মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

এখন বড়ই অচেনা হয়ে গেছে বাংলাদেশ


গুলশানের হোটেল আর্টিজান ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৮ জন বিদেশিসহ ২২ জন মানুষের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের চেহারাই বদলে গেছে। এখন আর কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে, বাংলাদেশের ইমেজ আর কখনও আগের জায়গায় ফিরে যাবে। হাজার বছর ধরে অতিথিবৎসল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম সৃষ্টি হয়েছিল, গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর তার বিনাশ ঘটেছে। এরপর ঘটেছে আরও দুটো ঘটনা। একটি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বহত্তম ঈদ জামাতে হামলা আর কল্যাণপুরে একটি মেসে সন্ত্রাসী বলে অবিহিত ৯ জন যুবকের হত্যাকাণ্ড। শোলাকিয়ায়ও নিহত হয়েছেন দুই পুলিশ সদস্য, এক সন্ত্রাসী ও একজন গৃহবধূ। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ফলে সারা বিশ্বের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশ ও তার জনগণ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে এখন আর আসতে চাইছে না, কোনো ব্যাবসায়ী, বিনিয়োগকারী বা পর্যটক। অথচ এর সবই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে জড়িত।
যদিও পুলিশ সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু তার কোনো কিছুই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বিশেষ করে বিদেশিদের মধ্যে ভীতি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তারা যেমন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তেমনি উদ্বিগ্ন তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়েও।
ইতিমধ্যে এদের অনেকেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেক বিদেশি বাংলাদেশ ছাড়বার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। অনেকেই নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিবারবর্গকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ তো হচ্ছেই না, আসছে না সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও। থমকে গেছে সব কিছু। এখন বাংলাদেশকে দুটো ফ্রন্টই সামাল দিতে হচ্ছে, একটি অভ্যন্তরীণ আরেকটি বৈদেশিক।
পুলিশ সম্ভাব্য জঙ্গিদের ধরা ও নির্মূল করার নানমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিদেশিদের মন থেকে ভয় দূর করার জন্য সরকারের তরফ থেকে নানা রকম আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। পর্যটনমন্ত্রী এমনও বলেছেন যে, পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য তাদের সঙ্গে পুলিশ দেয়া হবে। কিন্তু পুলিশের পাহারায় কেউ কি বেড়াতে আসে? রাতে যে হোটেলে থাকবেন তার গেটে যদি পুলিশ পাহারা বসানো হয় তাহলে তাদের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না। মানুষ বেড়াতে যায় কিংবা আসে নির্মল আনন্দ লাভের জন্য। পুলিশ পাহারায় সেটি কিছুতেই সম্ভব হবে না। একই কথা প্রযোজ্য বিদেশি কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। ভয়ভীতি নিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় না। কোনো কোনো দূতাবাস তাদের কর্মীদের বাসা গুলশান বনানী ছেড়ে বারিধারায় স্থানান্তর করতে বলেছেন। কোনো কোনো দূতাবাস তাদের কূটনীতিক ও কর্মীদের পাঁচতারকা হোটেল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। অথচ ব্যবসায়িক আলাপ-আলোচনা, চুক্তিÑএসবই সম্পাদিত হয় পাঁচতারকা হোটেলগুলোতেই। আর নিরাপত্তা সমস্যার কারণেই বিদেশিরা এখন আর বাংলাদেশে আসতে চাইছেন না। এমন কি ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য তারা তৃতীয় কোনো দেশে বৈঠক করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এ রকম গোঁজামিলে বাণিজ্য হয় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় তারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। সে প্রক্রিয়াও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আর ভারত মরিয়া হয়ে বাংলাদেশে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সেসব ব্যবসা বাণিজ্য করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে।
পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন যে, সরকারের বহুমুখী চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আবার আগের বাংলাদেশ হবে- এ ব্যাপারে তার শঙ্কা রয়েছে।
বিদেশিদের অশঙ্কা এই জন্য কাটছে না যে, সরকার জননিরাপত্তার এই ইস্যুটিকে বিরোধী দলকে ঘায়েলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আর সেভাবেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার বিদেশিদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে দৃশ্যত চেষ্টার ত্রুটি করছে না। কিন্তু পরিহাস হলো এই যে, এ রকম একটি জাতীয় সঙ্কটকালে সকল রাজনৈতিক দল ও সুধী সমাজকে একতাবদ্ধ করার কোনো প্রয়াস সরকারের নেই। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যখন ঐক্যের ডাক দেয়া হয়েছিল, তখন সরকারী লোকেরা নানা মশকার করে সে আহ্বান উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটি কোনো পরিপক্বতার পরিচায়ক নয়। সরকার মনে করছে, তারা নিজেরাই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম। এতে বিদেশিদের উদ্বেগ তো কমায়ই নি, বরং বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
আতঙ্ক এখন সর্বত্র। কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়গুলো আছে কড়া নজরদারিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জঙ্গি বলে তরুণদের সন্দেহ করা হচ্ছে। অভিভাবকদের দিন কাটছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়। তাদের সন্তানও কি কোনো চরম পন্থার দিকে ঝুঁকছে কিংবা তারা অযথা পুলিশের হয়রানির শিকার হবে না তো? তা ছাড়া পুলিশ ধারাবাহিকভাবে ব্যাচেলদের মেসবাড়িতে জঙ্গি খুঁজতে হানা দিচ্ছে। এসব মেসবাড়িতে যেমন হাজার হাজার ছাত্র থাকেন, তেমনি থাকেন বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত চাকরিজীবীরা। যারা সপ্তাহান্তে বা মাসান্তে একবার গ্রামে যান। স্ত্রী পুত্র কন্যা পিতা মাতা নিয়ে বাসা ভাড়া করে শহরে থাকবার সঙ্গতি তাদের নেই। শুধু পুলিশের ভয়ে নয়, বাড়িওয়ালারাও এখন ব্যাচেলরদের আর মেস ভাড়া দিতে চাইছেন না। তাদেরও ভয় ছাত্র কিংবা চাকরিজীবীর পরিচয়ে কোনো জঙ্গি তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেবে না তো। সে রকম হলে পুলিশি হাঙ্গামার শিকার হবেন তারা। এমনি এক আতঙ্কের মধ্যে এখন আছে জনজীবন।
কিন্তু এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার শতভাগ নির্ভর করছে পুলিশ বাহিনীর উপর। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর একার পক্ষে কোনোদিনই জঙ্গি দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হবে না। এর জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। আর সেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কাজ পুলিশের নয়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ জঙ্গি দমনের নামে সাধারণ মানুষের উপর কঠোর নির্যাতন চালাচ্ছে। ফলে আস্থা অর্জনের বদলে পুলিশের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ। সুতরাং অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শুধুমাত্র পুলিশের উপর নির্ভরশীলতা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হচ্ছে। তাদের ব্যাপক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভয় পাচ্ছেন বহু ক্ষেত্রে। আর সে কারণেই বাংলাদেশি মানুষ কিংবা বিদেশিরা এমনটি আশা করেন না যে, শিগগিরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
এদিকে আরও নতুন হামলা আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের নাগরিকদের ঢাকার পাঁচতারকার হোটেল কিংবা জনসমাগমস্থলে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। অন্যান্য দূতাবাস তাদের কর্মীদের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা কিংবা অরক্ষিত সাধারণ যাববাহনে চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট নিজেও বিভিন্ন পার্টি ও অভিজাত হোটেলে আয়োজিত কর্মসূচিতে যোগদান থেকে বিরত রয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও ইউরোপীয় দেশসমূহ ঢাকায় কর্মরত তাদের কূটনীতিকদের পরিবারকে দেশে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। কানাডা তাদের কূটনীতিকদের পরিবারকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। দুজন জার্মান কূটনীতিক তাদের সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা আর বাংলাদেশে কাজ করতে যাবেন না। জাপান সরকার তাদের কূটনীতিকদের গুলশান বনানী ছেড়ে বারিধারায় বাসা নিতে বলেছে। কারণ, দূতাবাস মনে করছে, গুলশান-বনানীর চেয়ে বারিধারা অধিক নিরাপদ। তারা দ্রুত বাসা বদল করছেন।
এখন আবার দেশে পালিত হচ্ছে নিরুত্তাপ পর্যটন বর্ষ। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার মনে করছে যে, বিশেষ করে বিদেশিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। তাই বৃটিশরা যেন এমন সব জায়গা পরিহার করে চলে, যেখানে সাধারণত বিদেশিদের সমাগম বেশি হয়। কানাডা মনে করে, বাংলাদেশে আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। আর তা হতে পারে যে কোনো স্থানে, যেকোনা সমাগমে। পর্যটন বর্ষাকালেও দেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলোর অবস্থা শোচনীয়। হাজার হাজার বিদেশি, যারা বাংলাদেশে বেড়াতে আসবেন বলে হোটেল বুকিং দিয়েছিলেন, তারা সেসব বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন। অনেক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা হোটেলে বা কনফারেন্স সেন্টারে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, গুলশান হামলার পর তারাও সেগুলোও বাতিল করে দিয়েছেন। অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতেও নেই বিদেশি অতিথিদের ভিড়। ফলে তাদের ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলার জোগাড়। ট্যুর অপারেটরস সমিতি কিছুদিন আগে জানিয়েছে যে, গত দেড় মাসে ১০ হাজার বিদেশি তাদের নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন।
এরপরও কীভাবে আশা করা যায় যে, বাংলাদেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads