মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫

কান্নার আর্তধ্বনি ওঠে


প্রতিদিন এই জনপদের নগর বন্দর গ্রামের কোনো না কোনো কোণে কান্নার আর্ত ধ্বনি ওঠে। সন্তানহারা মায়ের, পিতার, স্বামীহারা স্ত্রীর, পিতৃহারা সন্তানের আর্ত-চিৎকার ধ্বনিতে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। একটি দুটি নয়, কখনও কখনও তা এক ডজন দুই ডজনও ছাড়িয়ে যায়। এক জায়গায় শোক স্তিমিত হয়ে আসতেই আর এক জায়গায় উচ্চকণ্ঠের আর্তনাদ ধ্বনিত হয়ে ওঠে। ঘাতকের বুলেট, রামদা বা চাপাতির আঘাতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে যায় জলজ্যান্ত মানুষ। এই নষ্ট করে ফেলা সমাজে যেন কারোরই রেহাই নেই। ঘাতকের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বধ্যভূমি, দেশের প্রান্তর।
ব্যর্থ অথর্ব ঘাতকবান্ধব সরকার অবিরাম বলার চেষ্টা করে, এসব হত্যাকাণ্ডের দায় তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। বিরোধীদের ওপর দায় চাপিয়েই যেন তাদের সকল দায়িত্ব শেষ। আর ঘাকতরা ক্রমেই আরও বেশি করে এই সুযোগ নিচ্ছে। কারণ তারা জেনে গেছে যে, হত্যা করলে কেউ তাদের পিছু নেবে না। কেউ তাড়া করবে না। ফলে প্রতিদিন খুনের সংখ্যা বাড়ছেই। সরকার তার বিরোধীদের তাড়া করে, খুনিরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এর স্বাভাবিক যা পরিণতি এখন তাই ঘটতে শুরু করেছে। চালু হয়েছে বিচারহীনতার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি। আর তাই বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও কোনো হত্যাকাণ্ডেরই বিচার পাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের আর সব মন্ত্রী-নেতা অবিরাম বলতে থাকেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দল বা তার নেত্রী দায়ী। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোনোরূপ তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই সরকার প্রধান জানিয়ে দেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দায়ী। তখন তদন্তকারীদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে না। প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলে দিয়েছেন, যে গাইডলাইন দিয়েছেন, তার বাইরে যাওয়া তদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তদন্ত এগোয় না। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, ঘাতক ধরা পড়ে না।
এদিকে রজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকার যে নিষ্ঠুর পথে অগ্রসর হচ্ছে, আমরা বারবার বলেছি, তার পরিণতি কখনও শুভ হতে পারে না। প্রত্যেক আঘাতেরই একটা প্রত্যাঘাত আছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ধারাবাহিকভাবে শিকার হচ্ছেন গুম-খুনের। হামলা-মামলা হচ্ছে হাজারে হাজারে। আর গুম-খুনের কোনো প্রতিকার কোথায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাড়ছে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই পাওয়া যাচ্ছে গণপিটুনিতে নিহত হবার খবর। প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে মারার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই পথ। তার ওপর চলছে ক্রসফায়ার। র‌্যাব-পুলিশ প্রভৃতি বাহিনী ‘অপরাধীদের’ বিচারের বদলে ‘ক্রসফায়ারে’র নামে যেভাবে হত্যা করছে, তাও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এদের শাস্তি হওয়া উচিত বিচার বিভাগের মাধ্যমে। তাহলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারের কর্মকাণ্ডে সে আস্থার পরিবেশ প্রতিনিয়তই বিনষ্ট হচ্ছে।
এর মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন উপসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে জঙ্গি তৎপরতা। যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমান, সে দেশে ইসলাম চর্চার বিরুদ্ধে সরকারের এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণাও নতুন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সরকার আমাদের ধারাবাহিকভাবে জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে সরকারের যেমন অনুগত রাখার চেষ্টা করেছে, তেমনি জঙ্গি জঙ্গি করে বিদেশিদের বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে, বাংলাদেশ জঙ্গিতে ভরে গেছে, আর তা একমাত্র নির্মূল করতে পারে বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বহীন অনির্বাচিত সরকার। আর বিএনপি যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসে, তাহলে আর কোনো উপায় নেই, পুরো বাংলাদেশ ভরে যাবে আইএস যোদ্ধায়। অতএব তারা নির্বাচিত হোক বা না হোক, বিদেশিরা যেন তাদের সমর্থন দিয়ে যায়।
এর আগে থেকেই দেশে শুরু হয়েছিল ব্লগার হত্যা। ব্লগাররা ইসলাম, আল্লাহ ও হযরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে যা লিখছিলেন, তা যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি তাদের হত্যা করার মতো গুরুতর অপরাধও কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিগত পাঁচ-ছয় বছরেও এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা হয়নি। হত্যাকারীরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্লগাররা যখন তাদের জীবনের প্রতি হুমকি বিষয়ে থানায় জিডি করতে গেছেন, তখন সে জিডি গ্রহণ করেনি থানা।
এ থানা ওদিকে ঠেলেছে, ও থানা সেদিকে ঠেলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে খুন হয়েছেই। আবার গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় খুন হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির কাছে পুলিশের সামনে। হত্যাকারীরা পুলিশের সামনে দিয়ে এসে পুলিশের সামনেই খুন করে হেঁটে নির্বিঘেœ পালিয়ে গেছে। পুলিশ তাদের ধরতে পারেনি। কারণ পুলিশ ‘মনে করেছিল’ সেখানে ‘ঝগড়াঝাটি’ হচ্ছে, তাই তারা এগিয়ে যায়নি। সেখানে ডজন ডজন সিসি টিভির ক্যামেরা ছিল, তার কোনোটাতেও ধরা পড়েনি খুনিরা। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের সরল উক্তি আছে। আর তা হলো সিসিটিভির ফুটেজ অস্পষ্ট। তাই চেনা যাচ্ছে না। কার্যত খুনিদের পাকড়াও করার ইতি ঘটেছে সেখানেই।
অভিজিৎ রায়ের নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কে লেখা বই প্রকাশ করেছিল প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর। গত ৩১ অক্টোবর দুপুরে এই দুটি প্রকাশনা সংস্থায় একযোগে হামলা চালায় ঘাতকরা। জাগৃতি প্রকাশনীর অফিস শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তিনতলায়। দুপুর আড়াইটার দিকে সেখানে একাই ছিলেন জাগৃতির কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন। ঘাতকরা ক্রেতা সেজে সেখানে ঢুকে দীপনকে ঘাড়ে কুপিয়ে হত্যা করে দরজা লক করে দিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। শুদ্ধস্বর-এর অফিস লালমাটিয়ার সি ব্লকের একটি ভবনের চার তলায়।। ঘাতকরাও সেখানে ঢুকে ঐ প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে ও গুলি করে গুরুতর আহত করে দরোজা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যায়।
ফয়সল আরেফিন দীপনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তচিন্তক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবুল কাসেম ফজলুল হক। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দীপন ছিলেন পিতার সঙ্গেই। তারপর চলে যান নিজ কার্যালয়ে। তিনটা থেকেই তিনি ছেলেকে বারবার ফোন করতে থাকেন। দীপন ফোন না ধরায় বেলা চারটার দিকে তিনি নিজে যান আজিজ সুপার মার্কেটে। গিয়ে দেখেন, জাগৃতির অফিস বন্ধ। কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে। বাসায় ফিরে এসে তিনি পুত্রবধূকে ফোন করে জানতে পারেন, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর অফিসে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে। তখন তিনি আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ফের আজিজ সুপার মার্কেটে যান। তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তিনি দেখতে পান, তার ছেলে পড়ে আছে। মৃত। ঘাতকদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দীপনের ঘাড় ফাঁক হয়ে গেছে। রক্তে ভেসে গেছে পুরো ঘর।
শোকাহত ক্ষুব্ধ হতাশ পিতা আবুল কাসেম ফজলুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি কোনা বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এইটুকু আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে। বিষয়টা রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। নিয়ম রক্ষার জন্য হয়ত জিডি করতে হবে।’ আবুল কাসেম ফজলুল হক পরদিন দুপুরে আবার বলেন, ‘গতকালও বলেছি, আজও বলছি, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই না। একথা আমি ক্ষোভ থেকে বলিনি। সুস্থ বিচার বিবেচনা থেকেই বলেছি। দেশের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলে এ ধরনের সমস্যা আর থাকবে না। তিনি বলেন, আদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তারপর আইনগতভাবে। নইলে এ সমস্যার সমাধান কখনও হবে না।’ সত্যিই তো, কার কাছে কে কিসের বিচার চাইবেন? গত ৩২ মাসে এভাবে খুন হয়েছে ছয়জন। কোনো খুনেরই বিচার হয়নি, নিষ্পত্তি হয়নি। নিষ্পত্তির উদ্যোগও যেন অনুপস্থিত। অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমদ  জানিয়েছেন, তিনিও অভিজিৎ হত্যার বিচার চান না। বিচার হবে না।
এই ঘটনার পর চমকে উঠলাম আওয়ামী লীগের এক যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য দেখে। সারা দেশ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সচেতন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যখন এই হত্যাকা-ের ঘটনার নিন্দা আর প্রতিবাদে মুখর, যখন গোটা দেশ শোকে স্তব্ধ, তখন তিনি বললেন, ব্লগারদের যারা হত্যা করেছে, নিহত দীপনের বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক হয়তো তাদেরই অনুসারী। এ কারণেই তিনি পুত্র হত্যার বিচার চাননি। উনি উনার দলের লোকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না বলেই এ ধরনের কথা বলেছেন। আঁৎকে ওঠার মতো অভিযোগ। এ কি কোনো মানুষ কথা বলছে, নাকি কোনো পিশাচ? কিশোরকালে ভূত-পিশাচের কাহিনী পড়েছি। ভূত ভয় দেখায়। কখনও কখনও ঘাড়ও মটকায়। কিন্তু পিশাচ হলো মাংসাশী ভূত। এরা মানুষ থেকে শুরু করে যে কোনো মৃত প্রাণীর পচাগলা মাংস খায়। ঐ ব্যক্তির কথা শুনে মনে হলো পিশাচের কণ্ঠস্বর শুনছি।
তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি শিক্ষক কাসেম স্যারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, সমাজে  শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সে পথেই এর সমাধান।
পুনশ্চ
১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই কাসেম স্যারের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। তার বাসায় যাতায়াত। কাসেম স্যার আর ফরিদা আপার অপত্য স্নেহে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করেছি। দুপুরের দিকে গেলে কোনোদিন না খয়ে আসতে দিতেন না তাঁরা। প্রথম বর্ষ থেকেই কাসেম স্যার আমাকে গবেষণায় অবিরাম প্রেরণা আর উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। থার্ড ইয়ারে উঠতে উঠতে আমি তমদ্দুন মজলিসের ওপর গবেষণা সম্পন্ন করি, যা ড. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পত্রিকা পা-ুলিপিতে প্রকাশিত হয়। কাসেম স্যারই আমাকে পিএইচডি করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনিই ছিলেন আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক। আমাদের সম্পর্ক এখনও পারিবারিকভাবে অটুট আছে। দীপন বেড়ে উঠেছিল আমাদের চোখের সামনেই। ও একটি গবেষণামূলক লেখার পাণ্ডুলিপি চেয়েছিল। সময় করতে পারিনি। আমি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে দীপনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তিনি তাকে বেহেশত নসিব করুন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads