দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের ব্যাপারে জোর আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। কারণ, চলতি মাস ডিসেম্বরে বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। নিয়ম ও আইন অনুযায়ী তার আগেই নতুন ইসি গঠন করতে হবে। বিষয়টি খুব সহজে মীমাংসা করা যাবে বলে সচেতন কেউই কখনো মনে করেননি। কারণ, একদিকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠনের জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো সুনির্দিষ্ট দাবি ও প্রস্তাব উপস্থিত করেছে। মাঝখানে আবার ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসেবে নিন্দিত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।
এসব নিয়ে বিতর্ক জমে উঠতে না উঠতেই সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা। কারণটি অবশ্য গর্বিত হওয়ার মতো ছিল না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদসহ পাঁচ কমিশনার গত ২৬ নবেম্বর হাইকোর্টে গিয়ে ‘নিঃশর্ত’ ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলে ১৪ নবেম্বর হাইকোর্ট পুরো কমিশনকেই সশরীরে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ দিয়েছিলেন। ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যেই পাঁচ কমিশনার গিয়েছিলেন হাইকোর্টে। তারা তাই বলে কোনো বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়াননি। বরং চুপিসারে গিয়েছিলেন ছুটির দিন শনিবারে। শুধু তা-ই নয়, তারা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে ক্ষমার জন্য দরখাস্ত জমা দিয়ে এসেছেন।
প্রকাশিত খবরে কারণ সম্পর্কেও জানানো হয়েছে। চলতি বছরের ২২ মার্চ থেকে ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, চরম অনিয়ম ও জালিয়াতি এবং ফলাফল পাল্টে ফেলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে সংক্ষুব্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কয়েক হাজার আবেদন জমা দেয়া হলেও কোনো একটি বিষয়েই নির্বাচন কমিশন বিচার বা নিষ্পত্তি করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য আইন থাকা সত্ত্বেও কোনো ট্রাইব্যুনালও গঠন করেনি। নিজেদের আইনত করণীয়র প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে কমিশনাররা বরং সকল সংক্ষুব্ধ প্রার্থীকে আদালতে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। ফলে প্রায় সকল আসনেই ‘নির্বাচিত’ হয়েছে সরকারদলীয় প্রার্থীরা, বঞ্চিত কোনো প্রার্থীই সুবিচার পাননি। নির্বাচন কমিশনের এই পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জাহিদুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট জাহিদুল ইসলামের অভিযোগ নিষ্পত্তি করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কমিশন নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ না নেয়ায় ১৪ নবেম্বর এক শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, নির্দেশ অমান্য করার মধ্যদিয়ে নির্বাচন কমিশন আদালত অবমাননা করেছে। আদালত অবমাননা করায় হাইকোর্ট পুরো কমিশনকে সশরীরে হাজির হয়ে ক্ষমা চাওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ অনুযায়ী ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য চার কমিশনার হাইকোর্টে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তারা নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানালেও কথা উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন, হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চের সামনে হাজির হওয়ার পরিবর্তে রেজিস্ট্রারের অফিসে দরখাস্ত জমা দিয়ে আসাটা আদৌ যথেষ্ট এবং আইনসম্মত হতে পারে না। তাছাড়া চাতুরিপূর্ণ কৌশল নিয়ে তারা ছুটির দিনে গিয়ে নামকা ওয়াস্তে একটি দরখাস্ত ফেলে রেখে এসেছেন। এজন্যই দাবি উঠেছে, সর্বোচ্চ আদালতের উচিত কোনো পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সামনে তাদের হাজির হওয়ার আদেশ দেয়া, যাতে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষও জানতে পারে। গণতন্ত্রসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এটা দরকারও। কারণ, পুরো কমিশনের ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনায় পরিষ্কার হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন তথা ‘কাজী রকিবউদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানি’ আসলেও গুরুতর অপরাধ করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনারই সংবিধান এবং কমিশন ও নির্বাচন সংক্রান্ত আইন লংঘন করেছেন। নিজেদের সুবিধামতো আইনের ব্যাখ্যা হাজির করার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। যেমন নির্বাচনী আইনের ২২ ও ২৩ ধারার সঙ্গে বিধির ৫৩ ও ৯০ ধারা মিলিয়ে পড়া হলে যে কোনো অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনালে তার নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব কমিশনের ওপর বর্তায়। সে ক্ষমতাও কমিশনকে আইনেই দেয়া আছে। কিন্তু কমিশনাররা আইনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে অভিযোগকারী সকলকে ঢালাওভাবে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, যে সংক্ষুব্ধ প্রার্থী জাহিদুল ইসলামের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য আদেশ দিয়েছিলেন, তার ব্যাপারেও কমিশন যথারীতি মৌনতা অবলম্বন করেছে। এজন্যই কমিশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠেছে এবং পাঁচ কমিশনারকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছে। তারা অবশ্য দোষ স্বীকার করতে চাননি। বরং বলেছেন, এটা নাকি তাদের ‘অনিচ্ছাকৃত’ ভুল!
সেটা তারা বলতেই পারেন কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের তথা ইউপি নির্বাচনের বিষয়টিকে কোনোভাবেই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। অন্যদিকে ছয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনের ব্যাপারে প্রথম থেকেই অমার্জনীয় উপেক্ষা দেখিয়েছেন কমিশনাররা। তারও আগে যদি শুধু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে আয়োজিত কর্মকান্ডের উল্লেখ করা যায়, তাহলেও এ অভিযোগ অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে যে, সরকারের গঠন করা ইসি কতটা নির্লজ্জভাবে ক্ষমতাসীনদের আদেশ পালন করে থাকে। ওই নির্বাচনে তিনশ’ আসনের মধ্যে ১৫৫টি আসনেই আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থক দলগুলোর প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন। অন্য আসনগুলোতেও বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী না থাকায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দেশের ভেতরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে মেনে নেয়নি। স্বীকৃতি দেয়নি এমনকি ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকারকেও। কিন্তু ‘মেরুদন্ডহীন’ হিসেবে বর্ণিত ইসি সংশোধনমূলক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
এরই প্রতিফলন দেখা গেছে ইউপি নির্বাচনের সময়। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে আর কোনো দলের প্রার্থীদের মনোননয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি। অনেকের মনোননয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। অনেককে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এলাকা থেকে তাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা। তারা ভোটকেন্দ্র দখল করেছে, ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে ইচ্ছামতো। গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছে দেড়শ’র বেশি নিরীহ মানুষ, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। সবকিছুই ঘটেছে নির্বাচন কমিশন তথা কমিশনারদের চোখের সামনে। অভিযোগও এসেছে তাৎক্ষণিকভাবে। কিন্তু কোনো একটি বিষয়েই কমিশন বা কমিশনারদের তৎপর হতে দেখা যায়নি। তারা নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালেও বিচারের পদক্ষেপ নেননি। কমিশনাররা বরং আদালতে যাওয়ার উপদেশ খয়রাত করেছেন। তারা লক্ষ্যই করেননি যে, নির্বাচনকেন্দ্রিক অন্যায়, অনিয়ম ও অপরাধের বিচার এবং অভিযোগের নিষ্পত্তি করার জন্যই নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিধান করা হয়েছে। একই কারণে আদালতে যাওয়ার উপদেশ দেয়ার কোনো অধিকার তাদের থাকতে পারে না। অন্যদিকে আদালতে যাওয়ার উপদেশ দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের কর্তব্যের বিষয়ে অবহেলা তো করেছেনই, কমিশনাররা এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকেও পাত্তা দেননি। এতটাই ক্ষমতাধর ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন নির্বাচন কমিশনাররা!
নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আপত্তিও উঠেছে অনেক আগে থেকে। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা অবশ্য জনগণের দাবি ও প্রত্যাশার পরিপন্থী অবস্থান নিয়েছেন। তারা একই সাথে বিতর্কের কারণও সৃষ্টি করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে একটি সার্চ কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, ওই কমিটি যাদের নাম প্রস্তাব করবে তাদের সমন্বয়েই নতুন ইসি গঠন করা হবে। প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে পরিকল্পিত এই সার্চ কমিটিকে কেন্দ্র করে। কারণ, অতীতে বিভিন্ন উপলক্ষে দেখা গেছে, যে ব্যাপারে বা যে প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই গঠন করা হোক না কেন, এ ধরনের কমিটিতে সব সময় সরকার সমর্থকদের প্রাধান্য থাকে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, যে কোনো সার্চ কমিটিই বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে গঠন করা উচিত।
একই কারণে নতুন ইসি গঠন করার ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি উঠেছে। এই দাবি জানিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রধান ও ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো। গত সেপ্টেম্বরে বিএনপির নেতারা বলেছেন, সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। দলটির নেতারা প্রধান দলগুলোর প্রতিটি থেকে পাঁচজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে এই কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। তারা বলেছেন, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নিরপেক্ষ কমিশন গঠিত হতে পারে না। বিএনপির নেতারা এই বলে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে কোনো ইসি গঠন করা হলে সে ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনকে জনগণ তো মানবেই না, বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রও অমন কোনো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে না। সুতরাং সরকারের উচিত প্রথমে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা এবং তারপর ওই কমিটির তৈরি তালিকা থেকে বাছাই করা ব্যক্তিদের নিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা। এখানে উল্লেখ করা দরকার, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অন্য সকল বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজও তুলেছে।
এরপর দু’মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। গত ১৮ নবেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। ঠিক কোন পর্যায়ের কতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে সে কথা তো রয়েছেই, প্রস্তাবে নির্বাচনের দিন করণীয় সম্পর্কেও বলেছেন খালেদা জিয়া। যেমন আইন-শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে ভোট কেন্দ্রগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেসির তথা বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়োজিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। আরো বলেছেন, ভোট কেন্দ্রে বাড়তি বা অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স পাঠানো হলে সেগুলোকে আগে থেকেই প্রকাশ্য স্থানে রাখতে হবে। কোনো ব্যালট বাক্স ভোটারদের দেয়া ভোটে ভর্তি হয়ে গেলে সেটাকে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রের বাইরে আনা চলবে না এবং ভোট গণনা শেষে বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের কাছে স্বাক্ষরিত বিবরণী না দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসার কেন্দ্র ছেড়ে চলে আসতে পারবেন না।
প্রতিক্রিয়া জানাতে ক্ষমতাসীনরা অবশ্য দেরি করেননি। চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে বেগম খালেদা জিয়া সদিচ্ছার পরিচয় দিলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক কথায় ‘অন্তঃসারশূন্য’ বলে তার সকল প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন। অন্য ক্ষমতাসীনরাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, মেনে নেয়া দূরে থাকুক, বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার ব্যাপারেও ন্যূনতম ইচ্ছা নেই সরকারের। এরপর দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি শুধু বেগম খালেদা জিয়ার ‘অধিকার’ নিয়েই প্রশ্ন তোলেননি, ঝামেলা বাধানোর সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে ২৭ নবেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কেও গুরুগম্ভীর প্রস্তাবনা রেখেছেন। নিজের পাঁচ দফা তুলে ধরে এরশাদ দাবি জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইন পাস করতে হবে বর্তমান সংসদে, যেখানে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানে রয়েছে। কথার মারপ্যাঁচে এরশাদ আরো একবার বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটকে বাইরে ঠেলে দিয়েছেন। অর্থাৎ এসব দলকে আলোচনায় যেমন সুযোগ দেয়া চলবে না তেমনি তাদের কোনো দাবি বা পরামর্শও মেনে নেয়া যাবে না। পরামর্শ যা কিছু দেয়ার সবই জাতীয় পার্টি একাই দেবে! উল্লেখ্য, এর আগে তিনি বলে রেখেছেন, যেহেতু সংসদের ভেতরে নেই সেহেতু নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে কোনো কথা বলার অধিকারই বেগম খালেদা জিয়ার নেই!
এভাবেই একে-ওকে দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান দিয়ে চলেছেন ক্ষমতাসীনরা। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, অন্য অনেক বিষয়ের মতো নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নেও ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছারই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালানো হবে। তেমন ইচ্ছা তাদের থাকতেই পারে, কিন্তু মাঝখানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোর পাশাপাশি রয়েছে আরো কিছু শক্তি বা ফ্যাক্টরও। এসবের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করতেই হবে। মাত্র ক’দিন আগেও এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট। গত ২৮ নবেম্বর কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, তার দেশ বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন দেখতে চায়। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট আরো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় পরবর্তী সংসদ নির্বাচন এমন হবে যেখানে প্রত্যেক ভোটার নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারবে এবং তাদের প্রতিটি ভোট গণনা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, অমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা।
পরবর্তী সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য, পরামর্শ ও আশাবাদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা দরকার। কারণ, এমন এক জটিল সময়ে তিনি দলীয় প্রভাবমুক্ত ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য পরামর্শের আড়ালে আহ্বান জানিয়েছেন, যখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিষয়টি নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ও পরামর্শের মধ্য দিয়েও কিন্তু এ সত্যেরই প্রকাশ ঘটেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শুধু সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনই চায় না, একই সঙ্গে দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও দেখতে চায়।
এজন্যই দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কোনো কৌশলি পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত বেগম খালেদা জিয়ার দাবি ও প্রস্তাব মেনে নেয়া এবং কালবিলম্ব না করে স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা। কারণ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হঠাৎ করে বা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কথা বলেননি। বাস্তবে নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার এবং দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে। মাস কয়েক আগে ঢাকা সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও একই পরামর্শ ও তাগিদ দিয়ে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এ সত্যই প্রকাশিত হয়েছিল যে, সরকার দাবি করলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। স্মরণ করা দরকার, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা দেয়নি। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্কের বিষয়টিও গোপন নেই। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় জানিয়ে এসেছে, সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিভিন্ন সময়ে একই তাগিদ দিয়েছে। অন্যদিকে সরকার কেবল সংশয়ের কারণই সৃষ্টি করে চলেছে। জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য ইলেক্টোরাল কলেজ নামের এমন এক ভোটার গোষ্ঠী তৈরি করার পদক্ষেপও সরকার নিয়েছে, যার ফলে গণতন্ত্রই শুধু বিতাড়িত হবে না, গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেবে।
দেশকে অমন অশুভ পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। একই কারণে সরকারের উচিত দলীয় প্রভাবমুক্ত এমন একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা, যার অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারবে। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। আমাদের ধারণা, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকেন্দ্রিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই সরকার বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার পরিচয় দেবে।
আশিকুল হামিদ