বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬

পরিবর্তনটা আগে কোথায় হওয়া প্রয়োজন?


আবারও হামলা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। ৪ নবেম্বর ভোর রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাংচুর ও লুটপাটের ৫ দিন পর একই উপজেলায় দ্বিতীয় দফায় এ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলো। এসব ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৩ নেতাকে বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। নাসিরনগরের পর হামলার ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জের মধুপুর মন্দির ও বরিশালের বানারীপাড়া পৌরসভার কেন্দ্রীয় হরিসভা মন্দিরে। এ ছাড়া হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ঠাকুরগাঁও সদরের একটি মন্দিরে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নারগুন ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান পয়গাম আলিকে পুলিশ আটক করেছে। বগুড়ার ধুনটের ইছামতী নদীর তীরে কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাট সংলগ্ন মন্দির থেকে চুরি হয়ে গেছে চারটি প্রতিমার মাথা। হঠাৎ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন।
আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। শত শত বছর ধরে এই জনপদের মানুষ নানা ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। আর এই দেশের একটি ইতিবাচক বিষয় হলো, জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই মুসলিম। মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে শুধু সদাচরণেই উদ্বুদ্ধ করেনি, অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকারও নির্দেশনা দিয়েছে। এ কারণে অন্য ধর্মের লোকদের উপর হামলা কিংবা নিপীড়ন ইসলাম ধর্মে গর্হিত বা গুনাহের কাজ। ফলে প্রশ্ন জাগে, এরপরও এ দেশে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালালো কারা? এদের পরিচয় কি? কী তাদের উদ্দেশ্য? তবে একটি বিষয় সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ইসলাম ধর্মে অনুরাগী কিংবা ধর্মপ্রাণ কোন মুসলমান এই ধরনের হামলার সাথে জড়িত থাকতে পারে না। এ কাজ যারা করেছে তারা অবশ্যই মন্দ লোক। ধর্ম ভাবনায় সমৃদ্ধ কোন মানুষ এমন কাজ করতে পারে না। এসব মন্দ লোকদের আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রশাসনের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। তবে সঙ্গত এই কাজটি করতে হলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ব্লেমগেম থেকে মুক্ত থাকতে হবে। যথাযথ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা বন্ধ হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার মতো লোকও আছে এ দেশে। মতলববাজ এমন লোকদের অপপ্রচার ও শঠতার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে দেশের জনগণকে। কিছু কিছু অদ্ভুত কথাও শোনা যাচ্ছে বর্তমান সময়ে। যেমন ৪ নবেম্বর রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগে জামায়াতীকরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের ভেতরে জামায়াতে ইসলামীর লোকজন ঢুকে পড়েছে। তারা সাম্প্রদায়িক হামলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমন বক্তব্য জনমনে নানা সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে আদৌ কোন অবদান রাখতে সক্ষম হবে কিনা সেই প্রশ্ন জাগতেই পারে। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বক্তব্য রাখার পরিবর্তে কিছু রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ব্লেম-গেমে মত্ত থাকতেই পছন্দ করছেন। জাতির জন্য এটাও একটি বড় আপদ।
আমরা মনে করি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে কা’বা শরীফের ছবির উপর মূর্তি বসিয়ে পবিত্র কা’বার অবমাননার যে কাজটি করা হয়েছে তা খুবই আপত্তিকর। কেন এ কাজটি করা হলো? সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে প্রকৃত মোটিভ উদ্ধার করা প্রয়োজন। আর এই ঘটনাকে পুঁজি করে যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো ন্যক্কারজনক কাজ করেছে তাদেরও আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করা প্রয়োজন। কারণ দু’টি কাজই ধর্ম ও মানবিক বিবেচনায় নিকৃষ্ট কাজ। এমন কাজের কারণে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে এবং ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশের ভাবমর্যাদা। তাই এসব বিষয়ে সততার সাথে ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক কোন্দল ঘটনার সাথে জড়িয়ে যাওয়ায় সততার বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ভারত। এ উদ্বেগের কথা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। খবর পিটিআইএর। উল্লেখ্য যে, ৬ নবেম্বর এক টুইট বার্তায় সুষমা স্বরাজ লিখেছেন, আমি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানাতে বলেছি। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ফেসবুকে দেওয়া ধর্মীয় অবমাননাকর একটি ছবিকে কেন্দ্র করে ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ২০টি হিন্দু বাড়ি ও ১৫টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুলিশ ইতোমধ্যে ৫৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযান এখনও অব্যাহত রয়েছে। নাসিরনগরের ইউএনওকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। উপজেলা সদরসহ বিভিন্নস্থানে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবিসহ অন্তত ৫০০ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
নাসিরনগর উপজেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনা শুধু অন্যায় নয়, ন্যক্কারজনকও। এলাকার জনগণ এবং দেশের মানুষ ওই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ও রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এলাকার মন্ত্রী ঘটনাকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিহিত করেছেন। পদবঞ্চিতদের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন তিনি। খবরে দলীয় কোন্দলের বিষয়টিও উঠে এসেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় নাসিরনগরে তা লক্ষ্য করা যায়নি। যথাযথ তদন্ত শেষে বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে এবং প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলে আমরা আশা করি।
নাসিরনগর উপজেলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি ভারতীয় হাইকমিশনারকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগের কথা জানাতে বলেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে যে ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেন তাতে আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নাসিরনগর উপজেলার সব মানুষ তো বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিকদের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তাবিধান সরকারের দায়িত্ব। সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে তার দায়িত্ব পালন করে থাকে। যারা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে এভাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের কী কারণ থাকতে পারে? আলোচ্য ঘটনায় তো একজন মানুষেরও প্রাণহানি হয়নি। তবে যা হয়েছে তার বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষপাতি আমরা। যে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, প্রসঙ্গত সেই দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কেও প্রশ্ন এসে যায়। ভারতের মত এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৃথিবীর আর কোথায়ও হয় কী। গরুর গোস্ত খাওয়ার অপরাধে তো ভারতে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কুরবানির গোস্ত বহন করার অপরাধে ভারতে নারী ও শিশুদের ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন। কই এইসব বিষয় নিয়ে তো বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। তবে করলে ভালো হতো। কারণ কোথায়ও সীমালঙ্ঘন হলে, বাড়াবাড়ি হলে এবং সংশ্লিষ্ট সরকার যৌক্তিক পদক্ষেপ না নিলে, সে ক্ষেত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করা অবশ্যই মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কিছু হয়েছে কী? আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে যে মাত্রায় সচেতন ও আন্তরিক, তারপরও তার সরকারকে এভাবে উদ্বেগ জানানোর বিষয়টি আমাদের কাছে সম্মানজনক বলে মনে হয়নি। কিছুটা অযৌক্তিক বলেও মনে হয়েছে।
মানুষ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, সৌন্দর্য সম্পর্কে চমৎকার চমৎকার সংজ্ঞা আছে। কিন্তু দুঃখের বিয় হলো, বর্তমান সময়ের রাজনীতি আমাদের সেখানে পৌঁছতে দিচ্ছে না। এই বিষয়টি আমরা দেশে, উপমহাদেশে এবং লক্ষ্য করছি বৈশ্বিক পরিমন্ডলেও। নাসির নগরের মত ঘটনা নানা বর্ণে নানা মাত্রায় আমরা বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করছি। এই ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের করণীয় আছে। তবে রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের রয়েছে প্রচুর অভিযোগ। এই সব অভিযোগ থেকে মুক্ত না হয়ে তারা গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে কাজ করতে সক্ষম হবেন কী? অর্থাৎ আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছি। তবে এখানে একটি প্রশ্ন জাগে- পরিবর্তনটা আগে কোথায় হওয়া প্রয়োজন? আচরণে, নাকি বচনে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads