বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

জেলা পরিষদ নির্বাচন

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ প্রধান এবং ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি ও প্রতিবাদের প্রতি চরম উপেক্ষা দেখিয়ে নির্বাচন কামিশনের মাধ্যমে সরকার জেলা পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর আয়োজিত নির্বাচন নামের এই কার্যক্রমে অংশ নেয়নি এমনকি আওয়ামী জোটের কোনো দলও। শুধু তা-ই নয়, এরশাদের জাতীয় পার্টি এর বিরোধিতা করে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছে। অর্থাৎ একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরো একটি একদলীয় নির্বাচনের নজীর স্থাপিত হয়েছে। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নির্বাচন তাই বলে ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হতে পারেনি। কারণ, অন্য কোনো দল অংশ না নিলেও ছড়াছড়ি ছিল ‘বিদ্রোহী’ নামে পরিচিত প্রার্থীদের- যারা আসলে আওয়ামী লীগেরই লোকজন। এই ‘বিদ্রোহী’রা জিতেছেনও ১২টি জেলা পরিষদে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ২৫টিতে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক আসনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ঘটেছে। 
উল্লেখ্য, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী পার্বত্য তিন জেলা ছাড়া দেশের ৬১টি জেলা পরিষদে ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো দল বা ব্যক্তি অংশ না নেয়ায় আওয়ামী লীগের মনোনীতরা আগেই ২২টিতে চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। সে হিসাবে ৫৯টির মধ্যে দলটির মনোনীতজনেরা জিতেছেন ৪৭টিতে। চেয়ারম্যানের পাশাপাশি কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদেও সব মিলিয়ে ২৫৬ জন আগেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে রয়েছেন। এদের সঙ্গে এবার যুক্ত হবেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসা প্রার্থীরা। খবরে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো দুই থেকে চারজন ব্যক্তিও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এদের গণনায় নিলে আওয়ামী লীগের দলীয় চেয়ারম্যানের সংখ্যা কিছুটা কমে আসবে। এই কম-বেশিতে অবশ্য কোনো পার্থক্য ঘটবে না। কারণ, যেভাবেই হিসাব করা হোক না কেন, সকল চেয়ারম্যানই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের লোকজনই হবেন। প্রকৃতপক্ষে হয়ে গেছেনও। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের সসম্মানে দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। 
কেবল একতরফা নির্বাচনের কারণে নয়, জেলা পরিষদের এই নির্বাচনকেন্দ্রিক অন্য কিছু বিষয় নিয়েও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যেমন কোনো রাজনৈতিক দল অংশ না নিলেও এ নির্বাচন উপলক্ষে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। আগের দিন একটি জাতীয় দৈনিক তো প্রধান শিরোনামই করেছে, ‘জেলায় জেলায় উড়ছে টাকা’। অর্থাৎ ভোট কেনাবেচা হয়েছে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। এরই পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে সংঘাতের বিষয়টি। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সংঘাত ঘটেছে। কোনো কোনো জেলায় কয়েকটি পর্যন্ত কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিতও করতে হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো, সংঘাত-সহিংসতায় আসলে আওয়ামী লীগই এগিয়ে রয়েছে। 
আমরা মনে করি, অন্য কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় এবং বিপুল টাকার লেনদেন থেকে সংঘাত-সহিংসতা পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ২৮ ডিসেম্বরের জেলা পরিষদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তারও আগে রয়েছে নির্বাচনের বিশেষ পদ্ধতির বিষয়টি। কারণ, এই নির্বাচন প্রচলিত নিয়মের অনেক বাইরে গিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল। প্রাপ্তবয়স্ক সাধারণ মানুষকে এতে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। এর ভোটার ছিলেন শুধু ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যরা। মাস কয়েক আগে আইন সংশোধন করে সরকার এই ইলেক্টোরাল কলেজের প্রবর্তন করেছে। নতুন আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলর, সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের সমন্বয়ে ইলেক্টোরাল কলেজ গঠন করা হয়েছে। জেলা পরিষদের নির্বাচনে শুধু তারাই ভোট দেয়ার অধিকার পেয়েছেন যারা কোনো না কোনো স্থানীয় সরকার সংস্থায় নির্বাচিত হয়েছেন।
জেলা পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করে নতুন এই ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার ফলে সাধারণ মানুষ তো সংবিধান প্রদত্ত ভোটাধিকার হারিয়েছেই, একই সাথে গণতন্ত্রকেও ঝেঁটিয়ে বিদায় করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনীতিকদের পাশাপাশি বিশিষ্টজনেরাও বলেছেন, সরকার দেশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র করছে, যে ব্যবস্থায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। আইয়ুব খান পাকিস্তানের দুই প্রদেশে ৪০ হাজার করে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী বা বেসিক ডেমোক্র্যাট নির্বাচিত করার উদ্ভট পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন, যাদের বিডি মেম্বার বলা হতো। এই ৮০ হাজার বিডি মেম্বারই পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসহ সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে ভোটার হতো। তাদের নগদ অর্থ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে কেনা যেতো। কেনা হতও। একই কারণে বিডি মেম্বাররা সব সময় সরকারের পক্ষে থাকতো।
এই ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও পাকিস্তানের নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পদাংক অনুসরণ করতে শুরু করেছে। পর্যবেক্ষকরা আশংকা করছেন, জেলা পরিষদের নির্বাচনকে পরীক্ষামূলক মহড়া হিসেবে ব্যবহার করে সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই ইলেক্টোরাল কলেজকে ভোটার বা ইলেক্টর বানানোর চেষ্টা করতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের বিনাশ তো ঘটবেই, জনগণও হারিয়ে ফেলবে তাদের ভোটের অধিকার। আমরা তাই সংশোধিত জেলা পরিষদ আইনটি বাতিল করার দাবি জানাই। সরকারকে একই সাথে ২৮ ডিসেম্বর আয়োজিত নির্বাচনও বাতিল করতে হবে। ইলেক্টোরাল কলেজ বা নতুন কোনো গণতন্ত্র বিরোধী ব্যবস্থা নয়, আমরা চাই সকল বিষয়ে সংবিধানের বিধি-বিধান মেনে চলা হোক। সংবিধান জনগণকে যে ভোটের অধিকার দিয়েছে কোনো অজুহাতেই সে অধিকার কেড়ে নেয়া চলবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads