শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

নূর হোসেনের হাসি


নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির করা হয়েছিল গত ১২ নবেম্বর। আদালতে নেয়ার পথে এবং আদালত প্রাঙ্গণে তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল। আদালতে উকিলদের সঙ্গেও তিনি ঠাট্টা মশকরা করছিলেন। যেন কিছুই হয়নি, কিছুই করেননি তিনি। বেড়াতে এসেছেন স্বজনদের বাড়িতে। তেমনই অভিযোগ করেছেন নিহত নজরুল ইসলামের পরিবার।
নূর হোসেনকে ফেরত আনা নিয়ে সরকার অনেক মজার নাটক করেছে। তার আগের দিন ১১ নবেম্বর দিবাগত রাত বারোটার পর সরকার আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) নেতা অনুপ চেটিয়াকে কারাগার থেকে অতি গোপনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। সরকারের এমন কেউ, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। যার এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানোরও দরকার নেই। কারণ ১২ তারিখ সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান যে, অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি তার জানা নেই। পরে অবশ্য দুপুরের দিকে তিনি বলেন যে, নিয়ম মেনে সাজার মেয়াদ শেষে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য অনুপ চেটিয়ার সাজার মেয়াদ শেষ হয় ২০০৪ সালে।
তবে অনুপ চেটিয়ার ঘটনা একটু ভিন্ন রকম। বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে অনুপ চেটিয়া আটক হন ১৯৯৭ সালে। তাতে তার সাজা হয় সাত বছরের জেল। সাজা শেষে ২০০৪ সালে, ২০০৭ সালে ও ২০১১ সালে অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা মঞ্জুর করেনি। এর মধ্যে ভারত বারবারই অনুপ চেটিয়াকে ফেরত চেয়ে আসছে। শেষ দিকে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছিল যে, অনুপ চেটিয়া এখন নিজেই স্বদেশে ফেরত যেতে চাইছে। তাই যদি হয়, তা হলে অনুপ চেটিয়াকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলো না কেন? তিনি তো আর সাজাপ্রাপ্ত আসামী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিরাপত্তা হেফাজতে। তাহলে রাতের অন্ধকারে কেন তাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হলো? সেটা জানাতে কোনো বাধা ছিল না। অনুপ চেটিয়াকে জোর করে ভারতে ফেরত পাঠানো নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছিলেন যে, এর ফলে উলফা গেরিলাদের হামলার টার্গেটে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কিছুতেই এই ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু সরকার সেসব বিষয়কে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে গোপনে ফেরত পাঠালো। এ ক্ষেত্রে জনগণকে বোকা বানাতে সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে তারা ভারত থেকে ফেরত আনছেন নূর হোসেনকে। কিন্তু অনুপ চেটিয়া আর নূর হোসেনের কেস সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেশ কিছুকাল আগেই ভারতের আদালত রায় দিয়েছিলেন যে, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক নূর হোসেনকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হোক। ফলে আজ হোক আর কাল হোক, নূর হোসেনকে ফেরত দিতে বাধ্য ছিল ভারত সরকার। তাই দুটো ঘটনাকে এক সূত্রে গাঁথা যায় না।
গত ১১ নবেম্বর সন্ধ্যা থেকেই বেনাপোল সীমান্তে নূর হোসেনকে স্বাগত জানানোর জন্য সরকারি মহল তৎপর হয়ে উঠেছিল। সেখানে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের একটি দল আগেই রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন বেনাপোলের দিকে। আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাবের কর্মকর্তারাও। নিয়ম অনুযায়ী নূর হোসেনকে হস্তান্তর করার কথা ছিল পুলিশের হাতেই। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাকে হস্তান্তর করা হলো র‌্যাবের কাছে। এই সাত খুনের ঘটনায় যুক্ত ছিলেন র‌্যাবের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারাও। তাদের মধ্যে আছেন র‌্যাবের সাবেক সিও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ। তারা আছেন কারাবন্দী। কার্যত র‌্যাব কর্মকর্তারা নূর হোসেনের ভাড়াটে খুনি হিসেবেই কাজ করেছেন। নূর হোসেনকে কেন বিজিবি বা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলো না, এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে ঐ দুই কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। তারা নূরকে র‌্যাবের কাছেই হস্তান্তর করতে চেয়েছে। তখন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল হাসান এগিয়ে গিয়ে নূর হোসেনকে নিয়ে আসেন। এরপর র‌্যাবের একটি দল নূরকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে যায়। আসলে এটা তো ভারতীয়দের কোনো ব্যাপার ছিল না। তাদের আদালত তো এমন কোনো নির্দেশ দেয়নি যে, নূর হোসেনকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
তারপরও সেই র‌্যাব কর্মকর্তারাই খোশ গল্প করতে করতে বেনাপোল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন সাত খুনের প্রধান আসামী নূর হোসেনকে। দৈনিক ইত্তেফাক রিপোর্ট করেছে, আদালতে হাজির করার আগে নূর হোসেন র‌্যাব-পুলিশের হেফাজতে ছিলেন ১৩ ঘণ্টা। ‘এ সময় অনেক কথাই বলেন নূর হোসেন। তিনি স্বীকার করেন, সাত খুনের ঘটনা তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে র‌্যাব-১১-এর সাবেক সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ জানতেন বলে তিনি জানিয়েছেন। পুরানো ঢাকায় তারেক সাঈদের জমি নিয়ে সমস্যা ছিল। সেখানে আইনজীবী দিয়ে সহায়তা করার কথা জানিয়েছেন নূর হোসেন। নূর হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নোংরা। এখানে সব সময় ‘বস’দের খুশি রাখতে হয়। এটা না করলে টিকে থাকা যায় না। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ‘বস’ই আমাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। টেলিভিশন টক-শোতে কথা বলার সুযোগ দিতে র‌্যাবের কাছে দাবি জানান নূর হোসেন। তিনি বলেন, তা হলে দেশবাসীর কাছে মনের কথা খুলে বলতে পারবেন।’
ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী নূর হোসেন আরও বলেন  যে, ‘আমি তো এখন নেই। তাহলে আমার সিদ্ধিরগঞ্জের সেই সাম্রাজ্য এখন কার দখলে? কারা এখন সুবিধাভোগী?’ এরপর নূর হোসেন যা বলেছেন, তার অনেক কিছুই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। নূর হেসেনের টার্গেট ছিল প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। তাতে হত্যা করানোর জন্যই তিনি র‌্যাবের সঙ্গে চুক্তি করেন। টাকাও কিছু পরিশোধ করেন। আর র‌্যাবের ভাড়াটে কর্মকর্তারা সাক্ষীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য অন্যদের হত্যা করে। তিনি আরও জানান, ‘প্রতিনিয়ত র‌্যাব-পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে এসেছি।’ পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত চাঁদা দিয়েছেন তিনি। কারণ, তিনি বলেন, ‘চাঁদা দেয়া ছাড়া আমার টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। পড়াশোনা জানি না। টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে রাখতাম। বালু ও ট্রাকের ব্যবসা ছিল। পরিবহনের চাঁদাবাজি থেকে অনেক টাকা আসতো।’ র‌্যাবের কর্নেল জিয়া তার সঙ্গে আলাপ কালে তিনি এসব কথা বলেন।
নূর হেসেন ১২ নবেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত র‌্যাবের হাতেই ছিলেন। এরপর তাকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় দুপুরের পর আদালতে হাজির করলে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের কোনো আবেদন করেনি। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ তো দূরের কথা, সাত খুনের এই প্রধান আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। বিক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জবাসী তাকে রিমান্ডে নেয়ার দাবিতে জুতা মিছিল করে। নানা রকম স্লোগান দেয়। মানববন্ধন করে। নিহত নজরুলের পরিবারও একই দাবি করেন। যদিও চার্জশীট হয়ে গেলে কাউকে আর রিমান্ডে নেয়ার রেওয়াজ নেই। কিন্তু অধিকতর তদন্তের জন্য রিমান্ডে নেয়া যায়। পুলিশ সে পথে অগ্রসর হয়নি। নারায়ণগঞ্জের এসপি ও সরকারি উকিল (পিপি) জোর গলায় বলেছেন, তাকে রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ নেই।
আদালতে নেবার পথে ও এজলাশে নূর হোসেনের হাসির রহস্য এখানেই। ঐ সাত খুনের মামলায় নূর হোসেন হুকুমের আসামী মাত্র। তিনি তো আর নিজ হাতে খুন করেননি। খুন করেছেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা। নূর হোসেন জানেন, সেসব কর্মকর্তাকে কেমন জামাই আদরে আদালতে নিয়ে আসা হয়েছে। তা হলে নূর হোসেনকে তো আরও সমাদর করারই কথা। সমাদর তিনি পেয়েছেন। ফলে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তার হাসি। 
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান ১৬ নবেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, যে কোনো আইনজীবী ইচ্ছা করলে সাত খুন মামলার আসামীদের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন। তিনি বলেন, নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ নেই। এর আগে জেলা আইনজীবী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সাত খুনের কোনো আসামীর পক্ষে নারায়ণগঞ্জের কোনো আইনজীবী দাঁড়াবেন না। এ সম্পর্কে সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যা বলার সভাপতিই বলবেন। তবে এই মামলায় এতদিন নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আসামী পক্ষে দাঁড়াননি। সভাপতি আনিছুর রহমান বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার যখন একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই রাজনৈতিক ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চলছে।
এ থেকেও স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে নূর হোসেনের এখন হাসবারই সময়। কাঁদবার সময় খুনের শিকার সাত পরিবারের, নূর হোসেনের নয়। নূর হোসেন গং ‘চিরজীবী হোক’।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads