বাংলাদেশের রাজনীতি একটি প্রকৃত সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্কটটি মাঠে-ময়দানের ক্ষেত্রে যেমন সত্য; চিন্তা-দর্শনের ক্ষেত্রে ততোধিক সত্য। সঙ্কটটি রাজনীতির গতিপথ নিয়ে। রাজনীতির গতিপথটি কি আদর্শের দিকে যাবে? নাকি স্বার্থের পথে চলবে? এই প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত, আমরা যে রাজনৈতিক সঙ্কট ও স্থবিরতা দেখতে পাচ্ছি, সেটা দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং আদর্শ ও স্বার্থের প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান ও বিশ্বস্ত বক্তব্য দিতে রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপছে। স্বৈরাচার ফায়দা লুটছে। গণতন্ত্রের করুণ দশা আরো বাড়ছে। সংগ্রামী ও প্রকৃত জনসম্পৃক্তশক্তি, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রামের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশকে একটি আদর্শবাদী-কল্যাণধর্মী-ইনসাফভিত্তিক-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপহার দিতে চায়, তাদেরকেও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাঠে যথার্থ সাথী খুঁজে নেওয়ার বা প্রকৃত শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। কারণ শেষ বিচারে রাজনীতি একটি আদর্শগত লড়াই এবং এখানে স্বার্থবাদীদেরকে কোনো না কোনো পর্যায়ে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
আদর্শ ও স্বার্থগত প্রশ্নে রাজনৈতিক শক্তিসমূহের দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতার সূত্রপাত ১/১১-এর পর থেকেই উদ্ভব ঘটে। অনেক বড় দলও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের আদর্শিক গভীরতা ও সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুধাবনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। পরিবর্তন যে কেবল ক্ষমতার ক্ষেত্রেই হয় নি, আদর্শের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, সেটা বোঝার সামর্থ্য অনেকের কাছ থেকেই দেখতে পাওয়া যায় নি। একটি আস্ত রাজনীতিক মতাদর্শ, দল ও পরিবার এবং এদের সহযোগীদের ধ্বংস ও নস্যাৎ করার চূড়ান্ত পদক্ষেপ গৃহীত হওয়ার পরেও অনেকের বোধোদয় হয় নি যে, আসলে রাজনীতির নামে কী হচ্ছে! বরং বাল-সুলভ চপলতায় নানা ফন্দি ও তৎপরতায় সমস্যাটিকে মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে ঘাটে ঘাটে নাকাল হয়েও তাদের সাবালকত্ব আসে নি। এই ধরনের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও দীর্ঘমেয়াদী লড়াই যে গামছাওয়ালা বা কালাকোটওয়ালা একদলীয়দের বাই-প্রোডাক্টদের সাথে নিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেই কাণ্ডজ্ঞানটুকু অনেকের মধ্যে নেই। আদর্শগত লড়াই আদর্শগত বিবেচনাতেই দেখার কথা। স্বার্থের প্রয়োজনে রাম-যদুকে দলে ভিড়িয়ে তা সম্ভব হওয়ার নয়। হচ্ছেও না।
জাতির সামনে যখন মৌলিক দায়িত্ব হিসাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলার অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে, তখন এসব ঠুনকো সেনাপতিতে কাজ হওয়ার কথা নয়। বাক্যবাগীশ তালপাতার সেপাইদের উপরে আদর্শকে স্থান দান করাই তখন কর্তব্য। বরং অতীতের ফতুর ও দেউলিয়া এবং যারা নানা দ্বারে করুণা ভিক্ষাকারী, তাদেরকে চরম সঙ্কট উত্তরণে সংযুক্ত করা মানেই হলো বোঝা বাড়ানো; যারা যথাসময়ে তাদের প্রাচীন রক্ত ও সুপ্তভাবে লালিত বিশ্বাসের পক্ষেই কথা বলবে। রাজনীতির আদি প্রভুর চরণের দিকেই তারা ঠাঁই খুঁজে নেবে। এতোটুকু সরল সত্য অনুধাবনে ইতিমধ্যে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচিতি কালিমাযুক্ত, অস্তিত্ব প্রায়-বিপন্ন বা বিলুপ্ত তাদের বাজার-মূল্য খানিক বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণের কোনো লাভ হবে না এবং চলমান সঙ্কট বিমোচনের পথেও কোনো কার্যকর সুরাহা আসবে না, এই পরিষ্কার কথাটি রাখ-ঢাক করে বলার দরকার পড়ে না। পাঠশালাগামী নি¤œস্তরের বালকেরাও এ কথা সজোরে বলতে দ্বিধা করবে না। অবিরাম হত্যা-হামলা-মামলা-রক্তদানের বিরুদ্ধে এইসব মেকীদের সংঘশক্তি হাস্যকর নাটকীয় বিনোদন ছাড়া আর কিছুই প্রসব করতে পারবে না। রাজনৈতিক ডিগবাজি-দলবদলকারীদের বাজার-মূল্য এতে কিছুটা বাড়লেও জনগণের আন্দোলনের বিশেষ কোনো লাভ হওয়ার কোনো সঙ্গত বা যৌক্তিক কারণ নেই।
এ কথা না বললেও চলে যে, বাংলাদেশে জনগণ সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন পরিস্থিতি পাড়ি দিচ্ছে। গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন অনেক রক্ত দিয়ে চলেছে। দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয় নি। আইনের শাসনের আওয়াজ দেশে-বিদেশে প্রতিনিয়তই শোনা যায়। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে রয়েছে। অধিকারের আরো অনেক জায়গায় জনতার পক্ষ থেকে উত্থাপিত হচ্ছে বহু দাবি। সুন্দরবন বাঁচানোর আকুতির সঙ্গে সঙ্গে পানি ও নদীর জন্য হাহাকার তো রয়েছেই। এমনই অবস্থায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। অজ্ঞাত সূত্র থেকে চলছে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা। আকস্মিকভাবে মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষজন। আটক জঙ্গি বা সন্দেহভাজনরাও মারা যাচ্ছে ক্রস ফায়ারে; কথিত বন্দুক যুদ্ধে। পুরো পরিস্থিতিই একটি আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চার করেছে, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া অতীব জরুরি এবং এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সমস্যা বাড়লেও প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়ে চলছে কালবিলম্ব, রাজনীতি ও ক্ষুদ্রতা। একে রাখা যাবে না, ওকে নিতে হবে, এই জাতীয় কথা-বার্তা বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মুখেই মানায়, যারা ফ্যাসিস্ট ও গণবিরোধী। দুঃখজনক সত্য হলো, এমন কথা শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার স্বার্থে ক্ষমতাসীনরাই বলছে না; বলছে এমন কেউ, মোটে গামছাই যার সম্বল। পরিস্থিতি এখানেই থেমে থাকলে বলার কিছু ছিল না। বলতে হচ্ছে এ কারণে যে, সকল রাজনৈতিক রীতি-নীতি, শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। উর্দু প্রবাদের মতো ‘উল্টা চোর কোতওয়াল কো ঢাটে’-এর মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই চলছে। এমন ব্যাটা হম্বি-তম্বি করছে, যাদের রেকর্ড ঘোরতর কালো। বলছে তাদের সম্পর্কে যারা ফাঁসি, জেল, জুলুম, রক্ত, ত্যাগের মাধ্যমে জনতার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। এমন হম্বি-তম্বি ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেও দেওয়া হয়েছিল। একে রাখুন, ওকে আনুন-এমন নসিয়ত বা ক্ষেত্র বিশেষে হুমকীও কম হয়নি। কে কার সঙ্গে থাকবে বা থাকবে না, এ মাথা ব্যথা অন্যের কেন? ডাল ম্যা কুছ তো কালা হ্যায়। পরামর্শদাতাদের উদ্দেশ্য ভালো না, তা বলাই বাহুল্য।
সম্ভবত জাতীয় নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলেছিলেন কথাটি। কথাটি হলো, “যখন তোমার প্রতিপক্ষ তোমার প্রশংসা করবে তখন সাবধান হবে। বুঝবে, তোমার বিপদ আছে। আর যখন তোমার প্রতিপক্ষ সমালোচনা ও নিন্দা করবে, জানবে, তুমি সঠিক পথে আছো।” বিরোধী বা প্রতিপক্ষের দলগুলোকে দম্ভভরে ক্ষমতায়-থাকা কিংবা ক্ষমতায়-থাকাদের ভাই-বেরাদররা এতো উপদেশ খয়রাত করছে কেন? তাদের কথা মতো সব কাজ করলে তো তাদের দলে গিয়ে মিশে যেতে হয়। একদলীয় পরিস্থিতির পথও সুগম হয়। তাহলে আর আন্দোলন-সংগ্রামের বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দরকার পড়ে কেন? হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আদর্শিক কারণে জেল-জুলুম সইতে হয় কেন? শহিদের রক্ত, কারাবন্দির হাহাকারকে পায়ে পিষে যদি কেউ মত ও পথ বদলায়, তবে সেটা ঐতিহাসিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই হবে না।
এমনটি হওয়ার কারণ একটিই। আদর্শ ও স্বার্থের মধ্যে ফারাক করতে না পারা। পরিস্থিতির আদর্শগত গভীরতা বুঝতে না পারা। নিজের নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে না পারা। দেশের অবস্থা পরিবর্তন করবো আর জেল-জুলুম কিছুই সইবো না, স্বার্থগত ও কৌশলগত অবস্থানের নামে তালে তালে থাকবো, এমন অবস্থা আর নেই। এমন অবস্থা আছে মনে করে যারা তাল করছেন, তারা সামনেই বিপদের রক্ত-দাঁতগুলো দেখতে পাবেন। এখনো যারা আদর্শগত বিবেচনায় রাজনীতি ও আন্দোলনের জায়গাটিকে স্পষ্ট করতে পারছেন না, স্বার্থগত সমীকরণের উপর ভর করে ফাঁকতালে ক্ষমতায় যাওয়ার যোগ-বিয়োগ করছেন, তাদের সামনেও কঠিন শিক্ষা অপেক্ষা করছে। ১/১১-এর পর রাজনীতি কোন চক্করে এবং কাদের খপ্পরে পড়েছে, সেটা মালুম হওয়ার মতো পোক্ত মগজ এখনো তাদের হয় নি। হবে। কিছুটা গোনাহগারি দেওয়ার পর।
এমন পরিস্থিতিতে স্বার্থগত রাজনৈতিক গতিপথকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করাই শ্রেয়। রাজনীতি যে আদর্শের খেলা, সে মেরুকরণ তীব্র হয়ে গেলে ক্ষুদ্র স্বার্থগত কৌশল বা চা-পানের রাজনীতি তুচ্ছ হয়ে যায়। তুচ্ছ পথে বড় বিজয় অসম্ভব। এভাবে জনতাকে সংগঠিত করা এবং জনস্বার্থে সম্মিলিত করাও অসম্ভব। জনতা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে রাজনীতিকে দেখে। বাস্তবতার কঠিন পরশে তারা মেরুকরণের আদর্শিক জায়গাটিকে বেছে নেয়। জনবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ বা তথাকথিত নেতাদের আহাজারিতে তাদের কিছুই করার থাকে না। জনতা থাকে জনসম্পৃক্ত নেতা-কর্মীদেরই সঙ্গে। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে জনতার সঙ্গে জনসম্পৃক্ত-দলের যে সম্পর্ক মজবুত ভিত্তি পেয়েছে, সেটাকে রাজনৈতিক-মতাদর্শিক মেরুকরণের পথে নিয়ে যাওয়াই এখন কর্তব্য। এমনই তীব্র পরিস্থিতিতে স্বার্থগত বা কৌশলগত সমঝোতার নামে রঙ-বেরঙের চরিত্রের উদ্দেশ্যমূলক একত্রীকরণ ফলপ্রসূ কোনো কার্যক্রম নয়। প্রতিপক্ষের পরামর্শ শোনলে আর নানা পদের বিচিত্র চরিত্রের ভিড় বাড়ালে আদর্শ ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বও যাবে, স্বার্থও হাসিল হবে না। অতএব সাধু সাবধান।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন