কাক্সিক্ষত সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে মানব জাতির অনেক কিছুই করণীয় আছে। কিন্তু করণীয় বিষয়ের সামনে এখন যেন বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এক দানব। কেউ কেউ বলছেন দানব নয়, এটা আসলে একটা ফাঁদ। এই ফাঁদের নাম সন্ত্রাসবাদ। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা আলোচনা। তবে এখানে বলার মত বিষয় হলো, সন্ত্রাস নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তেমন লক্ষ্য করা যায় না, প্রপাগান্ডার মাত্রাই বেশি। প্রপাগান্ডার মাধ্যমে কারো মতলব, রাজনীতি কিংবা মতবাদ প্রচার করা গেলেও আসল কাজের কিছুই হয় না। ফলে বৈশ্বিক বাতাবরণে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এত কথা ও কর্মসূচির পরও তেমন কোনো সুফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
যে কোনো সমস্যার সমাধানে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা যখন মানুষের আর্তনাদ শোনেনি, তখন ক্ষুব্ধ মানুষের মনে দেখা দিয়েছে দ্রোহ। বিদ্রোহী মানুষ তখন জালেম ও শোষকদের বিরুদ্ধে তুলে নিয়েছে অস্ত্র, সৃষ্টি করেছে আতঙ্ক। এই পথ যে সঠিক পথ নয়, তা বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, কিন্তু ওদের এ পথে নামতে যারা বাধ্য করলেন তাদের বিরুদ্ধেও যৌক্তিক বক্তব্য রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক শাসন পরিচালনার কারণে আমরা গেরিলাগোষ্ঠীর উদ্ভব লক্ষ্য করেছি। শ্রেণি-বৈষম্যের কারণেও আমরা উগ্রতা ও সশস্ত্র সংগ্রাম দেখেছি। আবার আগ্রাসী রাষ্ট্রের জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও আমরা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো পর্যালোচনা করলে চলে আসে আইরিশ গেরিলা, পিএলও হামাস, শ্রেণি সংগ্রাম, নকশাল, তামিল গেরিলা, মরো মুক্তি ফ্রন্ট ও কাশ্মীরী মুক্তি সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ। এদের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নানা পার্থক্যও লক্ষ্য করা গেছে। কেউ এদের মুক্তি সংগ্রামী বলেছেন, আবার অপরপক্ষ তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এইসব মতপার্থক্য থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য বলে কি কিছু নেই? যে যা বলবে সেটাই কি সঠিক? না, এতটা হতাশ হওয়ারও কারণ নেই। আসলে বর্তমান সময়ে যারা পৃথিবী পরিচালনা করছেন, তারা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে একটু ন্যায়নিষ্ঠ হন তাহলে পৃথিবীর অনাকাক্সিক্ষত চিত্র পাল্টে যেতে পারে। লোপ পেতে পারে সন্ত্রাসবাদও। বলা যেতে পারে, সমস্যা আসলে উপরের মহলে। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয়েছে এবং যারা সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য রাখেন, তারা যদি মানুষ হয়ে না ওঠেন, তাহলে মানুষের সংকট দূর হবে কীভাবে? এজন্য বর্তমান বাস্তবতায় যারা মানবোচিত সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী চান তাদের জেগে উঠতে হবে। সমাজে, রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি, অমানুষের সংখ্যা কম। এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে বীরের মত উচিত কর্ম সম্পাদন প্রয়োজন। অনুরোধ, উপরোধ, আফসোস ও বিলাপ তো অনেক করা হয়েছে, তাতে বিশ্ববাতাবরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অতএব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের জনপদে মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে মানুষের রাজনীতি করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় অপশাসকদের ধর্ম-বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা ও শ্রেণি স্বার্থের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে রাজত্ব করার সুযোগ আর দেয়া যাবে না। অতীতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই এ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে লাখো কোটি মানুষ। এই প্রসঙ্গে চলে আসে ফিলিস্তিনীদের কথা।
২০১৬ সালের প্রথম ৬ মাসে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৩৮৪ জন শিশুসহ প্রায় ৭৪০ জন ফিলিস্তিনীকে গৃহহীন করেছে। গত ২৭ জুলাই বুধবার মানবাধিকার সংগঠন ‘বি-সেলেম’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আল-জাজিরা পরিবেশিত খবরে আরো বলা হয়, পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এলাকা জুড়ে এরিয়া ‘সি’ এর অবস্থান এবং এখানে প্রায় ৩ লাখ ফিলিস্তিনীর বাড়িঘর রয়েছে। বর্তমানে এটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বি-সেলেমের মুখপাত্র মিচেলি বলেন, যেখানে মানুষের রাজনৈতিক প্রভাব নেই, এমন জনবিরল অঞ্চলকে লক্ষ্য করে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এসব ফিলিস্তিনীর এরিয়া ‘বি’-এর দিকে সরাতে চাইছে, যাতে তারা বসতি সম্প্রসারণের জন্য এরিয়া ‘সি’ দখল করতে পারে। এটা ইসরাইলি নিপীড়ন ও আগ্রাসনের একটা ক্ষুদ্র চিত্র মাত্র। তবে এখানেও লক্ষ্য করা গেছে, যেখানে মানুষ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয় সেই এলাকাই ইসরাইলি সেনাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। এমন বাস্তবতায় আবারও উল্লেখ করতে হয়, এই পৃথিবীতে অমানুষের বদলে মানুষের নেতৃত্ব প্রয়োজন। মানুষ মেরুদ- সোজা করে ন্যায়ের চেতনায় মানুষের রাজনীতিকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে এগিয়ে আসলে শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়, সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন, অজাচার-অনাচার পরাভূত হতে বাধ্য।
আমরাতো চাই আমাদের দেশ জুলুম-নির্যাতন ও সন্ত্রাসবাদের আপদ থেকে মুক্ত হোক। এমন চাওয়া খুবই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। কিন্তু চাওয়ার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সক্ষমতা অর্জন এবং সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে এখানে ন্যায় ও সততার বিষয়ও যুক্ত করতে হয়। কারণ কথা ও কাজে গড়মিলের চিত্র দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
যে ভূমিতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে সে ভূমিই মানুষের জন্মভূমি। জন্মভূমির আলো-বাতাসেই মানুষ বেড়ে ওঠে। ফল-ফসল গ্রহণ করে মানুষ পুষ্টি লাভ করে। তাই জন্মভূমির প্রতি মানুষের ভালবাসা অকৃত্রিম। এ ভালবাসা কখনও সুপ্ত থাকে, কখনো বা প্রকাশ পায়। তবে জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা প্রকাশের জন্য কিছু উদ্যোগ-আয়োজনেরও প্রয়োজন হয়। এমন আয়োজনে অবদান রাখতে পারে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র। প্রসঙ্গত এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হলো, দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি করতে পারে এমন যে কোনো কর্মকা- প্রতিরোধে এগিয়ে আসাও দেশপ্রেমের অন্যতম লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে জঙ্গিবাদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর দেশে সবাই একবাক্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এমন চেতনাকে আমরা দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। প্রসঙ্গত এখানে একটি বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হলো, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সন্ত্রাসমুক্ত মানসিকতার বিকাশ। আমরা জানি, বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদ কোনো বিশেষ এলাকা বা জনপদের বিষয় নয়। বৈশ্বিক পরিম-লের সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন জনপদে আঘাত হেনেছে। আমাদের দেশকে আমরা সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত রাখতে চাই। তবে বৈশ্বিক পরিম-লের একটা প্রভাব না চাইলেও সব দেশেই কমবেশি এসে পড়ে। এ কারণেই গণসচেতনতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের সঠিক নেতৃত্ব। বর্তমান সময়ে আমরা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস বিরোধী সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধনের কর্মসূচি লক্ষ্য করছি। তবে এসব তৎপরতায় এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যাতে প্রশ্ন জাগে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও আমরা আসলে মানসিকভাবে সন্ত্রাসী চেতনা থেকে কতটা মুক্ত হতে পেরেছি? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে চিন্তা-চেতনা ও মননে উগ্রতা পরিহার করা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন আদর্শিক ও নৈতিকবোধে পুষ্ট হওয়া।
প্রসঙ্গত এখানে দুইএকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রাম কলেজের সামনে জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন করা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ৩১ জুলাই গোলাগুলী ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কলেজের মূল ফটকের সামনে এই সংঘর্ষের ঘটনায় গুলীবিদ্ধ হয়েছেন তিনজন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক। প্রথম আলোয় মুদ্রিত খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম এবং চকবাজার থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরুল মোস্তফার অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনায় মানুষের মধ্যে শঙ্কা জাগে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিজেরাই যদি সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সন্ত্রাস দূর হবে কেমন করে? এ ঘটনার একদিন পরেই পহেলা আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। এতে গোলাগুলীতে নিহত হন একজন, আহত হন আরো কয়েকজন। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সন্ত্রাসবিরোধী রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতা গঠন। এজন্য প্রয়োজন হবে নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধ। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে জ্ঞান-চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এখন প্রোপাগান্ডায় যতটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় জ্ঞান-চর্চায় ততটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন।
সন্ত্রাস ও জহঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন কর্মসূচীতে ছাত্রলীগের বিবদমান দু’টি গ্রুপ নিজেরাই সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত হওয়ায় বিষয়টি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রশ্ন জেগেছে, এমন মানসিকতা সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণে আদৌ কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হবে কী? আর পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী প্রপাগান্ডার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতার বিকাশ এবং শান্তির মর্মবাণী উপলব্ধি। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা ভালো যে, তরতাজা উদাহরণ হিসেবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনার কথা উঠে আসলেও অন্যরা এমন মানসিকতা থেকে মুক্ত তেমনটি বলার উপায় নেই। কারণ অতীতে আমরা অন্যদেরও সন্ত্রাসী ঘটনায় লিপ্ত হতে দেখেছি। আসলে দলকানা হয়ে কিংবা ব্লেমগেমে লিপ্ত থেকে দেশ ও জনগণকে কোনো কল্যাণ উপহার দেয়া যায় না। শুধু বৈশ্বিক পরিমন্ডলে নয়, আমাদের দেশেও আমরা জাতীয়তাবাদ, শ্রেণী সংগ্রাম ও ইসলামের নামে অনেক উগ্রতা লক্ষ্য করেছি। এর পরিণাম কারো জন্যই ভালো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ভুল উপলব্ধি করে সঠিক পথে ফিরে আসলেই মঙ্গল।
যে কোনো সমস্যার সমাধানে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা যখন মানুষের আর্তনাদ শোনেনি, তখন ক্ষুব্ধ মানুষের মনে দেখা দিয়েছে দ্রোহ। বিদ্রোহী মানুষ তখন জালেম ও শোষকদের বিরুদ্ধে তুলে নিয়েছে অস্ত্র, সৃষ্টি করেছে আতঙ্ক। এই পথ যে সঠিক পথ নয়, তা বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, কিন্তু ওদের এ পথে নামতে যারা বাধ্য করলেন তাদের বিরুদ্ধেও যৌক্তিক বক্তব্য রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক শাসন পরিচালনার কারণে আমরা গেরিলাগোষ্ঠীর উদ্ভব লক্ষ্য করেছি। শ্রেণি-বৈষম্যের কারণেও আমরা উগ্রতা ও সশস্ত্র সংগ্রাম দেখেছি। আবার আগ্রাসী রাষ্ট্রের জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও আমরা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো পর্যালোচনা করলে চলে আসে আইরিশ গেরিলা, পিএলও হামাস, শ্রেণি সংগ্রাম, নকশাল, তামিল গেরিলা, মরো মুক্তি ফ্রন্ট ও কাশ্মীরী মুক্তি সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ। এদের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নানা পার্থক্যও লক্ষ্য করা গেছে। কেউ এদের মুক্তি সংগ্রামী বলেছেন, আবার অপরপক্ষ তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এইসব মতপার্থক্য থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য বলে কি কিছু নেই? যে যা বলবে সেটাই কি সঠিক? না, এতটা হতাশ হওয়ারও কারণ নেই। আসলে বর্তমান সময়ে যারা পৃথিবী পরিচালনা করছেন, তারা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে একটু ন্যায়নিষ্ঠ হন তাহলে পৃথিবীর অনাকাক্সিক্ষত চিত্র পাল্টে যেতে পারে। লোপ পেতে পারে সন্ত্রাসবাদও। বলা যেতে পারে, সমস্যা আসলে উপরের মহলে। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয়েছে এবং যারা সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য রাখেন, তারা যদি মানুষ হয়ে না ওঠেন, তাহলে মানুষের সংকট দূর হবে কীভাবে? এজন্য বর্তমান বাস্তবতায় যারা মানবোচিত সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী চান তাদের জেগে উঠতে হবে। সমাজে, রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি, অমানুষের সংখ্যা কম। এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে বীরের মত উচিত কর্ম সম্পাদন প্রয়োজন। অনুরোধ, উপরোধ, আফসোস ও বিলাপ তো অনেক করা হয়েছে, তাতে বিশ্ববাতাবরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অতএব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের জনপদে মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে মানুষের রাজনীতি করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় অপশাসকদের ধর্ম-বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা ও শ্রেণি স্বার্থের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে রাজত্ব করার সুযোগ আর দেয়া যাবে না। অতীতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই এ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে লাখো কোটি মানুষ। এই প্রসঙ্গে চলে আসে ফিলিস্তিনীদের কথা।
২০১৬ সালের প্রথম ৬ মাসে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৩৮৪ জন শিশুসহ প্রায় ৭৪০ জন ফিলিস্তিনীকে গৃহহীন করেছে। গত ২৭ জুলাই বুধবার মানবাধিকার সংগঠন ‘বি-সেলেম’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আল-জাজিরা পরিবেশিত খবরে আরো বলা হয়, পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এলাকা জুড়ে এরিয়া ‘সি’ এর অবস্থান এবং এখানে প্রায় ৩ লাখ ফিলিস্তিনীর বাড়িঘর রয়েছে। বর্তমানে এটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বি-সেলেমের মুখপাত্র মিচেলি বলেন, যেখানে মানুষের রাজনৈতিক প্রভাব নেই, এমন জনবিরল অঞ্চলকে লক্ষ্য করে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এসব ফিলিস্তিনীর এরিয়া ‘বি’-এর দিকে সরাতে চাইছে, যাতে তারা বসতি সম্প্রসারণের জন্য এরিয়া ‘সি’ দখল করতে পারে। এটা ইসরাইলি নিপীড়ন ও আগ্রাসনের একটা ক্ষুদ্র চিত্র মাত্র। তবে এখানেও লক্ষ্য করা গেছে, যেখানে মানুষ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয় সেই এলাকাই ইসরাইলি সেনাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। এমন বাস্তবতায় আবারও উল্লেখ করতে হয়, এই পৃথিবীতে অমানুষের বদলে মানুষের নেতৃত্ব প্রয়োজন। মানুষ মেরুদ- সোজা করে ন্যায়ের চেতনায় মানুষের রাজনীতিকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে এগিয়ে আসলে শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়, সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন, অজাচার-অনাচার পরাভূত হতে বাধ্য।
আমরাতো চাই আমাদের দেশ জুলুম-নির্যাতন ও সন্ত্রাসবাদের আপদ থেকে মুক্ত হোক। এমন চাওয়া খুবই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। কিন্তু চাওয়ার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সক্ষমতা অর্জন এবং সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে এখানে ন্যায় ও সততার বিষয়ও যুক্ত করতে হয়। কারণ কথা ও কাজে গড়মিলের চিত্র দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
যে ভূমিতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে সে ভূমিই মানুষের জন্মভূমি। জন্মভূমির আলো-বাতাসেই মানুষ বেড়ে ওঠে। ফল-ফসল গ্রহণ করে মানুষ পুষ্টি লাভ করে। তাই জন্মভূমির প্রতি মানুষের ভালবাসা অকৃত্রিম। এ ভালবাসা কখনও সুপ্ত থাকে, কখনো বা প্রকাশ পায়। তবে জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা প্রকাশের জন্য কিছু উদ্যোগ-আয়োজনেরও প্রয়োজন হয়। এমন আয়োজনে অবদান রাখতে পারে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র। প্রসঙ্গত এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হলো, দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি করতে পারে এমন যে কোনো কর্মকা- প্রতিরোধে এগিয়ে আসাও দেশপ্রেমের অন্যতম লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে জঙ্গিবাদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর দেশে সবাই একবাক্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এমন চেতনাকে আমরা দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। প্রসঙ্গত এখানে একটি বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হলো, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সন্ত্রাসমুক্ত মানসিকতার বিকাশ। আমরা জানি, বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদ কোনো বিশেষ এলাকা বা জনপদের বিষয় নয়। বৈশ্বিক পরিম-লের সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন জনপদে আঘাত হেনেছে। আমাদের দেশকে আমরা সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত রাখতে চাই। তবে বৈশ্বিক পরিম-লের একটা প্রভাব না চাইলেও সব দেশেই কমবেশি এসে পড়ে। এ কারণেই গণসচেতনতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের সঠিক নেতৃত্ব। বর্তমান সময়ে আমরা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস বিরোধী সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধনের কর্মসূচি লক্ষ্য করছি। তবে এসব তৎপরতায় এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যাতে প্রশ্ন জাগে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও আমরা আসলে মানসিকভাবে সন্ত্রাসী চেতনা থেকে কতটা মুক্ত হতে পেরেছি? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে চিন্তা-চেতনা ও মননে উগ্রতা পরিহার করা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন আদর্শিক ও নৈতিকবোধে পুষ্ট হওয়া।
প্রসঙ্গত এখানে দুইএকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রাম কলেজের সামনে জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন করা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ৩১ জুলাই গোলাগুলী ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কলেজের মূল ফটকের সামনে এই সংঘর্ষের ঘটনায় গুলীবিদ্ধ হয়েছেন তিনজন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক। প্রথম আলোয় মুদ্রিত খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম এবং চকবাজার থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরুল মোস্তফার অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনায় মানুষের মধ্যে শঙ্কা জাগে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিজেরাই যদি সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সন্ত্রাস দূর হবে কেমন করে? এ ঘটনার একদিন পরেই পহেলা আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। এতে গোলাগুলীতে নিহত হন একজন, আহত হন আরো কয়েকজন। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সন্ত্রাসবিরোধী রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতা গঠন। এজন্য প্রয়োজন হবে নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধ। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে জ্ঞান-চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এখন প্রোপাগান্ডায় যতটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় জ্ঞান-চর্চায় ততটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন।
সন্ত্রাস ও জহঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন কর্মসূচীতে ছাত্রলীগের বিবদমান দু’টি গ্রুপ নিজেরাই সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত হওয়ায় বিষয়টি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রশ্ন জেগেছে, এমন মানসিকতা সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণে আদৌ কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হবে কী? আর পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী প্রপাগান্ডার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতার বিকাশ এবং শান্তির মর্মবাণী উপলব্ধি। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা ভালো যে, তরতাজা উদাহরণ হিসেবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনার কথা উঠে আসলেও অন্যরা এমন মানসিকতা থেকে মুক্ত তেমনটি বলার উপায় নেই। কারণ অতীতে আমরা অন্যদেরও সন্ত্রাসী ঘটনায় লিপ্ত হতে দেখেছি। আসলে দলকানা হয়ে কিংবা ব্লেমগেমে লিপ্ত থেকে দেশ ও জনগণকে কোনো কল্যাণ উপহার দেয়া যায় না। শুধু বৈশ্বিক পরিমন্ডলে নয়, আমাদের দেশেও আমরা জাতীয়তাবাদ, শ্রেণী সংগ্রাম ও ইসলামের নামে অনেক উগ্রতা লক্ষ্য করেছি। এর পরিণাম কারো জন্যই ভালো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ভুল উপলব্ধি করে সঠিক পথে ফিরে আসলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন