চার দিক যেন থমথমে নিঃস্তব্ধ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়া গুমোট। কোথাও শীতল হাওয়ার দোলা নেই। কিছুকাল আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, “চার দিকে থমথমে অবস্থা। এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের আগে ঠিক এমনি এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এ কথা আপনারা সবাই জানেন, ঝড়ের আগে এমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়। বাঙালিরা যেমন বীরের জাতি, তেমনি বেঈমানেরও জাতি। তারা ‘বঙ্গবন্ধু’কে হত্যা করেছে। স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাই না। আপনারা বুঝে নেবেন। সুতরাং আওয়ামী নেতাকর্মীদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।” তিনি বুঝতে পেরেছেন, ঝড় সমম্ভবত আসন্ন। তার এ কথার মধ্যে যে বার্তা নিহিত ছিল, তা সব আওয়ামী লীগার অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কিনা, বলা দুষ্কর। কিন্তু দিন দিন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে আশঙ্কা হচ্ছে, প্রবল টাইফুন বোধকরি আরো কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্মান্ধ স্তাবকেরা তার কিছুই দেখতে পারছেন বলে মনে হয় না।
এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, আপাতত শান্ত সমাহিত পরিবেশের পেছনে কিছু একটা রহস্যময় বিষয় গভীরভাবে পাকিয়ে উঠছে। গুলশানের হোলি আর্টিজান কাফেতে এবং কিশোরগঞ্জে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ জামাত শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। দেশের ভেতরকার, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কথিত জিহাদিরা এই উদ্ভূত সঙ্কট থেকে যেমন ফায়দা লুটতে চেষ্টা করছে। তেমনি তারা জাতির অস্তিত্বের জন্যও এক ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব এখন সত্যি সত্যি বিপন্ন। আর কথিত জিহাদিদের ধরার নামে সরকার যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যেভাবে সাধারণ মানুষেরা নির্যাতনের শিক্ষা হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।
এভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বারবার বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বহীন শাসক দল ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এর গভীরতা কিছুই আঁচ করতে পারছে বলে মনে হয় না। এ যাবৎ প্রমাণিত হয় না যে, তা আঁচ করার সামর্থ্য তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডারের লুটেরা সেনাবাহিনী যখন উপমহাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, তখনো এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।
জনগণের দ্বারা মূলত নির্বাচিত নয়, এমন একদল মানুষ প্রধানত পুলিশের ওপর ভর করে রাষ্ট্র শাসনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে জনগণ বা জনগণের স্বার্থ বা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে তারা তাদের বড় দায়িত্ব বলে মনে করছেন না। দেশ এখন পরিণত হয়েছে পুলিশ শাসিত রাষ্ট্রে। পুলিশ যেমন, সেই সঙ্গে সরকারও দেশটাকে তাদের তালুক-মুলুক ভাবতে শুরু করেছে। ক্রসফায়ারের নামে যখন তখন হত্যার অধিকার যেন কোনো কোনো বাহিনী পেয়ে গেছে। ফলে তারা ক্রসফায়ারের নাটক সাজাতে পারছে। এর বিচারের কোনো ব্যবস্থা আপাতত নেই।
এখন দেশজুড়ে চলছে ‘রেড-অ্যালার্ট’ বা কঠোর সতর্ক অবস্থা। এটি বাস্তবায়ন করছে পুলিশ বাহিনী। শাসকমহল ও শাসিতের দল মিলে ১৬ কোটি ১০ লাখ মানুষ কারো দৃষ্টির বাইরে এটা ঘটছে না। শাসিতের দল কোনো অবস্থাতেই এই বিপুল দুঃখগাথা উপেক্ষা করতে পারছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের কাছে এর প্রতিকারের কোনো উপায় নেই। কারণ খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে উপমহাদেশের মানুষ আলেকজান্ডারের বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। তেমনি, ১২০২ সালে বখতিয়ার খিলজি অল্প কয়েকজন ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা নিয়ে যখন বাংলা আক্রমণ করেছিলেন, তখনো কেউ তাদের প্রতিরোধ করতে পারেনি।
আবার ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক বেনিয়া ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বনের কারণে বাংলাদেশকে ২০০ বছরের জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের পদানত হতে হয়েছিল। এদিকে, বাংলাদেশ এখন সুস্পষ্টরূপে বিভক্ত। যারা সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে, তাদের ওপর বর্তমান শাসকেরা তাদের নানাভাবে চালাচ্ছে নির্যাতন ও হয়রানি। সরকারের নির্যাতন যত বাড়ছে, ততই বিপন্ন হয়ে পড়ছে দেশের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এমনকি বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ার শঙ্কা এখন বহু গুণ বেশি। উপরন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর দেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য বহু গুণে বেড়ে গেছে। আর এসবের ফলেই বিপন্ন হয়ে পড়েছে শান্তিশৃঙ্খলা।
বাংলাদেশে বোধহয় একজন লোকও পাওয়া যাবে না, যিনি বলবেন বাংলাদেশ সঠিক পথে চলছে। সরকার থেকেই বারবার বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু কোনো সাধারণ মানুষ এর সাথে একমত হতে পারেন না। সামাজিক নিরাপত্তা বলে এখন আর কিছু নেই। গুম, খুন অতীত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বা খুনোখুনি বেড়েছে। আরো বাড়ছে। ফলে ঘরছাড়া হচ্ছেন ডজন ডজন যুবক। আর পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের অনেকে যোগ দিচ্ছেন কথিত জিহাদি কর্মকাণ্ডে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা ইতিবাচক পরিবর্তন চান।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় সাম্প্রতিক হামলার পর রক্ত হিম করা এক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কথিত জিহাদিরা বাংলদেশকে একটি কট্টর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এই ক্ষেত্রে আগে সরল ও দরিদ্্র মাদরাসা ছাত্রদের ইঙ্গিত করা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, সম্পন্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণেরা যোগ দিচ্ছে এই উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে। সরকার এর মূল কারণ অনুসন্ধান করতে চাইছে বলে মনে হয় না। এর প্রধান কারণ সমাজের ভেতরে পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে; অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা লোপ পেয়েছে। সব নাগরিকের সমান অধিকারের বিষয়কে পদদলিত করা হচ্ছে।
আবার হোলি আর্টিজানে ১৮ জন বিদেশী নাগরিকসহ ২২ জনের হত্যাকাণ্ড এবং সেই সাথে ছয় জঙ্গি হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক হয়ে পড়েছে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা ছাড়া বিদেশীদের তেমন কেউ এখন বাংলাদেশ আসতে চাইছেন না। পর্যটন শিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদেশী পর্যটকেরা হোটেল বুকিং বাতিল করছেন। পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে বিদেশী নেই। দেশী পর্যটকেরাও সতর্ক। কোথায় বিপদ ওঁৎ পেতে আছে, কেউ জানে না। কূটনীতিকেরা বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন দূতাবাস তাদের কর্মীদের পাঁচতারকা হোটেল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। তার ওপর, অভিজাত আবাসিক এলাকা থেকে হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট তুলে দেয়ার ফলে সেখানে বিদেশীদের বসবাসের পরিবেশও নেই বলা চলে। বন্ধ হয়ে গেছে বিদেশী স্কুল, স্থবির হয়ে গেছে অনেককিছু। এই অবস্থা থেকে শিগগির বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তারপর, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেশের গোটা উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। শস্য, গৃহপালিত পশু, অবকাঠামো এবং অন্যান্য সম্পদের সর্বনাশ ঘটেছে।
প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে, এই বন্যায় ক্ষতি হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো কমে গেছে রফতানি আয়। ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
দেশের এই রকম একটা বিপর্যয়কর মুহূর্তে পরিস্থিতির গুরুত্ব ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং হয়রানি ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রাজনৈতিক নির্দেশনাÑ কোথায়ও আশার আলো নেই। উপরন্তু যে ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক বস্তিতে জীবনযাপন করে তাদের অবস্থা আরো বেশি রূপ নিয়েছে। বস্তি উচ্ছেদের নামে সরকার তাদের মাথার ওপর থেকে ছাদ কেড়ে নিয়েছে। বন্যার ফলে সর্বস্ব হারিয়ে আরো লাখ লাখ মানুষ শোচনীয় শহরগুলোতে এসে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। শহরগুলোর জন্য সেটি মোটেও সুসংবাদ নয়। আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, প্রয়োজন থাকলেও হেলিকপ্টার দিয়ে বন্যাদুর্গত-দুর্গত দুর্গম এলাকার মানুষদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়নি। এখন দেশে কমপক্ষে এক কোটি ২০ লাখ লোক পানিবন্দি। তাদের না আছে খাদ্য, না আছে আশ্রয়, না আছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, তাদের গবাদি পশুও অনাহারি। তারা কাটাচ্ছে নির্ঘুম রাত। দেখার কেউ নেই।
কিন্তু এতসব কাণ্ডের মধ্যেও অধিকাংশ মিডিয়া সরকারি গীত গেয়ে চলছে। এসব বিপন্ন মানুষের চিত্র কমই মিডিয়ায় প্রতিফলিত হচ্ছে। উপরন্তু, পুলিশ যেসব নিরপরাধ তরুণকে ‘জঙ্গি’ অভিহিত করে নগর শহর বন্দরে তাড়া করে ফিরছে তাদের কাহিনী কোথাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বরং ধামাধরা মিডিয়াগুলো ব্যস্ত আছে দিবস পালনের গৎবাঁধা প্রতিযোগিতায়। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জঙ্গি ধরা আতঙ্ক থেকে মুক্তি আর অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা। এর সাথেই জাতীয় স্বস্থি ও স্থিতি জড়িত। কিন্তু মৃত্যু হয় যে পথে, সে পথ উত্তরণের কোনো পথ নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে বিদেশীদের বোঝানো যাবে না যে, বাংলাদেশের অবস্থা অস্থিতিশীল নয়। সেটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক কোনোভাবেই নয়। সরকার যদি এমন এক মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে যে, ‘হয় আমরা থাকব নয়তো ওরা থাকবে’- তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবেই। আর সেরকম পরিস্থিতিতে কট্টরপন্থীদের উত্থান ঘটার শঙ্কাই বেড়ে যাবে।
রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন