গণতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থা বিপন্ন থাকলে চলে না। চলে তো নাই-ই বরং বিপদ বৃদ্ধি পায়। গণতন্ত্র চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা লাগবেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি সে রকম দেখা যাচ্ছে না। বরং নির্বাচন ব্যবস্থা নানা দিক থেকে দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় গণতন্ত্রের দুর্বলতাকেই বার বার প্রমাণ করছে। সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের পৌরসভা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনেও বেহালদশা দেখা গেছে। দিনে দিনে নির্বাচন ব্যবস্থার বিপন্নতা যেন বাড়ছেই। নানা আকারের অনিয়ম ও অসঙ্গতি নির্বাচনের আগে ও পরে এসে ভিড় করছে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত।
বস্তুত নির্বাচনী কারচুপি, অনিয়ম আর অস্বচ্ছতার জন্যই যে একদা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছিল, সে কথাও সকলের জানা। এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় সরকার থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পারফরম্যান্স বা দক্ষতা অনেক বেশি পরিচয় পাওয়া গেছে। সম্ভবত এ কারণেই, রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিটি এখন পর্যন্ত জোরালো নৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো।
নির্বাচন ব্যবস্থার সমস্যা গণতন্ত্রের পবিত্রতাকে সরাসরি বিনষ্ট করে। বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং পুরো কার্যক্রমকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সঠিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনে স্বচ্ছ, অবাধ, চাপমুক্ত নির্বাচনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। জনগণের ভোটাধিকারের মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে উন্নত গণতন্ত্রে কখনোই নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন, সংশয় বা বিতর্ক দেখা যায়নি। সেসব দেশের গণতন্ত্রের শরীরেও অবৈধতার সিল-ছাপ্পড় লাগেনি।
কিন্তু অনগ্রসর দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়েছে সম্পূর্ণ ভয়াবহ। গণতন্ত্র আর নির্বাচন যেন ছেলে খেলা। শক্তির দাপটে জনগণের ভোটাধিকার বিনষ্ট হচ্ছে। নির্বাচন পরিণত হচ্ছে মহা-প্রহসনে। একদা হোন্ডা-গুণ্ডা ভিত্তিক নির্বাচনী অপরাধও এখন ব্যাপকতর হয়েছে। নানা রকম প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভোটের বারোটা বাজানো হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়া, ভোটারদের আসতে না দেয়ার মতো অপরাধ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বাহবার কাজ হচ্ছে ১১/১২ টার মধ্যেই কেন্দ্র দখল করে ফলাফল ছিনিয়ে নেয়ার মতো তা-বতায়। সে-ই এখন দক্ষ ও যোগ্য রাজনৈতিক শক্তি, যারা নির্দ্বিধায় অপরাধ হজম করে নিজের পক্ষে ফল হাসিল করতে পারে। গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থায় এহেন দম্ভ প্রয়োগের ঘটনা সম্ভবত বিরল।
নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের সময়ই নয়, নির্বাচনের পরেও চলছে শক্তির নগ্ন দাপট। জনপ্রিয়তা ও ভোটের জোরে যদি কখনো কেউ নির্বাচিত হয়েও যায়, তাবে তাকে রেহাই দেয়া হচ্ছে না। হাজার রকম মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে। শপথের সময় গ্রেফতার করা হচ্ছে। জেলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারপর ফাঁকতালে নিজের লোককে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেন ভোট পাওয়া ও নির্বাচিত হওয়াটাই অপরাধ। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির কালো ছায়া ক্রমশ ঘিরে ধরেছে নির্বাচন ব্যবস্থায় এবং সেই সূত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আর আইনের শাসনের নানা অঙ্গনে।
রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এমন একমুখী শক্তি প্রয়োগ হওয়া সম্ভব ছিল না। জনপ্রিয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও চলছে হামলা-মামলার এমনই নিকৃষ্ট ধারা। বিপরীত চিন্তা ও দর্শনের কবর রচনা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গণতন্ত্রের নামে যদি বহুত্ববাদী চিন্তার অবসান ঘটানো হয়, তাহলে গণতন্ত্রের বিশুদ্ধতা থাকে না। গণতন্ত্রের শরীরে অগণতান্ত্রিক স্বৈরতার ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একদলীয় প্রবণতার অভিযোগও উঠছে এ কারণেই। পুরো বিষয়গুলোই গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচারের পরিপন্থী।
গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচারের প্রশ্নে এখন গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। শুধু মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলাই যে গণতন্ত্র নয়, সেটাও বুঝতে হবে। যেখানে ভোট না দিলেও নির্বাচন হয়, সেখানে গণতন্ত্র দাবি করা কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য। এটাও মনে রাখতে হবে যে, কার্যকর বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলে খোদ গণতন্ত্রেরই অস্তিত্ব থাকে না। এতে শুধু গণতন্ত্রই ব্যাহত হয় না, সাংবিধানিক সমস্যাও দেখা দেয়। শাসনের নৈতিক ভিত্তিটিও নাজুক হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এসব মৌলিক বিষয়ে উদাসীন থাকেন, তাহলে গণতন্ত্র এগিয়ে নেয়া মোটেই সম্ভব হবে না।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র চলছে উত্থান আর পতনের মধ্য দিয়ে। অরাজনৈতিক শক্তি যেমন গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছে, রাজনৈতিক শক্তিও গণতন্ত্রকে নিজের ব্যক্তিসত্তা বা দলের অধীনে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। ফলে নিখাদ গণতন্ত্রের পরিচয় অধিকাংশ সময়েই পাওয়া যায়নি। পাপমুক্ত নির্বাচনও দেখা গেছে কমই। সুশাসনের ব্যাপক বিকাশও হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে দশক ধরে আলোচনা করলে গণতন্ত্রের আলো ও ছায়ার দেখা পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাধাহীন পথচলার বিবরণ দেয়া সব সময়ই সম্ভব হয় না।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কলুষ আড়ালের জন্য কখনো কখনো উন্নয়নকে সামনে আনা হয়। বিশেষত সামরিক শাসকরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করে নিজের স্বৈরশাসন কায়েমের সময় কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রদর্শন করে। আয়ুব বা এরশাদের তেমন কৃতিত্ব আছে। কিন্তু উন্নয়নের চমকের আড়ালে গণতন্ত্র ও সুশাসনের যে বারোটা বাজানো হয়, সেটা টের পাওয়া যায় পরে। স্বৈরশাসকদের উন্নয়নের চেয়ে সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশিই হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন, মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতার চূড়ান্ত সর্বনাশ করে যে উন্নয়ন দেখানো হয়, সেটা সুশাসনের পক্ষে সহায়ক বলে বিবেচিত হয় না। বিভিন্ন গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে।
অতএব বিশুদ্ধ গণতন্ত্র এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ-সম্পন্ন গণতন্ত্রই একটি সমাজের শান্তি, স্থিতি, উন্নয়ন ও কল্যাণের পূর্বশর্ত। একদলীয় বা স্বৈরতান্ত্রিক আদলে আর যাই হোক, গণতন্ত্র হয় না। নির্বাচন ব্যবস্থা বিনষ্ট করেও গণতন্ত্রের দেখা পাওয়া কিংবা শাসনের বৈধতা হাসিল করা অসম্ভব। যে কারণে বার বার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত ভোটের ব্যবস্থা করার দাবি শোনা যাচ্ছে। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে নানা কথা বলা হচ্ছে। মিডিয়ায় ভোটের বিভিন্ন অসঙ্গতি উপস্থাপিত হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরাও বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব কথা শোনা হলে গণতন্ত্রেরই লাভ এবং নির্বাচন ব্যবস্থারই কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
গণতন্ত্র নিয়ে তত্ত্বগতভাবে যা বলা হয় আর বাস্তবে যা আছে, তা মিলিয়ে দেখলে সত্যিই হতাশ হতে হয়। শুধু নির্বাচনই নয়, গণতন্ত্রের নানা ক্ষেত্রে ক্রমে ক্রমে পুঞ্জীভূত হচ্ছে নানা অসঙ্গতি। এসব কমানোর বদলে বাড়ানোই হচ্ছে একতরফাভাবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পক্ষসমূহের মধ্যে তীব্রভাবে বাড়ছে বিভেদ ও দূরত্ব। নিকট-অতীতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের একটি কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নৈকট্য বাড়ানোর কাজ করা হলেই মঙ্গল হতো। সেটা হয়নি। সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার কথা দেশ-বিদেশ থেকে বহুবার বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। সঙ্কট মোচনের উদ্যোগ না নিলে সঙ্কট বৃদ্ধি পাবে, এটা একটি সাধারণ জ্ঞানের কথা। এই কথাটি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না।
সংসদ থেকে ইউপি পর্যন্ত নির্বাচনের যে অভিজ্ঞতা সকলের সামনে রয়েছে, সেটাকে কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। যদি ভোট না দিলেও নির্বাচন হয়ে যায়, তাহলে সে নির্বাচনের শুদ্ধতা বা বৈধতার অস্তিত্ব থাকে না। আর ভোটার ও ভোটবিহীন গণতন্ত্রের কথা তো অকল্পনীয় বিষয়। প্রতিপক্ষের প্রার্থী-সমর্থকদের হটিয়ে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে একতরফা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আপাত স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও বৈধতা কখনোই দিতে পারবে না। সাংবিধানিক নীতির সঙ্গেও এসব অসঙ্গতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। পুরো বিষয়টিই একটি তালগোল পাকানো বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়, যা কালক্রমে শাসনের জন্য ভালোর বদলে মন্দ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে।
আগে-ভাগে সঙ্কট ও সমস্যা সমাধান না করে কোনক্রমে অগ্রসর হওয়া যায় বটে; কিন্তু ভবিষ্যৎ ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয় না। ভবিষ্যৎ বিপদ আঁচ করতে পারার নামই বিচক্ষণতা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিলেই সকলের কল্যাণ।
বস্তুত নির্বাচনী কারচুপি, অনিয়ম আর অস্বচ্ছতার জন্যই যে একদা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছিল, সে কথাও সকলের জানা। এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় সরকার থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পারফরম্যান্স বা দক্ষতা অনেক বেশি পরিচয় পাওয়া গেছে। সম্ভবত এ কারণেই, রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিটি এখন পর্যন্ত জোরালো নৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো।
নির্বাচন ব্যবস্থার সমস্যা গণতন্ত্রের পবিত্রতাকে সরাসরি বিনষ্ট করে। বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং পুরো কার্যক্রমকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সঠিক গণতন্ত্রের প্রয়োজনে স্বচ্ছ, অবাধ, চাপমুক্ত নির্বাচনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। জনগণের ভোটাধিকারের মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে উন্নত গণতন্ত্রে কখনোই নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন, সংশয় বা বিতর্ক দেখা যায়নি। সেসব দেশের গণতন্ত্রের শরীরেও অবৈধতার সিল-ছাপ্পড় লাগেনি।
কিন্তু অনগ্রসর দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়েছে সম্পূর্ণ ভয়াবহ। গণতন্ত্র আর নির্বাচন যেন ছেলে খেলা। শক্তির দাপটে জনগণের ভোটাধিকার বিনষ্ট হচ্ছে। নির্বাচন পরিণত হচ্ছে মহা-প্রহসনে। একদা হোন্ডা-গুণ্ডা ভিত্তিক নির্বাচনী অপরাধও এখন ব্যাপকতর হয়েছে। নানা রকম প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভোটের বারোটা বাজানো হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়া, ভোটারদের আসতে না দেয়ার মতো অপরাধ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বাহবার কাজ হচ্ছে ১১/১২ টার মধ্যেই কেন্দ্র দখল করে ফলাফল ছিনিয়ে নেয়ার মতো তা-বতায়। সে-ই এখন দক্ষ ও যোগ্য রাজনৈতিক শক্তি, যারা নির্দ্বিধায় অপরাধ হজম করে নিজের পক্ষে ফল হাসিল করতে পারে। গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থায় এহেন দম্ভ প্রয়োগের ঘটনা সম্ভবত বিরল।
নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের সময়ই নয়, নির্বাচনের পরেও চলছে শক্তির নগ্ন দাপট। জনপ্রিয়তা ও ভোটের জোরে যদি কখনো কেউ নির্বাচিত হয়েও যায়, তাবে তাকে রেহাই দেয়া হচ্ছে না। হাজার রকম মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে। শপথের সময় গ্রেফতার করা হচ্ছে। জেলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারপর ফাঁকতালে নিজের লোককে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেন ভোট পাওয়া ও নির্বাচিত হওয়াটাই অপরাধ। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির কালো ছায়া ক্রমশ ঘিরে ধরেছে নির্বাচন ব্যবস্থায় এবং সেই সূত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আর আইনের শাসনের নানা অঙ্গনে।
রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এমন একমুখী শক্তি প্রয়োগ হওয়া সম্ভব ছিল না। জনপ্রিয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও চলছে হামলা-মামলার এমনই নিকৃষ্ট ধারা। বিপরীত চিন্তা ও দর্শনের কবর রচনা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গণতন্ত্রের নামে যদি বহুত্ববাদী চিন্তার অবসান ঘটানো হয়, তাহলে গণতন্ত্রের বিশুদ্ধতা থাকে না। গণতন্ত্রের শরীরে অগণতান্ত্রিক স্বৈরতার ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একদলীয় প্রবণতার অভিযোগও উঠছে এ কারণেই। পুরো বিষয়গুলোই গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচারের পরিপন্থী।
গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচারের প্রশ্নে এখন গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। শুধু মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলাই যে গণতন্ত্র নয়, সেটাও বুঝতে হবে। যেখানে ভোট না দিলেও নির্বাচন হয়, সেখানে গণতন্ত্র দাবি করা কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য। এটাও মনে রাখতে হবে যে, কার্যকর বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলে খোদ গণতন্ত্রেরই অস্তিত্ব থাকে না। এতে শুধু গণতন্ত্রই ব্যাহত হয় না, সাংবিধানিক সমস্যাও দেখা দেয়। শাসনের নৈতিক ভিত্তিটিও নাজুক হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এসব মৌলিক বিষয়ে উদাসীন থাকেন, তাহলে গণতন্ত্র এগিয়ে নেয়া মোটেই সম্ভব হবে না।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র চলছে উত্থান আর পতনের মধ্য দিয়ে। অরাজনৈতিক শক্তি যেমন গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছে, রাজনৈতিক শক্তিও গণতন্ত্রকে নিজের ব্যক্তিসত্তা বা দলের অধীনে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। ফলে নিখাদ গণতন্ত্রের পরিচয় অধিকাংশ সময়েই পাওয়া যায়নি। পাপমুক্ত নির্বাচনও দেখা গেছে কমই। সুশাসনের ব্যাপক বিকাশও হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে দশক ধরে আলোচনা করলে গণতন্ত্রের আলো ও ছায়ার দেখা পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাধাহীন পথচলার বিবরণ দেয়া সব সময়ই সম্ভব হয় না।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কলুষ আড়ালের জন্য কখনো কখনো উন্নয়নকে সামনে আনা হয়। বিশেষত সামরিক শাসকরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করে নিজের স্বৈরশাসন কায়েমের সময় কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রদর্শন করে। আয়ুব বা এরশাদের তেমন কৃতিত্ব আছে। কিন্তু উন্নয়নের চমকের আড়ালে গণতন্ত্র ও সুশাসনের যে বারোটা বাজানো হয়, সেটা টের পাওয়া যায় পরে। স্বৈরশাসকদের উন্নয়নের চেয়ে সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশিই হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন, মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতিকতার চূড়ান্ত সর্বনাশ করে যে উন্নয়ন দেখানো হয়, সেটা সুশাসনের পক্ষে সহায়ক বলে বিবেচিত হয় না। বিভিন্ন গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে।
অতএব বিশুদ্ধ গণতন্ত্র এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ-সম্পন্ন গণতন্ত্রই একটি সমাজের শান্তি, স্থিতি, উন্নয়ন ও কল্যাণের পূর্বশর্ত। একদলীয় বা স্বৈরতান্ত্রিক আদলে আর যাই হোক, গণতন্ত্র হয় না। নির্বাচন ব্যবস্থা বিনষ্ট করেও গণতন্ত্রের দেখা পাওয়া কিংবা শাসনের বৈধতা হাসিল করা অসম্ভব। যে কারণে বার বার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত ভোটের ব্যবস্থা করার দাবি শোনা যাচ্ছে। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে নানা কথা বলা হচ্ছে। মিডিয়ায় ভোটের বিভিন্ন অসঙ্গতি উপস্থাপিত হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরাও বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব কথা শোনা হলে গণতন্ত্রেরই লাভ এবং নির্বাচন ব্যবস্থারই কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
গণতন্ত্র নিয়ে তত্ত্বগতভাবে যা বলা হয় আর বাস্তবে যা আছে, তা মিলিয়ে দেখলে সত্যিই হতাশ হতে হয়। শুধু নির্বাচনই নয়, গণতন্ত্রের নানা ক্ষেত্রে ক্রমে ক্রমে পুঞ্জীভূত হচ্ছে নানা অসঙ্গতি। এসব কমানোর বদলে বাড়ানোই হচ্ছে একতরফাভাবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পক্ষসমূহের মধ্যে তীব্রভাবে বাড়ছে বিভেদ ও দূরত্ব। নিকট-অতীতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের একটি কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নৈকট্য বাড়ানোর কাজ করা হলেই মঙ্গল হতো। সেটা হয়নি। সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার কথা দেশ-বিদেশ থেকে বহুবার বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। সঙ্কট মোচনের উদ্যোগ না নিলে সঙ্কট বৃদ্ধি পাবে, এটা একটি সাধারণ জ্ঞানের কথা। এই কথাটি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না।
সংসদ থেকে ইউপি পর্যন্ত নির্বাচনের যে অভিজ্ঞতা সকলের সামনে রয়েছে, সেটাকে কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। যদি ভোট না দিলেও নির্বাচন হয়ে যায়, তাহলে সে নির্বাচনের শুদ্ধতা বা বৈধতার অস্তিত্ব থাকে না। আর ভোটার ও ভোটবিহীন গণতন্ত্রের কথা তো অকল্পনীয় বিষয়। প্রতিপক্ষের প্রার্থী-সমর্থকদের হটিয়ে দিয়ে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে একতরফা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আপাত স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও বৈধতা কখনোই দিতে পারবে না। সাংবিধানিক নীতির সঙ্গেও এসব অসঙ্গতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। পুরো বিষয়টিই একটি তালগোল পাকানো বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়, যা কালক্রমে শাসনের জন্য ভালোর বদলে মন্দ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে।
আগে-ভাগে সঙ্কট ও সমস্যা সমাধান না করে কোনক্রমে অগ্রসর হওয়া যায় বটে; কিন্তু ভবিষ্যৎ ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয় না। ভবিষ্যৎ বিপদ আঁচ করতে পারার নামই বিচক্ষণতা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিলেই সকলের কল্যাণ।