সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যখন তাদের সম্মানের জন্য আন্দোলন করছিলেন, তখন মনে হয়েছিল তারা না জানি কতো বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। নতুন বেতন স্কেলের প্রস্তাব আনার পর থেকেই শিক্ষকরা ঐ বেতন কাঠামোর প্রতিবাদ করে আসছিলেন। কিন্তু তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখিনি। এমপিদের তো নয়ই। বরং প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই সমস্বরে শিক্ষকদের এই আন্দোলনকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বাড়াবাড়ি বলে অভিহিত করেছেন। সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন স্কেলের প্রস্তাব জাতীয় সংসদেও অনুমোদিত হয়।
সংসদে কী অনুমোদিত হয়, কী হয় না, সে খবর সংসদ সদস্যরা জানেন বলে মনে হয় না। মন্ত্রী পরিষদে যখন কিছু অনুমোদিত হয়, কী অনুমোদিত হলো তার খবর মন্ত্রীরা রাখেন বলে মনে হয় না। প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা যা কিছু হাতে ধরিয়ে দেন, কোনো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই তা অনুমোদন করে দেওয়া হয়। আবার সেসব প্রস্তাব যখন সংসদে উপস্থাপন করা হয়, তখন তার ভালো-মন্দ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তার কোনো চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় না। সরকারি দল মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই যেহেতু এটা সংসদে তোলা হয়েছে, তাই তাদের এ বিষয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। সে ক্ষমতাও অবশ্য কারও নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে কোন নাদান হাতে পাওয়া মন্ত্রিত্বের সোনার হরিণ হারাতে চাইবে। অতএব ডিটো ভরসা। কারণ বোবার শত্রু নেই।
এসব প্রস্তাব যখন সংসদে ওঠে, তখন সরকারি দলের এমপিরা সে ব্যাপারে নীরব থাকেন। কারণ একই। কী বলতে কী বলে আবার কোন বিপদে পড়েন। বিপদে পড়ার নজির তো আছেই। বিপদে পড়েছিলেন তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু ও সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। যে-কোনো চাপেই হোক সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত সে ফাঁড়া কাটিয়ে উঠেছিলেন, আবার তাকে ধুপ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। অন্যরা চুপ করে থেকে কোনোমতে গড়িয়ে গাড়িয়ে আবার মন্ত্রিত্বে ফিরে এসছেন। তারা কেন ঝুঁকি নিতে যাবেন? আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন ভ্যাটেরান আওয়ামী লীগার। যদিও একবার এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে তার স্ত্রীকে আওয়ামী সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এমপি বানিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য তাকে কোনো দোষ দেয়া যায় না। কারণ এরশাদের ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে তার ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান অনুঘটক ছিল আওয়ামী লীগই। এখনও এরশাদই আওয়ামী লীগের একমাত্র ভরসা, সহযোগী। তারা মিলে মিশে লেপ্টালেপ্টি করে বেশ আছেন।
ফলে মিসেস লতিফ সিদ্দিকীর এরশাদের সঙ্গে গিয়ে এমপি হওয়া দোষের কিছু বলে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে হাসিনাপুত্র জয় সম্পর্কে বেফাঁস কথা বলে বিপদে পড়েছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার মন্ত্রিত্ব গেছে। সংসদ সদস্যপদ গেছে। আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদও গেছে। প্রয়োজনে হয়তো আবারও তিনি আসবেন পাদপ্রদীপের আলোয়। লতিফ সিদ্দিকী কী ভাবছেন, জানি না, কিন্তু আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি। এমন সব নজির সামনে রেখে শেখ হাসিনা চিন্তা-চেতনার বাইরে অন্য কিছু ভাবাও অকল্পনীয়। তাই সংসদে বিল এলে আলাপ-আলোচনা ভালোমন্দ বিবেচনা না করেই সকলে সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে ধ্বনি দেন আর স্পীকার রায় দেন, ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে।’ আইন পাস হয়ে যায়।
জাতীয় সংসদে এর রক্ষাকবচ হতে পারে একমাত্র বিরোধী দল। কিন্তু বর্তমান সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বলে চালানোর চেষ্টা করে সরকার এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। তার দল থেকে সরকারে আছে ৪ মন্ত্রী ও দুই উপদেষ্টা। উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা মন্ত্রীর সমতুল্য। এরশাদের স্ত্রী রওশন হয়েছেন কিম্ভূত বিরোধী দলের নেত্রী। তার পদমর্যাদাও মন্ত্রীর। হুইপরাও হাফ-মন্ত্রী। এদরকেই আবার বিরোধী দল বলে অভিহিত করা হচ্ছে। পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন বিরোধী দলের কথা কেউ কখনো শোনেনি।
অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই এমন কাণ্ডই বারবার ঘটে। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এলে এক ধুয়া তোলা হয়েছিল, তার নাম মুজিববাদ। স্লোগান উঠতো, ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ, মুজিববাদ’। সে মুজিববাদ হালে পানি পায়নি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় বাকশাল গঠন করলে বোঝা গেল, এ স্লোগানের আড়ালে তাদের কী মতলব ছিল। এবারের ‘বিরোধী দল’ নিয়ে চমৎকার সন্তুষ্টির মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এবারের বিরোধী দল নিয়ে চমৎকার চলছে জাতীয় সংসদ। হল্লাচিল্লা নেই, গালিগালাজ নেই, ওয়াকআউট নেই, ফাইল ছোঁড়াছুঁড়ি নেই। খুবই শান্তিপূর্ণভাবে চলছে সংসদ। খুবই সদাচরণ করছেন সরকারী বিরোধী দল। সুতরাং কোনো বিলের ওপর তথাকথিত বিরোধী দলেরও কোনো মতামতের প্রয়োজন নেই। সে কাজটি তারা করেনও না, করার যোগ্যতাও নেই।
ফলে জাতীয় সংসদে কোনা রকম আলাপ-আলোচনা বিশ্লেষণ ছাড়াই পাস হয়ে গেছে সরকারি কর্মচারিদের নতুন বেতন স্কেল। এই পে স্কেলের খসড়া প্রকাশের পরপরই শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ছাড়া শিক্ষক সমাজ প্রকৃচিসহ ৩৪টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এর কাঠামোর প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত বলতে শুরু করেন যে, শিক্ষকরা না বুঝেই আন্দোলন ও পে স্কেলের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। মুহিত প্রকারান্তরে তাদের মূর্খ বলে অভিহিত করার প্রয়াস পান। এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, কোনো আলোচনা হবে না। শিক্ষকরা এত পাত্তা দেননি। তারা বলেছেন, অর্থমন্ত্রী সকালে কী বলেন, আর বিকালে কী বলেন, তার কোনো ঠিক নেই। তারাও তার সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসবেন না। এ নিয়ে বিতর্কে পিছিয়ে থাকলেন না প্রধানমন্ত্রী নিজেও। তিনি বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, পৃথিবীর কোথায়ও কেউ সরকারি কর্মচারিদের বেতন ৯৭ ভাগ বাড়ায়নি। তা হলে কেন আন্দোলন করতে হবে। এখন মনে হচ্ছে, বেতন না বাড়ালেই ভাল করতাম।
এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টিটকারি দিয়ে আরও বললেন যে, তা হলে শিক্ষকরা সচিব হয়ে যাক। তা হলে তারা ৬৫ বছরের বদলে ৫৯ বছর চাকরি করুক। অবসরের পর সরকার আমলাদের কখনও কখনও চার-পাঁচ বছরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে রাখে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা তাহলে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবে না। জ্ঞানদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির এমন চিন্তাও তাহলে করা যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী ভুলেই গেলেন যে, ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরির বিধান শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৫৯ বছরই। তারাও আছেন আন্দোলনে। কারণ তাদেরও সরকার প্রশাসনিক ক্যাডারদের অধীনস্ত করে ফেলেছেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকরা কোনো আন্দোলন করেননি। উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যই সরকারে তাদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে শিক্ষকরা আরও বললেন যে, তারা কেন সচিব হবেন, তারা সচিব তৈরি করেন। অত্যন্ত হক কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সবচেয়ে ভালো ফল করেন, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় থাকেন বা থাকতে চান। এক সময় অবশ্য শীর্ষস্থানীয় রেজাল্টধারীদের প্রশাসনিক পদে আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হতো। সেটা পাকিস্তান আমলের কথা। বাংলাদেশ আমলে তোফায়েল ক্যাডারদের মাধ্যমে তার কবর রচনা শুরু হতে থাকে। এখন প্রশাসনের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন মধ্যম সারির শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি করতে চায়। কিন্তু সেখানেও দলীয়করণের ফলে গুণ্ডা-মাস্তান, দলীয় ক্যাডার, ধর্ষণের সেঞ্চুরিকার, টেন্ডারবাজেরা প্রধানত নানা কোটায় সরকারি চাকরিতে ঢোকে। তাদের শিক্ষার মান কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেক্ষেত্রেও যে দূষণ হচ্ছে না, এমন কথা আমি বলব না। অযোগ্য দলীয় লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিতে ঢুকিয়ে শিক্ষার মান নিম্নমুখি করা হয়েছে। তাই একটি ইংরেজী চিঠি ড্রাফট করতে প্রশাসনিক ক্যাডারে বাইরে থেকে লোক হায়ার করে আনতে হয়। শত দলীয়করণ সত্ত্বেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এখনও এটা ঘটেনি।
বেতন বৃদ্ধি বিষয়ে শিক্ষকদের কোনো অভিযোগ নেই। তারা বলেছেন, প্রশাসনিক ক্যাডারের আমলাদের তুলনায় তাদের মর্যাদা এই বেতন স্কেলে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ সরকারি কলেজের শিক্ষক ও প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদেরও। এই অভিযোগ প্রশাসনিক ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারদেরও। শিক্ষকদের মর্যাদার দিক থেকে আমলাদের চেয়ে তিন ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এই কুকাজ করতে গিয়ে গেজেট জারির সময় আমলারা প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সুপারিশ পর্যন্ত গাপ করে দেয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এখানে সরকার ভারি অসহায়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রজ্ঞাপনে ভুল হয়েছে, কিন্তু তা এখন আর সংশোধনের সময় নেই। সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী প্রথমে তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েিেছলেন। এই সকল পর্যায়ে একেবারে চুপ করে ছিলেন জাতীয় সংসদের অনির্বাচিত সদস্যরা।
কিন্তু গোল বাঁধল জাতীয় সংসদ সদস্যদের যখন সম্মানি বাড়ানো হলো তখন। প্রেসিডেন্ট, বিচারপতিগণ, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিগণ ও সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতাদিও দ্বিগুণ করার বিল সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। তাতে দেখা গেল এমপিদের সম্মানিভাতাও সচিবদের চেয়ে কম ধরা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই কাঠামো নিয়ে তারা আপত্তি তুলেছেন। বৈঠকে তারা বলেছেন, আমরা তো আমলাদের নিচে থাকতে পারি না। তারা বলেন, সংসদ সদস্যরা যদি পাস করেন তবেই আমলাদের বেতন বাড়বে। এমপিরাই যদি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাহলে তাদেরকে সবার ওপরে নিতে হবে। আর অভিমান করে তারা বলেছেন, এটা যদি সম্মানি ভাতা হয়, তবে এক টাকা করা হোক। কিন্তু আমাদের মর্যাদাটা তো রাখতে হবে। আমলারা প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী স্পীকার মন্ত্রীদেরটা বাড়ায়, সঙ্গে নিজেদেরটাও বাড়ায়।
কেন বাড়ায়? কোন সাহসে তারা নিজেদের বেতন ভাতা এমপিদের ওপর নির্ধারণে সাহস পায়? সুরঞ্জিত সাহেব বিচক্ষণ লোক। তার সেটা অনুধাবন করা উচিত। বাড়ায় এই কারণে যে, তারা জানে জনগণের ভোটে নয়, যারা এবার এমপি হয়েছেন, তারা তা হয়েছেন আমলাদের কারচুপি আর ঘোষণার বলে। সবাই জানেন, সরকারের মসনদ রক্ষার জন্য আপাতত আমলারা কতোটা প্রয়োজনীয়। আমলারা সঙ্গে থাকলে আর কোনো ক্যাডার, শিক্ষক, মন্ত্রী-এমপির কোনো প্রয়োজন নেই। আমলারা যদি না চাইত, তবে আপনারা এমপি-মন্ত্রী হতে পারতেন না। তারা এমপি বানিয়েছে, তবে তাদের বেতন এমপিদের ওপরে হবে না কেন? আর একথা প্রধানমন্ত্রীও জানেন। তাই তিনি আমলাদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষকদের কটূক্তি করতে দ্বিধা করেননি। আজ এমপিদের এই অমর্যাদার দিনে কে দাঁড়াবে তাদের পাশে। সকলকে তো আগেই আপনারা বধ্যভূমিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সংসদে কী অনুমোদিত হয়, কী হয় না, সে খবর সংসদ সদস্যরা জানেন বলে মনে হয় না। মন্ত্রী পরিষদে যখন কিছু অনুমোদিত হয়, কী অনুমোদিত হলো তার খবর মন্ত্রীরা রাখেন বলে মনে হয় না। প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা যা কিছু হাতে ধরিয়ে দেন, কোনো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই তা অনুমোদন করে দেওয়া হয়। আবার সেসব প্রস্তাব যখন সংসদে উপস্থাপন করা হয়, তখন তার ভালো-মন্দ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তার কোনো চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় না। সরকারি দল মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই যেহেতু এটা সংসদে তোলা হয়েছে, তাই তাদের এ বিষয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। সে ক্ষমতাও অবশ্য কারও নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে কোন নাদান হাতে পাওয়া মন্ত্রিত্বের সোনার হরিণ হারাতে চাইবে। অতএব ডিটো ভরসা। কারণ বোবার শত্রু নেই।
এসব প্রস্তাব যখন সংসদে ওঠে, তখন সরকারি দলের এমপিরা সে ব্যাপারে নীরব থাকেন। কারণ একই। কী বলতে কী বলে আবার কোন বিপদে পড়েন। বিপদে পড়ার নজির তো আছেই। বিপদে পড়েছিলেন তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু ও সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। যে-কোনো চাপেই হোক সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত সে ফাঁড়া কাটিয়ে উঠেছিলেন, আবার তাকে ধুপ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। অন্যরা চুপ করে থেকে কোনোমতে গড়িয়ে গাড়িয়ে আবার মন্ত্রিত্বে ফিরে এসছেন। তারা কেন ঝুঁকি নিতে যাবেন? আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন ভ্যাটেরান আওয়ামী লীগার। যদিও একবার এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে তার স্ত্রীকে আওয়ামী সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এমপি বানিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য তাকে কোনো দোষ দেয়া যায় না। কারণ এরশাদের ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে তার ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান অনুঘটক ছিল আওয়ামী লীগই। এখনও এরশাদই আওয়ামী লীগের একমাত্র ভরসা, সহযোগী। তারা মিলে মিশে লেপ্টালেপ্টি করে বেশ আছেন।
ফলে মিসেস লতিফ সিদ্দিকীর এরশাদের সঙ্গে গিয়ে এমপি হওয়া দোষের কিছু বলে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে হাসিনাপুত্র জয় সম্পর্কে বেফাঁস কথা বলে বিপদে পড়েছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার মন্ত্রিত্ব গেছে। সংসদ সদস্যপদ গেছে। আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদও গেছে। প্রয়োজনে হয়তো আবারও তিনি আসবেন পাদপ্রদীপের আলোয়। লতিফ সিদ্দিকী কী ভাবছেন, জানি না, কিন্তু আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি। এমন সব নজির সামনে রেখে শেখ হাসিনা চিন্তা-চেতনার বাইরে অন্য কিছু ভাবাও অকল্পনীয়। তাই সংসদে বিল এলে আলাপ-আলোচনা ভালোমন্দ বিবেচনা না করেই সকলে সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে ধ্বনি দেন আর স্পীকার রায় দেন, ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে।’ আইন পাস হয়ে যায়।
জাতীয় সংসদে এর রক্ষাকবচ হতে পারে একমাত্র বিরোধী দল। কিন্তু বর্তমান সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বলে চালানোর চেষ্টা করে সরকার এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। তার দল থেকে সরকারে আছে ৪ মন্ত্রী ও দুই উপদেষ্টা। উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা মন্ত্রীর সমতুল্য। এরশাদের স্ত্রী রওশন হয়েছেন কিম্ভূত বিরোধী দলের নেত্রী। তার পদমর্যাদাও মন্ত্রীর। হুইপরাও হাফ-মন্ত্রী। এদরকেই আবার বিরোধী দল বলে অভিহিত করা হচ্ছে। পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন বিরোধী দলের কথা কেউ কখনো শোনেনি।
অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই এমন কাণ্ডই বারবার ঘটে। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এলে এক ধুয়া তোলা হয়েছিল, তার নাম মুজিববাদ। স্লোগান উঠতো, ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ, মুজিববাদ’। সে মুজিববাদ হালে পানি পায়নি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় বাকশাল গঠন করলে বোঝা গেল, এ স্লোগানের আড়ালে তাদের কী মতলব ছিল। এবারের ‘বিরোধী দল’ নিয়ে চমৎকার সন্তুষ্টির মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এবারের বিরোধী দল নিয়ে চমৎকার চলছে জাতীয় সংসদ। হল্লাচিল্লা নেই, গালিগালাজ নেই, ওয়াকআউট নেই, ফাইল ছোঁড়াছুঁড়ি নেই। খুবই শান্তিপূর্ণভাবে চলছে সংসদ। খুবই সদাচরণ করছেন সরকারী বিরোধী দল। সুতরাং কোনো বিলের ওপর তথাকথিত বিরোধী দলেরও কোনো মতামতের প্রয়োজন নেই। সে কাজটি তারা করেনও না, করার যোগ্যতাও নেই।
ফলে জাতীয় সংসদে কোনা রকম আলাপ-আলোচনা বিশ্লেষণ ছাড়াই পাস হয়ে গেছে সরকারি কর্মচারিদের নতুন বেতন স্কেল। এই পে স্কেলের খসড়া প্রকাশের পরপরই শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ছাড়া শিক্ষক সমাজ প্রকৃচিসহ ৩৪টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এর কাঠামোর প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত বলতে শুরু করেন যে, শিক্ষকরা না বুঝেই আন্দোলন ও পে স্কেলের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। মুহিত প্রকারান্তরে তাদের মূর্খ বলে অভিহিত করার প্রয়াস পান। এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, কোনো আলোচনা হবে না। শিক্ষকরা এত পাত্তা দেননি। তারা বলেছেন, অর্থমন্ত্রী সকালে কী বলেন, আর বিকালে কী বলেন, তার কোনো ঠিক নেই। তারাও তার সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসবেন না। এ নিয়ে বিতর্কে পিছিয়ে থাকলেন না প্রধানমন্ত্রী নিজেও। তিনি বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, পৃথিবীর কোথায়ও কেউ সরকারি কর্মচারিদের বেতন ৯৭ ভাগ বাড়ায়নি। তা হলে কেন আন্দোলন করতে হবে। এখন মনে হচ্ছে, বেতন না বাড়ালেই ভাল করতাম।
এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টিটকারি দিয়ে আরও বললেন যে, তা হলে শিক্ষকরা সচিব হয়ে যাক। তা হলে তারা ৬৫ বছরের বদলে ৫৯ বছর চাকরি করুক। অবসরের পর সরকার আমলাদের কখনও কখনও চার-পাঁচ বছরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে রাখে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা তাহলে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবে না। জ্ঞানদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির এমন চিন্তাও তাহলে করা যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী ভুলেই গেলেন যে, ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরির বিধান শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৫৯ বছরই। তারাও আছেন আন্দোলনে। কারণ তাদেরও সরকার প্রশাসনিক ক্যাডারদের অধীনস্ত করে ফেলেছেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকরা কোনো আন্দোলন করেননি। উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যই সরকারে তাদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে শিক্ষকরা আরও বললেন যে, তারা কেন সচিব হবেন, তারা সচিব তৈরি করেন। অত্যন্ত হক কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সবচেয়ে ভালো ফল করেন, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় থাকেন বা থাকতে চান। এক সময় অবশ্য শীর্ষস্থানীয় রেজাল্টধারীদের প্রশাসনিক পদে আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হতো। সেটা পাকিস্তান আমলের কথা। বাংলাদেশ আমলে তোফায়েল ক্যাডারদের মাধ্যমে তার কবর রচনা শুরু হতে থাকে। এখন প্রশাসনের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন মধ্যম সারির শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি করতে চায়। কিন্তু সেখানেও দলীয়করণের ফলে গুণ্ডা-মাস্তান, দলীয় ক্যাডার, ধর্ষণের সেঞ্চুরিকার, টেন্ডারবাজেরা প্রধানত নানা কোটায় সরকারি চাকরিতে ঢোকে। তাদের শিক্ষার মান কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেক্ষেত্রেও যে দূষণ হচ্ছে না, এমন কথা আমি বলব না। অযোগ্য দলীয় লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিতে ঢুকিয়ে শিক্ষার মান নিম্নমুখি করা হয়েছে। তাই একটি ইংরেজী চিঠি ড্রাফট করতে প্রশাসনিক ক্যাডারে বাইরে থেকে লোক হায়ার করে আনতে হয়। শত দলীয়করণ সত্ত্বেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এখনও এটা ঘটেনি।
বেতন বৃদ্ধি বিষয়ে শিক্ষকদের কোনো অভিযোগ নেই। তারা বলেছেন, প্রশাসনিক ক্যাডারের আমলাদের তুলনায় তাদের মর্যাদা এই বেতন স্কেলে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ সরকারি কলেজের শিক্ষক ও প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদেরও। এই অভিযোগ প্রশাসনিক ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারদেরও। শিক্ষকদের মর্যাদার দিক থেকে আমলাদের চেয়ে তিন ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এই কুকাজ করতে গিয়ে গেজেট জারির সময় আমলারা প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সুপারিশ পর্যন্ত গাপ করে দেয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এখানে সরকার ভারি অসহায়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রজ্ঞাপনে ভুল হয়েছে, কিন্তু তা এখন আর সংশোধনের সময় নেই। সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী প্রথমে তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েিেছলেন। এই সকল পর্যায়ে একেবারে চুপ করে ছিলেন জাতীয় সংসদের অনির্বাচিত সদস্যরা।
কিন্তু গোল বাঁধল জাতীয় সংসদ সদস্যদের যখন সম্মানি বাড়ানো হলো তখন। প্রেসিডেন্ট, বিচারপতিগণ, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিগণ ও সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতাদিও দ্বিগুণ করার বিল সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। তাতে দেখা গেল এমপিদের সম্মানিভাতাও সচিবদের চেয়ে কম ধরা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই কাঠামো নিয়ে তারা আপত্তি তুলেছেন। বৈঠকে তারা বলেছেন, আমরা তো আমলাদের নিচে থাকতে পারি না। তারা বলেন, সংসদ সদস্যরা যদি পাস করেন তবেই আমলাদের বেতন বাড়বে। এমপিরাই যদি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাহলে তাদেরকে সবার ওপরে নিতে হবে। আর অভিমান করে তারা বলেছেন, এটা যদি সম্মানি ভাতা হয়, তবে এক টাকা করা হোক। কিন্তু আমাদের মর্যাদাটা তো রাখতে হবে। আমলারা প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী স্পীকার মন্ত্রীদেরটা বাড়ায়, সঙ্গে নিজেদেরটাও বাড়ায়।
কেন বাড়ায়? কোন সাহসে তারা নিজেদের বেতন ভাতা এমপিদের ওপর নির্ধারণে সাহস পায়? সুরঞ্জিত সাহেব বিচক্ষণ লোক। তার সেটা অনুধাবন করা উচিত। বাড়ায় এই কারণে যে, তারা জানে জনগণের ভোটে নয়, যারা এবার এমপি হয়েছেন, তারা তা হয়েছেন আমলাদের কারচুপি আর ঘোষণার বলে। সবাই জানেন, সরকারের মসনদ রক্ষার জন্য আপাতত আমলারা কতোটা প্রয়োজনীয়। আমলারা সঙ্গে থাকলে আর কোনো ক্যাডার, শিক্ষক, মন্ত্রী-এমপির কোনো প্রয়োজন নেই। আমলারা যদি না চাইত, তবে আপনারা এমপি-মন্ত্রী হতে পারতেন না। তারা এমপি বানিয়েছে, তবে তাদের বেতন এমপিদের ওপরে হবে না কেন? আর একথা প্রধানমন্ত্রীও জানেন। তাই তিনি আমলাদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষকদের কটূক্তি করতে দ্বিধা করেননি। আজ এমপিদের এই অমর্যাদার দিনে কে দাঁড়াবে তাদের পাশে। সকলকে তো আগেই আপনারা বধ্যভূমিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন