জাতিগত নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে এবার ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা জানিয়েছে, স্যাটেলাইটে সেসব ভস্মীভূত গ্রামের ছবি ধরা পড়েছে। ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘের প্রতি সংগঠনটি আহ্বান জানিয়েছে বলে জানায় আল-জাজিরা। ১২ নবেম্বর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নবেম্বরের মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় মংগদাউ জেলার তিনটি গ্রামে ৪৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নতুন স্যাটেলাইট ইমেজ রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শনই শুধু প্রকাশ করেনি বরং এটাও নিশ্চিত করেছে যে, আমরা আগে যা ভেবেছিলাম পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ।’ এইচ আর ডব্লিউ’র তথ্য অনুযায়ী যে তিনটি গ্রাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো হলো- পায়উংপিত, কিয়েতইযোপিন এবং ওয়াপেইক। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখানে ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়া, নারীদের ধর্ষণসহ নানান ধারার শারীরিক মানসিক নিপীড়ন চলছে।
সম্প্রতি সিএনএন মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘শ্যুট ফার্স্ট আস্ক কোয়েশ্চেন লেটার’। এদিকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান যিনি রাখাইন স্টেটে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত অ্যাডভাইজারি কমিশনের প্রধান তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, উত্তর রাখাইন এলাকায় সাম্প্রতিক সহিংসতা গভীর উদ্বেগজনক যা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এ ঘটনায় নতুন করে মানুষ ঘর-বাড়ি ছাড়া হচ্ছে। রাখাইন অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মুসলমান থাকলেও তাদের কোনো নাগরিক স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। তারা স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করতে না পারায় কাজকর্মও করতে পারছে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জমি বা সম্পদের কোনো অধিকার নেই। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের হামলায় বেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও তাদের ফেরত নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এদের অনেকে সাগর পথে পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়ার অভিযাত্রায় ক্ষুধায় ও নৌকাডুবিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
রাখাইন স্টেটে গত মাস থেকে শুরু করা অভিযানে সেনা সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকরাও। অভিযানের সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকেও রাখাইন স্টেটে গুলিবর্ষণ করা হয়। তারা ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কমপক্ষে আড়াই হাজার বাড়ি ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। গুলিবর্ষণে ও আগুনে পুড়ে মারা গেছে প্রায় তিনশ’ জন। আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মা ছেলেকে নিয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন মার কাছ থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের যেন কোন শেষ নেই। মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্বল্পমাত্রায় কিছু উহ্-আহ্ করছে কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও হত্যাযজ্ঞ বন্ধে বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যৌক্তিক ও কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করছে না। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অংসান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং নির্বাচনের আগে-পরে ফাঁস হয়েছে সু চির মুসলিমবিদ্বেষী নানা কথা। নির্বাচনে তিনি কোন মুসলমানকে প্রার্থীও করেননি। ফলে প্রশ্ন জাগে ভেতর বা বাইরে থেকে তথা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কি রোহিঙ্গা মুসলমানদের মুক্তির কিংবা মানুষের মত বাঁচার কোনো বার্তা নেই? এমন প্রশ্নের মধ্যে অন্য একটি বার্তা আছে। আর তা হলো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, সভ্যতা ঠিক পথে চলছে না।
এক সময় বলা হতো, সব কবি কবি নয়, কেউ কেউ কবি। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় এখন আবার অনেকে বলছেন, সব মানুষ মানুষ নয়, কেউ কেউ মানুষ। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরীহ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকাণ্ড দেখে এমন উপলব্ধি খুবই সঙ্গত। বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষণের সাথে সাথে তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু কথাবার্তা বললেও বিশ্বের প্রতাপশালী রাষ্ট্রগুলো নীরব। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কিছু মানুষের জীবন খুবই মূল্যবান, আর অনেক মানুষের জীবনের কোন দামই নেই। আলো ঝলমলে ও বিজ্ঞানমনস্ক বর্তমান পৃথিবীতে এমন বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা কেমন করে চলছে তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। এক সময় ভাবা হতো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অকথ্য জুলুম নির্যাতন চলতে পারছে। গণতন্ত্রমনা নেত্রী অং সান সুচির ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন ক্ষমতার পরিবর্তন হলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনে মুক্তি আসতে পারে। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল তো হলো কিন্তু রোহিঙ্গাদের জীবনে কোন পরিবর্তন এলো না। মন-মানসিকতায় অংসান সু চিও উদারতার পরিচয় দিতে সক্ষম হননি। বরং তার মধ্যেও মুসলিম বিদ্বেষ কাজ করছে।
অং সান সু চির মুখোশ ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। ফলে তার কৃত্রিম ইমেজের পালকও খসে পড়ছে। সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনলাইন আবেদনে ইতিমধ্যে স্বাক্ষর করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ব্যাপারে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই আবেদন জানানো হয়। নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি, যারা এ পুরস্কার দেয় তাদের প্রতি আবেদনে এ পুরস্কার প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে চেঞ্জ ডট অরগে এই আবেদনটি করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদেরই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। সু চির মতো যারা এই পুরস্কার পান তারা শেষ দিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা, নয় ফিরিয়ে নেয়া।’
লক্ষাধিক মানুষের অং সান সু চির নোবেল প্রত্যাহারের দাবিটি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলমাদের ব্যাপারে সঙ্গত ভূমিকা পালনে সু চি ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ অবাক হয়েছে। সু চি যে ইমেজ সংকটে পড়ে গেছেন তা তিনি এবং তার দল কতটা উপলব্ধি করতে পারছেন তা আমরা জানি না। তবে লক্ষাধিক মানুষ তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের যে দাবি জানিয়েছেন তা তিনি এড়িয়ে যাবেন কেমন করে? বিষয়টি যে শুধু তার নিজের এবং দলের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রের জন্যও তা কলঙ্কজনক। আর দেশে-দেশে যদি সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া হয়, তাহলে এ পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে কেমন করে? আর আখেরে ওই অপকর্মগুলো মিয়ানমারের জন্যও কি কোন শুভ ফল বয়ে আনবে? এ বিষয়টি নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি বুঝতে সক্ষম না হলে তার নোবেল প্রত্যাহার করাই সমীচীন বলে আমরা মনে করি।
২৩ নবেম্বর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলা অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যটিতে জঙ্গি নিধনের নামে নির্বিচারে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। গত মাসে সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন শুরুর পর আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদেরও রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমার পৌঁছার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিধি দলটি পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, উদ্বিগ্ন এই সব মানুষ দেখা করলে, কথা বললে কি পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে?
এমন প্রশ্নের কারণ আছে। মিয়ানমারের সবচেয়ে পরিশীলিত ও গণতন্ত্রমনা মানুষ হিসেবে পরিচিত নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির চিন্তা-চেতনা ও মনোভঙ্গি এখন বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে : মিয়ানমারের নতুন সরকার জনগণের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছিল। অনেকে আশা করেছিলেন সু চি হয়তো রোহিঙ্গাদের সংকট দূর করবেন।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যা আশা করা হয়েছিল তা ছিল ভুল। কারণ অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে বিবেচনা করছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাঙালি। তিনি আরও বলেছেন, পুলিশের ওপর হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর এই অভিযান চলছে আইনের ওপর ভিত্তি করে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে যে চিত্র ফুটে উঠলো, তাতে মনে হচ্ছে, সু চি যেন মুক্ত বায়ুর অক্সিজেন নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সুরে সুর মিলাবার শপথ নিয়েছেন। বিশেষত তিনি যখন বলেন, রোহিঙ্গারা বিদেশি এবং বাঙালি, তখন বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকে। নোবেল বিজয়ী একজন মানুষ ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে এমন মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা কী করে বলেন? তিনি যে নোবেলের অযোগ্য তা আবারও প্রমাণ করলেন। সুন্দর মুখের আড়ালে এমন অসুন্দর মন কী করে লুকিয়ে থাকে?
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি, উদ্বেগ প্রকাশ ও আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাঁচানো যাবে না। এখন প্রয়োজন, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা তো বেশ শক্তিশালী। বিশ্ববাসী ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ায় তাদের শক্তিমত্তার প্রমাণ পেয়েছে। জল্লাদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সেই শক্তির কিঞ্চিৎ প্রয়োগে তো কোনো আপত্তি থাকার কারণ নেই। বরং এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে পারবেন যে, তাদের উদ্বেগ প্রকাশটা খাঁটি ছিল এবং তারা যথার্থই মানবতাবাদী।
সম্প্রতি সিএনএন মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘শ্যুট ফার্স্ট আস্ক কোয়েশ্চেন লেটার’। এদিকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান যিনি রাখাইন স্টেটে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত অ্যাডভাইজারি কমিশনের প্রধান তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, উত্তর রাখাইন এলাকায় সাম্প্রতিক সহিংসতা গভীর উদ্বেগজনক যা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এ ঘটনায় নতুন করে মানুষ ঘর-বাড়ি ছাড়া হচ্ছে। রাখাইন অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মুসলমান থাকলেও তাদের কোনো নাগরিক স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। তারা স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করতে না পারায় কাজকর্মও করতে পারছে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জমি বা সম্পদের কোনো অধিকার নেই। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের হামলায় বেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও তাদের ফেরত নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এদের অনেকে সাগর পথে পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়ার অভিযাত্রায় ক্ষুধায় ও নৌকাডুবিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
রাখাইন স্টেটে গত মাস থেকে শুরু করা অভিযানে সেনা সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকরাও। অভিযানের সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকেও রাখাইন স্টেটে গুলিবর্ষণ করা হয়। তারা ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কমপক্ষে আড়াই হাজার বাড়ি ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। গুলিবর্ষণে ও আগুনে পুড়ে মারা গেছে প্রায় তিনশ’ জন। আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মা ছেলেকে নিয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন মার কাছ থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের যেন কোন শেষ নেই। মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্বল্পমাত্রায় কিছু উহ্-আহ্ করছে কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও হত্যাযজ্ঞ বন্ধে বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যৌক্তিক ও কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করছে না। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অংসান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং নির্বাচনের আগে-পরে ফাঁস হয়েছে সু চির মুসলিমবিদ্বেষী নানা কথা। নির্বাচনে তিনি কোন মুসলমানকে প্রার্থীও করেননি। ফলে প্রশ্ন জাগে ভেতর বা বাইরে থেকে তথা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কি রোহিঙ্গা মুসলমানদের মুক্তির কিংবা মানুষের মত বাঁচার কোনো বার্তা নেই? এমন প্রশ্নের মধ্যে অন্য একটি বার্তা আছে। আর তা হলো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, সভ্যতা ঠিক পথে চলছে না।
এক সময় বলা হতো, সব কবি কবি নয়, কেউ কেউ কবি। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় এখন আবার অনেকে বলছেন, সব মানুষ মানুষ নয়, কেউ কেউ মানুষ। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরীহ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকাণ্ড দেখে এমন উপলব্ধি খুবই সঙ্গত। বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষণের সাথে সাথে তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু কথাবার্তা বললেও বিশ্বের প্রতাপশালী রাষ্ট্রগুলো নীরব। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কিছু মানুষের জীবন খুবই মূল্যবান, আর অনেক মানুষের জীবনের কোন দামই নেই। আলো ঝলমলে ও বিজ্ঞানমনস্ক বর্তমান পৃথিবীতে এমন বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা কেমন করে চলছে তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। এক সময় ভাবা হতো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অকথ্য জুলুম নির্যাতন চলতে পারছে। গণতন্ত্রমনা নেত্রী অং সান সুচির ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন ক্ষমতার পরিবর্তন হলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনে মুক্তি আসতে পারে। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল তো হলো কিন্তু রোহিঙ্গাদের জীবনে কোন পরিবর্তন এলো না। মন-মানসিকতায় অংসান সু চিও উদারতার পরিচয় দিতে সক্ষম হননি। বরং তার মধ্যেও মুসলিম বিদ্বেষ কাজ করছে।
অং সান সু চির মুখোশ ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। ফলে তার কৃত্রিম ইমেজের পালকও খসে পড়ছে। সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনলাইন আবেদনে ইতিমধ্যে স্বাক্ষর করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ব্যাপারে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই আবেদন জানানো হয়। নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি, যারা এ পুরস্কার দেয় তাদের প্রতি আবেদনে এ পুরস্কার প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে চেঞ্জ ডট অরগে এই আবেদনটি করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদেরই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। সু চির মতো যারা এই পুরস্কার পান তারা শেষ দিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা, নয় ফিরিয়ে নেয়া।’
লক্ষাধিক মানুষের অং সান সু চির নোবেল প্রত্যাহারের দাবিটি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলমাদের ব্যাপারে সঙ্গত ভূমিকা পালনে সু চি ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ অবাক হয়েছে। সু চি যে ইমেজ সংকটে পড়ে গেছেন তা তিনি এবং তার দল কতটা উপলব্ধি করতে পারছেন তা আমরা জানি না। তবে লক্ষাধিক মানুষ তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের যে দাবি জানিয়েছেন তা তিনি এড়িয়ে যাবেন কেমন করে? বিষয়টি যে শুধু তার নিজের এবং দলের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রের জন্যও তা কলঙ্কজনক। আর দেশে-দেশে যদি সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া হয়, তাহলে এ পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে কেমন করে? আর আখেরে ওই অপকর্মগুলো মিয়ানমারের জন্যও কি কোন শুভ ফল বয়ে আনবে? এ বিষয়টি নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি বুঝতে সক্ষম না হলে তার নোবেল প্রত্যাহার করাই সমীচীন বলে আমরা মনে করি।
২৩ নবেম্বর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলা অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যটিতে জঙ্গি নিধনের নামে নির্বিচারে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। গত মাসে সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন শুরুর পর আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদেরও রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমার পৌঁছার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিধি দলটি পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, উদ্বিগ্ন এই সব মানুষ দেখা করলে, কথা বললে কি পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে?
এমন প্রশ্নের কারণ আছে। মিয়ানমারের সবচেয়ে পরিশীলিত ও গণতন্ত্রমনা মানুষ হিসেবে পরিচিত নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির চিন্তা-চেতনা ও মনোভঙ্গি এখন বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে : মিয়ানমারের নতুন সরকার জনগণের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছিল। অনেকে আশা করেছিলেন সু চি হয়তো রোহিঙ্গাদের সংকট দূর করবেন।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যা আশা করা হয়েছিল তা ছিল ভুল। কারণ অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে বিবেচনা করছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাঙালি। তিনি আরও বলেছেন, পুলিশের ওপর হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর এই অভিযান চলছে আইনের ওপর ভিত্তি করে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে যে চিত্র ফুটে উঠলো, তাতে মনে হচ্ছে, সু চি যেন মুক্ত বায়ুর অক্সিজেন নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সুরে সুর মিলাবার শপথ নিয়েছেন। বিশেষত তিনি যখন বলেন, রোহিঙ্গারা বিদেশি এবং বাঙালি, তখন বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকে। নোবেল বিজয়ী একজন মানুষ ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে এমন মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা কী করে বলেন? তিনি যে নোবেলের অযোগ্য তা আবারও প্রমাণ করলেন। সুন্দর মুখের আড়ালে এমন অসুন্দর মন কী করে লুকিয়ে থাকে?
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি, উদ্বেগ প্রকাশ ও আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাঁচানো যাবে না। এখন প্রয়োজন, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা তো বেশ শক্তিশালী। বিশ্ববাসী ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ায় তাদের শক্তিমত্তার প্রমাণ পেয়েছে। জল্লাদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সেই শক্তির কিঞ্চিৎ প্রয়োগে তো কোনো আপত্তি থাকার কারণ নেই। বরং এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে পারবেন যে, তাদের উদ্বেগ প্রকাশটা খাঁটি ছিল এবং তারা যথার্থই মানবতাবাদী।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন