মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬

নেপালের রাজনীতিতে ভারতপন্থীদের বিপর্যয়


আঠার বছর পর এ মাসের প্রথম সপ্তাহে নেপাল সফরে এসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। নেপালের ওপর ভারতের খবরদারির ইতিহাস দীর্ঘকালের। কিন্তু ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সেখানে শুরু হয় গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। সেই লক্ষ্যে নেপালে একটি সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচিত হয়। এই পরিষদের প্রধান কাজ ছিলো একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করা। তার জন্য নেপালের দীর্ঘ সময় লেগেছে। তাকে খুব অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ নেপালে রাজতন্ত্র কায়েম ছিল ২৭০ বছর ধরে। সেই বৃত্ত থেকে বেরুনো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেক আলাপ আলোচনা আর বিতর্ক শেষে ১৯১৫ সালের ৩০ অক্টোবর নেপালের প্রথম গণতান্ত্রিক সংবিধান সাংবিধানিক পরিষদে গৃহীত হয়। নেপালের ৬০১ সদস্যের এই পরিষদে ৫০৭ সদস্যই সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন এবং সংসদে সংবিধান গৃহীত হয়। বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র থেকে নেপাল প্রজাতন্ত্রে রূপ নেয়। ভারত ও নেপালের মধ্যকার সঙ্কটের শুরু হয় সেখান থেকেই।
নেপালের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে। নেপালের দক্ষিণাঞ্চলের তেরাইতে মাধেসী বলে এক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে ষাটের দশক থেকে। তেরাই অঞ্চল নেপালের সমতল ভূমি ও অত্যন্ত উর্বর এলাকা। ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক লোককে দিল্লী ঐ এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তারা এসে বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করে। এখানে নেপালিরাও চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। নেপালের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ এই তেরাই অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ২০ ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাধেসী। নেপালের রাজতন্ত্রের আমলে আশির দশকে রাজা ভারতীয় বংশোদ্ভূত অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে রাজতন্ত্র অবসানের হুমকি প্রদান করেন। বরং ভারতের অবৈধ অভিবাসীদের আত্মীকরণের জন্য নেপালের রাজাকে চাপ দেন। নিজের গদী রক্ষার জন্য রাজা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। ভারতীয় মাধেসীরা আসন গেড়ে বসে।
এখানে ভারতীয় পরিকল্পনা কারও কাছে অস্পষ্ট ছিলো না। তাদের লক্ষ্য ছিলো, ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে তারা কোনোদিন মণিপুর বা সিকিমের মতো নেপালের তেরাই অঞ্চল দখল করে নেবে। আর নেপাল দখল করতে পারলে তাদের পক্ষে চীনকে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হয়ে উঠবে। নেপালের রাজার ওপর ঐ চাপ সৃষ্টির পর থেকে ভারত অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নেপালে মাধেসীদের বসতি বাড়াতে শুরু করে। কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিষয়টির প্রতি তারা মনোযোগী হয় এবং মাধেসী জনসংখ্যা নেপালে যাতে আর বাড়তে না পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে আগের মতো ধমক দিয়ে ফায়দা হাসিলের পরিবেশ আর নেপালে নেই। ফলে এ যাত্রা ভারত নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তার একটি নেপালের নবগঠিত সংবিধান সংশোধন। এই সংশোধনের মাধমে ভারত মাধেসীদের জন্য অধিক আসন ও স্বতন্ত্র প্রদেশ তৈরি করতে চায়।
নেপালের ৬০১ আসনের সাংবিধানিক পরিষদ দীর্ঘ আট বছর আলাপ-আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত সংবিধানের ওপর ভোটাভুটি করে। তাতে সকল দলের মোট ৫০৭ জন ঐ খসড়া সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন আর ৯৪ জন এর বিরুদ্ধে ভোট দেন। আবার এই সাংবিধানিক পরিষদে মাধেসীদের ভোট সংখ্যা ছিল ১১৬। তাদের মধ্যে ভোটাভুটির সময় ১১১ জন নয়া সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন। অর্থাৎ মাধেসীরাও ব্যাপকভাবে এই সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন। এখানেই প্রমাদ গোণে ভারত সরকার। ভারত দেখতে পায় যে নেপালের ওপর চাপ প্রয়োগের এত বড় একটা হাতিয়ার তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আর তাই তারা মাধেসী দলগুলোর নেতাদের দিল্লীতে ডেকে নিয়ে এবং কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতাবাসে বৈঠক করে সংবিধানের বিরুদ্ধে তাদের উস্কে দিতে থাকে। আর এই সুযোগে নেপালকে মাধেসীদের অসঙ্গত দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ভারত চাপ দিতে শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে ভারত গত বছর প্রচণ্ড শীতের মধ্যে নেপালে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ আরোপ করে রাখে। নেপালে জ্বালানি তেল, খাদ্যশস্য, শাকসবজি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু নেপালের সাধারণ মানুষ এতে দমে যাননি। তারা সকল কষ্ট সহ্য করেও নিজেদের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে যান। নেপাল তার জ্বালানি তেলের জন্য শতভাগ নির্ভরশীল ভারতের ওপর। রান্নার গ্যাসও আসে ভারত থেকে। ভারত সেই জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ওলি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চীন আপৎকালের জন্য প্রায় ৫০ লক্ষ্য লিটার জ্বালানি স্থলবেষ্টিত নেপালকে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে উপহার দেয়। সেই সঙ্গে সরবরাহ করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধও। দেয় লাখ লাখ সিলিন্ডার গ্যাস। জ্বালানি তেলে রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। নেপালীরা এমনিতেই কষ্টসহিষ্ণু জাতি। তারা পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে শুরু করেন। নিজেদের ঊষ্ণ রাখার জন্য ও রান্নার জন্য তারা গ্যাসের বদলে ব্যবহার করতে শুরু করেন জ্বালানি কাঠ। সরকার সে কাঠ রেশন ব্যবস্থায় জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। ভারতের ওপর বাড়ে আন্তর্জাতিক চাপ।
আবার মাধেসীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভারত তার সীমান্তের ভেতরে মাধেসীদের জন্য তৈরি করে দেয় অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে আন্দোলনকারীদের জন্য রান্না ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। মাধেসীরা নেপালের ভেতরে ঢুকে নানা ধরনের নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। এক সময় এসব মাধেসী আন্দোলনের বদলে নানা ধরনের নিত্যপণ্যের চোরাচালানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার আন্দোলন করার জন্য লোকেরও অভাব দেখা দেয়। আন্দোলন করে না হয় তাদের নিজেদের পেট চলছিল, কিন্তু তাদের পরিবার পরিজনের খাওয়া-পরার জন্য তো অর্থের দরকার। কাজ দরকার। ফলে ধীরে ধীরে ভারতের তৈরি করা আন্দোলনের ক্যাম্প ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। লোকের অভাবে মাধেসীদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভারতীয় পণ্যের সরবরাহ ফের শুরু হয়।
নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি সম্পাদন করেন। তার মধ্যে আছে রেল ও সড়ক যোগাযোগ চুক্তি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের সরবরাহ চুক্তি। যাতে ভবিষ্যতে ভারতের এ ধরনের চাপ প্রয়োগের বিপরীতে নেপালের সরবরাহ লাইন একেবারে বন্ধ হয়ে না যায়। চীনের সঙ্গে নেপালের এই চুক্তি ভারত ভালোভাবে নেয়নি। ফলে তারা ওলি সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হয়। ওলি নেপালের মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল ওরফে প্রচণ্ডকে নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। প্রচণ্ড ওলির কোয়ালিশন থেকে বের হয়ে এসে এখন নেপালি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছেন। শর্ত হলো যে, উভয় দল এগারো মাস করে ক্ষমতায় থেকে নতুন নির্বাচন দেবেন। উল্লেখ্য, নেপালে নতুন সংবিধান গ্রহণের সময় নেপালি কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। এখনও কাঠমান্ডু দিল্লীর সম্পর্ক নিয়ে নানা টানাপোড়েন চলছে। মাধেসীরা সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েই যাচ্ছে। কূটনৈতিক উদ্যোগও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মাধেসীদের দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের বড় ধরনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এর মধ্যেই নেপাল সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। তার বার্তাও একই ছিল। নেপাল যেন মাধেসীদের দাবি অনুযায়ী তাদের সংবিধান দ্রুত সংশোধন করে নেয়। তার এই বক্তব্যে নেপালের সাধারণ মানুষ ও পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, সংবিধান সংশোধনকামী কিছুসংখ্যক ভারতীয় বংশোদ্ভূত’র মাধ্যমে দিল্লী নেপালের অখণ্ডতা ধ্বংস করতে চায়। তাদের আশঙ্কা, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারত কার্যত নেপালের উর্বর ও সমতলভূমি দখল করে নিতে চায়। বস্তুত প্রণব মুখার্জি নেপাল ত্যাগের আগে সেখানকার রাজনীতিকদের প্রতি এই আহ্বান জানিয়ে গেছেন যে, তারা যেন মাধেসীদের দাবি অনুযায়ী দ্রুত নেপালের সংবিধান সংশোধন করে।
আসলে প্রণবের এই নেপাল সফরে কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। ভারতীয় পত্রিকা ফার্স্টপোস্ট লিখেছে, নেপাল ও ভারতের প্রেসিডেন্টের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে দু’দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান, জনগণের মৈত্রী প্রভৃতি বিষয় স্থান পেলেও তাদের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নেপালের সংবাদপত্রগুলো বরং প্রণবের সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনাই করেছে। মিডিয়া বলেছে, এটা অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে নেপালের জনগণের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, প্রণবের সঙ্গে আলোচনায় সে বিষয়টি স্থান না পাওয়ায় নেপালের রাজনীতিকরা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল তার ভারত সফরের আগে সংবিধানের কিছু সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানের প্রধান বিরোধী দল ওলির সিপিএন ইউএমএল ও তার মিত্রদের বাধায় তা করতে পারেননি। অথচ এই দাহালই গত বছর বলেছিলেন, ‘সংবিধান গ্রহণ করে আমরা কেবল আমাদের সাংবিধানিক অধিকারই প্রতিষ্ঠা করেছি। কারও চাপের কাছে আমরা নতি স্বীকার করবো না। এটা আমাদের বিবেক ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। এবার নেপালি জনগণ তাদের নিজেদের সংবিধান নিজেরাই প্রণয়ন করেছে। এটা ছিল আমাদের ৭০ বছরের স্বপ্ন।’
তবে সিপিএন ইউএমএল-এর সমর্থন ছাড়া নেপালের সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। ওলির দল ও তাদের সহযোগী আরপিপি-এন ২০০ আসনের অধিকারী। ওলি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সংবিধান সংশোধনে সায় দেবেন না। সংবিধান সংশোধন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার। নেপালের সংসদে সদস্য সংখ্যা ৫৯৫। এ ছাড়াও নেপাল মজদুর কিষাণ পার্টি, সিপিএন-এমএল, ন্যাশনাল পিপলস ফ্রন্ট জানিয়েছে, তারা সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ভোট দেবেন না। এ ছাড়াও ভারতপন্থী বলে পরিচিত নেপালি কংগ্রেসের তরুণ সদস্যরাও সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ভোট দেবেন না বলে প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন। ওলি সরকারের পতন ঘটিয়ে ও সংবিধান সংশোধনের পক্ষ নিয়ে কাঠমান্ডু ভ্যালিতে মাওবাদী ও নেপালি কংগ্রেস তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। নাম প্রকাশ না করে নেপালি কংগ্রেসের এক নেতা বলেছেন, ‘এখানে গত নির্বাচনে তারা ১১টি আসন পেয়েছিলেন, সামনের নির্বাচনে তিনটি আসনও পাবেন না।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads