বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫

দীপন কখনো ব্লগে যায়নি-


“দীপন কখনো ব্লগে যায়নি। সে বলতো, ব্লগে যারা লেখালেখি করে, তারা মূলত দু’টি ধারায় লেখে। যাদের একটি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে উসকানি দেয়, অপরটি প্রকৃত ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে এসে ইসলামের স্বপক্ষে কথা বলতে যায়। ব্লগারদের এই দুই ধারার কোনোটিই তাকে টানে না। এরপরও আমার ছেলেকে খুন হতে হলো।” গত ৩ নবেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কান্না জড়ানো কণ্ঠে এই কথাগুলো বললেন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। শুধু পিতার নয়, দীপনের জন্য আমাদের সবারই মন কাঁদছে। স্বচ্ছভাবনার অধিকারী প্রাণবন্ত এই যুবকটি আমাদের সমাজে বাঁচতে পারলো না। তাকে হত্যা করা হলো নির্মমভাবে। কিন্তু কারা তাকে হত্যা করলো? তাদের জীবনদর্শন বা রাজনীতির পরিচয় কী? যারা জীবনদর্শন হিসেবে ইসলাম, সমাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রকে গ্রহণ করেছে- তাদের হাতেতো চাপাতি উঠতে পারে না, তারাতো এমন নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে না। তাহলে ওরা কারা? ওরা কি বিভ্রান্ত পাপেট, পেশাদার খুনী, নাকি আন্তর্জাতিক গডফাদারদের অনুচর? এই রহস্য উদঘাটনে প্রয়োজন ন্যায়ের চেতনায় বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত। এমন তদন্তের অবশ্য আমাদের সংকট রয়েছে।
নৃশংস দু’টি হামলার ঘটনা ঘটে গেল রাজধানীতে। এই হামলায়, শনিবার ৩১ অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে নিহত হন জাগৃতি প্রাকশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন। প্রায় একই সময়ে লালমাটিয়ায় আরেক প্রখাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর মালিক আহমেদুর রশিদ টুটুল এবং তার সঙ্গে থাকা দুই ব্লগার সুদীপ কুমার বর্মণ ও তারেক রহিমকে কুপিয়ে একইভাবে আহত করা হয়। লেখক ও প্রকৌশলী তারেক রহিমকে গুলিও করা হয়েছে, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তারা ৩ জনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নৃশংস হামলার এমন ঘটনায় মানুষ ব্যথিত ও স্তম্ভিত। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে এমন নৃশংস হামলা চলতে পারে না। তাই প্রশ্ন জাগে, আমরা এখন সভ্যতা এবং গণতন্ত্রের কোন্ পর্যায়ে আছি? এমন ঘটনার শুধু নিন্দা করলে চলে না, যথার্থ বিচার এবং ঘটনার কারণ অনুসন্ধানও বিশেষভাবে প্রয়োজন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নৃশংস এমন ঘটনার পর আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও ব্লেম-গেমে মত্ত হয়েছেন। কেউ কেউ তো বলেই ফেলেছেন, এ ঘটনা বিএনপি-জামায়াতের লোকজন ঘটিয়েছে। জানি না আমরা কখন মানুষ হবো, আমাদের বিবেক কখন জাগ্রত হবে? আসলে নৈতিক মেরুদ- দুর্বল হয়ে পড়লে মানুষ আর মানুষ থাকে না, প্রাণী হয়ে যায়। এমন অবস্থায় তথাকথিত মানুষের সমাজে পাশবিক ও পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের দৌরাত্ম্য বাড়ে। যার বিভিন্ন উদাহরণ এখন আমরা সমাজে লক্ষ্য করছি। মানুষ হত্যার মত জঘন্য ও নৃশংস ঘটনায় প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করার পরিবর্তে যখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার লক্ষ্যে ব্লেম-গেমের তৎপরতা দেখা যায়, তখন আমাদের সুস্থতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন জাগে। এমন দৃশ্য অবলোকজন করেই হয়তো বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরাজনীতি ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি পরিহার করে জাতীয়ভাবে সমস্যার মোকাবিলায় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন সরকার এবং রাজনীতিবিদদের।
একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনায় সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে চাপ ও অস্বস্তি বাড়ছে। এসব ঘটনায় ব্লেম-গেম লক্ষ্য করা গেলেও আসলে কারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছে এবং এর বাস্তবায়ন কিভাবে হচ্ছে সে সম্পর্কে সরকার অন্ধকারে রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তাই প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত ও নৈতিক দায়িত্ববোধ। দেশের মানুষ এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতির বদলে ন্যায় ও আইনের শাসনের বাতাবরণে বসবাস করতে চায়। আমরা মনে করি, জনগণের এমন আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন সরকারের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। দীপন হত্যার ঘটনায় নানা রকম বিশ্লেষণ হচ্ছে, তবে এক্ষেত্রে দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের বক্তব্য আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী আমি একটি মামলা করবো, কারণ আমি আইন মেনে চলি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি এর ওপর নির্ভর করি। আমি শুভবুদ্ধির উদয় চাই। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন এবং যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয়পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয়পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয় তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে। বিচার, পুলিশ ও আইন-আদালত দিয়ে তো শুধু আমরা একজনকে শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু তাতে জাতীয় উন্নতি হবে না। আসলে সংশ্লিষষ্ট সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির বিষয়টাই এখন সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এ বিষয়টিকে ধারণ করতে কে কতটা এগিয়ে আসেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে পুরো জাতি। আমরা জানি শুভবুদ্ধি শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, সমাজের ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধির বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলে জাতি বেঁচে যাবে।
সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্যে সব সময় সঠিক বিষয় বেরিয়ে আসে না। কারণ তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বক্তব্য রাখেন। কখনো কখনো একে-অপরকে আক্রমণ করেন। এছাড়া ব্লেম- গেমতো রয়েছেই। তাই দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে মানুষ এক ধরনের সংকটের মধ্যে রয়েছেন। তারা এখন এমন মানুষের বক্তব্য শুনতে চান, যিনি কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলতে পারেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এমন বক্তব্য এখন খুব কমই শোনা যায়।
মানুষতো সঠিক বক্তব্য শুনতে চায়, কিন্তু এমন বক্তব্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে কেউ সঠিক বক্তব্য পেশ করতে পারেন না। আমাদের দেশে কিন্তু বক্তব্যের অভাব নেই, বরং একটু বেশিই আছে। কিন্তু দলকানা বক্তব্যেতো মানুষের আগ্রহ নেই। কারণ এই সব বক্তব্যে সংকট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩১ অক্টোবর মানবজমিন-এ মুদ্রিত একটি সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করা যায়। সাক্ষাৎকারটি আমাদের কাছে একটি ব্যতিক্রমধর্মী বলেই মনে হয়েছে। উক্ত সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক সংকট থেকে দেশে একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সময়ে সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পিছনেও মূলত: একই কারণ রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে একবার সরকারই বলে আইএস জড়িত আবার সরকারই বলে আইএস নাই। যদি এ ধরনের স্ববিরোধী কথাবার্তা থাকে তাহলে বাইরে থেকে তো লোকেরা চিন্তিত হবেই। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে একবার বলা হচ্ছে অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে, আরেকবার বলা হচ্ছে সবকিছু কন্ট্রোলে। কথা হচ্ছে- তাদের দিক থেকে মনে করছে তারা নিরাপদবোধ করছেন না। রাস্তায় বের হলে কেউ হয়তো আক্রমণ করতে পারে। যেহেতু একটা রাজনৈতিক সংকট রয়ে গেছে, সেহেতু অনেকেই সুবিধা নিচ্ছে এই রাজনৈতিক সংকটের কারণে। সেই জিনিসটাকেই তারা ভয় পাচ্ছেন।
আইএস-এর ঝুঁকি সম্পর্কে প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমার কাছে প্রমাণ নেই বাংলাদেশে আইএস আছে কিনা। তবে আমি মনে করি না সেটা আমাদের দেশের বড় সমস্যা। আমাদের বড় সমস্যা এখনও দুই বড় দলের রাজনৈতিক সংকট। তবে আমি মনে করি বড় দুই দলের সংকট কেটে যাবে। বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্ক বার্তা অব্যাহত রাখার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা মনে করছে এটা যৌক্তিক। কারণ দুই বিদেশী যদি মারা যায়, স্বাভাবিকভাবে তারা চিন্তিত। একজন একেবারে হাই সিকিউরিটি জোনে মারা গেছেন। সেই হিসেবে তারা সতর্কতা দিচ্ছেন। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতির সংকট এখনও কাটেনি, তাই তারা মনে করছেন এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় সম্পর্কে ড. ইমতিয়াজ বলেন, আপাতত সংকট সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশে সংকট হয়েছে। এখনও একটা নতুন সংকট চলছে। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বড় একটি দল পার্লামেন্টের বাইরে। আবার যে একটা বিরোধীদল সেটার অর্ধেক সরকারে। বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যাটা একদিন না একদিন কাটতেই হবে। যতদিন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হবে ততদিন সংকট থাকবে। এই সংকট যতদিন থাকবে ততদিন স্বাভাবিকভাবে উন্নয়ন হবে না। স্থিতিশীলতা থাকবে না। যতটুকু থাকা দরকার ততটুকু থাকবে না। এ বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার। আমরা মনে করি, ড. ইমতিয়াজের বক্তব্যে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তবে তার বক্তব্য থেকে সরকার ও অন্যরা কোনো বার্তা গ্রহণ করে কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads