মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর


গত সোমবার ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। অনেক কারণেই এ সফর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সফরকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনাও কম করা হয়নি। প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনের ব্যাপারে নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছে। সন্ত্রাস বিরোধী চলমান আন্তর্জাতিক যুদ্ধের প্রধান শক্তি বা নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যে সরকারকে প্রশংসা করবে সে কথা ধরেই নেয়া হয়েছিল। এই সমর্থন একেবারে শর্তহীন হয়েছে কি না তা জানার জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে অন্য একটি সত্যও অপ্রকাশিত থাকেনি যে, জন কেরি বলেছেন, বাংলাদেশে গড়ে ওঠা জঙ্গিদের সঙ্গে আইএস-এর সম্পর্ক ও যোগাযোগ আছে। উল্লেখ্য, মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকা সফরে আগত মার্কিন সহকারী পরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও একই সম্পর্কের কথা বলে গেছেন। সরকার যথারীতি সেটা অস্বীকার করেছে। একই কারণে সহকারী পরাষ্ট্রমন্ত্রীর পর পর জন কেরির এই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় আইএস-এর বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে, অন্যদিকে আইএস নেই এমন যুক্তি দেখিয়ে সরকার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের পুরো বিষয়টিকে সরকার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেও দেখাতে চাচ্ছে।
আমরা মনে করি, সরকারের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু আইএস তথা আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদীদের সম্পর্ক ও যোগসাজশের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে সেহেতু সরকারের উচিত প্রকৃত সত্য জনগণকে জানানো। সরকারকে একই সঙ্গে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে- যে বিষয়ে বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বারবার আহবান জানানো হয়েছে। আমাদের ধারণা, আইএস-এর বিষয়টিকে সামনে আনার মাধ্যমে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকারান্তরে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থানকেই শক্তি ও সমর্থন যুগিয়ে গেছেন। এখন দেখার বিষয়, সরকার তার এতোদিনকার কৌশল ও কর্মকাণ্ডে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনে কি না।
প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার ব্যাপারেও জন কেরি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে জন কেরি পৃথকভাবে বৈঠক করার পরিপ্রেক্ষিতে। বিএনপির মহাসচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বৈঠকে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জন কেরি বলেছেন, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার এবং দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন অর্জন করবে তেমনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জন কেরি।
আমরা মনে করি, এখানেও কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা দরকার। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এ সত্যই প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার দাবি করলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। স্মরণ করা দরকার, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র বৈধতা দেয়নি। ফলে পরোক্ষভাবে হলেও বর্তমান সরকারও দেশটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্কের বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে জানাজানি হয়েছে। আমাদের মতে সরকারের উচিত জন কেরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জানিয়ে দেয়া মনোভাব ও অবস্থানের মূল কথা অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের পথে পা বাড়ানো। স্মরণ করা দরকার, ইতপূর্বে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়াল এবং ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাটও বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছেন, গণতন্ত্রহীনতার কারণে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দুর্বিষহ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক সংকটও কাটিয়ে উঠতে হবে। এ ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া যে সমাধানের পন্থা উপস্থাপন করেছেন এবং ক্ষমতাসীনরা যে তার কোনো একটিও গ্রহণ করেননি- সে বিষয়েও নিশ্চয়ই জানানো হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
আমরা মনে করি, জন কেরির ১০ ঘণ্টার সফর কেবলই আনুষ্ঠানিকতার বিষয় ছিল না। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে আইএসকে টেনে আনা থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের মনোভাব ও অবস্থান পরিষ্কার করে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকটিও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের মতে সব মিলিয়েই সরকারের জন্য নতুন করে চিন্তা করার এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। সরকারের উচিত জঙ্গিবাদ দমনে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া। পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। সরকার সদিচ্ছার প্রমাণ দিলে এ সব বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো যে সরকারের পাশে দাঁড়াবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা মনে করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়ার জন্যই সরকারের উচিত বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সততার সঙ্গে উদ্যোগী হওয়া।

শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সীমান্ত হত্যা নির্যাতন : শীর্ষ ব্যক্তিদের আস্কারা


বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলি চালানো বন্ধ হবে না- বিবিসির সঙ্গে সাক্ষৎকারে এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান ইউ কে বানশাল। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসফের গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত সে দেশের দেওয়া প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজেপি)। অথচ দুই দেশের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহাপরিচালক পর্যায়ে কয়েকবারই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে সীমান্তে কেউ গুলি ছুড়বে না। ভারত এখন বলছে গুলি বন্ধ হবে না। বানশালের মতে বাংলাদেশীরাই অপরাধী। আর এ অপরাধ আটকাতে বিএসএফকে গুলি চালাতেই হবে। বিএসএফের এই রক্তাক্ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান বলেন- সীমান্তের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। বিএসফের অস্ত্র প্রয়োগ বন্ধে প্রয়োজনে তাঁরা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে নালিশ করবেন।
একবার-দুইবার নয়, বহুবার ভারত ও বাংলাদেশের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীল মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ডে হবে না, কেউ গুলি ছুড়বে না। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ রেখেছে, কিন্তু ভারত রাখেনি। গত এক বছরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ২১ জন বাংলাদেশী নাগরিক। ভারতের পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন একজন। ভারতীয় নাগরিকদের হাতে বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন ১০ জন। সীমান্তের ওপারের অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির হাতে নিহত হয়েছেন তিন বাংলাদেশী। সব মিলিযে গত এক বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), ভারতীয় পুলিশ, ভারতীয় নাগরিকের হাতে ৩৫ জন বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি), পুলিশ, বাংলাদেশী নাগরিক কিংবা কোনো বাংলাদেশী দুষ্কৃতিকারীর হাতে একজন ভারতীয় নাগরিকও নিহত হয়নি! ভারত বরাবরই বলে, বাংলাদেশ তার অকৃত্রিম বন্ধু! এই কি বন্ধুর নমুনা?
বহুবার, বহু সময়, বহু বৈঠকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে বলেছে, ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ভারতের অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশে ভক্তিতে গদগদ হয়েছে। বটবৃক্ষের মতো বৃহৎ এ বন্ধুর বাহুডোরে লেপ্টে থাকতে শ্রদ্ধায় নতজানু প্রদর্শন করেছে। অকৃত্রিম বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে একজন বাংলাদেশীকে বিবস্ত্র করে হাত-পা বেঁধে নির্দয়ভাবে আঘাত করে গোপনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে আদিম উল্লাসের পর আরো উদ্দাম প্রকাশ করতে বিবস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকের ভিডিওচিত্র ধারণ করেছে বিএসএফ। এই অকৃত্রিম বন্ধুত্বের! বন্ধুত্বপনায় মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হয়েছেন রীতিমতো মুগ্ধ! সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে গত ২১ জানুয়ারি তিনি মন্তব্য করেন, সীমান্তে যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। এসব অতীতে ঘটেছে, এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করে না।
ভারত তার অকৃত্রিম বন্ধুত্বের অপার এ নিদর্শন বারবার প্রদর্শন করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের হাবিবুর রহমানের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর ক্ষেত্রে, দিনাজপুরের বিরামপুরের সাইফুল ইসলামসহ দুই দিন পর পর নিরীহ বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে। এই বর্বর বন্ধুত্ব প্রদর্শনের প্রতিবাদ ভারত কোনো সময়ই তেমনভাবে পায়নি। ফলে তার বন্ধুত্ব প্রদর্শন গাঢ়ত্ব পেয়েছে। আগে গুলি করে মেরে ফেলত; এখন মেরে ফেলার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে। আবার ঝুলিয়ে রাখা প্রদর্শন শেষ হলে পশুর মতো লটকিয়ে বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে তোলে।
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের তথাকপিত এই অকৃত্রিম বন্ধুত্ব দিনদিন বাড়তেই থাকবে, যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ নতজানু মনোভাব পরিহার না করবে, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার জন্য বা টিকে থাকার জন্য তীর্থের কাকের মতো ভারতের দিকে চেয়ে না থাকবে। মন্ত্রিত্ব বা পদের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশীদের দুর্গতিতে দুঃখিত হয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা উদাত্ত কণ্ঠে যখন বলে উঠবেন, ‘অকৃত্রিম বন্ধুত্ব প্রদর্শনের এ বর্বরতা বন্ধ না হলে বাংলাদেশ সমুচিত জবাব দেবে’- তখনই হয়তো বন্ধ হবে ভারতের এই বর্বর প্রদর্শনী। গুলির বদলে গুলি, হত্যার বদলে হত্যা নীতিতে এগোনোর সামান্য ক্ষমতাও যদি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বিজিবিকে দেয়, তাহলে সব বাংলাদেশীই বিশ্বাস করে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মতো ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও বিজিবিকে দেখলে বিএসএফ লেজ গুটিয়ে পালাবে। মদ খেয়ে পড়ে মাতাল হয়ে নিরীহ বাংলাদেশী হত্যার অসৎ উল্লাস চিরতরে ভুলে যাবে।
গুলি চলবে : বিএসএফ প্রধান ইউ কে বানশাল : ৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রধান ইউ কে বানশাল বিবিসিকে দেওয়া এক দসাক্ষাৎকারে বলেন, “সীমান্তে গুলি চালানো বন্ধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। যত দিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ হতে থাকবে, তত দিন অপরাধ আটকাতে হবে বিএসএফকেই। আর এটাই বিএসএফের দায়িত্ব।’
বিএসএফ কখন বা কেন গুলি করবে না, সে প্রসঙ্গে বানশাল বলেন, ‘বাংলাদেশী বাহিনী যদি তাদের নিজেদের সীমান্ত এলাকায় পাহারার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে, রাত্রিবেলা সীমান্ত এলাকায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে অপরাধীরা ভারতের দিকে আসতে পারবে না, বিএসএফকে গুলি করতে হবে না।’
বিএসএফ প্রধান ইউ কে বানশাল বিসিবির সঙ্গে ‘সীমান্তে গুলি চলবে’ সংক্রান্ত বিবৃতিটি এমন একসময় দিলেন, যখন বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ আরো কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তি, ফেনী নদীর ওপর সড়ক নির্মাণসহ ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ও বাংলাদেশ-ভারত সরাসরি রেলপথ নির্মাণে যখন দুই দেশের শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে অনেকটা কাছাকাছি পৌছেছেন, বিএসএফ প্রধান বললেন, ‘সীমান্তে গুলি চলবে।’
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, ইউ কে বানশাল যা বলতে চাচ্ছেন, তার সারমর্ম এককথায় বাংলাদেশীরা অপরাধী। তিনি ভারতীয়দের কিংবা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কোনো অপরাধ দেখেননি। তিনি বলছেন, বাংলাদেশী বাহিনী যদি তাদের নিজেদের দিকে পাহারা কড়া করে, সীমান্তে রাতে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে অপরাধীরা ভারতের দিকে আসতে পারবে না। পৃথিবীর যেকোনো সীমান্তে চোরাচালান-সংক্রান্ত কোনো বিষয় না থেকে থাকে তাহলে সীমান্তটি যে দুই দেশের মধ্যে অবস্থিত, সে দুই দেশের নাগরিকরাই অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি গরু আনতে ভারতে অনুপ্রবেশ করে, তাহলে তা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু ভারতীয় যে নাগরিক গরুগুলো বাংলাদেশের হাত তুলে দেয় সে কি অপরাধী নয়। অথচ বানশাল বলছেন, বাংলাদেশীরাই অপরাধী। তিনি সোজাসাপ্টা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ হতে থাকবে, ততক্ষণ সে। অপরাধ আটকাতে হবে বিএসএফকে- সেটাই বিএসএফর দায়িত্ব।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ যদি সংঘটিত হতেই থাকে এবং তা আটকানোর দায়িত্ব যদি বিএসএফের হয, তাহলে বিএসএফের গুলিতে গত এক বছরে ২১ বাংলাদেশী নিহত হলে অন্তত ১০ জন ভারতীয় অপরাধীও নিহত হওয়ার কথা। তা কি হয়েছে? চোরাচালানে অংশ নিচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের নাগরিক, অথচ অপরাধী শুধু বাংলাদেশীরা। ভারতীয় অপরাধীরা কিছুই নয়? বানশাল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যা বলছেন, তা হলো, বাংলাদেশীরাই একমাত্র অপরাধী, তাদের দেখামাত্র গুলি করে।
বানশাল বিবিসির সঙ্গে দেওয়া ‘সীমান্ত গুলি চলবে’ শীর্ষক বিবৃত নিজে তৈরি করে দেননি। তাঁর এ বিবৃতি ভারতয় কর্তৃপক্ষের চিন্তা-চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। ভারত এত দিন যা বলেছে, তা ছিল প্রতারণামূলক আশ্বাস। এখন বিএসএফ প্রধান যা বলছেন, তাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনের কথা। ভারত যে এ অঞ্চলে নিজেকে প্রভু মনে করে এবং তার আশপাশে ঘিরে থাকা দেশগুলোকে মনে করে ভৃত্য-তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল বানশালের বিবৃতিতে। ভারত তার চেতনার এই প্রকাশ আরো বৃদ্ধি করবে-যতক্ষণ পর্যন্ত না ভৃত্যের কাছ থেকে কঠোর জবাব পাবে। বাংলাদেশের সময় এসেছে কঠিন জবাব দেওয়ার। নতজান মনোভাব না দেখিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সীমান্তবাসী, সেইসঙ্গে দেশবাসী গর্জে উঠবে বানশালের মতো ভারতীয় কর্মকর্তাদের দুঃসাহস হবে না বলতে যে ‘সীমান্তে গুলি চলবে।’
রক্তক্ষয়ের কারণ : পেঁয়াজ-ফেনসিডিল : বেশির ভাগ ভারতীয় পেঁয়াজ ও গরুর মাংস খায় না। অথচ আমরা বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বেশি খাই পেঁয়াজ ও গরুর মাংস। এ দুটি আবার একটি অন্যটির পরিপূরক। রান্না করা গরুর মাংসে আমাদের গৃহিণীরা মসলা হিসেবে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ ব্যবহার করার পরও গরুর ভুনা মাংসের সঙ্গে কচকচ করে পেঁয়াজ চিবানোর অভ্যাসও আমাদের বাংলাদেশীদের নিতান্ত কম নয়। এক কেজি গরুর মাংস রান্না করতে আমরা অন্ততপক্ষে ১০০ গ্রাম পেঁয়াজ ব্যবহার করি। সেই রান্না করা মাংস খেতে গিয়ে আমরা কাঁচা পেঁয়াজ খাই আরো ১০০ গ্রাম। অর্থাৎ এক কেজি গরুর মাংস পেট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে তেল, লবণ, পানি, দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ, তেজপাতা, আদা রসুন, মরিচ, হলুদ, জিরা ও ধনিয়ার বাইরেও কমপক্ষে ২০০ গ্রাম পেঁয়াজ সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, লবণ ও পানি ছাড়া পেঁয়াজসহ সব মসলার বাংলাদেশের অন্যতম জোগানদাতা ভারত। এ জোগান বৈধ-অবৈধ দুভাবেই হয়ে থাকে। একটা গরুতে যদি ৬০ কেজি মাংস হয় তাহলে সেই গরু জিহ্বার রসনা মিটিয়ে মসলা ও সালাদ হিসেবে পেটে যায় ১২ কেজি পেঁয়াজ সঙ্গে নিয়ে। গরুর মাংসের সঙ্গে পেঁয়াজের যেন অপূর্ব মিতালি। রসনায় এবং রন্ধনে।
আমরা যে শুধু গরুর মাংসের সঙ্গে পেঁয়াজ খাই এমন নয়। প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই আমরা পেঁয়াজ খাই। আলুভর্তা থেকে শুরু করে বার্গার পর্যন্ত সব কিছুতেই আমাদের পেঁয়াজ লাগে। বিয়ে বাড়িতে সালাদের সঙ্গে পেঁয়াজ না থাকলে অতিথিদের মধ্যে কানাঘুষা চলে। অনেকে নিচু গলায় বলেও দেয়, পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা, তাই হয়তো সালাদে পেঁয়াজ নেই।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি ধরা হয় ১৬ কোটি এবং এর মধ্যে যদি ছয় কোটি জনসংখ্যাকে পেঁয়াজ খাওয়ার আওতার বাইরে রাখা হয় তা হলেও বাংলাদেশের অন্তত ১০ কোটি লোক পেঁয়াজ খায়। একজন লোক যদি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ গ্রাম পেঁয়াজ খায় তাহলে বাংলাদেশে প্রতিদিন পেঁয়াজ লাগে ১০০ কোটি গ্রাম অর্থাৎ ১০ লাখ কেজি। এ ১০ লাখ কেজি পেঁয়াজের একটা বড় অংশ আসে সীমান্ত পথে ভারত থেকে। ফলে বিএসএফের ভাগ-বাটোয়ারায় সমস্যা হলে চালানো হয় গুলি।
বাংলাদেশে পেঁয়াজ যে চাষ হয় না এমন নয়। ফরিদপুরের ফরিদপুরি পেঁয়াজ, রাজশাহীর তাহেরপুরি পেঁয়াজ আর মানিকগঞ্জ ও পাবনার পেঁয়াজেরও বেশ নামডাক আছে। কিন্তু সেগুলো আকারে ছোট। একটা বড়সড় বরইর মতো। এর বিপরীতে ভারতীয় পেঁয়াজ বেশ নাদুসনুদুস। মাঝারি আকারের আপেলের মতো। তবে ঝাঁঝ কম। স্বাদও কম।
সে যা-ই হোক, আমরা বছরে যে পরিমাণ পেঁয়াজ খাই তাতে হয়তো মাসখানেকের চাহিদা পূরণ করে থাকে ফরিদপুর ও রাজশাহীর পেঁয়াজ। এর বাইরে প্রতি জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে যে পেঁয়াজ চাষ হয় তাতে আরো পনের দিন চলে। বাদ বাকি সাড়ে ১০ মাসের পেঁয়াজের চাহিদা আমরা মিটিয়ে থাকি বাইরের পেঁয়াজ দিয়ে। তার বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বৈধ ও অবৈধভাবে। এতে তারা ব্যবসায়িকভাবে লাভবানও হচ্ছে।
ভারত প্রতি বছর তার লাখ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে আসছে শুধু বাংলাদেশের চাহিদা মেটানো জন্য। তারা পেঁয়াজ তেমন না খেলেও বাংলাদেশীদের খাওয়ানোর জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পেঁয়াজ চাষ করে। সেই পেঁয়াজ তারা যেমন বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমাদের জন্য বৈধপথে পাঠায় তেমনি বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথেও পাঠায়। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পণ্য চোরাচালানের ক্ষেত্রে ফেনসিডিলের পরই সম্ভবত পেঁয়াজের স্থান। আর এই পেঁয়াজ চোরাচালানের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধীরা যেমন জড়িত তেমন জড়িত ভারতের অপরাধীরাও। অথচ বানশালের দৃষ্টিতে বাংলাদেশীরাই অপরাধী। ভারত ধোয়া তুলসি পাতা।
এক-এগারোর পর বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের সরকারি মহল ও মিডিয়া প্রবল উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তাদের উচ্ছ্বাসের প্রধান কারণই ছিল এক-এগারোর আগের পাঁচ বছরে ক্ষমতায় থাকা বিএনপির ক্ষমতায় আসতে না পারার বিষয়টি। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভারত বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি তা বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা নেই বলে তাদের উচ্ছ্বাসের মাত্রাটা ছিল অতিরিক্ত। ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, পাইলাইনের গ্যাস ইত্যাদি ইস্যু বর্তমান সরকারের কাছ থেকে খুব ভালোভাবে আদায় করতে পারার সুখ-স্বপ্নে তারা বিভোর হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে তখনই যখন তারা দেখতে পায় বর্তমান সরকারও বিগত বিএনপি সরকারের মতো কিছু প্রকল্পের বিষয়ে একই নীতিতে হাঁটছে।
বাংলাদেশী শীর্ষ ব্যক্তিদের আশকারা : বানশালের এ ধরনের বিবৃতির মূলে রয়েছে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের আশকারামূলক কথার্বাতা। যেমন- ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের নির্মম নির্যাতনের ভিডিওচিত্র যেদিন দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হয়, এর পরদিন (২১ জানুয়ারি) এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। এসব অতীতে ঘটেছে, এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করে না।’ একজন বাংলাদেশীকে বিবস্ত্র করে হাত-পা বেঁধে বুটজুতা ও লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে আঘাত করছে-আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টিতে এ জাতীয় ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটবে, সরকার এ বিষয়ে চিন্তিত নয়। একজন বাংলাদেশীকে উলঙ্গ করে তাঁর গোপনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে উল্লাস করছে বিএসএফ-সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃষ্টিতে এ জাতীয় ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটবে। একজন বাংলাদেশীকে দিগম্বর করে ভিডিও করছে বিএসএফ-আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী বলছেন, এ জাতীয় ঘটনা ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্র এতে চিন্তিত নয়।
ফেলানী, হাবিবুর কিংবা রাশেদুজ্জামানই নয়, পর্যালোচনায় দেখা যায়, মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছিল বাংলাদেশীদের লাশের মিছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসারপর সীমান্ত এলাকায় ২০১২ সালে ৯৮ জন, ২০১৪ সালে ৭৪ জন এবং ২০১৬ সালে ৩১ জন নিহিত হয়েছেন। এ সময় বিএসএফের হাতে অহরণের শিকার হয়েছেন ৯০ বাংলাদেশী। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে বিএসএফ ৯৮ বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা ছাড়াও পিটিয়ে বা পাথর ছুড়ে আহত করেছে ৭৯ জনকে, অপহরণ করেছে ২৫ জনকে, নিখোঁজ হয়েছে ৯২ জন এবং বাংলাদেশে পুশইন করেছে ১১ জনকে। ২০১৫ সালে ৭৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা ছাড়াও পিটিয়ে আহত করেছে ৭২ জনকে, অপহৃত হয়েছে ৪৩ জন। ২০১৬ সালে ৩১ জন হত্যা, পিটিয়ে ও নির্যাতন করে আহত করেছে ৬০ জনকে। এ সময় অপহৃত হয়েছে ২২ জনকে বাংলাদেশী নাগরিক। আর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব মতে ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪৭ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যার কথা স্বীকার করেছে বিএসএফ। এসব ঘটনায় অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান বিবিসিকে সম্প্রতি বলেন, গত ১০ বছরে পরও সহিংস ঘটনা কমেনি।’ এহব ঘটনা পর্যালোচনা করে আদিলুর রহমান খান বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তটি পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠার পেছনে বিএসএফের বর্বরতা ভারত সরকারের প্রভুসুলভ মনোভাব, সে দেশের নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে দায়ী। কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের দায়-দায়িত্ব কম নয়। ভারত বিশাল রাষ্ট্র-এই ভয়ে আমরা যেন সব সময় ত্রস্ত থাকি। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয় মিনমিনে। ভারতের সুশীল সমাজ তাদের দেশের বিএসএফের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের সুশীল সমাজসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা পারলে বিএসএফের পক্ষ নেয়।
গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য। আমাদের নীতি-নির্ধারকরা ঘটেছে, ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে বলে বিএসএফকে প্রকারান্তরে উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশী নিধনে। এই নিধনযজ্ঞ সেদিনই শেষ হবে, যেদিন পুরো জাতি জেগে উঠবে। গর্জে উঠবে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তখন আর কোনো নেতা বলতে পারবেন না, সীমান্তের ঘটনায় সরকার চিন্তিত নয়।

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এখন বড়ই অচেনা হয়ে গেছে বাংলাদেশ


গুলশানের হোটেল আর্টিজান ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৮ জন বিদেশিসহ ২২ জন মানুষের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের চেহারাই বদলে গেছে। এখন আর কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে, বাংলাদেশের ইমেজ আর কখনও আগের জায়গায় ফিরে যাবে। হাজার বছর ধরে অতিথিবৎসল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম সৃষ্টি হয়েছিল, গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর তার বিনাশ ঘটেছে। এরপর ঘটেছে আরও দুটো ঘটনা। একটি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বহত্তম ঈদ জামাতে হামলা আর কল্যাণপুরে একটি মেসে সন্ত্রাসী বলে অবিহিত ৯ জন যুবকের হত্যাকাণ্ড। শোলাকিয়ায়ও নিহত হয়েছেন দুই পুলিশ সদস্য, এক সন্ত্রাসী ও একজন গৃহবধূ। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ফলে সারা বিশ্বের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশ ও তার জনগণ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে এখন আর আসতে চাইছে না, কোনো ব্যাবসায়ী, বিনিয়োগকারী বা পর্যটক। অথচ এর সবই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে জড়িত।
যদিও পুলিশ সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু তার কোনো কিছুই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বিশেষ করে বিদেশিদের মধ্যে ভীতি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তারা যেমন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তেমনি উদ্বিগ্ন তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়েও।
ইতিমধ্যে এদের অনেকেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেক বিদেশি বাংলাদেশ ছাড়বার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। অনেকেই নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিবারবর্গকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ তো হচ্ছেই না, আসছে না সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও। থমকে গেছে সব কিছু। এখন বাংলাদেশকে দুটো ফ্রন্টই সামাল দিতে হচ্ছে, একটি অভ্যন্তরীণ আরেকটি বৈদেশিক।
পুলিশ সম্ভাব্য জঙ্গিদের ধরা ও নির্মূল করার নানমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিদেশিদের মন থেকে ভয় দূর করার জন্য সরকারের তরফ থেকে নানা রকম আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। পর্যটনমন্ত্রী এমনও বলেছেন যে, পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য তাদের সঙ্গে পুলিশ দেয়া হবে। কিন্তু পুলিশের পাহারায় কেউ কি বেড়াতে আসে? রাতে যে হোটেলে থাকবেন তার গেটে যদি পুলিশ পাহারা বসানো হয় তাহলে তাদের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না। মানুষ বেড়াতে যায় কিংবা আসে নির্মল আনন্দ লাভের জন্য। পুলিশ পাহারায় সেটি কিছুতেই সম্ভব হবে না। একই কথা প্রযোজ্য বিদেশি কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। ভয়ভীতি নিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় না। কোনো কোনো দূতাবাস তাদের কর্মীদের বাসা গুলশান বনানী ছেড়ে বারিধারায় স্থানান্তর করতে বলেছেন। কোনো কোনো দূতাবাস তাদের কূটনীতিক ও কর্মীদের পাঁচতারকা হোটেল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। অথচ ব্যবসায়িক আলাপ-আলোচনা, চুক্তিÑএসবই সম্পাদিত হয় পাঁচতারকা হোটেলগুলোতেই। আর নিরাপত্তা সমস্যার কারণেই বিদেশিরা এখন আর বাংলাদেশে আসতে চাইছেন না। এমন কি ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য তারা তৃতীয় কোনো দেশে বৈঠক করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এ রকম গোঁজামিলে বাণিজ্য হয় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় তারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। সে প্রক্রিয়াও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আর ভারত মরিয়া হয়ে বাংলাদেশে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সেসব ব্যবসা বাণিজ্য করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে।
পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন যে, সরকারের বহুমুখী চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আবার আগের বাংলাদেশ হবে- এ ব্যাপারে তার শঙ্কা রয়েছে।
বিদেশিদের অশঙ্কা এই জন্য কাটছে না যে, সরকার জননিরাপত্তার এই ইস্যুটিকে বিরোধী দলকে ঘায়েলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আর সেভাবেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার বিদেশিদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে দৃশ্যত চেষ্টার ত্রুটি করছে না। কিন্তু পরিহাস হলো এই যে, এ রকম একটি জাতীয় সঙ্কটকালে সকল রাজনৈতিক দল ও সুধী সমাজকে একতাবদ্ধ করার কোনো প্রয়াস সরকারের নেই। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যখন ঐক্যের ডাক দেয়া হয়েছিল, তখন সরকারী লোকেরা নানা মশকার করে সে আহ্বান উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটি কোনো পরিপক্বতার পরিচায়ক নয়। সরকার মনে করছে, তারা নিজেরাই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম। এতে বিদেশিদের উদ্বেগ তো কমায়ই নি, বরং বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
আতঙ্ক এখন সর্বত্র। কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়গুলো আছে কড়া নজরদারিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জঙ্গি বলে তরুণদের সন্দেহ করা হচ্ছে। অভিভাবকদের দিন কাটছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়। তাদের সন্তানও কি কোনো চরম পন্থার দিকে ঝুঁকছে কিংবা তারা অযথা পুলিশের হয়রানির শিকার হবে না তো? তা ছাড়া পুলিশ ধারাবাহিকভাবে ব্যাচেলদের মেসবাড়িতে জঙ্গি খুঁজতে হানা দিচ্ছে। এসব মেসবাড়িতে যেমন হাজার হাজার ছাত্র থাকেন, তেমনি থাকেন বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত চাকরিজীবীরা। যারা সপ্তাহান্তে বা মাসান্তে একবার গ্রামে যান। স্ত্রী পুত্র কন্যা পিতা মাতা নিয়ে বাসা ভাড়া করে শহরে থাকবার সঙ্গতি তাদের নেই। শুধু পুলিশের ভয়ে নয়, বাড়িওয়ালারাও এখন ব্যাচেলরদের আর মেস ভাড়া দিতে চাইছেন না। তাদেরও ভয় ছাত্র কিংবা চাকরিজীবীর পরিচয়ে কোনো জঙ্গি তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেবে না তো। সে রকম হলে পুলিশি হাঙ্গামার শিকার হবেন তারা। এমনি এক আতঙ্কের মধ্যে এখন আছে জনজীবন।
কিন্তু এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার শতভাগ নির্ভর করছে পুলিশ বাহিনীর উপর। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর একার পক্ষে কোনোদিনই জঙ্গি দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হবে না। এর জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। আর সেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কাজ পুলিশের নয়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ জঙ্গি দমনের নামে সাধারণ মানুষের উপর কঠোর নির্যাতন চালাচ্ছে। ফলে আস্থা অর্জনের বদলে পুলিশের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ। সুতরাং অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শুধুমাত্র পুলিশের উপর নির্ভরশীলতা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হচ্ছে। তাদের ব্যাপক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভয় পাচ্ছেন বহু ক্ষেত্রে। আর সে কারণেই বাংলাদেশি মানুষ কিংবা বিদেশিরা এমনটি আশা করেন না যে, শিগগিরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
এদিকে আরও নতুন হামলা আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের নাগরিকদের ঢাকার পাঁচতারকার হোটেল কিংবা জনসমাগমস্থলে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। অন্যান্য দূতাবাস তাদের কর্মীদের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা কিংবা অরক্ষিত সাধারণ যাববাহনে চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট নিজেও বিভিন্ন পার্টি ও অভিজাত হোটেলে আয়োজিত কর্মসূচিতে যোগদান থেকে বিরত রয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও ইউরোপীয় দেশসমূহ ঢাকায় কর্মরত তাদের কূটনীতিকদের পরিবারকে দেশে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। কানাডা তাদের কূটনীতিকদের পরিবারকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। দুজন জার্মান কূটনীতিক তাদের সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা আর বাংলাদেশে কাজ করতে যাবেন না। জাপান সরকার তাদের কূটনীতিকদের গুলশান বনানী ছেড়ে বারিধারায় বাসা নিতে বলেছে। কারণ, দূতাবাস মনে করছে, গুলশান-বনানীর চেয়ে বারিধারা অধিক নিরাপদ। তারা দ্রুত বাসা বদল করছেন।
এখন আবার দেশে পালিত হচ্ছে নিরুত্তাপ পর্যটন বর্ষ। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার মনে করছে যে, বিশেষ করে বিদেশিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। তাই বৃটিশরা যেন এমন সব জায়গা পরিহার করে চলে, যেখানে সাধারণত বিদেশিদের সমাগম বেশি হয়। কানাডা মনে করে, বাংলাদেশে আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। আর তা হতে পারে যে কোনো স্থানে, যেকোনা সমাগমে। পর্যটন বর্ষাকালেও দেশের বিলাসবহুল হোটেলগুলোর অবস্থা শোচনীয়। হাজার হাজার বিদেশি, যারা বাংলাদেশে বেড়াতে আসবেন বলে হোটেল বুকিং দিয়েছিলেন, তারা সেসব বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন। অনেক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা হোটেলে বা কনফারেন্স সেন্টারে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, গুলশান হামলার পর তারাও সেগুলোও বাতিল করে দিয়েছেন। অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতেও নেই বিদেশি অতিথিদের ভিড়। ফলে তাদের ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলার জোগাড়। ট্যুর অপারেটরস সমিতি কিছুদিন আগে জানিয়েছে যে, গত দেড় মাসে ১০ হাজার বিদেশি তাদের নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন।
এরপরও কীভাবে আশা করা যায় যে, বাংলাদেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে ঠিক এমনি এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল !

চার দিক যেন থমথমে নিঃস্তব্ধ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়া গুমোট। কোথাও শীতল হাওয়ার দোলা নেই। কিছুকাল আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, “চার দিকে থমথমে অবস্থা। এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের আগে ঠিক এমনি এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এ কথা আপনারা সবাই জানেন, ঝড়ের আগে এমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়। বাঙালিরা যেমন বীরের জাতি, তেমনি বেঈমানেরও জাতি। তারা ‘বঙ্গবন্ধু’কে হত্যা করেছে। স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাই না। আপনারা বুঝে নেবেন। সুতরাং আওয়ামী নেতাকর্মীদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।” তিনি বুঝতে পেরেছেন, ঝড় সমম্ভবত আসন্ন। তার এ কথার মধ্যে যে বার্তা নিহিত ছিল, তা সব আওয়ামী লীগার অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কিনা, বলা দুষ্কর। কিন্তু দিন দিন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে আশঙ্কা হচ্ছে, প্রবল টাইফুন বোধকরি আরো কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্মান্ধ স্তাবকেরা তার কিছুই দেখতে পারছেন বলে মনে হয় না।

এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, আপাতত শান্ত সমাহিত পরিবেশের পেছনে কিছু একটা রহস্যময় বিষয় গভীরভাবে পাকিয়ে উঠছে। গুলশানের হোলি আর্টিজান কাফেতে এবং কিশোরগঞ্জে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ জামাত শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। দেশের ভেতরকার, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কথিত জিহাদিরা এই উদ্ভূত সঙ্কট থেকে যেমন ফায়দা লুটতে চেষ্টা করছে। তেমনি তারা জাতির অস্তিত্বের জন্যও এক ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব এখন সত্যি সত্যি বিপন্ন। আর কথিত জিহাদিদের ধরার নামে সরকার যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যেভাবে সাধারণ মানুষেরা নির্যাতনের শিক্ষা হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।
এভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বারবার বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বহীন শাসক দল ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে এর গভীরতা কিছুই আঁচ করতে পারছে বলে মনে হয় না। এ যাবৎ প্রমাণিত হয় না যে, তা আঁচ করার সামর্থ্য তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডারের লুটেরা সেনাবাহিনী যখন উপমহাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, তখনো এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।
জনগণের দ্বারা মূলত নির্বাচিত নয়, এমন একদল মানুষ প্রধানত পুলিশের ওপর ভর করে রাষ্ট্র শাসনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে জনগণ বা জনগণের স্বার্থ বা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে তারা তাদের বড় দায়িত্ব বলে মনে করছেন না। দেশ এখন পরিণত হয়েছে পুলিশ শাসিত রাষ্ট্রে। পুলিশ যেমন, সেই সঙ্গে সরকারও দেশটাকে তাদের তালুক-মুলুক ভাবতে শুরু করেছে। ক্রসফায়ারের নামে যখন তখন হত্যার অধিকার যেন কোনো কোনো বাহিনী পেয়ে গেছে। ফলে তারা ক্রসফায়ারের নাটক সাজাতে পারছে। এর বিচারের কোনো ব্যবস্থা আপাতত নেই।
এখন দেশজুড়ে চলছে ‘রেড-অ্যালার্ট’ বা কঠোর সতর্ক অবস্থা। এটি বাস্তবায়ন করছে পুলিশ বাহিনী। শাসকমহল ও শাসিতের দল মিলে ১৬ কোটি ১০ লাখ মানুষ কারো দৃষ্টির বাইরে এটা ঘটছে না। শাসিতের দল কোনো অবস্থাতেই এই বিপুল দুঃখগাথা উপেক্ষা করতে পারছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের কাছে এর প্রতিকারের কোনো উপায় নেই। কারণ খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে উপমহাদেশের মানুষ আলেকজান্ডারের বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। তেমনি, ১২০২ সালে বখতিয়ার খিলজি অল্প কয়েকজন ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা নিয়ে যখন বাংলা আক্রমণ করেছিলেন, তখনো কেউ তাদের প্রতিরোধ করতে পারেনি।
আবার ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক বেনিয়া ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বনের কারণে বাংলাদেশকে ২০০ বছরের জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের পদানত হতে হয়েছিল। এদিকে, বাংলাদেশ এখন সুস্পষ্টরূপে বিভক্ত। যারা সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে, তাদের ওপর বর্তমান শাসকেরা তাদের নানাভাবে চালাচ্ছে নির্যাতন ও হয়রানি। সরকারের নির্যাতন যত বাড়ছে, ততই বিপন্ন হয়ে পড়ছে দেশের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এমনকি বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ার শঙ্কা এখন বহু গুণ বেশি। উপরন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর দেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য বহু গুণে বেড়ে গেছে। আর এসবের ফলেই বিপন্ন হয়ে পড়েছে শান্তিশৃঙ্খলা।
বাংলাদেশে বোধহয় একজন লোকও পাওয়া যাবে না, যিনি বলবেন বাংলাদেশ সঠিক পথে চলছে। সরকার থেকেই বারবার বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু কোনো সাধারণ মানুষ এর সাথে একমত হতে পারেন না। সামাজিক নিরাপত্তা বলে এখন আর কিছু নেই। গুম, খুন অতীত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বা খুনোখুনি বেড়েছে। আরো বাড়ছে। ফলে ঘরছাড়া হচ্ছেন ডজন ডজন যুবক। আর পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের অনেকে যোগ দিচ্ছেন কথিত জিহাদি কর্মকাণ্ডে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা ইতিবাচক পরিবর্তন চান।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় সাম্প্রতিক হামলার পর রক্ত হিম করা এক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কথিত জিহাদিরা বাংলদেশকে একটি কট্টর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এই ক্ষেত্রে আগে সরল ও দরিদ্্র মাদরাসা ছাত্রদের ইঙ্গিত করা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, সম্পন্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণেরা যোগ দিচ্ছে এই উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে। সরকার এর মূল কারণ অনুসন্ধান করতে চাইছে বলে মনে হয় না। এর প্রধান কারণ সমাজের ভেতরে পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে; অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা লোপ পেয়েছে। সব নাগরিকের সমান অধিকারের বিষয়কে পদদলিত করা হচ্ছে।
আবার হোলি আর্টিজানে ১৮ জন বিদেশী নাগরিকসহ ২২ জনের হত্যাকাণ্ড এবং সেই সাথে ছয় জঙ্গি হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক হয়ে পড়েছে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা ছাড়া বিদেশীদের তেমন কেউ এখন বাংলাদেশ আসতে চাইছেন না। পর্যটন শিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদেশী পর্যটকেরা হোটেল বুকিং বাতিল করছেন। পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে বিদেশী নেই। দেশী পর্যটকেরাও সতর্ক। কোথায় বিপদ ওঁৎ পেতে আছে, কেউ জানে না। কূটনীতিকেরা বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন দূতাবাস তাদের কর্মীদের পাঁচতারকা হোটেল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। তার ওপর, অভিজাত আবাসিক এলাকা থেকে হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট তুলে দেয়ার ফলে সেখানে বিদেশীদের বসবাসের পরিবেশও নেই বলা চলে। বন্ধ হয়ে গেছে বিদেশী স্কুল, স্থবির হয়ে গেছে অনেককিছু। এই অবস্থা থেকে শিগগির বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তারপর, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেশের গোটা উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। শস্য, গৃহপালিত পশু, অবকাঠামো এবং অন্যান্য সম্পদের সর্বনাশ ঘটেছে।
প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে, এই বন্যায় ক্ষতি হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো কমে গেছে রফতানি আয়। ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
দেশের এই রকম একটা বিপর্যয়কর মুহূর্তে পরিস্থিতির গুরুত্ব ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং হয়রানি ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রাজনৈতিক নির্দেশনাÑ কোথায়ও আশার আলো নেই। উপরন্তু যে ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক বস্তিতে জীবনযাপন করে তাদের অবস্থা আরো বেশি রূপ নিয়েছে। বস্তি উচ্ছেদের নামে সরকার তাদের মাথার ওপর থেকে ছাদ কেড়ে নিয়েছে। বন্যার ফলে সর্বস্ব হারিয়ে আরো লাখ লাখ মানুষ শোচনীয় শহরগুলোতে এসে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। শহরগুলোর জন্য সেটি মোটেও সুসংবাদ নয়। আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, প্রয়োজন থাকলেও হেলিকপ্টার দিয়ে বন্যাদুর্গত-দুর্গত দুর্গম এলাকার মানুষদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়নি। এখন দেশে কমপক্ষে এক কোটি ২০ লাখ লোক পানিবন্দি। তাদের না আছে খাদ্য, না আছে আশ্রয়, না আছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, তাদের গবাদি পশুও অনাহারি। তারা কাটাচ্ছে নির্ঘুম রাত। দেখার কেউ নেই।
কিন্তু এতসব কাণ্ডের মধ্যেও অধিকাংশ মিডিয়া সরকারি গীত গেয়ে চলছে। এসব বিপন্ন মানুষের চিত্র কমই মিডিয়ায় প্রতিফলিত হচ্ছে। উপরন্তু, পুলিশ যেসব নিরপরাধ তরুণকে ‘জঙ্গি’ অভিহিত করে নগর শহর বন্দরে তাড়া করে ফিরছে তাদের কাহিনী কোথাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বরং ধামাধরা মিডিয়াগুলো ব্যস্ত আছে দিবস পালনের গৎবাঁধা প্রতিযোগিতায়। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জঙ্গি ধরা আতঙ্ক থেকে মুক্তি আর অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা। এর সাথেই জাতীয় স্বস্থি ও স্থিতি জড়িত। কিন্তু মৃত্যু হয় যে পথে, সে পথ উত্তরণের কোনো পথ নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে বিদেশীদের বোঝানো যাবে না যে, বাংলাদেশের অবস্থা অস্থিতিশীল নয়। সেটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক কোনোভাবেই নয়। সরকার যদি এমন এক মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে যে, ‘হয় আমরা থাকব নয়তো ওরা থাকবে’- তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবেই। আর সেরকম পরিস্থিতিতে কট্টরপন্থীদের উত্থান ঘটার শঙ্কাই বেড়ে যাবে।
রেজোয়ান সিদ্দিকী

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

মন্দের ভিড়ে হাঁসফাঁস


আজকের নিবন্ধ দু’জন অতি সাধারণ মানুষের কথা দিয়ে শুরু করবো। একজন জামাল, বাড়ি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এলাকায়। গোপালগঞ্জে। দ্বিতীয়জনের নাম গিয়াস উদ্দিন, ঘনিষ্ঠজনেরা ডাকে ঘেসু মিয়া। তারও বাড়ি গোপালগঞ্জের আশপাশে। শরিয়তপুরে। জামাল রাজধানীর কোনো একটি এলাকায় সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করে। আমার সঙ্গে পরিচয়ের কারণও সেটাই। অন্যদিকে গিয়াস উদ্দিন ওরফে ঘেসু মিয়া সিএনজি চালায়। ১৯৯৯ সালের দিক থেকে আমি তার বাহনটি ভাড়ায় ব্যবহার করে আসছি। তখন ছিল বেবি ট্যাক্সি, এখন হয়েছে সিএনজি। ঘেসু মিয়াকে আগে বলে রাখলে তো বটেই, মোবাইলে খবর দিলেও ঠিক সময়ে আমার বাসায় চলে আসে। আমার ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের সবার বাসাই তার চেনা। ফলে অমুকের বাসায় যেতে হবে বলাটাই যথেষ্ট। ঘেসু মিয়াকে বেশি কাজে লাগে ঈদুল আযহার দিন। কুরবানীর গোশতের প্যাকেটগুলো হাতে ধরিয়ে দিলেই পৌঁছে যায় আত্মীয়-স্বজনদের বাসায়।
পাঠকরা তাই বলে ভাববেন না যে, বিনা টাকায় এই সার্ভিসটুকু পাওয়া যায়। আমাকে মিটারের চাইতে দ্বিগুণের মতো বেশি ভাড়া দিতে হয়। ঈদের সময় তো বখশিসের ব্যাপার-স্যাপার রয়েছেই। এসব ছাড়াও সময়ে সময়ে নানাভাবে তাকে সাহায্য করতে হয়। যেমন তার একমাত্র মেয়ের জামাই আবদুস সালামকে অন্তত খান চারেক অফিসে এ পর্যন্ত পিয়নের চাকরি যোগাড় করে দিয়েছি। কিন্তু কোথাও বেশিদিন টিকতে পারে না সে। তাকে নাকি বেতনে ঠকানো হয়! সে কারণে বারবার চাকরি বদল করে সালাম। লেখাপড়া না জানলেও চেহারা-সুরত ভালো এবং কথাবার্তায় স্মার্ট বলে নতুন নতুন চাকরি পেতে অসুবিধা হয় না তার। ভালো চেহারা এবং স্মার্ট হওয়াটাই অবশ্য বিপদও ডেকে এনেছে সালামের জন্য। সেদিন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় হাঁফাতে হাঁফাতে ঘেসু মিয়া এসে জানালো, সাদা পোশাকের কারা যেন আবদুস সালামকে ধরে নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে নাকি জঙ্গিদের ‘কালেকশন’ আছে! এই একটি বিষয়ে আমি কোনো সাহায্যই করতে পারলাম না ঘেসু মিয়াকে।
আফসোস করে ঘেসু মিয়া বললো, আজ যদি ‘রেজ্জাক’ ভাই থাকতো! আওরঙ্গ দাদাও তো মরে গেছে। উল্লেখ্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের কথা বলেছিল ঘেসু মিয়া। শরিয়তপুরের মানুষ হিসেবে আবদুর রাজ্জাককে শুধু চিনতো না, মাঝে-মধ্যে তার কাছে যাতায়াতও করতো ঘেসু মিয়া। এমনকি মন্ত্রী থাকার সময়ও বেশ কয়েকবার তার কাছে আবদুর রাজ্জাকের কথা শুনতে হয়েছিল। তার মতো ভালো মানুষই নাকি হয় না। এখন সে আবদুর রাজ্জাকও নেই, শরিয়তপুরের আরেক নেতা হেমায়েত হোসেন আওরঙ্গও দু’ বছর আগে মারা গেছেন। ফলে মহা বিপদে পড়েছে ঘেসু মিয়া। ‘আমার জামাইয়ের কি হবে স্যার’ বলতে বলতে সেদিন বিদায় নিয়েছিল সে! এটা মাস তিনেক আগের ঘটনা। ক’দিন আগেও শুনলাম, জামাই সালাম এখনো জেলখনাতেই আছে। ঘেসু মিয়া সেই সাথে জানালো, তার ভাগ্য ভালো যে, মহল্লার অমুক-অমুকের মতো তার জামাইকেও ক্রস ফায়ারে দেয়া হয়নি। জামাই বেঁচে আছে- এতেই খুশি ঘেসু মিয়া।
এবার জামালের কথা। সে বিপদে পড়েছে তার এক ভাতিজাকে নিয়ে। বড় ভাইয়ের এই ‘যুয়ান পোলাডা’ গ্রামের কলেজে পড়ে। কলেজ থেকে ফিরেই লেগে যায় মাটি কাটার কাজে। ওটাই তার আয়  রোজগারের একমাত্র উপায়। এলাকার সবাই জানে ও চেনে জামালের ভাতিজাকে। সেই তাকেও মাস খানেক আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। অভিযোগ, সে নাকি ‘জামাত-শিবিরের লোক’! জামাল জানালো, গোপালগঞ্জের হেন কোনো এলাকা নেই যেখানে ছাত্র-যুবকদের এভাবে ‘জামাত-শিবিরের লোক’ বানানো না হচ্ছে। অনেককে নাকি জেএমবিও বানাচ্ছে পুলিশ!
প্রসঙ্গক্রমে রাজধানীর অন্য একজনের কথা না বললে কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক’দিন আগে গুলশান এলাকার একটি হোটেলের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি তার চাকরি হারানোর ভয়ে রয়েছেন। কারণ, জঙ্গি হামলা প্রতিরোধে তৎপর সরকার নাকি স্ক্যানিং মেশিন ও গেটসহ এমন বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে, যা স্থাপন করতে হলে ওই হোটেলের মালিককে অন্তত লাখ পঞ্চাশেক টাকা ব্যয় করতে হবে। কোন দেশ থেকে ঠিক কোন ব্র্যান্ডের মেশিনপত্তর আনতে হবে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে। কোনো হেরফের করা চলবে না। ওদিকে এত বেশি টাকা ব্যয় করার সাধ্য নেই হোটেল মালিকের। সে কারণে তিনি হোটেলই বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে আমার পরিচিত ম্যানেজার তো বটেই, আরো অনেকেই চাকরি চলে যাই যাই অবস্থায় পড়েছেন। আলাপে জানা গেলো, একই নির্দেশ রাজধানীর অন্য হোটেলগুলোকেও দেয়া হয়েছে, যেসব স্থানে বিদেশীরা যাতায়াত এবং খাওয়া-দাওয়া করেন।
এখানে নির্দেশের অন্তরালের কিছু বিষয় লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, জঙ্গি হামলার বিষয়টিকে সরকার অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য হামলা যাতে না ঘটতে পারে সে জন্য প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তার ব্যাপারেও সরকার লক্ষ্য রাখতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো বিশেষ বিশেষ দেশ থেকে শুধু নয়, স্ক্যানিং মেশিন ও সিকিউরিটি গেটসহ সবকিছু আমদানি করতে হবে বিশেষ ব্র্যান্ডের অর্থাৎ বিশেষ দু-একটি কোম্পানির। যেহেতু সেভাবেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেহেতু অন্য একটি অনুমানও না করে পারা  যায় না। বলা হচ্ছে, পুরো আয়োজনের পেছনে ‘কমিশন’ ধরনের ব্যাপার-স্যাপার থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আর বর্তমান সরকারের অধীনে ‘বিএনপি-জামায়াতের’ লোকজন যে অন্তত এই ব্যবসার সুযোগ পাবেন না সে কথা তো বলাই বাহুল্য!
এ পর্যন্ত এসে কাছাকাছি অন্য একটি প্রসঙ্গে যেতেই হবে। তারও আগে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রাখা দরকার। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে আমার বাসায় ডাকাতি হয়েছিল। এরপর বেশ কয়েকবার আমাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নেয়া হয়েছে। প্রথম দিনই একজন সহকারী কমিশনার বা এসি আমার স্ত্রীর একটি মোবাইল ফোন দেখালেন। সেটটি ছিল নোকিয়া ব্র্যান্ডের। এটা ডাকাতির মাত্র দু’দিন পরের ঘটনা। অর্থাৎ দু’দিনের মধ্যেই পুলিশ ফোন সেটটি উদ্ধার করেছিল। কিভাবে- সেটাও ক’দিন পর জানালেন ওই এসি। সামনে থাকা একটি ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখে তিনি বললেন, আপনার স্যামসাং-এর মোবাইল সেটটি এখন মাদারীপুর থেকে ঢাকার দিকে আসছে। গত তিন-চারদিন ধরেই এটা অর্থাৎ যার হাতে সেটটি রয়েছে সেই ব্যক্তি মাদারীপুর থেকে ঢাকা হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যাতায়াত করছে। কথাটা কিভাবে জানা সম্ভব হলো প্রশ্ন করায় এসি জানালেন, প্রতিটি ফোনসেটেই একটি আইএমইআই নম্বর থাকে। নম্বরটি কারো পক্ষে নষ্ট করা সম্ভব নয়। বিক্রির সময় রসিদে ব্যবসায়ীরা সাধারণত আইএমইআই নম্বর উল্লেখ করে। এটা সরকারের নির্দেশ। আর এই নম্বর জানা গেলে ফোনসেটটির লোকেশন বা অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। বাংলাদেশ পুলিশের কাছে সে টেকনোলজি রয়েছে। এই টেকনোলজি ব্যবহার করেই আমার স্ত্রীর নোকিয়া সেটটি উদ্ধার করেছিল পুলিশ। বলা দরকার, স্ত্রীর সে নোকিয়া তো বটেই, আমার হারানো স্যামসাং সেটটিও আমি ফিরে পাইনি। সবই নাকি পুলিশ ‘হজম’ করেছিল।
ডাকাতির ঘটনাটা বিনা কারণে বলা হচ্ছে না। প্রধান কারণ একথা জানানো যে, যে কোনো মোবাইল সেটে আইএমইআই নম্বর থাকাটা জরুরি। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের আমলে পরিস্থিতি হয়ে গেছে সম্পূর্ণ অন্য রকম। দিন কয়েক আগে সংবাদপত্রের এক রিপোর্টে দেখলাম, দেশে নকল মোবাইল ফোনসেটের বাধাহীন ব্যবসা ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ব্যবসায়ী নামের কিছু জালিয়াত চক্র বিদেশ থেকে চোরাই পথে আনা অতি নিম্ন মানের মোবাইল সেটের কভার পরিবর্তন করে সেগুলোর গায়ে নামি-দামি ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো লাগিয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনলাইন শপিং-এর আড়ালে বেশি দামের ফোন অবিশ্বাস্য পরিমাণে কম দামে বিক্রি করছে তারা। এমন ঘটনাও জানা গেছে, যেখানে ৮৫ হাজার টাকা দামের একটি আইফোন বিক্রি হয়েছে মাত্র সাত হাজার টাকায়। প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া প্রলুব্ধ ক্রেতা এত কম দামে বিক্রির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে না পেরে নগদ মূল্যে ফোনসেটটি কিনেছিলেন। প্রতারক কোম্পানি তার কাছে সেটা পৌঁছেও দিয়েছে। কিন্তু ব্যবহার করতে গিয়েই ক্রেতাকে বুঝতে হয়েছে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। কারণ, তার মোবাইলের স্ক্রিন কাজ করছিল না। অন্য অ্যাপসগুলোও ছিল অকার্যকর। ওই গ্রাহক ফোনে বিক্রয়কারী কোম্পানির সন্ধান পাননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোম্পানিটি ভুয়া ঠিকানা দিয়েছিল। সার্ভিস সেন্টারে গিয়েই গ্রাহক প্রথম জানতে পেরেছেন, তাকে আসলে দামি আইফোনের নামে অত্যন্ত নিম্ন মানের একটি সেট গছিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটিও এমন এক সেট যা মেরামত করা সম্ভব নয়।
এটা প্রতারণার অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মাত্র একটি। এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন আরো অনেক সাধারণ ক্রেতাই। শুধু অনলাইনে নয়, মার্কেটের দোকানেও চলছে প্রতারণার এই ব্যবসা। রাজধানীতে তো বটেই, দেশের উপজেলা পর্যায়ের মার্কেটগুলোতে পর্যন্ত নকল মোবাইল সেটের রমরমা ব্যবসা চলছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। দৈনিকটির রিপোর্টে জানানো হয়েছে, জালিয়াত চক্রকে সুকৌশলে সাহায্য করছে বিভিন্ন ফোন কোম্পানি। সময়ে সময়ে এসব কোম্পানি মূল্যহ্রাসসহ লোভনীয় নানা অফার দিচ্ছে। এতে একদিকে গ্রাহকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন, অন্যদিকে ঘোষিত অফারের সুযোগ নিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করছে জালিয়াত চক্রগুলো। তাদের জালে ফেঁসে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। রিপোর্টে রাজধানীর বড় বড় কয়েকটি মার্কেটের নাম উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, মূলত এই মার্কেটগুলোর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেই সারাদেশে নকল ও নিম্ন মানের মোবাইল সেট সরবরাহ করা হয়। এসব সেটের ব্যবসা চলে পাইকারি বাজারের নিয়মে। সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে শুধু নয়, রাজধানীর ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিশেষ করে মফস্বলের মোবাইল ব্যবসায়ীদের পক্ষেও কোনটি নকল আর কোনটি সঠিক তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। যেহেতু মোবাইলের গায়ে বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানির লোগো থাকে এবং সরবরাহও করা হয় বড় বড় মার্কেট থেকে সেহেতু ক্রেতা থেকে ক্ষুদে ও মফস্বলের ব্যবসায়ী পর্যন্ত সকলেই জালিয়াত চক্রের জালে সহজে ফেঁসে যান। জালিয়াত চক্রগুলোর দাপটে সৎ ও প্রকৃত মোবাইল ব্যবসায়ীরাও অসহায় হয়ে পড়েন। সব জেনেও তারা কিছুই করতে পারেন না। কারণ, এই জালিয়াতদের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের অনেকে নিজেরাও চুটিয়ে ব্যবসা করছে। একই কারণে পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সাহায্য পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এভাবে প্রতি বছর সারাদেশে কম করে হলেও এক কোটি ফোন সেট বিক্রি হচ্ছে। এসব ফোন সেট আসছে চীন ও ভারতসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এসব সেটের মধ্যে দু’ হাজার টাকা মূল্যের সেটগুলো বিক্রি হয় ৬০ শতাংশের বেশি। দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মূল্যের সেট বিক্রি হয় প্রায় ৪০ শতাংশ। গরীব ও নিম্নবিত্তের মানুষেরাই এসব ফোনসেটের প্রধান ক্রেতা। তারা তো প্রতারিত হচ্ছেই, পাশাপাশি রয়েছেন সেই সব গ্রাহকও, যারা বেশি দামের ফোন সেট অল্প টাকায় কেনার জন্য প্রলুব্ধ হন। না বুঝেই কিনে ফেলেন।
এভাবে সব মিলিয়েই দেশের মোবাইল ফোনসেটের বাজারে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থার কুফলও সমগ্র জাতির জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রথমত বেআইনী তথা চোরাচালানের অবৈধ পথে দেশের বাজারে ঢুকছে বলে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণের রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আসে নিরাপত্তার দিকটি। এসব সেটে ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্টার বা ইআইআর থাকে না। ফলে সরকার বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে সেটগুলোর ব্যবহারকারীদের খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। সম্ভব হচ্ছেও না। জঙ্গি-সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা তাই সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। হয়তো পার পাাচ্ছেও। তৃতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। কারণ, বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব সেটের মধ্যে থাকা রেডিয়েশনের গতি ও মাত্রা স্বাভাবিক ফোনের তুলনায় চার-পাঁচ গুণ বেশি। ফলে ফোনসেটের ব্যবহারকারীরা ক্যান্সারসহ জটিল ও মারাত্মক অনেক রোগের শিকার হবে। বাস্তবে হচ্ছেও, যে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানার জন্য কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সরকার কিন্তু নকল ফোনসেট আমদানি ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী শুধু একটি আইএমইআই ডাটাবেজ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন, যার মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির ওয়েবসাইট থেকে যে কোনো ফোনসেট সম্পর্কে জানা যাবে।
অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন,  বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এর মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাদের লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পাঠকরাও ভেবে দেখতে পারেন, মোবাইল সেট বা এ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে ক’জনের পক্ষে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দূরের কথা, বিটিআরসির মতো সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে নালিশ করতে যাওয়া সম্ভব। তারা তো এমনকি থানায়ও যেতে পারেন না। কখনো সাহস করে গেলেও পুলিশের সাহায্য পান না।
এজন্যই প্রতারণা প্রতিহত করতে হলে সরকারের উচিত এমন পদক্ষেপ নেয়া, যাতে চোরাই পথে নিম্ন মানের নকল মোবাইল সেট দেশের বাজারেই ঢুকতে না পারে। এসব ফোনের পেছনে তৎপর জালিয়াত চক্রগুলোর বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, তারা শুধু সরকারকেই রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে না, সমগ্র জাতিকেও ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ের মুখে।
বলা দরকার, দেশ ও জনগণের তো বটেই, সরকারেরও ভালোর জন্য মোবাইল ফোনসেটের প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করা হয়েছে। কারণ, মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বছরে এক কোটি ফোন সেট আমদানি ও বিক্রির কথা জানানো হয়েছে। এক কোটির অর্থ একশ’ লাখ। এই একশ’ লাখের মধ্যে কয়েক হাজার সেটেও যদি বিস্ফোরক দ্রব্য আনা হয়ে থাকে তাহলে গুলশানের মতো কয়েকটি এলাকার হোটেলে পঞ্চাশ লাখ টাকা দামের স্ক্যানিং মেশিন বা সিকিউরিটি গেট স্থাপন করে কতটা সুফল পাওয়া যাবে তা পাঠকরাও ভেবে দেখতে পারেন। মানতেই হবে, সরকার আসলে ‘গোড়ায় গলদ’ রেখে জঙ্গি হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এভাবে কি জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সুফলপ্রসূ হতে পারে? সাধারণ মানুষকে অবশ্য যথেচ্ছভাবে বিপদে ফেলা যাচ্ছে। একই কারণে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে তাদের।
আশিকুল হামিদ 

মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাস্তা বন্ধ


 এই জনপদে এখন সবার জন্যই রাস্তা বন্ধ। প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, এমপি, সরকারি বড় কর্মকর্তা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কোনো কোনো সরকারি তাঁবেদার সংবাদপত্রের সম্পাদক আর সাধারণ নাগরিক সবার জন্যই এখন রাস্তা বন্ধ। কারও জন্যই বোধকরি আর কোনো সরল পথ খোলা নেই। গত ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের ছবিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চতুর্দিকের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আশেপাশের ভবনগুলোর ছাদে মার্চ করতে করতে উঠে এসেছিল ডজন ডজন পুলিশ বাহিনী। চারদিকে পুলিশের হুইসিলে তটস্থ অবস্থা। ট্র্যাফিক জ্যাম কতোদূর বিস্তৃত হয়েছিল, জানি না। অসহায় মানুষ বন্ধ রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে শাপ-শাপান্ত করছিল।
এ শুধু ৩২  নম্বরের চিত্র নয়। মন্ত্রী সভার কেউ কোথায়ও যাবার জন্য বের হন, তখনই চতুর্দিকের রাস্তাঘাটের এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় আটকে ঘামতে থাকেন। তারা কী মনোভাব ব্যক্ত করেন, সেটা এখন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কোনো লোক আছে বলে মনে হয় না। এক সময় হয়তো প্রধানমন্ত্রী অনুমান করেছিলেন, এই জনভোগান্তির কথা। তাই তার শান্ত্রী, অমাত্যদের বলেছিলেন যে, নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আমাকে যেনো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা না হয়। সে রকম কথার কথায় কেউ কান দেয়নি। বরং কোনো এক সংবাদপত্রে বলা হয়, জনগণের যতো ভোগান্তিই হোক না কেনো তার নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে এখন তাই সবচেয়ে বেশি জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। আর তাই বিভিন্ন প্রকল্প তিনি এখন উদ্বোধন করছেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। জনগণের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন না।
পুলিশ-নির্ভর সরকারে পুলিশ এখন সব কিছুর নিয়ন্তা। তারা মন্ত্রীদের সতর্ক করে দিয়েছেন, তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। সতর্ক করা হয়েছে, মন্ত্রীদের গানম্যানদেরও। ফলে মন্ত্রীরাও আর ঘরের বার খুব একটা হচ্ছেন না। আগে যেমন নানা আলতু-ফালতু অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে খবর হবার চেষ্টা করতেন, এখন সে ধারা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পুলিশ সতর্ক করে দেওয়ার মানে কী। মানে হলো, পুলিশের পক্ষে এতো নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। যে পুলিশ সাধারণ মানুষকে উল্টো পথে যেতে বাধা দেয়, সে পুলিশই মন্ত্রী-যন্ত্রীদের রাস্তার উল্টো পথ দিয়ে নিয়ে গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু পুলিশ কেনো ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে  কৈফিয়ত তলব করার সাহস বোধকরি কোনো মন্ত্রীরও নেই। তাহলে আইন ভেঙে তিনিও রং লেনে যাবার অনুমতি পুলিশকে দিতেন না। মন্ত্রী যদি রং লেনে যেতে পারেন, তাহলে আমি কেনো পারবো না? আমাকে কেনো ট্র্যাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? বলিহারি বটে সরকার! তাই দেখি, আগে যেখানে টিভির টক-শোতে মন্ত্রী-এমপিরা যেতেন, এখন সেখানে যান পুলিশের ছোট-বড় কর্মকর্তারা। পুলিশি রাষ্ট্রে এমনই হবার কথা। সরকারি তাঁবেদার টেলিভিশনগুলোর মান এমন অবস্থায় নেমে এসেছে!
রাস্তায় বের হলে কেবলই জনগণকে ‘তফাত যাও’ হুইসিল শুনতে হয়। বড় সাহেব যাচ্ছেন, দূরে থাকো। পথ ছাড়ো। এ বড় সাহেবকে সব সময় মন্ত্রী হবার দরকার নেই। সচিব, যুগ্মসচিব, পুলিশ কর্মকর্তা হলেও চলবে। তার অধিকার আছে, জ্যামে রং লেনে দিয়ে পার হয়ে যাবার। এখানেই শেষ নয়। ঢাকা মহানগরীতে উত্তর-দক্ষিণে যা কিছু রাস্তা আছে, পুবে-পশ্চিমে তেমন রাস্তার অভাব। আর যাও-বা কিছু আছে, এখন তারও প্রায় সব বন্ধ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড পুবে-পশ্চিমে টানা। এটি প্রশস্তও। কিন্তু এই সরকার আসার পর থেকে সে সড়ক স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে এর উত্তর দিকে মেট্রো শপিং মলের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা গেছে ডানে বামে ঘুরে, ধানমন্ডির হাজার হাজাার যানবাহনকে যেতে হয় সে পথ দিয়ে। তীব্র তুমুল যানজটে নাভিশ্বাস অবস্থা।
এই অবস্থা শুধু ধানমডন্ড ৩২ নম্বরেরই নয়। গোটা ধানমন্ডি জুড়েই একই অবস্থা। সকল সড়কের মুখে লোহার পোল দিয়ে ব্যারিকেড লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, রাত এগারোটার পর ‘রাস্তা বন্ধ’। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ। কে এই কর্তৃপক্ষ, সে হদিশ কেউ দিতে পারে না। কিন্তু সত্যি সত্যি গেট বন্ধ হয়ে যায়। পোলের অপর মাথার আংটার সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয় তালা। ধানমন্ডির ভেতরে কাউকে যদি ছিনতাইকারী তাড়া করে, তবে তার বের হবার পথ নেই বললেই চলে। বেঘোরে ছিনতাইকারীর গুলি বা ছুরিতে প্রাণ দেয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকবে না।  কিন্তু এমনকি. জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে ধানমন্ডির মানুষ ঢুকবে বা বের হবে কোন পথ দিয়ে? ততোক্ষণে রোগী মারা যেতে বাধ্য। এ কাজ পুলিশ করেছে, সাইনবোর্ডে তেমন কথার উল্লেখ দেখিনি। পুলিশ যদি না করে থাকে, তবে তারা এই অবৈধ ব্যারিকেড কেনো সরিয়ে ফেলছে না?
আবার ধানমন্ডির দেখাদেখি এটা এখন বাড্ডা রামপুরাসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়ও চালু করা হরা হয়েছে। সেসব যায়গায় আরও এলাহি কাণ্ড। আমি আমার নিজের বাসায় আমার নিজের যানবাহনে যাব, কিন্তু রাত এগারোটা হলে প্রবেশ নিষেধ। যেতে হলে টোল দিতে হবে। পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, রামপুরা বাড্ডা প্রভৃতি এলাকায় এমন ব্যবস্থা চালু করেছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। পুলিশের বোধকরি এখানে কিছুই করার নেই। আসলে সরকার সমস্ত দেশটাকে যেমন, তেমনি রাজধানীকেও এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত করে ফেলেছে। এখানে প্রবেশ যেমন নিষেধ, বেরুবার পথও তেমনি রুদ্ধ।
এই অবস্থা শুধু আবাসিক এলাকায়ই নয়। একই চিত্র পাওয়া যাবে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতেও। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দৈনিক সমকাল অফিস থেকে সরাসরি এসে আগে ওঠা যেতো বিজয় সরণি বা ব্যাংগস ফ্লাইওভারে। এখন সে পথ বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। এই বন্ধ আবার কোনো অস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। একেবারে স্টিলের পোল গেড়ে, স্টিল শীট দিয়ে আটকে দিয়েছে পথ। সোজা ওঠা যাবে না ফ্লাইওভারে। আপনাকে ফ্লাইওভারে উঠতে হলে বামে গিয়ে ঘুরে আসতে হবে সাতরাস্তার মোড়। আবার সাতরাস্তার মোড় পার হলে নবনির্মিত হাজারো ত্রুটির ফ্লাইওভার ধরে নেমে আসছে শত শত যানবাহন। তীব্র যানজটের সে ভিড়ে দাঁড়াতে হবে আরও ঘণ্টাখানেক। তারপর একসময় গিয়ে হয়তো উঠতে পারবেন ফ্লাইওভার নামক নরকে। কারণ এই ফ্লাইওভার পার হতে আপনার সময় লাগতে পারে আরও এক ঘণ্টার বেশি সময়। ফ্লাইওভারের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত নিñিদ্র যানজট তেজগাঁর রাস্তা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। নিষ্ক্রিয় পুলিশ নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। বাকি আল্লাহ ভরসা। উল্লেখ্য, এই ফ্লাইওভারটিও পুবে-পশ্চিমে বিস্তৃত। যেটি স্বাভাবিকভাকে চালু থাকলে নগরে যানজট অনেকখানি নিরসন করা সম্ভব হতো।
তেমনি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত আর একটি সড়ক পরীবাগের বিপরীতে ভিআইপি সড়কের পুব পাশের রোডটি। সেখানে আছে আবাসিক এলাকা। আছে পুলিশের কি একটা কম্যুনিটি সেন্টার। পনানা অনুষ্ঠান চলে দিনরাত। কিন্তু ভিআইপি রাস্তা ধরে সেপথে যাবার কোনো উপায় নেই। আপনি হয়তো বাংলামোটর থেকে হলি ফ্যামিলির রাস্তা পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকবেন। কিন্তু না, ‘রাস্তা বন্ধ’। এ আয়োজনও কোনো কোনো সাময়িক ব্যবস্থা নয়। তেজগাঁও শিল্প এলাকার রাস্তার মতোই স্টিলের পিলার গেড়ে স্টিলের শীট দিয়ে একেবারে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তেজগাঁয় তবু বাঁদিকে বেরিয়ে সাতরাস্তার দিকে যাবার একটি পথ আছে, এখানে তাও নেই। এ পথে ঢুকতে হলে আপনাকে শেরাটন মোড় হয়ে বামের একটি সরু গলিতে ঢুকতে হবে। সেপথ দিয়ে শুধূু গাড়ি যায়ই না, আসেও। ফলে ঐটুকু সরু পথে রিকশা-গাড়ি-স্কুটারের ভিড়। পার হতে গলদঘর্ম। অথচ বন্ধ করে দেয়া প্রশস্ত রাস্তাটি খুলে দিলে এখানকার যানজট বহুলাংশে দূর হতে পারতো। তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের এই রাস্তা কেনো বন্ধ করে দেওয়া হলো, কে তার জবাব দেবে?
আর একটি উদাহরণ দিয়ে এই লেখাটি শেষ করতে চাই। সেটি হলো মিন্টো রোডের ভেতর দিয়ে মন্ত্রিপাড়ার প্রশস্ত সড়ক। নবনির্মিত সাতরাস্তা-রমনা থানা ফ্লাইওভার থেকে নেমে খানিক দূর এগিয়ে অফিসার্স ক্লাব বামে রেখে রাস্তাটি চলে গেছে ডান দিকে। শেরাটন হয়ে সোজা বেরিয়ে গেছে ভিআইপি রোডে। কেউ যেতে পারেন শাহবাগের দিকে, কেউ যেতে পারেন ফার্মগেটের দিকে। সপ্তাহ দুই আগে ফ্লাইওভার থেকে নেমে সে রাস্তায় ঢুকতে গেছি। দেখি কাাঁটাতারের বেড়া আর বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তারোধ করে উদ্যত সঙ্গীন হাতে দাঁড়িয়ে আছে ডজন দুই শান্ত্রী। বললো, কোথায় যাবেন? বললাম, এই পথ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। তাদের মধ্য থেকে একজন সামনে এসে বললেন, না, এই পথ দিয়ে যেতে পারবেন না। এই পথ দিয়ে যেতে পারবে, শুধু এসবি আর সিআইডি। সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। রাস্তা বন্ধ।
গাড়ি ঘুরিয়ে উত্তর দিকে সামনে এগিয়ে গেলাম। রমনা থানা ডাইনে রেখে পুলিশ কম্যুনিটি সেন্টারের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। যদি সোজা যেতে পারতাম, তাহলে পড়তাম ভিআইপি রোডে। সেটি তো স্থায়ীভাবে বন্ধ। আবার বামের সেই সরু পথ ধরতে হলো। শেরাটনের পুব পাশের গোলচত্বরের সামনে এসে গাড়ির সমুদ্রের মধ্যে পড়লাম। ঐ ১০০ গজ পাড়ি দিতে ঘণ্টা দেড়েক লাগলো। কিন্তু এই রাস্তা বন্ধ রাখার খামখেয়ালির কি কোনো জবাবদিহিতা নেই?

পাদটীকা :
আমার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এসবি-সিআইডি পথের অভিজ্ঞতা বলছিলেন। তিনি আমার মতো পাতলা দুবলা নন। গাট্টাগোট্টা চেহারার হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক। সঙ্গে জিপ গাড়ি। ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে হাতের ইশারায় ডাক দিলেন এক পুলিশ সদস্যকে। বললেন, এই সব ঠিক আছে তো? পুলিশ সদস্যটি তাকে স্যালুট দিয়ে গেট খুলে দিলো। তিনি নির্বিঘ্নে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সহজ পথে পৌঁছে গেলেন। অর্থাৎ নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনিতে ফসকা গেরোটা রয়েই গেছে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রোমের পুলিশ


সম্প্রতি ইটালির রোমে পুলিশ চমৎকার একটি কা- ঘটিয়েছে। অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই কমবেশি অভিযোগ থাকেই। পুলিশকে চোর-ডাকাত গুণ্ডা-বদমায়েশ, হন্তারকের মতো অপরাধীরা ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বহু দেশে সাধারণ মানুষও পুলিশের ভয়ে ভীত ও আতঙ্কিত থাকেন। অথচ পুলিশের এমন হবার কথা নয়। পুলিশ হবে মানুষের তথা জনগণের বন্ধু। কেউ জুলুমের শিকার হলে, নির্যাতিত বা নিগ্রহের মুখোমুখি হলে পুলিশের কাছে সহায়তা চাবেন, পুলিশকে বন্ধু মনে করে ছুটে যাবেন থানায়। এই হচ্ছে নিয়ম। কোথাও দুষ্ট মানুষের দ্বারা অঘটন ঘটবার আশঙ্কা বুঝতে পারলে পুলিশ নিজেই সেখানে উপস্থিত হয়ে তা নিরসন করবে। এমনকি সরকারি সম্পত্তি, জনগণের কোনও সম্পদ বিনষ্ট হতে দেখলেও পুলিশ সেখানে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এছাড়া সরকারি কর্মচারি, কর্মকর্তাসহ সাধারণ জনগণের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্বও থাকে পুলিশের ওপর। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন হচ্ছে পুলিশের প্রধান কাজ। প্রয়োজনে দুষ্টদের আইন-আদালতের কাছে তুলে দিয়ে সমাজের মানুষকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখার দায়িত্বও থাকে পুলিশের ওপর। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে পুলিশকে যেভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়, তা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই চোখে পড়ে না। বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশই প্রতিপক্ষ হয়ে জনগণের ওপর চড়াও হয়। পাবলিককে মারধর করে। তাই শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই আজকাল পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
রোমের পুলিশ যে কাণ্ড ঘটিয়েছে সে কথায় ফিরে যাওয়া যাক। প্রায় ৭০ বছর ধরে এক সঙ্গে ঘরসংসার করছেন সেখানকার এক দম্পতি। এই দীর্ঘদিন এক সঙ্গে চলবার পরও মাঝে মধ্যে দেখা দেয় টানাপোড়েন। রোমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন ৯৪ বছর বয়স্ক গৃহকর্তা ও তার লাইফপার্টনার। তারও বয়স ৮৯ বছর। অর্থাৎ এই দম্পতি যখন ঘর বাঁধেন তখন তাদের একজনের বয়স ছিল ২৪ এবং আরেকজনের ১৯। সম্প্রতি এক রাতে এই দম্পতির ফ্ল্যাটে তুমুল ঝগড়া বাধে। প্রতিবেশীরা বিরক্ত হয়ে পুলিশকে জানান বিষয়টি। খবর পেয়েই ছুটে আসে ৪ পুলিশের একটি দল বয়স্ক দম্পতির ফ্ল্যাটে। পুলিশ এসেই বুঝতে পারে রান্নাবাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার সূত্রপাত দুই বুড়োবুড়ির মধ্যে। বিষয়টি অনুধাবন করে পুলিশসদস্যরাই ঘরে থাকা বাটার ও চিজ দিয়ে দম্পতিটির জন্য পাস্তা রান্না করে। অতঃপর দুইজনকে এক টেবিলে বসিয়ে পাস্তা খাইয়ে শান্ত করে পুলিশ। পুলিশের রান্না করা পাস্তা বেশ তৃপ্তির সঙ্গে বুড়োবুড়ি খেয়েছেন বলে এসোসিয়েট প্রেস জানিয়েছে। নিজেদের রান্না করা পাস্তা এক সঙ্গে বসিয়ে বয়স্ক দম্পতিকে খেতে দিতে দিতে হয়তো রসিক পুলিশ মজাও করেছে। সুন্দর করে বুঝিয়েছে যে, এই বয়সে ঝগড়া করা যেমন নিজেদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়, তেমনই তা প্রতিবেশীদের জন্যও অপ্রীতিকর। এই যে পুলিশের মহানুভবতা, পারিবারিক বিতণ্ডা মিটিয়ে দেবার উদ্যোগ তা নিশ্চয়ই দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমন পুলিশ হলেই না সমাজে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা বাড়বে। সাধারণ মানুষ পুলিশকে ভাববে বন্ধু। অবশ্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশকে কখনও কখনও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অনেক সময় জীবনও দিতে হয়। এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে আমাদের দেশসহ পৃথিবীতে বহু। অবশ্য অনেক দেশে পুলিশকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। বিপত্তি ঘটে এখানেই। পুলিশ তখন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে অশুভ ইঙ্গিতে সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়। ছড়ি ঘোরায়।
আমরা সব পুলিশকে দোষী বলতে চাই না। আমাদের পুলিশ বৃটিশদের তৈরি পুলিশ নয়। আমাদের ভাই-বেরাদর ও সন্তানরাই পুলিশের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত। আমরা রোমের এই চার পুলিশসদস্যের মতো পুলিশ দেখতে চাই। পুলিশকে আমরা জনগণের বন্ধু হিসেবে পেতে চাই। পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য আমরা গৌরবান্বিত বোধ করতে চাই। অহঙ্কার করতে চাই।

রবিবার, ৭ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনীতির গতিপথ : আদর্শ না স্বার্থ?


বাংলাদেশের রাজনীতি একটি প্রকৃত সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্কটটি মাঠে-ময়দানের ক্ষেত্রে যেমন সত্য; চিন্তা-দর্শনের ক্ষেত্রে ততোধিক সত্য। সঙ্কটটি রাজনীতির গতিপথ নিয়ে। রাজনীতির গতিপথটি কি আদর্শের দিকে যাবে? নাকি স্বার্থের পথে চলবে? এই প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত, আমরা যে রাজনৈতিক সঙ্কট ও স্থবিরতা দেখতে পাচ্ছি, সেটা দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং আদর্শ ও স্বার্থের প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান ও বিশ্বস্ত বক্তব্য দিতে রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপছে। স্বৈরাচার ফায়দা লুটছে। গণতন্ত্রের করুণ দশা আরো বাড়ছে। সংগ্রামী ও প্রকৃত জনসম্পৃক্তশক্তি, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রামের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশকে একটি আদর্শবাদী-কল্যাণধর্মী-ইনসাফভিত্তিক-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপহার দিতে চায়, তাদেরকেও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাঠে যথার্থ সাথী খুঁজে নেওয়ার বা প্রকৃত শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। কারণ শেষ বিচারে রাজনীতি একটি আদর্শগত লড়াই এবং এখানে স্বার্থবাদীদেরকে কোনো না কোনো পর্যায়ে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
আদর্শ ও স্বার্থগত প্রশ্নে রাজনৈতিক শক্তিসমূহের দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতার সূত্রপাত ১/১১-এর পর থেকেই উদ্ভব ঘটে। অনেক বড় দলও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের আদর্শিক গভীরতা ও সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুধাবনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। পরিবর্তন যে কেবল ক্ষমতার ক্ষেত্রেই হয় নি, আদর্শের ক্ষেত্রেই ঘটেছে, সেটা বোঝার সামর্থ্য অনেকের কাছ থেকেই দেখতে পাওয়া যায় নি। একটি আস্ত রাজনীতিক মতাদর্শ, দল ও পরিবার এবং এদের সহযোগীদের ধ্বংস ও নস্যাৎ করার চূড়ান্ত পদক্ষেপ গৃহীত হওয়ার পরেও অনেকের বোধোদয় হয় নি যে, আসলে রাজনীতির নামে কী হচ্ছে! বরং বাল-সুলভ চপলতায় নানা ফন্দি ও তৎপরতায় সমস্যাটিকে মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে ঘাটে ঘাটে নাকাল হয়েও তাদের সাবালকত্ব আসে নি। এই ধরনের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও দীর্ঘমেয়াদী লড়াই যে গামছাওয়ালা বা কালাকোটওয়ালা একদলীয়দের বাই-প্রোডাক্টদের সাথে নিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেই কাণ্ডজ্ঞানটুকু অনেকের মধ্যে নেই। আদর্শগত লড়াই আদর্শগত বিবেচনাতেই দেখার কথা। স্বার্থের প্রয়োজনে রাম-যদুকে দলে ভিড়িয়ে তা সম্ভব হওয়ার নয়। হচ্ছেও না।
জাতির সামনে যখন মৌলিক দায়িত্ব হিসাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলার অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে, তখন এসব ঠুনকো সেনাপতিতে কাজ হওয়ার কথা নয়। বাক্যবাগীশ তালপাতার সেপাইদের উপরে আদর্শকে স্থান দান করাই তখন কর্তব্য। বরং অতীতের ফতুর ও দেউলিয়া এবং যারা নানা দ্বারে করুণা ভিক্ষাকারী, তাদেরকে চরম সঙ্কট উত্তরণে সংযুক্ত করা মানেই হলো বোঝা বাড়ানো; যারা যথাসময়ে তাদের প্রাচীন রক্ত ও সুপ্তভাবে লালিত বিশ্বাসের পক্ষেই কথা বলবে। রাজনীতির আদি প্রভুর চরণের দিকেই তারা ঠাঁই খুঁজে নেবে। এতোটুকু সরল সত্য অনুধাবনে ইতিমধ্যে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচিতি কালিমাযুক্ত, অস্তিত্ব প্রায়-বিপন্ন বা বিলুপ্ত তাদের বাজার-মূল্য খানিক বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণের কোনো লাভ হবে না এবং চলমান সঙ্কট বিমোচনের পথেও কোনো কার্যকর সুরাহা আসবে না, এই পরিষ্কার কথাটি রাখ-ঢাক করে বলার দরকার পড়ে না। পাঠশালাগামী নি¤œস্তরের বালকেরাও এ কথা সজোরে বলতে দ্বিধা করবে না। অবিরাম হত্যা-হামলা-মামলা-রক্তদানের বিরুদ্ধে এইসব মেকীদের সংঘশক্তি হাস্যকর নাটকীয় বিনোদন ছাড়া আর কিছুই প্রসব করতে পারবে না। রাজনৈতিক ডিগবাজি-দলবদলকারীদের বাজার-মূল্য এতে কিছুটা বাড়লেও জনগণের আন্দোলনের বিশেষ কোনো লাভ হওয়ার কোনো সঙ্গত বা যৌক্তিক কারণ নেই। 
এ কথা না বললেও চলে যে, বাংলাদেশে জনগণ সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন পরিস্থিতি পাড়ি দিচ্ছে। গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন অনেক রক্ত দিয়ে চলেছে। দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয় নি। আইনের শাসনের আওয়াজ দেশে-বিদেশে প্রতিনিয়তই শোনা যায়। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে রয়েছে। অধিকারের আরো অনেক জায়গায় জনতার পক্ষ থেকে উত্থাপিত হচ্ছে বহু দাবি। সুন্দরবন বাঁচানোর আকুতির সঙ্গে সঙ্গে পানি ও নদীর জন্য হাহাকার তো রয়েছেই। এমনই অবস্থায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। অজ্ঞাত সূত্র থেকে চলছে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা। আকস্মিকভাবে মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষজন। আটক জঙ্গি বা সন্দেহভাজনরাও মারা যাচ্ছে ক্রস ফায়ারে; কথিত বন্দুক যুদ্ধে। পুরো পরিস্থিতিই একটি আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চার করেছে, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া অতীব জরুরি এবং এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সমস্যা বাড়লেও প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিয়ে চলছে কালবিলম্ব, রাজনীতি ও ক্ষুদ্রতা। একে রাখা যাবে না, ওকে নিতে হবে, এই জাতীয় কথা-বার্তা বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মুখেই মানায়, যারা ফ্যাসিস্ট ও গণবিরোধী। দুঃখজনক সত্য হলো, এমন কথা শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার স্বার্থে ক্ষমতাসীনরাই বলছে না; বলছে এমন কেউ, মোটে গামছাই যার সম্বল। পরিস্থিতি এখানেই থেমে থাকলে বলার কিছু ছিল না। বলতে হচ্ছে এ কারণে যে, সকল রাজনৈতিক রীতি-নীতি, শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। উর্দু প্রবাদের মতো ‘উল্টা চোর কোতওয়াল কো ঢাটে’-এর মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই চলছে। এমন ব্যাটা হম্বি-তম্বি করছে, যাদের রেকর্ড ঘোরতর কালো। বলছে তাদের সম্পর্কে যারা ফাঁসি, জেল, জুলুম, রক্ত, ত্যাগের মাধ্যমে জনতার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। এমন হম্বি-তম্বি ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেও দেওয়া হয়েছিল। একে রাখুন, ওকে আনুন-এমন নসিয়ত বা ক্ষেত্র বিশেষে হুমকীও কম হয়নি। কে কার সঙ্গে থাকবে বা থাকবে না, এ মাথা ব্যথা অন্যের কেন? ডাল ম্যা কুছ তো কালা হ্যায়। পরামর্শদাতাদের উদ্দেশ্য ভালো না, তা বলাই বাহুল্য।
সম্ভবত জাতীয় নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলেছিলেন কথাটি। কথাটি হলো, “যখন তোমার প্রতিপক্ষ তোমার প্রশংসা করবে তখন সাবধান হবে। বুঝবে, তোমার বিপদ আছে। আর যখন তোমার প্রতিপক্ষ সমালোচনা ও নিন্দা করবে, জানবে, তুমি সঠিক পথে আছো।” বিরোধী বা প্রতিপক্ষের দলগুলোকে দম্ভভরে ক্ষমতায়-থাকা কিংবা ক্ষমতায়-থাকাদের ভাই-বেরাদররা এতো উপদেশ খয়রাত করছে কেন? তাদের কথা মতো সব কাজ করলে তো তাদের দলে গিয়ে মিশে যেতে হয়। একদলীয় পরিস্থিতির পথও সুগম হয়। তাহলে আর আন্দোলন-সংগ্রামের বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দরকার পড়ে কেন? হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আদর্শিক কারণে জেল-জুলুম সইতে হয় কেন? শহিদের রক্ত, কারাবন্দির হাহাকারকে পায়ে পিষে যদি কেউ মত ও পথ বদলায়, তবে সেটা ঐতিহাসিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই হবে না।
এমনটি হওয়ার কারণ একটিই। আদর্শ ও স্বার্থের মধ্যে ফারাক করতে না পারা। পরিস্থিতির আদর্শগত গভীরতা বুঝতে না পারা। নিজের নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে না পারা। দেশের অবস্থা পরিবর্তন করবো আর জেল-জুলুম কিছুই সইবো না, স্বার্থগত ও কৌশলগত অবস্থানের নামে তালে তালে থাকবো, এমন অবস্থা আর নেই। এমন অবস্থা আছে মনে করে যারা তাল করছেন, তারা সামনেই বিপদের রক্ত-দাঁতগুলো দেখতে পাবেন। এখনো যারা আদর্শগত বিবেচনায় রাজনীতি ও আন্দোলনের জায়গাটিকে স্পষ্ট করতে পারছেন না, স্বার্থগত সমীকরণের উপর ভর করে ফাঁকতালে ক্ষমতায় যাওয়ার যোগ-বিয়োগ করছেন, তাদের সামনেও কঠিন শিক্ষা অপেক্ষা করছে। ১/১১-এর পর রাজনীতি কোন চক্করে এবং কাদের খপ্পরে পড়েছে, সেটা মালুম হওয়ার মতো পোক্ত মগজ এখনো তাদের হয় নি। হবে। কিছুটা গোনাহগারি দেওয়ার পর।
এমন পরিস্থিতিতে স্বার্থগত রাজনৈতিক গতিপথকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করাই শ্রেয়। রাজনীতি যে আদর্শের খেলা, সে মেরুকরণ তীব্র হয়ে গেলে ক্ষুদ্র স্বার্থগত কৌশল বা চা-পানের রাজনীতি তুচ্ছ হয়ে যায়। তুচ্ছ পথে বড় বিজয় অসম্ভব। এভাবে জনতাকে সংগঠিত করা এবং জনস্বার্থে সম্মিলিত করাও অসম্ভব। জনতা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে রাজনীতিকে দেখে। বাস্তবতার কঠিন পরশে তারা মেরুকরণের আদর্শিক জায়গাটিকে বেছে নেয়। জনবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ বা তথাকথিত নেতাদের আহাজারিতে তাদের কিছুই করার থাকে না। জনতা থাকে জনসম্পৃক্ত নেতা-কর্মীদেরই সঙ্গে। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে জনতার সঙ্গে জনসম্পৃক্ত-দলের যে সম্পর্ক মজবুত ভিত্তি পেয়েছে, সেটাকে রাজনৈতিক-মতাদর্শিক মেরুকরণের পথে নিয়ে যাওয়াই এখন কর্তব্য। এমনই তীব্র পরিস্থিতিতে স্বার্থগত বা কৌশলগত সমঝোতার নামে রঙ-বেরঙের চরিত্রের উদ্দেশ্যমূলক একত্রীকরণ ফলপ্রসূ কোনো কার্যক্রম নয়। প্রতিপক্ষের পরামর্শ শোনলে আর নানা পদের বিচিত্র চরিত্রের ভিড় বাড়ালে আদর্শ ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বও  যাবে, স্বার্থও হাসিল হবে না। অতএব সাধু সাবধান।

বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

‘দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল ভুলিতেছে মাঝি পথ’


সমগ্র জাতি কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। স্বর্ণ আর পিতলে একাকার করে ফেলছে। অনুভবের বাইরে চলে যাচ্ছে দিবস-রজনী। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে দৃষ্টির উত্তাপ। ভালো এবং মন্দে পার্থক্য নির্ণয়ে ঠোকর খাচ্ছে কপালে। এই ঠোকরে ঠোকরে এখন ভগ্নদশা কপালের। আত্মীয়-অনাত্মীয় চিহ্নিত করতে গিয়েও দুর্ভাবনায় যাচ্ছে জড়িয়ে। এর কারণ কি হতাশা, অবসাদ, না বয়সের ভার। পঞ্চাশ বছর কি খুব বেশি সময়। জাতি এবং দেশের বয়স এখন মাত্র পঞ্চাশ। পঞ্চাশেই বুড়িয়ে যাবার কারণ। দিকভ্রান্ত হবারই কারণ? বুদ্ধি বিভ্রাটের কারণ? এমনি শত শত কারণের মুখোমুখি হতবিহ্বল জাতি।
পঞ্চাশ বছরেও সারছে না বিভেদের অসুস্থতা। রাজনীতিতে বিভেদ, শিক্ষানীতিতে বিভেদ, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিভেদ, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভেদ এমনকি ধর্মনীতিতেও বিভেদ পাকানোর চেষ্টা কম হচ্ছে না। কম হোক আর বেশি হোক বিভেদের মাঝখানটায় থমকে আছে দেশ-জাতির উত্থান-উন্নতি। এক সময় সুচতুর ইংরেজ বিভেদের বীজ বপন করেছিল এদেশে। তাদের নীতি ছিল ভাগ কর আর শাসন কর। তারা সফলও হয়েছিল বিবাদ বিসম্বাদকে সঙ্গী করে। তারা তাদের শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। এই পারার পশ্চাতে ছিল সমগ্র জাতির নির্বুদ্ধিতা। বোধহীন জাতি পথের দিশা পায় না। চলতে ফিরতে হোঁচট খায় পদে পদে। এই সময় অনুপ্রবেশ ঘটে বহির্শত্রুর আর কচ্ছপের খোল থেকে বাইরে আনে মাথা ঘাপটি মেরে থাকা বিভীষণরা। বিভীষণদের উৎপাত বড় বেশি যন্ত্রণাদায়ক। হুশহীন হলেই মহা বিপদ ঘনিয়ে আসে।
পক্ষ আর বিপক্ষ এই ঝগড়ার যেন অবসান ঘটছে না আজ অবধি। কারণে অকারণে শব্দ দুটির ব্যবহার প্রবল হয়। কোন কোন সময় জলাতঙ্ক রোগীর মতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রলাপ বকে ব্যবহারকারীর। বকাবকি শেষাবধি বক্রতায় রূপ নেয়। বক্রতা থেকেই জন্ম নেয় বিভেদ-বিপথ। এই বিপথেই হাঁটছে জাতি। বর্তমানের পরিবেশ পরিস্থিতি যেন এমন ধারণাকেই উসকে দিচ্ছে। আর একটি নতুন যন্ত্রণা দেশ ও জাতির দুয়ারে এসে উপস্থিত। যদিও এমন যন্ত্রণা সমগ্র বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে।  তবু এদেশে এটি বলতে গেলে নতুন উপদ্রব। এই অনাহুত উপদ্রব থেকে উদ্ধারের উপায় বিভেদের প্রাচীর শক্ত হাতে ধ্বংস করে ¯েœহ ভালোবাসার পতাকা উড্ডীন করা। জঙ্গি বা সন্ত্রাস তা যে নামেই শত্রুর আগমন ঘটুক না কেন বিশৃঙ্খলা বা খুনোখুনি কখনো মঙ্গলকে স্পর্শ করে না। এখানে সুবিবেচনার লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। এরা যতই শান্তির বাণী স্বস্তির বাণী আওড়াক না কেন। আসলে এরা বিভ্রান্ত বিধায় মারতে এবং মরতে দ্বিধা করছে না। বিশৃঙ্খল রাজনীতি এবং উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষানীতি বিভ্রান্তির পথকে প্রসারিত করে। দেশে সাম্প্রতিক দু-একটি হাঙ্গামা এবং অঘটন জাতির সামনে এমন পাঠকে উপস্থিত করেছে। এই উপস্থিতি অশনি সংকেতেরই নামান্তর। এমন দুঃসময়ে প্রয়োজন একতা বা ঐক্য। সহৃদয় বিবেচনা। বিবেচনায় যদি ফাঁক থাকে তবেই বিপদ।
ঐক্যের কথা ধ্বনিত হচ্ছে এখানে সেখানে। পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে প্রতিবেদন। চ্যানেলে চ্যানেলে সংলাপ-সংকল্প। দ্বিধা দৈন্য দশায় হলেও সমগ্র জাতি যে এক কাতারে দাঁড়ানো প্রয়োজন এ বিষয়টি মোটামুটি চিন্তাচেতনায় আলোড়িত হচ্ছে। এটি একটি সুখবর। বিলম্বে হলেও ব্যাপারটি চিহ্নিত হলো। প্রবাদ আছে সৎ কাজে শত বাধা। বাধা আসতেই পারে। বহির্শত্রু এবং বিভীষণরা প্রতিবন্ধক রূপে উঠে আসে। ঐক্যে ফাটল সৃষ্টিতে তৎপর হয়। এমতাবস্থায় কিছু কিছু ব্যক্তির আচরণে তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। একে বাদ দাও ওকে বাদ দাও। বাদ থাকলে আর ঐক্য হয় কি করে। দেশের প্রতিটি মানুষই তো এই প্রক্রিয়ারই অংশ। যারা এমন মনোভঙ্গির বাইরে এরা অবশ্যই দেশ এবং জাতির ভালো মন্দকে বিবেচনায় আনে না। ভালোবাসার খোলসে এরা আসলেই বিভীষণ চরিত্রের প্রাণী। মনের কালিমা আজীবন ধরে রাখলে মহৎ কাজে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে হয়। দিন দিন এই বাধা দুর্লঙ্ঘ হয়ে উঠে। সময় এখনও অতিক্রম করে যায়নি। জাতি পার করছে ক্রান্তিকাল। দুর্যোগ দুর্ভাবনার সময়। এটি যেমন ক্ষমতাবানদের জন্যে সত্য, বিপরীতে ক্ষমতাহীনদের জন্য আরো বড় সত্য। এই সত্যকে যতদিন উপলব্ধিতে না আনার চেষ্টা করবে উভয়পক্ষ ততদিন দেশ এবং জাতির কপালের অশনি নামবে না। তাতে পোয়াবারো হবে শত্রুর। এরা নিক্ষেপ করবে কুপরামর্শের শায়ক আড়াল থেকে।
কুরাজনীতি আর কুশিক্ষায় বিভ্রান্ত হচ্ছে দেশের তরুণশ্রেণী। অভিভাবকরা মোটেও ভাবছে না এ বিষয়টি চোখের সামনে তার সন্তানের পরিণতি দেখেও। অভিভাবকদের নির্লিপ্ততা ধ্বংস ডেকে আনছে দেশ এবং জাতির ভবিতব্যে, স্বপ্নে। স্বাধীনতার দশ-বিশ বছরে বিশ্বের অনেক জাতিই উন্নতির সোপানে উঠে যাচ্ছে তরতর করে। গড়ে তুলেছে বিশাল অর্জন। অন্যদিকে এদেশ পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করতে চললেও অর্জনের থলিতে তেমন কিছুই জমা করতে পারেনি। কেবল হিংসা বিদ্বেষ ছাড়া। এই হিংসাই জাতির অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করছে। ঐক্য নামের শব্দটি বাতাসে ভাসলেও যারা ঐক্যের স্লোগানদাতা তারা ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। লাফালাফির অবসান না ঘটলে তো ঐক্যের ভাবনায় স্থির থাকা যাচ্ছে না। আবার অন্য দিকে হৃদয়ের ঊষ্ণতাকে উচ্ছল না করলে ঐক্যের সুবাতাস বইবে না। অন্তরের প্রসারতা বাড়ায় সুশিক্ষা। শিক্ষায়ও ইদানিং নানান প্রতিবন্ধক। এটা পড়ানো যাবে না ওটা পড়ানো যাবে না, এমন শাসনের রক্তচোখ। এই রকম রক্তচোখ এড়িয়ে সুবচন  শেখা বড় দায়। তাই কুবচন ভরসা। এখানে সেখানে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাঙাভাঙির আওতায়ও পড়েছে কোন কোনটি। তাতে অন্ধকারে পড়েছে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। অভিভাবকরা সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে পড়ছেন সংশয়ে। ব্যবস্থাপত্রটি এমন হচ্ছে মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটো। ধনীর সন্তানরা হয়তো পাশের দেশগুলোতে ভর্তি হবে। অন্যদের কি হবে? মূর্খ হয়ে বেড়ে ওঠাই হয়তো এদের নিয়তি। শিক্ষা নিয়ে এমন বিভ্রাটের পশ্চাতের কারণ কি কে জানে। জাতি এক থাকলে শাসকশ্রেণীর সুবিবেচনার বিষয়টি মীমাংসা হয়তো হতে পারতো। বিভেদ বিভাজনে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সমগ্র জাতির তদারকির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই থেকে যাওয়াটা মোটেও শুভলক্ষণের আওতায় পড়ে না।
দেশপ্রেম আর বিশ্বাসের বড় বেশি অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে ইদানিং। জাতির অভিভাবক পর্যায়ে যারা নিজেদের জাহির করতে অভ্যস্ত তাদের আচার আচরণে তেমনটাই ধারণা জন্মে আমলোকের। কি ক্ষমতাবান কি ক্ষমতাহীন মনুষ্যকুলের। তাদের অবস্থানটি এক কাতারে বলেই প্রতীয়মান হয়। ঐক্যের ব্যাপারে উভয় পক্ষের সুরই কিন্তু একই হাওয়ায় প্রবাহমান। কেবল শব্দের হেরফের। ইঞ্জিনে গোলমাল থাকলে বগিতে অবস্থানরত যাত্রীগণ সর্বাবস্থায়ই কম্পমান থাকেন। যেকোন সময় দুর্ঘটনার আশংকায় থাকা। এমতাবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটেও কোন কোন সময়। দেশে বিরাজমান অসুস্থ রাজনীতি সেরকমেরই একটা পরিস্থিতিকেই যেন তুলে আনছে জাতির সামনে। রাজনীতিকদের ভুল-ভ্রান্তি স্বার্থপরতা দেশের জন্য যেমন বিপদের, জাতির মঙ্গলের ব্যাপারেও মহাশংকার। কি ‘জঙ্গিবাদ’ কি ‘সন্ত্রাসবাদ’ এক মুহূর্তে বাদের তালিকায় তুলে আনা যায় যদি একটি একতাবদ্ধ জাতি রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু আফসোসের বিষয় এদেশের অসুস্থ রাজনীতিকদের ক্ষমতার লোভ আর স্বার্থপরতা এখানে বড় প্রতিবন্ধক। এরপরেও জাতীয় কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করতে হয়- ‘দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।’

বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দলকানা হয়ে দেশের কল্যাণ করা যায় না


কাক্সিক্ষত সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে মানব জাতির অনেক কিছুই করণীয় আছে। কিন্তু করণীয় বিষয়ের সামনে এখন যেন বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এক দানব। কেউ কেউ বলছেন দানব নয়, এটা আসলে একটা ফাঁদ। এই ফাঁদের নাম সন্ত্রাসবাদ। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা আলোচনা। তবে এখানে বলার মত বিষয় হলো, সন্ত্রাস নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তেমন লক্ষ্য করা যায় না, প্রপাগান্ডার মাত্রাই বেশি। প্রপাগান্ডার মাধ্যমে কারো মতলব, রাজনীতি কিংবা মতবাদ প্রচার করা গেলেও আসল কাজের কিছুই হয় না। ফলে বৈশ্বিক বাতাবরণে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এত কথা ও কর্মসূচির পরও তেমন কোনো সুফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
যে কোনো সমস্যার সমাধানে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা যখন মানুষের আর্তনাদ শোনেনি, তখন ক্ষুব্ধ মানুষের মনে দেখা দিয়েছে দ্রোহ। বিদ্রোহী মানুষ তখন জালেম ও শোষকদের বিরুদ্ধে তুলে নিয়েছে অস্ত্র, সৃষ্টি করেছে আতঙ্ক। এই পথ যে সঠিক পথ নয়, তা বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, কিন্তু ওদের এ পথে নামতে যারা বাধ্য করলেন তাদের বিরুদ্ধেও যৌক্তিক বক্তব্য রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক শাসন পরিচালনার কারণে আমরা গেরিলাগোষ্ঠীর উদ্ভব লক্ষ্য করেছি। শ্রেণি-বৈষম্যের কারণেও আমরা উগ্রতা ও সশস্ত্র সংগ্রাম দেখেছি। আবার আগ্রাসী রাষ্ট্রের জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও আমরা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো পর্যালোচনা করলে চলে আসে আইরিশ গেরিলা, পিএলও হামাস, শ্রেণি সংগ্রাম, নকশাল, তামিল গেরিলা, মরো মুক্তি ফ্রন্ট ও কাশ্মীরী মুক্তি সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ। এদের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নানা পার্থক্যও লক্ষ্য করা গেছে। কেউ এদের মুক্তি সংগ্রামী বলেছেন, আবার অপরপক্ষ তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এইসব মতপার্থক্য থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য বলে কি কিছু নেই? যে যা বলবে সেটাই কি সঠিক? না, এতটা হতাশ হওয়ারও কারণ নেই। আসলে বর্তমান সময়ে যারা পৃথিবী পরিচালনা করছেন, তারা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে একটু ন্যায়নিষ্ঠ হন তাহলে পৃথিবীর অনাকাক্সিক্ষত চিত্র পাল্টে যেতে পারে। লোপ পেতে পারে সন্ত্রাসবাদও। বলা যেতে পারে, সমস্যা আসলে উপরের মহলে। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয়েছে এবং যারা সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য রাখেন, তারা যদি মানুষ হয়ে না ওঠেন, তাহলে মানুষের সংকট দূর হবে কীভাবে? এজন্য বর্তমান বাস্তবতায় যারা মানবোচিত সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী চান তাদের জেগে উঠতে হবে। সমাজে, রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি, অমানুষের সংখ্যা কম। এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে বীরের মত উচিত কর্ম সম্পাদন প্রয়োজন। অনুরোধ, উপরোধ, আফসোস ও বিলাপ তো অনেক করা হয়েছে, তাতে বিশ্ববাতাবরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অতএব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের জনপদে মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে মানুষের রাজনীতি করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় অপশাসকদের ধর্ম-বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা ও শ্রেণি স্বার্থের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে রাজত্ব করার সুযোগ আর দেয়া যাবে না। অতীতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই এ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে লাখো কোটি মানুষ। এই প্রসঙ্গে চলে আসে ফিলিস্তিনীদের কথা।
২০১৬ সালের প্রথম ৬ মাসে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৩৮৪ জন শিশুসহ প্রায় ৭৪০ জন ফিলিস্তিনীকে গৃহহীন করেছে। গত ২৭ জুলাই বুধবার মানবাধিকার সংগঠন ‘বি-সেলেম’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আল-জাজিরা পরিবেশিত খবরে আরো বলা হয়, পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এলাকা জুড়ে এরিয়া ‘সি’ এর অবস্থান এবং এখানে প্রায় ৩ লাখ ফিলিস্তিনীর বাড়িঘর রয়েছে। বর্তমানে এটি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বি-সেলেমের মুখপাত্র মিচেলি বলেন, যেখানে মানুষের রাজনৈতিক প্রভাব নেই, এমন জনবিরল অঞ্চলকে লক্ষ্য করে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এসব ফিলিস্তিনীর এরিয়া ‘বি’-এর দিকে সরাতে চাইছে, যাতে তারা বসতি সম্প্রসারণের জন্য এরিয়া ‘সি’ দখল করতে পারে। এটা ইসরাইলি নিপীড়ন ও আগ্রাসনের একটা ক্ষুদ্র চিত্র মাত্র। তবে এখানেও লক্ষ্য করা গেছে, যেখানে মানুষ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয় সেই এলাকাই ইসরাইলি সেনাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। এমন বাস্তবতায় আবারও উল্লেখ করতে হয়, এই পৃথিবীতে অমানুষের বদলে মানুষের নেতৃত্ব প্রয়োজন। মানুষ মেরুদ- সোজা করে ন্যায়ের চেতনায় মানুষের রাজনীতিকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে এগিয়ে আসলে শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়, সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন, অজাচার-অনাচার পরাভূত হতে বাধ্য।
আমরাতো চাই আমাদের দেশ জুলুম-নির্যাতন ও সন্ত্রাসবাদের আপদ থেকে মুক্ত হোক। এমন চাওয়া খুবই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। কিন্তু চাওয়ার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সক্ষমতা অর্জন এবং সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে এখানে ন্যায় ও সততার বিষয়ও যুক্ত করতে হয়। কারণ কথা ও কাজে গড়মিলের চিত্র দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
যে ভূমিতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে সে ভূমিই মানুষের জন্মভূমি। জন্মভূমির আলো-বাতাসেই মানুষ বেড়ে ওঠে। ফল-ফসল গ্রহণ করে মানুষ পুষ্টি লাভ করে। তাই জন্মভূমির প্রতি মানুষের ভালবাসা অকৃত্রিম। এ ভালবাসা কখনও সুপ্ত থাকে, কখনো বা প্রকাশ পায়। তবে জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা প্রকাশের জন্য কিছু উদ্যোগ-আয়োজনেরও প্রয়োজন হয়। এমন আয়োজনে অবদান রাখতে পারে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র। প্রসঙ্গত এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হলো, দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি করতে পারে এমন যে কোনো কর্মকা- প্রতিরোধে এগিয়ে আসাও দেশপ্রেমের অন্যতম লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে জঙ্গিবাদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর দেশে সবাই একবাক্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এমন চেতনাকে আমরা দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। প্রসঙ্গত এখানে একটি বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হলো, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সন্ত্রাসমুক্ত মানসিকতার বিকাশ। আমরা জানি, বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসবাদ কোনো বিশেষ এলাকা বা জনপদের বিষয় নয়। বৈশ্বিক পরিম-লের সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন জনপদে আঘাত হেনেছে। আমাদের দেশকে আমরা সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত রাখতে চাই। তবে বৈশ্বিক পরিম-লের একটা প্রভাব না চাইলেও সব দেশেই কমবেশি এসে পড়ে। এ কারণেই গণসচেতনতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের সঠিক নেতৃত্ব। বর্তমান সময়ে আমরা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস বিরোধী সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধনের কর্মসূচি লক্ষ্য করছি। তবে এসব তৎপরতায় এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যাতে প্রশ্ন জাগে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও আমরা আসলে মানসিকভাবে সন্ত্রাসী চেতনা থেকে কতটা মুক্ত হতে পেরেছি? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে চিন্তা-চেতনা ও মননে উগ্রতা পরিহার করা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন আদর্শিক ও নৈতিকবোধে পুষ্ট হওয়া।
প্রসঙ্গত এখানে দুইএকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রাম কলেজের সামনে জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন করা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ৩১ জুলাই গোলাগুলী ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় কলেজের মূল ফটকের সামনে এই সংঘর্ষের ঘটনায় গুলীবিদ্ধ হয়েছেন তিনজন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক। প্রথম আলোয় মুদ্রিত খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম এবং চকবাজার থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরুল মোস্তফার অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনায় মানুষের মধ্যে শঙ্কা জাগে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিজেরাই যদি সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সন্ত্রাস দূর হবে কেমন করে? এ ঘটনার একদিন পরেই পহেলা আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। এতে গোলাগুলীতে নিহত হন একজন, আহত হন আরো কয়েকজন। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সন্ত্রাসবিরোধী রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতা গঠন। এজন্য প্রয়োজন হবে নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধ। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে জ্ঞান-চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এখন প্রোপাগান্ডায় যতটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় জ্ঞান-চর্চায় ততটা উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন।
সন্ত্রাস ও জহঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন কর্মসূচীতে ছাত্রলীগের বিবদমান দু’টি গ্রুপ নিজেরাই সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত হওয়ায় বিষয়টি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রশ্ন জেগেছে, এমন মানসিকতা সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণে আদৌ কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হবে কী? আর পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী প্রপাগান্ডার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্ত্রাসবিরোধী মানসিকতার বিকাশ এবং শান্তির মর্মবাণী উপলব্ধি। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা ভালো যে, তরতাজা উদাহরণ হিসেবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনার কথা উঠে আসলেও অন্যরা এমন মানসিকতা থেকে মুক্ত তেমনটি বলার উপায় নেই। কারণ অতীতে আমরা অন্যদেরও সন্ত্রাসী ঘটনায় লিপ্ত হতে দেখেছি। আসলে দলকানা হয়ে কিংবা ব্লেমগেমে লিপ্ত থেকে দেশ ও জনগণকে কোনো কল্যাণ উপহার দেয়া যায় না। শুধু বৈশ্বিক পরিমন্ডলে নয়, আমাদের দেশেও আমরা জাতীয়তাবাদ, শ্রেণী সংগ্রাম ও ইসলামের নামে অনেক উগ্রতা লক্ষ্য করেছি। এর পরিণাম কারো জন্যই ভালো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ভুল উপলব্ধি করে সঠিক পথে ফিরে আসলেই মঙ্গল।

Ads