বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে সরকার এ পর্যন্ত যা করেছে, তাতে সুস্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, এই টাকা চুরির সঙ্গে দেশের খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছেন। আর তারা এতই প্রভাবশালী যে, তাদের টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতা ‘রাবিশ-স্টুপিড’খ্যাত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতের অন্তত নেই। তার নানাবিধ আচরণে এখন আর অস্পষ্ট নেই যে, তিনি এই চুরির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের ও বাইরের চোরদের রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাই শেষ বার তিনি রাগত স্বরে বলে দিয়েছেন যে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে দেরি হবে, অনেক দেরি হবে।’ ভাবখানা এমন যে, এ টাকা তার পৈতৃক সম্পত্তি। তিনি এই টাকার বিষয়ে যা খুশি তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
কিন্তু তা তিনি পারেন না। তিনি এ টাকার আমানতকারী ছিলেন, খেয়ানত করেছেন। হিসাব অনুযায়ী অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টার জন্য এতোদিনে তার জেলে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আজব দেশ এই বাংলাদেশ। এখানে চোরেরাই কেবল সিনাজুরি করে বেড়ায়। মুহিত কেন তদন্ত রিপোর্ট একেবারে তার কোলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন, প্রকাশ করছেন না, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেন না। কেবল বলেন, প্রকাশ করা যাবে না। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পর্যন্ত কঠোর মন্তব্য করলো। কোনো কিছুই জনাব মুহিতকে স্পর্শ করলো না। এটা মাসতুতো ভাইদের গল্প ছাড়া আর কী হতে পারে।
এখানে এক আজব ঘটনা লক্ষ্য করা গেল। টাকাটা চুরি হলো এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান প্রায় এক মাস এই ঘটনা লুকিয়ে রেখে টাকাটা ফিলিপিন্সের জুয়াড়িদের মাধ্যমে লাপাত্তা হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে মার্চের মাঝামাঝি প্রকাশ করলেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে গেছে। তারপর অর্থমন্ত্রীর কাছে নয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ‘বীরের মতো’ পদত্যাগ করে চলে এলেন। আর প্রধানমন্ত্রী তার জন্য না টাকার শোকে অঝোর ধারায় কাঁদলেন। কেঁদেছেন যে, সেটা আতিউরই বলেছেন। তখন অর্থমন্ত্রীর সে কী নাচন-কুদন! গভর্নর আতিউরের ওপর তিনি এক হাত নিলেন। অন্য কোনো দেশ হলে আতিউরের কী কী হতে পারতো না পারতো, বললেন। রাগে অগ্নিশর্মা হলেন। শেষে মিশে গেলেন সেই গড্ডালিকা প্রবাহেই।
সরকার লোক দেখানোর জন্য আওয়ামী ঘরানার ব্যাংকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে এই চুরির ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করলো। এই কমিটি মে (২০১৬) মাসে নির্ধারিত সময়েই তাদের রিপোর্ট অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। অর্থমন্ত্রী জানান যে, শিগগিরই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সে ‘শিগগিরই’ এখন পর্যন্ত আসেনি। আর অর্থমন্ত্রীর সর্বশেষ কথায় মনে হলো, আর কোনোদিন আসবেও না। ড. ফরাসউদ্দিনের রিপোর্টে স্পষ্ট করেই বলা হয় যে, রাজকোষ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ কর্মকর্তা জড়িত। এদিকে সিআইডি’র তদন্ত টিমের প্রধান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অসাধু চক্রের সহায়তায় রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। ঐ অসাধু চক্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র মিলে ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে। সিআইডি’র তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির আগেই পর্যায়ক্রমে ২৩ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করেছিলেন। তারা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রিজার্ভ সার্ভার ব্যবহার করেন। চলতি মাসের জানুয়ারিতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করেন। তারা ব্যাংকের সার্ভার ব্যবহার করে ধীরে ধীরে এটিকে অরক্ষিত করে ফেলেন।
সিআইডি’র রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সার্ভারের সঙ্গে কোনো ইন্টারনেট যোগাযোগ ছিল না। হ্যাকারদের সহযোগিতা করতেই ঐসব বিদেশি নাগরিক সার্ভারে ইন্টানেট সংযোগ দেন। এরপর সুবিধামতো সময়ে রিজার্ভ সরিয়ে নিতে মাঠে নামেন। রিজার্ভ চুরি করতে তারা বিশ্বের অন্যতম দুর্বল ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহারকারী ম্যানিলার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক’কে বেছে নেন। তারপর টাকা রিজাল ব্যাংকে চলে যায়। আর সেখান থেকে জুয়াড়িদের হাত হয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা। সিআইডি’র সূত্রমতে বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় রিজার্ভ সার্ভার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারপর ৫ ফেব্রুয়ারি টাকা সরিয়ে ফেলে। সিআইডি বলেছে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ কর্মকর্তা জড়িত।
এরপর থেকে যতো লাফালাফি হচ্ছে, তার সবই হচ্ছে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত আনা নিয়ে। সেখানকার জুয়াড়িদের নিয়ে। টাকা কীভাবে হাওয়া হয়ে গেল, তা নিয়ে। সরকারের কথাবার্তায় মনে হতে থাকলো, একেবারে উড়োজাহাজ ভর্তি করে ফিলিপিন্স থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল টাকা ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরিতে কে সহায়তা করলো, কোন কোন বিদেশি এতে জড়িত ছিল, তার আর কী দরকার। টাকা তো আমরা পেয়েই গেছি।
আবার আমরা এই নিয়ে গবেষণায় বসেছি যে, কী কায়দায় পুরো টাকাটা জুয়াড়িদের হাতে গেলো। যেন, জুয়া খেলা একটি অত্যন্ত সৎ ও মহান পেশা। এখানে কোনো চালিয়াতি-জালিয়াতির ঠাঁই নেই। অথচ জুয়ার ব্যবসা মানেই জালিয়াতির ব্যবসা। কে কাকে কীভাবে ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে, এ ব্যবসা তারই প্রতিযোগিতা। তাই ২৩ ফেব্রুয়ারি খেলাটা এমনভাবে আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে পুরো টাকাটাই হ্যাকারদের অর্থাৎ চোরদের হাতে চলে যায়। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এই হলো আমাদের ‘বিবি তালাকের’ ফতোয়া খোঁজা! কিন্তু ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংক বাংলাদেশকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির কোনো দায়-দায়িত্ব নেবে না এবং সে টাকার এক পয়সাও ফেরত দেবে না।
রিজাল ব্যাংকের বক্তব্য হলো, এই টাকা চুরির জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়ী। টাকা চুরি হতে পেরেছে এসব কর্মকর্তার সহযোগিতায়। রিজাল ব্যাংক এই চুরির সঙ্গে কোনো পর্যায়েই জড়িত নয়। ক্লায়েন্টের টাকা এসেছে। তারা টাকা রেখে দিয়েছে। আবার ক্লায়েন্ট তার সুবিধাজনক সময়ে টাকাটা তুলে নিয়েছেন। এটাই ব্যাংকিং। আর তাই যতো দীর্ঘমেয়াদিই হোক, রিজাল ব্যাংক এই ফেরত দাবির বিরুদ্ধে তাদের আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে। রিজালের আইনজীবী সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িতদের সামনে আনতে স্বচ্ছভাবে তদন্ত ও প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, চুরির ঘটনার জন্য রিজাল দায়ী নয়। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলাই এর জন্য দায়ী। এর আগে ম্যানিলায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রিজাল ব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে। এ প্রেক্ষিতেই রিজালের আইনজীবী জানালেন যে, ক্ষতিপূরণের প্রশ্নই ওঠে না। কারণ চুরির তিনটি ধাপ পার হয়ে অর্থ তাদের ব্যাংকে এসেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন তাদের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান। তবে অর্থমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, কোনো অবস্থাতেই তাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে না। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতই যদি আপনাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হবে, তবে চুরি-যাওয়া টাকার জন্য ফিলিপিন্সে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? আবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বলেছেন যে, প্রয়োজনে প্রতিবেদন তাদের দেয়া হবে।
এখানে গুরুতর প্রশ্নটি অনালোচিতই থেকে যাচ্ছে। ড. ফরাসউদ্দিন ও সিআইডি’র তদন্ত প্রতিবেদনে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, এই চুরির ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে চোরদের সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ বা ৬ কর্মকর্তা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো রিপোর্টেই ঐ কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। আর এখন পর্যন্ত তাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও শোনা যায়নি। কারণ কী? তবে কি এই চোরেরা বা চোরদের সহযোগীরা অর্থমন্ত্রী, পুলিশ, র্যাব, সিআইডি প্রভৃতি সংস্থার চেয়েও অধিক শক্তিশালী? সে রকম শক্তিশালী কে আছে বাংলাদেশে? এ বিষয়ে ড. ফরাসউদ্দিন রয়টার্সকে বলেছেন যে, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন যে, যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি, সেহেতু ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেশ ভালো আছেন এই কর্মকর্তারা।
এবার আসা যায় চুরির ঘটনায় জড়িত ২৩ বিদেশি প্রসঙ্গে। আমরা এখন পর্যন্ত এসব ভাশুরেরও নাম নেইনি। কেন বলা যাবে না ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা ও তার ফটকা প্রতিষ্ঠান ‘ফায়ার আই’ সম্পর্কে? গভর্নর আতিউর রিজার্ভ চুরির কয়েক মাস আগে এই রাকেশ আস্তানাকে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায় আস্তানা কোনো আইটি বিশেষজ্ঞই নন। তার লোকজন যথেচ্ছ সার্ভার রুমে ঢুকে এবং নানা কারসাজি চালায়। তারা কারা ছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড আছে। ধরে ধরে তাদের নামও প্রকাশ করা যাচ্ছে না কেন? আবার এই চুরির ঘটনা ঘটার পর দেশের ভেতরে সে কথা গোপন রেখে গভর্নর আতিউর ভারতে গিয়েছিলেন কিসের পরামর্শের জন্য? ফিলিপিন্সে তোলপাড়ের আগে কেন তিনি প্রকাশ করেননি চুরির ঘটনা? এত বড় ঘটনার পরও আতিউর কী করে ধোয়া তুলশি পাতা রয়ে গেলেন?
সব কিছু আছে ঘরের ভেতরেই। কিন্তু ঘরের ভেতরে বাঘ প্রশ্রয় দিয়ে আমরা তাড়াচ্ছি বনের মোষ। ভূত রয়েছে সরষের ভেতরেই, আর আমরা ভূত খুঁজছি বনে বনে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
কিন্তু তা তিনি পারেন না। তিনি এ টাকার আমানতকারী ছিলেন, খেয়ানত করেছেন। হিসাব অনুযায়ী অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টার জন্য এতোদিনে তার জেলে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আজব দেশ এই বাংলাদেশ। এখানে চোরেরাই কেবল সিনাজুরি করে বেড়ায়। মুহিত কেন তদন্ত রিপোর্ট একেবারে তার কোলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন, প্রকাশ করছেন না, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেন না। কেবল বলেন, প্রকাশ করা যাবে না। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পর্যন্ত কঠোর মন্তব্য করলো। কোনো কিছুই জনাব মুহিতকে স্পর্শ করলো না। এটা মাসতুতো ভাইদের গল্প ছাড়া আর কী হতে পারে।
এখানে এক আজব ঘটনা লক্ষ্য করা গেল। টাকাটা চুরি হলো এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান প্রায় এক মাস এই ঘটনা লুকিয়ে রেখে টাকাটা ফিলিপিন্সের জুয়াড়িদের মাধ্যমে লাপাত্তা হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে মার্চের মাঝামাঝি প্রকাশ করলেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে গেছে। তারপর অর্থমন্ত্রীর কাছে নয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ‘বীরের মতো’ পদত্যাগ করে চলে এলেন। আর প্রধানমন্ত্রী তার জন্য না টাকার শোকে অঝোর ধারায় কাঁদলেন। কেঁদেছেন যে, সেটা আতিউরই বলেছেন। তখন অর্থমন্ত্রীর সে কী নাচন-কুদন! গভর্নর আতিউরের ওপর তিনি এক হাত নিলেন। অন্য কোনো দেশ হলে আতিউরের কী কী হতে পারতো না পারতো, বললেন। রাগে অগ্নিশর্মা হলেন। শেষে মিশে গেলেন সেই গড্ডালিকা প্রবাহেই।
সরকার লোক দেখানোর জন্য আওয়ামী ঘরানার ব্যাংকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে এই চুরির ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করলো। এই কমিটি মে (২০১৬) মাসে নির্ধারিত সময়েই তাদের রিপোর্ট অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। অর্থমন্ত্রী জানান যে, শিগগিরই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সে ‘শিগগিরই’ এখন পর্যন্ত আসেনি। আর অর্থমন্ত্রীর সর্বশেষ কথায় মনে হলো, আর কোনোদিন আসবেও না। ড. ফরাসউদ্দিনের রিপোর্টে স্পষ্ট করেই বলা হয় যে, রাজকোষ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ কর্মকর্তা জড়িত। এদিকে সিআইডি’র তদন্ত টিমের প্রধান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অসাধু চক্রের সহায়তায় রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। ঐ অসাধু চক্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র মিলে ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে। সিআইডি’র তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির আগেই পর্যায়ক্রমে ২৩ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করেছিলেন। তারা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রিজার্ভ সার্ভার ব্যবহার করেন। চলতি মাসের জানুয়ারিতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করেন। তারা ব্যাংকের সার্ভার ব্যবহার করে ধীরে ধীরে এটিকে অরক্ষিত করে ফেলেন।
সিআইডি’র রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সার্ভারের সঙ্গে কোনো ইন্টারনেট যোগাযোগ ছিল না। হ্যাকারদের সহযোগিতা করতেই ঐসব বিদেশি নাগরিক সার্ভারে ইন্টানেট সংযোগ দেন। এরপর সুবিধামতো সময়ে রিজার্ভ সরিয়ে নিতে মাঠে নামেন। রিজার্ভ চুরি করতে তারা বিশ্বের অন্যতম দুর্বল ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহারকারী ম্যানিলার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক’কে বেছে নেন। তারপর টাকা রিজাল ব্যাংকে চলে যায়। আর সেখান থেকে জুয়াড়িদের হাত হয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা। সিআইডি’র সূত্রমতে বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় রিজার্ভ সার্ভার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারপর ৫ ফেব্রুয়ারি টাকা সরিয়ে ফেলে। সিআইডি বলেছে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ কর্মকর্তা জড়িত।
এরপর থেকে যতো লাফালাফি হচ্ছে, তার সবই হচ্ছে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত আনা নিয়ে। সেখানকার জুয়াড়িদের নিয়ে। টাকা কীভাবে হাওয়া হয়ে গেল, তা নিয়ে। সরকারের কথাবার্তায় মনে হতে থাকলো, একেবারে উড়োজাহাজ ভর্তি করে ফিলিপিন্স থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল টাকা ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরিতে কে সহায়তা করলো, কোন কোন বিদেশি এতে জড়িত ছিল, তার আর কী দরকার। টাকা তো আমরা পেয়েই গেছি।
আবার আমরা এই নিয়ে গবেষণায় বসেছি যে, কী কায়দায় পুরো টাকাটা জুয়াড়িদের হাতে গেলো। যেন, জুয়া খেলা একটি অত্যন্ত সৎ ও মহান পেশা। এখানে কোনো চালিয়াতি-জালিয়াতির ঠাঁই নেই। অথচ জুয়ার ব্যবসা মানেই জালিয়াতির ব্যবসা। কে কাকে কীভাবে ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে, এ ব্যবসা তারই প্রতিযোগিতা। তাই ২৩ ফেব্রুয়ারি খেলাটা এমনভাবে আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে পুরো টাকাটাই হ্যাকারদের অর্থাৎ চোরদের হাতে চলে যায়। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এই হলো আমাদের ‘বিবি তালাকের’ ফতোয়া খোঁজা! কিন্তু ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংক বাংলাদেশকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির কোনো দায়-দায়িত্ব নেবে না এবং সে টাকার এক পয়সাও ফেরত দেবে না।
রিজাল ব্যাংকের বক্তব্য হলো, এই টাকা চুরির জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়ী। টাকা চুরি হতে পেরেছে এসব কর্মকর্তার সহযোগিতায়। রিজাল ব্যাংক এই চুরির সঙ্গে কোনো পর্যায়েই জড়িত নয়। ক্লায়েন্টের টাকা এসেছে। তারা টাকা রেখে দিয়েছে। আবার ক্লায়েন্ট তার সুবিধাজনক সময়ে টাকাটা তুলে নিয়েছেন। এটাই ব্যাংকিং। আর তাই যতো দীর্ঘমেয়াদিই হোক, রিজাল ব্যাংক এই ফেরত দাবির বিরুদ্ধে তাদের আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে। রিজালের আইনজীবী সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িতদের সামনে আনতে স্বচ্ছভাবে তদন্ত ও প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, চুরির ঘটনার জন্য রিজাল দায়ী নয়। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলাই এর জন্য দায়ী। এর আগে ম্যানিলায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রিজাল ব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে। এ প্রেক্ষিতেই রিজালের আইনজীবী জানালেন যে, ক্ষতিপূরণের প্রশ্নই ওঠে না। কারণ চুরির তিনটি ধাপ পার হয়ে অর্থ তাদের ব্যাংকে এসেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন তাদের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান। তবে অর্থমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, কোনো অবস্থাতেই তাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে না। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতই যদি আপনাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হবে, তবে চুরি-যাওয়া টাকার জন্য ফিলিপিন্সে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? আবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বলেছেন যে, প্রয়োজনে প্রতিবেদন তাদের দেয়া হবে।
এখানে গুরুতর প্রশ্নটি অনালোচিতই থেকে যাচ্ছে। ড. ফরাসউদ্দিন ও সিআইডি’র তদন্ত প্রতিবেদনে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, এই চুরির ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে চোরদের সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ বা ৬ কর্মকর্তা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো রিপোর্টেই ঐ কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। আর এখন পর্যন্ত তাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও শোনা যায়নি। কারণ কী? তবে কি এই চোরেরা বা চোরদের সহযোগীরা অর্থমন্ত্রী, পুলিশ, র্যাব, সিআইডি প্রভৃতি সংস্থার চেয়েও অধিক শক্তিশালী? সে রকম শক্তিশালী কে আছে বাংলাদেশে? এ বিষয়ে ড. ফরাসউদ্দিন রয়টার্সকে বলেছেন যে, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন যে, যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি, সেহেতু ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থমন্ত্রীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেশ ভালো আছেন এই কর্মকর্তারা।
এবার আসা যায় চুরির ঘটনায় জড়িত ২৩ বিদেশি প্রসঙ্গে। আমরা এখন পর্যন্ত এসব ভাশুরেরও নাম নেইনি। কেন বলা যাবে না ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা ও তার ফটকা প্রতিষ্ঠান ‘ফায়ার আই’ সম্পর্কে? গভর্নর আতিউর রিজার্ভ চুরির কয়েক মাস আগে এই রাকেশ আস্তানাকে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায় আস্তানা কোনো আইটি বিশেষজ্ঞই নন। তার লোকজন যথেচ্ছ সার্ভার রুমে ঢুকে এবং নানা কারসাজি চালায়। তারা কারা ছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড আছে। ধরে ধরে তাদের নামও প্রকাশ করা যাচ্ছে না কেন? আবার এই চুরির ঘটনা ঘটার পর দেশের ভেতরে সে কথা গোপন রেখে গভর্নর আতিউর ভারতে গিয়েছিলেন কিসের পরামর্শের জন্য? ফিলিপিন্সে তোলপাড়ের আগে কেন তিনি প্রকাশ করেননি চুরির ঘটনা? এত বড় ঘটনার পরও আতিউর কী করে ধোয়া তুলশি পাতা রয়ে গেলেন?
সব কিছু আছে ঘরের ভেতরেই। কিন্তু ঘরের ভেতরে বাঘ প্রশ্রয় দিয়ে আমরা তাড়াচ্ছি বনের মোষ। ভূত রয়েছে সরষের ভেতরেই, আর আমরা ভূত খুঁজছি বনে বনে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন