শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কতিপয় দিক


পাঠকরা সম্ভবত প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের কথা ভুলে যাননি। জেনারেল মইন উ’র অধীনস্থ হয়ে পড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার উদ্দেশ্যে গোপনে গঠিত গ্রুপ ‘র‌্যাটস’-এর প্রথমজন ছিলেন তিনি। তারও আগে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের (১০৯৬-২০০১) পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তির প্রধান রূপকার ছিলেন এই নেতা। সে সময়, ১৯৯৮ সালে বন্যায় যখন পুরো দেশ ডুবে গিয়েছিল, মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তখন বলেছিলেন, যেহেতু ‘ভাটির দেশ’ সেহেতু ‘উজানের’ অর্থাৎ ভারতের পানিতে বাংলাদেশকে ‘ডুবতেই’ হবে। অবস্থায় অবশ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছিল রাজ্জাক সাহেবদের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’। ভারতের পানি আগ্রাসনে এরপর বাংলাদেশ ক্রমাগত পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশকে মরুভ’মিতে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে ভারত একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করেছে, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে।
এ ব্যাপারেও আবদুর রাজ্জাকের নাম ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লিখিত রয়েছে। কারণ, ড্যামটি পরিদর্শনের নামে এক হাওয়াই সফরশেষে একেবারে খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন তিনি এবং তার নেতৃত্বে যাওয়া দলটি। এটা ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্টের কথা। সেবার ভারতের বিমান ও হেলিকপ্টারে চড়ে উড়ে বেড়ানোর বাইরে কিছুই করতে পারেননি তারা। প্রকল্পের স্থান দেখা দূরে থাক, তারা এমনকি নামতেও পারেননি টিপাইমুখের আশেপাশে। কারণ, সে সময় মূষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল ওই এলাকায়। ফলে আসামের রাজধানী গৌহাটি থেকে ঘণ্টা চারেক ধরে হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারেননি আবদুর রাজ্জাক এবং তার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। তারা দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। অথচ ভারত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মণিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ও ফুলেরতলে। এটা বাংলাদেশের কাছাকাছি একটি এলাকা, যেখানে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু আবদুর রাজ্জাকরা বিমানে উড়ে গিয়েছিলেন ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে। তাদেরকে দু’দিন ধরে ব্রিফিংও দেয়া হয়েছিল নয়া দিল্লিতেইÑ যাকে অনেকে ‘কানপড়া’ বলেছিলেন। নয়া দিল্লি থেকে তারা হাওয়াই সফরে এসেছিলেন আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে রাজকীয় স্টাইলে গেছেন টিপাইমুখ দেখতে কিন্তু আবহাওয়া তাদের কিছুই দেখতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, বৃষ্টি ও কালো মেঘের ফাঁক দিয়েও তিনি নাকি দেখতে পেয়েছেন, সেখানে এখনো কোনো স্থাপনা তৈরি করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছিল, এত প্রচন্ড বৃষ্টি ও কালো মেঘের মধ্যে হেলিকপ্টারে বসে উড়ন্ত অবস্থায়ও তারা সব কিছু দেখতে পেয়েছিলেন কিভাবে? তাদের তো পাহাড় ও নদী ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়ার কথা ছিল না!
আসলেও পাহাড় ও নদী দেখেই ফিরেছিলেন আবদুর রাজ্জাকরা। তা সত্ত্বেও ভাষার মারপ্যাঁচ খাটানোর কসরত করেছিলেন এই নেতা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদ্যুৎমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, ভারত নাকি বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না সেখানে। কথার পিঠে কথাও যথেষ্টই উঠেছিল- কারণ, এ ধরনের আশ্বাস ভারতীয়রা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আগেই দিয়েছিলেন। বিষয়টি আসলে এতটা সহজ-সরল ছিল না। বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে বিরোধিতা ছিল বলেই সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নামে সেবার আওয়ামী শিবিরের পরীক্ষিত ভারতপন্থীদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অন্তরালে কিছু বিশেষ বিষয় ও উদ্দেশ্যও ছিল। বাংলাদেশে টিপাইমুখ ড্যাম বিরোধী আন্দোলনের প্রচন্ডতা দেখে ভারতকে কৌশল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। দেশটিতে তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চায়নি। সে কারণেই ভারত সংসদীয় প্রতিনিধি দলের জন্য ভ্রমণের আয়োজন করেছিল যাতে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণকে বলতে পারে যে, টিপাইমুখ ড্যামের বিরুদ্ধে তারা চেষ্টা করেছে। আর সে অবস্থার সুযোগ নিয়েই ভারত একের পর এক নিজের বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণ করে নিয়েছে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে করিডোরসহ বিভিন্ন বিষয়ে। মূলত সে কৌশলের ভিত্তিতেই ভারত এখনো এগিয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগ সরকারও যথার্থ সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এভাবে শুরু করার এবং আবদুর রাজ্জাককে টেনে আনার পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হলো, শুকনো মওসুম শুরু না হতেই এককালের প্রমত্তা নদী পদ্মার দশা অতি শীর্ণ হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ি থেকে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর মুখ পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকাজুড়ে পদ্মা অনেকাংশে এক সরু খালের রূপ নিয়েছে। ফারাক্কাসহ ভারতের অসংখ্য বাঁধের পাশাপাশি যথেচ্ছভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার এবং চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়ার ফলে পদ্মার কোথাও পানি নেই বললেই চলে। একযোগে বিস্তার ঘটছে অসংখ্য চরের। পদ্মার দুই তীর ঘেঁষে এখন শত শত চর। শুধু তা-ই নয়, পানি না থাকায় হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে ১৫টি পিলারের মধ্যে ১২টিই দাঁড়িয়ে আছে শুকনো চরের মধ্যে- নদীর অনেক বাইরে। যে তিনটি মাত্র পিলার সামান্য পানির মধ্যে রয়েছে সেখানেও আশপাশের কৃষকরা চাষাবাদ করছে। এসব স্থানে পানির পরিমাণও এত কম যে জেলেরা এমনকি নিজেদের খাবার মতো মাছই ধরতে পারছে না। অর্থাৎ পদ্মা তার স্বরূপ খুইয়ে ফেলেছে। এমন অবস্থার কারণ, এ বছরও ভারত চুক্তি লংঘন করেছে এবং বাংলাদেশকে ৩২ হাজার কিউসেক কম পানি দিয়েছে। সে কারণে পদ্মা তো বটেই, দেশের অন্য ৫৪টি নদ-নদীও শুকিয়ে গেছে।
পদ্মার পানি কমে যাওয়ায় মাওয়া থেকে ক্যাওড়াকান্দি পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথে যাতায়াতের সময় কয়েকটি পর্যন্ত স্থানে প্রতিদিনই যাত্রী ও যানবাহনসহ ফেরি আটকে পড়ছে। কয়েক ঘণ্টা লাগছে ড্রেজিং করে ফেরিগুলোাকে আবারও চালু করতে। এ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে খুলনা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, মাদারিপুর, কুষ্টিয়া এবং বরিশালসহ বহু এলাকার মানুষকে, যারা মাওয়া-ক্যাওড়াকান্দি এবং নগরবাড়ি-দৌলতদিয়া হয়ে যাতায়াত করেন। সেই সাথে রয়েছে শত শত পণ্যবাহী যানবাহনও। ফলে সব মিলিয়েই বাংলাদেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।
যারা যাতায়াত করেন তাদের সকলকেই পদ্মার করুণ দশা দেখে বিস্মিত ও দুঃখিত হতে হয়। পানি কমতে কমতে পদ্মা এতটাই রুগ্ন, শীর্ণ ও অগভীর হয়ে পড়েছে পদ্মা। বহুস্থানে চরই শুধু পড়েনি, কোনো কোনো চর রীতিমতো ‘বসবাসযোগ্য’ও হয়ে উঠেছে। বহু পরিবার ওইসব চরে গিয়ে বাসাবাড়ি বানিয়ে বসবাস করতেও শুরু করেছে। সে কারণে চলছে চরদখলের প্রতিযোগিতা। উল্লেখ করার মতো দ্বিতীয় বিষয়টি পানির গভীরতা। ফেরি চলাচল করার জন্য মাত্র ছয়-সাত ফুট গভীরতা দরকার। সেটাও এখন নেই পদ্মার বেশির ভাগ স্থানে, যার জন্য যখন-তখন ডুবোচরে আটকে পড়ছে ফেরিগুলো। বেশ কিছু এলাকায়  পদ্মার বুকে ৩০/৪০ ফুট পর্যন্ত ভেতরে এসে ছেলে-মেয়েরা সাঁতার পর্যন্ত কাটছে, বয়স্করা কোমর পানিতে গোসল করছে। অর্থাৎ সব মিলিয়েই এককালের প্রমত্তা পদ্মা এখন খাল-বিলের পর্যায়ে নেমে এসেছে।
একটি নদীর জন্য এর চাইতে করুণ পরিণতির কথা কল্পনা করা যায় না। বলা বাহুল্য, এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। সে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, ভারতকে প্রথমে সুযোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, সে চুক্তির ভিত্তিতেই ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল ভারত। কথা ছিল, ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মৌসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসার জন্য ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে। সে অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কিন্তু ৪১ দিনের পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে গঙ্গার পানি হুগলি নদীতে নিয়ে যায়। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফিডার ক্যানেল চালু করার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় পানি প্রবাহ যেখানে ছিল ৬৫ হাজার কিউসেক সেখানে ১৯৭৬ সালে তার পরিমাণ নেমে আসে মাত্র ২৩ হাজার ২০০ কিউসেকে। এর প্রধান কারণ ছিল ফিডার ক্যানেল দিয়ে ভারতের পানি প্রত্যাহার।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারত আবারও সুযোগ নিয়েছিল। সে বছরের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পর, ১৯৯৭ সালের মার্চেই ভারত তার পানি  সরিয়ে নেয়া আরো প্রচন্ড করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী মার্চের প্রথম ও দ্বিতীয় ১০ দিনের চক্রে বাংলাদেশের প্রাপ্য যেখানে ছিল ৩৫ হাজার কিউসেক, ভারত সেখানে দিয়েছিল গড়ে ২১ হাজার কিউসেক। সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ডও স্থাপিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের মার্চেই- ২৭ মার্চ বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক। একই চুক্তির আড়াল নিয়ে ভারত এখনো পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনের চক্রে ৫০ হাজার ১৫৪ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ২৮ হাজার ১১২ কিউসেক। এজন্যই এককালের প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। আবদুর রাজ্জাকের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ, তিনি মারা গেছেন। তাকে আর কোনো জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না।
এদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্য কোনো বিষয়েও আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বার্থে কিছুই করতে পারেনি- আসলে করার কোনো চেষ্টাও করেনি। উদাহরণ হিসেবে দু’ দেশের বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করা যায়। এ সম্পর্কে সর্বশেষ কিছু তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ- যিনি শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার জন্য গঠিত গ্রুপ ‘র‌্যাটস’-এর তিন নম্বর নেতা ছিলেন (আবদুর রাজ্জাক ছাড়া অন্য দু’জনের নাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও আমির হোসেন আমু)। গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় সংসদে মন্ত্রী তোফায়েল বলেছেন, দু’ দেশের বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ আট গুণ। বিগত পাঁচ মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১৭ হাজার ১৫২ কোটি টাকার পণ্য। এ সময়ে ভারতে রফতানির পরিমাণ ছিল দু’ হাজার ৭৪ কোটি টাকা।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতি সম্পর্কিত তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো যে অত্যন্ত আশংকাজনক সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশপ্রেমিক সকল মহলে উদ্বেগ বেড়েছে বিশেষ করে ঘাটতির ব্যাপারে। কারণ, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ঘাটতি শুধু বাড়ছেই না, ২০১৩-১৪’র মতো কোনো কোনো অর্থবছরে বাংলাদেশের ঘাটতি সর্বোচ্চ পর্যায়েও পৌঁছেছে। ওই একটি মাত্র অর্থবছরেই বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়েছিল ৩৩ দশমিক ৭৬ শতাংশÑ প্রায় পাঁচ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ প্রসঙ্গে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অন্য একটি তথ্য হলো, সরকারের পক্ষ থেকে চালসহ খাদ্যশস্য রফতানি করার গালগল্প শোনানো হলেও বাস্তবে আলোচ্য এক বছরেই ভারত থেকে এক হাজার ৮৫ দশমিক নয় মিলিয়ন ডলারের খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় খাতটিতে বাংলাদেশের ব্যয় বেড়েছিল ৫৯৮ দশমিক নয় মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। অন্য সব পণ্যের বেলায়ও বাংলাদেশ কেবল পিছিয়েই পড়েছে। পিছিয়ে পড়ার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। দ্বিগুণ বা তিনগুণ নয়, বর্তমানে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে আট গুণ, যা যে কোনো দেশের জন্যই গভীর উদ্বেগ ও ভীতির ব্যাপার।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীসহ তথ্যাভিজ্ঞদের স্পষ্ট অভিমত হলো, ঘাটতির পেছনে প্রধান ভূমিকা রয়েছে ভারতের। দেশটির দিক থেকে নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্কগত বাধার কারণেই বাংলাদেশ রফতানি বাড়াতে পারছে না। এ ব্যাপারে ভারতীয়দের নীতি ও কার্যক্রমকে রফতানিকারকসহ সংশ্লিষ্টজনেরা প্রতারণাপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ, প্রকাশ্যে আমদানি বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও ভারত সুকৌশলে এমন কিছু শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্কগত বাধার সৃষ্টি করে চলেছে যার ফলে রফতানির সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে বহু পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ভারত থেকে যেখানে ২০৮৬ ধরনের পণ্য আসছে সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ১৬৮ ধরনের পণ্য রফতানি করতে পারছে। নিজেদের শিল্প সংরক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশের ৭৫০ ধরনের পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। ভারত সেই সাথে এমন ৪৫০টি পণ্যের জন্য ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যেগুলোর ৯৮ শতাংশই বাংলাদেশ উৎপাদন করে না। এজন্যই বাড়তে বাড়তে বাংলাদেশের ঘাটতি আট গুণ হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে দু-একটি তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। যেমন ১৯৯৯ সালে ঢাকা-কোলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস উদ্বোধন উপলক্ষে ঢাকা সফরকালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ২৫ ক্যাটাগরির বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা এখনো ঘোষণাই রয়ে গেছে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরকালেও ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার কথা শোনানো হয়েছিল। কিন্তু তারও বাস্তবায়ন আজও হয়নি। এরপর ঢাকায় এসে যথেচ্ছভাবে নিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র নাথ মোদী। কিন্তু এত স্পষ্ট প্রতারণার পরও এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার বিষয়ে দরকষাকষির যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার কখনো উল্লেখযোগ্য কোনো চেষ্টাই করেনি। এখনো করছে না। এভাবেই ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে সরকার। এটাও আবার এমনভাবেই করা হচ্ছে যেন সবই আগে থেকে সরকারের এজেন্ডায় ছিল!
অথচ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে চেষ্টা করা দরকার। ঘাটতি কমিয়ে আনতে হলে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ভারতে রফতানি বাড়ানোর ব্যাপারে। এ উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের উচিত চোরাচালান প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া। কারণ বৈধ বাণিজ্যের চাইতে কয়েকশ’ গুণ বেশি বাণিজ্য ভারত চোরাচালানের পথে করে থাকে। সুতরাং সীমান্তে কঠোর অভিযানের মাধ্যমে চোরাচালান প্রতিরোধ করা গেলে ভারতের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়বে। দেশটি তখন বাংলাদেশের প্রতি নীতি-মনোভাব পরিবর্তন না করে পারবে না। এর ফলে দেশের রফতানি বাড়বে বহুগুণ। আমদানির ক্ষেত্রেও জাতীয় শিল্পের স্বার্থে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। ভারত থেকে এমন সব পণ্য আমদানি করতে দেয়া চলবে না যেগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। উল্লেখ্য, ভারতসহ বিশ্বের সব দেশই এভাবে নিজেদের শিল্প ও পণ্যকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এর ফলে একদিকে জাতীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে অন্যদিকে দেশের আমদানি ব্যয়ও অনেক কমে আসবে। একই কথা ৫৪টি নদ-নদীর পানির ব্যাপারেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads