সমগ্র জাতি কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। স্বর্ণ আর পিতলে একাকার করে ফেলছে। অনুভবের বাইরে চলে যাচ্ছে দিবস-রজনী। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে দৃষ্টির উত্তাপ। ভালো এবং মন্দে পার্থক্য নির্ণয়ে ঠোকর খাচ্ছে কপালে। এই ঠোকরে ঠোকরে এখন ভগ্নদশা কপালের। আত্মীয়-অনাত্মীয় চিহ্নিত করতে গিয়েও দুর্ভাবনায় যাচ্ছে জড়িয়ে। এর কারণ কি হতাশা, অবসাদ, না বয়সের ভার। পঞ্চাশ বছর কি খুব বেশি সময়। জাতি এবং দেশের বয়স এখন মাত্র পঞ্চাশ। পঞ্চাশেই বুড়িয়ে যাবার কারণ। দিকভ্রান্ত হবারই কারণ? বুদ্ধি বিভ্রাটের কারণ? এমনি শত শত কারণের মুখোমুখি হতবিহ্বল জাতি।
পঞ্চাশ বছরেও সারছে না বিভেদের অসুস্থতা। রাজনীতিতে বিভেদ, শিক্ষানীতিতে বিভেদ, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিভেদ, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভেদ এমনকি ধর্মনীতিতেও বিভেদ পাকানোর চেষ্টা কম হচ্ছে না। কম হোক আর বেশি হোক বিভেদের মাঝখানটায় থমকে আছে দেশ-জাতির উত্থান-উন্নতি। এক সময় সুচতুর ইংরেজ বিভেদের বীজ বপন করেছিল এদেশে। তাদের নীতি ছিল ভাগ কর আর শাসন কর। তারা সফলও হয়েছিল বিবাদ বিসম্বাদকে সঙ্গী করে। তারা তাদের শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। এই পারার পশ্চাতে ছিল সমগ্র জাতির নির্বুদ্ধিতা। বোধহীন জাতি পথের দিশা পায় না। চলতে ফিরতে হোঁচট খায় পদে পদে। এই সময় অনুপ্রবেশ ঘটে বহির্শত্রুর আর কচ্ছপের খোল থেকে বাইরে আনে মাথা ঘাপটি মেরে থাকা বিভীষণরা। বিভীষণদের উৎপাত বড় বেশি যন্ত্রণাদায়ক। হুশহীন হলেই মহা বিপদ ঘনিয়ে আসে।
পক্ষ আর বিপক্ষ এই ঝগড়ার যেন অবসান ঘটছে না আজ অবধি। কারণে অকারণে শব্দ দুটির ব্যবহার প্রবল হয়। কোন কোন সময় জলাতঙ্ক রোগীর মতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রলাপ বকে ব্যবহারকারীর। বকাবকি শেষাবধি বক্রতায় রূপ নেয়। বক্রতা থেকেই জন্ম নেয় বিভেদ-বিপথ। এই বিপথেই হাঁটছে জাতি। বর্তমানের পরিবেশ পরিস্থিতি যেন এমন ধারণাকেই উসকে দিচ্ছে। আর একটি নতুন যন্ত্রণা দেশ ও জাতির দুয়ারে এসে উপস্থিত। যদিও এমন যন্ত্রণা সমগ্র বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে। তবু এদেশে এটি বলতে গেলে নতুন উপদ্রব। এই অনাহুত উপদ্রব থেকে উদ্ধারের উপায় বিভেদের প্রাচীর শক্ত হাতে ধ্বংস করে ¯েœহ ভালোবাসার পতাকা উড্ডীন করা। জঙ্গি বা সন্ত্রাস তা যে নামেই শত্রুর আগমন ঘটুক না কেন বিশৃঙ্খলা বা খুনোখুনি কখনো মঙ্গলকে স্পর্শ করে না। এখানে সুবিবেচনার লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। এরা যতই শান্তির বাণী স্বস্তির বাণী আওড়াক না কেন। আসলে এরা বিভ্রান্ত বিধায় মারতে এবং মরতে দ্বিধা করছে না। বিশৃঙ্খল রাজনীতি এবং উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষানীতি বিভ্রান্তির পথকে প্রসারিত করে। দেশে সাম্প্রতিক দু-একটি হাঙ্গামা এবং অঘটন জাতির সামনে এমন পাঠকে উপস্থিত করেছে। এই উপস্থিতি অশনি সংকেতেরই নামান্তর। এমন দুঃসময়ে প্রয়োজন একতা বা ঐক্য। সহৃদয় বিবেচনা। বিবেচনায় যদি ফাঁক থাকে তবেই বিপদ।
ঐক্যের কথা ধ্বনিত হচ্ছে এখানে সেখানে। পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে প্রতিবেদন। চ্যানেলে চ্যানেলে সংলাপ-সংকল্প। দ্বিধা দৈন্য দশায় হলেও সমগ্র জাতি যে এক কাতারে দাঁড়ানো প্রয়োজন এ বিষয়টি মোটামুটি চিন্তাচেতনায় আলোড়িত হচ্ছে। এটি একটি সুখবর। বিলম্বে হলেও ব্যাপারটি চিহ্নিত হলো। প্রবাদ আছে সৎ কাজে শত বাধা। বাধা আসতেই পারে। বহির্শত্রু এবং বিভীষণরা প্রতিবন্ধক রূপে উঠে আসে। ঐক্যে ফাটল সৃষ্টিতে তৎপর হয়। এমতাবস্থায় কিছু কিছু ব্যক্তির আচরণে তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। একে বাদ দাও ওকে বাদ দাও। বাদ থাকলে আর ঐক্য হয় কি করে। দেশের প্রতিটি মানুষই তো এই প্রক্রিয়ারই অংশ। যারা এমন মনোভঙ্গির বাইরে এরা অবশ্যই দেশ এবং জাতির ভালো মন্দকে বিবেচনায় আনে না। ভালোবাসার খোলসে এরা আসলেই বিভীষণ চরিত্রের প্রাণী। মনের কালিমা আজীবন ধরে রাখলে মহৎ কাজে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। দিন দিন এই বাধা দুর্লঙ্ঘ হয়ে উঠে। সময় এখনও অতিক্রম করে যায়নি। জাতি পার করছে ক্রান্তিকাল। দুর্যোগ দুর্ভাবনার সময়। এটি যেমন ক্ষমতাবানদের জন্যে সত্য, বিপরীতে ক্ষমতাহীনদের জন্য আরো বড় সত্য। এই সত্যকে যতদিন উপলব্ধিতে না আনার চেষ্টা করবে উভয়পক্ষ ততদিন দেশ এবং জাতির কপালের অশনি নামবে না। তাতে পোয়াবারো হবে শত্রুর। এরা নিক্ষেপ করবে কুপরামর্শের শায়ক আড়াল থেকে।
কুরাজনীতি আর কুশিক্ষায় বিভ্রান্ত হচ্ছে দেশের তরুণশ্রেণী। অভিভাবকরা মোটেও ভাবছে না এ বিষয়টি চোখের সামনে তার সন্তানের পরিণতি দেখেও। অভিভাবকদের নির্লিপ্ততা ধ্বংস ডেকে আনছে দেশ এবং জাতির ভবিতব্যে, স্বপ্নে। স্বাধীনতার দশ-বিশ বছরে বিশ্বের অনেক জাতিই উন্নতির সোপানে উঠে যাচ্ছে তরতর করে। গড়ে তুলেছে বিশাল অর্জন। অন্যদিকে এদেশ পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করতে চললেও অর্জনের থলিতে তেমন কিছুই জমা করতে পারেনি। কেবল হিংসা বিদ্বেষ ছাড়া। এই হিংসাই জাতির অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করছে। ঐক্য নামের শব্দটি বাতাসে ভাসলেও যারা ঐক্যের স্লোগানদাতা তারা ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। লাফালাফির অবসান না ঘটলে তো ঐক্যের ভাবনায় স্থির থাকা যাচ্ছে না। আবার অন্য দিকে হৃদয়ের ঊষ্ণতাকে উচ্ছল না করলে ঐক্যের সুবাতাস বইবে না। অন্তরের প্রসারতা বাড়ায় সুশিক্ষা। শিক্ষায়ও ইদানিং নানান প্রতিবন্ধক। এটা পড়ানো যাবে না ওটা পড়ানো যাবে না, এমন শাসনের রক্তচোখ। এই রকম রক্তচোখ এড়িয়ে সুবচন শেখা বড় দায়। তাই কুবচন ভরসা। এখানে সেখানে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাঙাভাঙির আওতায়ও পড়েছে কোন কোনটি। তাতে অন্ধকারে পড়েছে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। অভিভাবকরা সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে পড়ছেন সংশয়ে। ব্যবস্থাপত্রটি এমন হচ্ছে মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটো। ধনীর সন্তানরা হয়তো পাশের দেশগুলোতে ভর্তি হবে। অন্যদের কি হবে? মূর্খ হয়ে বেড়ে ওঠাই হয়তো এদের নিয়তি। শিক্ষা নিয়ে এমন বিভ্রাটের পশ্চাতের কারণ কি কে জানে। জাতি এক থাকলে শাসকশ্রেণীর সুবিবেচনার বিষয়টি মীমাংসা হয়তো হতে পারতো। বিভেদ বিভাজনে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সমগ্র জাতির তদারকির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই থেকে যাওয়াটা মোটেও শুভলক্ষণের আওতায় পড়ে না।
দেশপ্রেম আর বিশ্বাসের বড় বেশি অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে ইদানিং। জাতির অভিভাবক পর্যায়ে যারা নিজেদের জাহির করতে অভ্যস্ত তাদের আচার আচরণে তেমনটাই ধারণা জন্মে আমলোকের। কি ক্ষমতাবান কি ক্ষমতাহীন মনুষ্যকুলের। তাদের অবস্থানটি এক কাতারে বলেই প্রতীয়মান হয়। ঐক্যের ব্যাপারে উভয় পক্ষের সুরই কিন্তু একই হাওয়ায় প্রবাহমান। কেবল শব্দের হেরফের। ইঞ্জিনে গোলমাল থাকলে বগিতে অবস্থানরত যাত্রীগণ সর্বাবস্থায়ই কম্পমান থাকেন। যেকোন সময় দুর্ঘটনার আশংকায় থাকা। এমতাবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটেও কোন কোন সময়। দেশে বিরাজমান অসুস্থ রাজনীতি সেরকমেরই একটা পরিস্থিতিকেই যেন তুলে আনছে জাতির সামনে। রাজনীতিকদের ভুল-ভ্রান্তি স্বার্থপরতা দেশের জন্য যেমন বিপদের, জাতির মঙ্গলের ব্যাপারেও মহাশংকার। কি ‘জঙ্গিবাদ’ কি ‘সন্ত্রাসবাদ’ এক মুহূর্তে বাদের তালিকায় তুলে আনা যায় যদি একটি একতাবদ্ধ জাতি রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু আফসোসের বিষয় এদেশের অসুস্থ রাজনীতিকদের ক্ষমতার লোভ আর স্বার্থপরতা এখানে বড় প্রতিবন্ধক। এরপরেও জাতীয় কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করতে হয়- ‘দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন