হোসাইন আনোয়ার : নতুন নতুন সংঘটিত ঘটনাবলী যা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রকাশিত, প্রচারিত, উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত হয় এবং যা জানতে জনগণ আগ্রহী ও কৌতূহলী তাই সংবাদ বা খবর। যে মাধ্যমে তা প্রচারিত বা প্রকাশিত হয় তাকে সংবাদমাধ্যম বলে। যারা এই সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত তাদেরকে সাংবাদিক বলা হয়। সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। সাংবাদিকরা সমাজের খুটিনাটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরেন। বর্তমান সময়ে সংবাদপত্র বা মিডিয়াকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়। মিডিয়ার একটি মাধ্যমের নাম টেলিভিশন। বিশ্বের প্রায় ৮০% মানুষ টেলিভিশন দেখে। অতএব মিডিয়া বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৪০০ শত বছর আগে সাংবাদিকতা বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. যে গাইড লাইন দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অনন্য। ইসলামে সাংবাদিকতা এক ধরনের আমানত। এই আমানত হচ্ছে, যে কোনো তথ্য ও সংবাদকে অবিকৃত অবস্থায় সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা। নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মতের রং লাগিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উল্টোভাবে পরিবেশন না করা। মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়। যে খবরটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তা আদৌ সত্য কিনা তা যাচাইয়ের নিয়ম আছে সংবাদপত্র জগতে। তথ্য যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনেও রয়েছে চমৎকার দিক-নির্দেশনা। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা যাচাই-বাছাই করে নাও; যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হও।’ (সূরা আল-হুজুরাত: ০৬)
সাংবাদিকদের জন্য এই আয়াতটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদকর্মীরা যদি কোনো তথ্য সঠিকভাবে যাচাই না করে মিডিয়ায় প্রচার করে দেন, তাহলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। যার মাসুল ঐ সংবাদকর্মী দিতে পারবেন না। যাচাই বাছাই ছাড়াই সংবাদ প্রকাশের অনেকগুলো মাধ্যমের মধ্যে একটি মাধ্যমের নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে এধরনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু করে সবখানে বিদ্যমান। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই না করে সংবাদ গ্রহণ ও পরিবেশন নিষেধ করেছেন। অনেক সংবাদকর্মী লোকমুখে যা শুনেন তাই মিডিয়ায় প্রচার করে দেন। এটিও ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘একজন ব্যক্তি মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়’। (মুসলিম : ১/১০৭)
ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা দলীয়স্বার্থ বিবেচনা করে অনেক সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেন। এ কাজটি করাও অন্যায়। জনস্বার্থে আসল তথ্য গোপন না করে তা প্রকাশ করা উচিত। মানুষ তথ্য জানার জন্য অধীর আগ্রহে পত্রিকা পড়েন কিংবা টিভির পর্দায় চোখ রাখেন। জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করা সম্পর্কে পবিত্র হাদীসে কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করল কিয়ামতের দিন আল্লাহতাআলা তাকে আগুনের লাগাম পড়াবেন।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান : হা. ৯৬)
অনেকে আবার কাউকে হেয় করার মানসে তার ব্যক্তিগত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেন। যেমন গত ৩১ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলীতে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন আহত হয়ে মেডিকেলে নেয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই সরকারের পক্ষ থেকে জামাত শিবিরকে দোষারোপ করা হয়েছে এবং মিডিয়াও এ সংবাদটি ঢালাওভাবে প্রচার করেছে। অথচ পরবর্তীতে যখন জাতীয় পার্টি (জাপা-এরশাদ) সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) এ কাদের খানকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো তখন বের হয়ে আসে আসল খুনির পরিচয়।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা জামায়াতকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপায় যার শিরোনাম ছিল ‘এবার ঘর পুড়ছে জামায়াতের’। এ খবরটি পরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকা ঢালাওভাবে ছাপায়। অথচ জামায়াতের পক্ষ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটিকে মিথ্যা খবর হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এ ধরনের অসংখ্য সংবাদ যাচাই বাছাই না করে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে যা ঠিক নয়।
কারো গোপন বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করে তাকে খাটো করা ইসলাম পছন্দ করে না। এক্ষেত্রে বরং ঐ ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করাই উত্তম। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন রাখল আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (বুখারি : ২/৮৬২ হা.২৩১০)
তবে কারো দোষ যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় তখন তা উন্মুক্ত করে তার আসল চেহারা বের করা দরকার, যাতে সে আর মানুষের ক্ষতি না করতে পারে। আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা তাদের লেখনীতে বিরুদ্ধমতাদর্শের লোকদের শক্তভাবে তিরস্কার কিংবা চরিত্রহনন করেন, যা একেবারে কাম্য নয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেন না, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেন না, সে উপহাসকারীনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে, তারাই জালিম।’ (সূরা আল হুজুরাত: ১১)
খবরের সত্যতা যাচাইয়ের ব্যপারেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও সভ্যতাই মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে শিখায় না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না?’ কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘হে আল্লহর রাসুল! হ্যাঁ, অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া।’ এরপর হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসে রাসুল (সা.) বললেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা’- (বুখারি)। তাই সংবাদের তথ্য যাচাই ও সত্যতা নিরূপণ করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য।
ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ কিংবা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বিরোধী হওয়ায় অনেকে প্রাপ্ত তথ্য গোপন করে থাকে। শোনা যায়, নিউজ রুমে অনেক নিউজ ‘কিল’ করা হয়। এমনটি কিছুতেই কাম্য নয়। সত্য গোপন করাকে ইসলাম পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী’ - (সুরা বাকারা : ২৮৩)।
প্রিয় নবী সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন; যে আমার কথা শুনে অতঃপর তা হুবহু ধারণ করে অবিকল অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়’- (তিরমিজি শরিফ)। এ কাজটি অনেক কঠিন। কারণ সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব যখনই যার বিপক্ষে গেছে বা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও এলিট শ্রেণির স্বার্থে আঘাত লেগেছ তখনই তাদের ওপর নেমে এসেছে বর্ণনীয় নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের জীবন দিয়েও প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছে। আর সংখ্যাটাও একেবারে নগণ্য নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যানুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ১১৭ জন গণমাধ্যম কর্মী নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলা ও নানাবিধ হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন ৩৭ জন, ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন ২১ জন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৯ জন। মামলার শিকার হয়েছেন ৯ জন। আর ২০১৫ সালে গোটা বিশ্বে ১১০ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কোনো শক্তির কাছে মাথা নত না করে ভয়শূন্য চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করাই ইসলামের দাবি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ’। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত মুয়াজ (রা.) বললেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, হে মুয়াজ, তুমি সত্য বলতেই থাকো, যদিও তা তিক্ত হয়।’ মূলত সত্য প্রকাশে আপসহীনতা একজন আদর্শ সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। সাংবাদিকরা নতজানু হয়ে কাজ করলে গণমাধ্যমের কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলাম সাংবাদিকের সত্য বলার অধিকার আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই ‘সত্য প্রকাশে আপসহীন’ এটিই হোক সাংবাদিক সমাজের স্লোগান আর এই স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তবেই সাংবাদিকরা সমাজের জাগ্রত বিবেকে পরিণত হতে পারবেন।
হোসাইন আনোয়ার