। কোনো তথ্যেরই বিকৃতি ঘটাতেন না। তার সঙ্গে বা অধীনে যারা সাংবাদিকতা করেছেন তাদেরও তিনি সঠিক তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সততা বজায় রাখার তাগিদ দিতেন। অনুসন্ধান বা খবর খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার দৃষ্টি ছিল খুবই তীক্ষ্ণ। এমন অনেক বিষয়েই তিনি রিপোর্ট করেছেন ও অন্যদের দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছেন- যেগুলো সহজে কারো চোখেই পড়তো না। এরকম অনেক খবরই পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসবের মাধ্যমে দেশ ও জাতিও যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে।
সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের যে কোনো সংকট ও দুঃসময়ে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। ১/১১-এর অবৈধ অভ্যুত্থান এবং জেনারেল মইন-ফখরুদ্দিনদের অসাংবিধানিক স্বৈরশাসনের দিনগুলোতে দৈনিক আমার দেশকে বাঁচিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন, চরম বিপদের মুখেও সাংবাদিকদের আগলে রেখেছেন পরম আদরে। হুমকির তিনি পরোয়াই করেননি কখনো। মইন-ফখরুদ্দিনদের সময় দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার ও অর্থনৈতিক অবরোধসহ বিভিন্ন কারণে আমার দেশ-এর অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল তখনও আতাউস সামাদই এগিয়ে এসেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমানকে তিনি শুধু আমার দেশ-এর সঙ্গে যুক্তই করেননি, তাকে সাংবাদিকতায়ও এনেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমার দেশ যখন দফায় দফায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মিথ্যা মামলার আড়ালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সরকার যখন কারাগারে ঢুকিয়েছে তখনও অভয়ের বাণীমুখে দুর্দান্ত সাহসে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। বস্তুত তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বই আমার দেশকে প্রায় নিশ্চিত ধ্বংসের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছিল। বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভিও আতাউস সামাদের নেতৃত্ব পেয়েছিল বলেই সে সময় টিকে থাকতে পেরেছে।
অতুলনীয় ছিল তার দেশপ্রেম। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং সীমান্তে হত্যাকা- থেকে ফারাক্কা বাঁধের কুফল ও পানি আগ্রাসন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি আপসহীন দেশপ্রেমিকের কাণ্ড পালন করেছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় স্বার্থেই ভারতকে করিডোর দেয়ার কঠোর বিরোধিতা করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন আতাউস সমাদ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোতে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এজন্যই দলনির্বিশেষে সবাই তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়েছিলেন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আতাউস সামাদ ছিলেন খোলা মনের মানুষ। ওয়াক্তিয়া নামায আদায় করতেন তিনি নিয়মিতভাবে। রোযাও রাখতেন, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করতেন না। সংস্কৃতির নামে জাতীয় জীবনের বহু কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় তিনি ছিলেন নির্ভীক ও দ্বিধাহীন। বিবিসি’র সাংবাদিক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা আতাউস সামাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি রয়েছে। অসাধারণ ছিল তার দেশপ্রেম। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তো বটেই, সব সরকারও তাকে যথেষ্ট সমীহ করতো। অনেকেই পরামর্শের জন্য তার কাছে যেতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি বর্তমানে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্তিকালের কয়েকদিন আগেও তিনি কলাম লিখেছেন।
দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে আতাউস সামাদ কতটা আন্তরিক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে একটি ঘটনা থেকে। এটা ২০১১ সালের কথা। সেবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সম্পাদকীয় লেখার ব্রিফিং দেয়ার সময় আতাউস সামাদ সেই বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয়ে বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, পহেলা বৈশাখে যারা ইলিশ দিয়ে পান্তা খাওয়ার মাধ্যমে উৎসব করেন, আনন্দ-স্ফূর্তিতে মেতে ওঠেন। আতাউস সামাদ তাদের ‘ফিলদি রিচ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশের কৃষক এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন এই গোষ্ঠীর লোকজন আসলে নোংরা রকমের ধনীÑ‘ফিলদি রিচ’। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রঙিন কাপড়-চোপড় পরা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া এবং গান-বাজনা করাসহ যা কিছু তারা করেন সে সবের সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাঙালিয়ানার নামে তারা আসলে অর্থ-বিত্ত প্রদর্শনের নোংরা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। বিষয়টিকে আতাউস সামাদ সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে কৃষকদের সঙ্গে তামাশা বলে মনে করতেন। সম্পাদকীয় লিখতেও বলেছিলেন সেভাবে। তার অভিমতেরই প্রতিফলন ঘটেছিল ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল সংখ্যা দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদকীয়তে। যিনি লিখেছিলেন তার কাছেই ঘটনাটি শুনেছি।
বস্তুত সাংবাদিক আতাউস সামাদ সামান্যও বাড়িয়ে বা অসত্য বলেননি এবং তার ব্যাখ্যায়ও কোনো ভুল ছিল না। পহেলা বৈশাখের উৎসব-আনন্দের দিকে লক্ষ্য করলে পাঠকরাও বুঝতে পারবেন, কেন তিনি এই ঢাকার পার্টিকে ‘ফিলদি রিচ’ বা নোংরা রকমের ধনী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, বাংলা সনের প্রথম দিন বলে পহেলা বৈশাখে যারা মাটির শানকিতে পান্তা-ইলিশ খেয়ে ‘ঐতিহ্যবাহী’ ও ‘সর্বজনীন উৎসব’ করেন, নাচ-গানের মধ্য দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন, লাল-হলুদসহ নানা রঙের কাপড় পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় অংশ নেন এবং প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দিনভর বৈশাখী মেলায় ঘুরে বেড়ান, তাদের সঙ্গে গ্রামের গরীব কৃষকসহ সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আসলে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে উপহাসের পাশাপাশি ফাজলামোই করেন। সাম্প্রতিক কোনো বছরই এর ব্যতিক্রম হয়নি। সব মিলিয়েই ফিলদি রিচদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ বিশেষ করে শহুরে অবস্থাপন্নদের জন্য নোংরা আনন্দের একটি দিনে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে জনগণ বলতে যাদের বোঝায় সেই সাধারণ মানুষের পক্ষে কিন্তু এই আনন্দ উপভোগ করার কোনো সুযোগই থাকে না। তারা যথারীতি বঞ্চিতই থেকে যায়।
ইতিহাসের পর্যালোচনা করলেও বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বঙ্গাব্দ তথা বাংলা বর্ষের ইতিহাস জানাতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন, বাংলা এই সালের সূচনা করেছিলেন মুসলিম মুঘল সম্রাট আকবর। উদ্দেশ্য ছিল ফসলের ঋতুর ভিত্তিতে খাজনা আদায় করা। এর ফলে কৃষকের পক্ষে খাজনা দেয়ার সময় অর্থাৎ কখন খাজনা দিতে হবে তা মনে রাখা সহজ হতো। সরকারও বছরের বিশেষ সময়ে কম ঝামেলায় খাজনা আদায় করতে পারতো। নববর্ষের উৎসবও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। ঐতিহাসিক এই তথ্যের আলোকে বলা যায়, নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ সম্পূর্ণরূপেই ছিল কৃষিভিত্তিক একটি দিন। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল সেটাও ছিল কৃষিভিত্তিকই। এদেশের মানুষের জীবনেও এর রয়েছে নানামুখী প্রভাব। দিনটিকে শুভ মনে করা হয় বলে অনেক কৃষক পহেলা বৈশাখে জমিতে হাল দেয়। অনেকে ফসলের বীজ বোনে, রোপণ করে শস্যের চারা। দোকানদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীরা হালখাতার মাধ্যমে পুরনো হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাবের সূচনা করে। গ্রাম থেকে শহর-নগর-বন্দর পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে আয়োজিত হয় বৈশাখী মেলা। এসব মেলায় হরেক রকমের পণ্য নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসে কামার-কুমার ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। মেলায় থাকে মাটির পুতুলসহ খেলনা এবং দই ও মুড়ি-মুড়কির মতো উপাদেয় নানা খাবার। মেলা পরিণত হয় মানুষের মিলন মেলায়। এখানে গ্রামীণ অর্থনীতিই প্রধান হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ‘ফিলদি রিচ’ তথা নোংরা রকমের ধনীদের উদ্যোগে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে রাজধানী ও বড় বড় কিছু শহরের বৈশাখী মেলা ও অনুষ্ঠানমালা নববর্ষের এই মূল চেতনা ও অবস্থান থেকে অনেকটাই এবং বহু দূরে সরে গেছে। বলা চলে, সুচিন্তিতভাবেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যেমন রাজধানীতে নববর্ষের উৎসব শুরু হয় রমনার বটমূলে। সেখানে পান্তা-ইলিশ ভোজনের মধ্য দিয়ে বাঙালিয়ানা দেখানোর বিলাসিতা করেন ওই নোংরা রকমের ধনীরা। তারা পহেলা বৈশাখকে বেছে নিয়েছেন টাকা দেখানোর এবং বিলাসিতা করার উপলক্ষ হিসেবে। অথচ পান্তা-ইলিশ খাওয়া কখনো গ্রাম বাংলার তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ছিল না। এটা চালু করেছেন ফিলদি রিচেরা। বিষয়টিকে বাংলা নববর্ষের মূল চেতনার সঙ্গেও মেলানোর উপায় নেই। কারণ, গ্রাম বাংলার কোনো অঞ্চলেই বছরের এই সময়ে ইলিশ পাওয়া যায় না। এটা ইলিশের মওসুমও নয়। সরকার তো বরং জাটকা ইলিশ নিধন বন্ধ করার জন্য এ সময় ইলিশ শিকারই নিষিদ্ধ করে থাকে। তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ বিশেষ করে ওই ‘ফিলদি রিচ’ তথা নোংরা রকমের ধনীরা নিষিদ্ধ সে ইলিশকে নিয়েই মেতে ওঠেন। সঙ্গে আবার খান পান্তা ভাত! অথচ গ্রাম বাংলার মানুষ কখনো ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারে না। তারা পান্তা খায় নুন-পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচ দিয়ে। সেটাও খায় বাধ্য হয়ে- ভালো কিছু খাওয়ার উপায় নেই বলে। একটু অবস্থাপন্নরা হয়তো সঙ্গে সবজি ও ছোট মাছ খায়। কিন্তু কেউই ইলিশ খায় না, পায় না বলে খেতেও পারে না।
এখানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কেও বলা দরকার। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নামে যেসব জীব-জন্তুর কুৎসিত মূর্তি এবং বীভৎস নানান প্রতিকৃতি নিয়ে রাজধানীতে মিছিল করা হয় সেগুলোর সঙ্গে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। এগুলো বরং মূর্তি পূজার কথাই মনে করিয়ে দেয়- ইসলাম যার বিরোধিতা করে। এজন্যই নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমানদের চিন্তা-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটানো দরকার। এটাই ছিল আতাউস সামাদের মূল কথা। তিনি মনে করতেন, একই দেশে নববর্ষ উদযাপনের এই বৈষম্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার এবং নববর্ষ উদযাপনের মূল অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সময় এসেছে।
মানুষের ‘মঙ্গল’ সত্যি কাম্য হলে নতুন বছরের শুরুতে বরং জাতীয় জীবনের অন্যসব দিকে দৃষ্টি ফেরানো উচিত। হত্যা-গুম ও রাজনৈতিক দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি লোডশেডিং এবং গ্যাস ও পানির সংকট মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুনের তথা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যেন মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলার বিষয়! কথায় কথায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের জীবন ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আইনের চোখে প্রতিটি মানুষেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। এজন্যই বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংস্থাই শুধু নিন্দা-সমালোচনা করছে না, সর্বোচ্চ আদালতও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আতাউস সামাদও মনে করতেন, অপরাধ দমন ও নির্মূল করা সত্যি উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে যদি বিরোধী দলকে দমনের কাজে ব্যস্ত না রাখা হয় এবং পুলিশ যদি সরকারদলীয় গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পায় তাহলে দেশে হত্যা-সন্ত্রাসসহ অপরাধ দমন ও নির্মূল করাটা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারে।
অন্যদিকে সব মিলিয়ে দেশের অবস্থা এখন শোচনীয়। এজন্যই নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে কেবলই উৎসব আনন্দ না করে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও নতুন করে অঙ্গিকার করা এবং উদ্যোগী হওয়া দরকার। প্রকৃতির প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ, সামনে থাকে কাল বৈশাখীর পালা। ওদিকে ভারতের পানি আগ্রাসনের পরিণতিতে বাংলাদেশের নদ-নদী খাল-বিল সব শুকিয়ে গেছে। দেশ মরুভূমি হওয়ার পর্যায়ে এসে গেছে। আর কিছুদিন পর ‘সাধের’ ইলিশও হয়তো পাওয়া যাবে না। অথচ ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরোধিতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো লক্ষণ ও প্রস্তুতিই কখনো লক্ষ্য করা যায় না। ভারতের পানি আগ্রাসন প্রতিহত করার এবং ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চেষ্টাও করছে না সরকার। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করনেওয়ালারাও ভারতের ব্যাপারে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকেন। কারণ অবশ্য সহজবোধ্য। এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। এজন্যই ভারতের কাছে নতজানু থাকার এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আড়ালে ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলমানদের মূর্তিপূজারী বানানোর কৌশলী কিন্তু ভয়ংকর প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে গেছেন আতাউস সামাদ। বস্তুত সব দিক থেকেই তার কাণ্ড ছিল আপসহীন এক দেশপ্রেমিকের। মুসলমান হিসেবেও তার অবস্থান ছিল বলিষ্ঠ। সে কারণেই যারা দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী তাদের উচিত ফ্যাসিস্ট শাসন এবং ভারতের সম্প্রসারণবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান এই দিশারী পুরুষের দেখিয়ে যাওয়া পথে এগিয়ে যাওয়া। মরহুম আতাউস সামাদকে বাঁচিয়ে রাখা।
আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন