সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫

প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা : বাস্তব প্রেক্ষাপট


ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অন্তত ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ১৪০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ভয়াবহ এইসব হামলায় আরো দু’শতাধিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী হামলাকারীরা একটি রেস্তোরাঁ, পানশালা বা মদের দোকান, একটি পাব বা কনসার্ট হল এবং একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের বাইরে হামলা চালায়। স্টেডিয়ামে তখন জার্মানী ও ফ্রান্সের জাতীয় দলের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।
বিবিসির খবরানুযায়ী প্যারিসে প্রথম হামলা হয় শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ৯:২০ মিনিটে। সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় একটি কনসার্ট অনুষ্ঠানে। এই স্থানটি লাশের সারিতে ভরে যায়। তার চারদিক চিৎকার আর কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠে। ঘটনার পর পরই ফরাসী প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং তিনদিনের শোক ঘোষণা করেন। বলাবাহুল্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে এই প্রথমবার জরুরি অবস্থা জারি হলো। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী নারকীয় এই হামলার দায় স্বীকার করে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস একটি বিবৃতি দিয়েছে। অবশ্য হামলাকারী ৮ জনই নিহত হয়েছেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বোমার স্পিন্টার ও আগুনে একজন হামলাকারীর দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তার সিরীয় পাসপোর্টটি অক্ষত ছিল। হামলাকারীদের সকলেরই মৃত্যু হবার পর আইএস এর দায় স্বীকার অথবা অপরাধীদের প্রকৃত পরিচয় চিহ্নিত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই ঘটনায় গভীর শোক ও  নিন্দা জানিয়েছেন। প্যারিসে এই হামলার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সারা দুনিয়ার সাথে আমরাও ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সন্ত্রাসীদের এই কাপুরুষোচিত হামলার নিন্দা জানাই এবং নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করি। সারা দুনিয়ায় যখন একটি অস্বস্তি বিরাজ করছে তখন ফ্রান্সের মতো একটি দেশে এই সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে ইসলামের নামধারী ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধ পরিপন্থী একটি প্রতিষ্ঠান এর দায় স্বীকার করায় ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো দুনিয়াব্যাপী ইসলামপন্থী এবং মুসলিম দেশগুলোর প্রতি বিরূপ আচরণ জোরদার করতে তৎপর হয়ে উঠছে বলে অনেকে সন্দেহ পোষণ করছেন।
ফ্রান্স বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সঙ্গত ও অসঙ্গত কারণে হানাহানি রক্তারক্তি এই দেশটির ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ষোড়শ লুই-এর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে যে ফরাসী বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল তার প্রভাব সারা দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সামন্তবাদী কাঠামোর ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।  প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮০০ সাল থেকে (বিপ্লবের পর) ২০১৫ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের কয়েক হাজার লোক সন্ত্রাসী হামলায় হতাহত হয়েছেন। হামলাকারীদের মধ্যে চরম ডান ও বামপন্থী গ্রুপগুলো যেমন ছিল তেমনি স্বাধীনতাকামী বাঙ্ক, ব্রিটন, কর্সিকান ও আলজেরিয়ার নাগরিক ছিলেন। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাকামীদের উপর ফরাসী উপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেখানে যেমন হামলা হয়েছে তেমনি উপনিবেশ সমর্থকরাও ফরাসী সরকারের উপর হামলা করেছেন। নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে হত্যার জন্য ১৮০০ সালে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই হামলার তীব্রতা বাড়ে। এর পেছনে ফ্রান্সের সরকারি নীতিকে অনেকে দায়ী করেন। তবে এর কারণ উদঘাটন করার জন্য নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ইসলাম বিদ্বেষী অনেক বিশ্লেষক ইতোমধ্যে ফ্রান্সে হামলার জন্য ইসলামপন্থীদের দায়ী করতে শুরু করেছেন। তাদের এই প্রবণতাকে আমি অন্যায় ও অন্ধ বিদ্বেষপ্রসূত বলে মনে করি।
আধিপত্যবাদী পশ্চিমা বিশ্ব ইরাকে মানব বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র থাকার অভিযোগ করেছিল। ইরাক অভিযোগ অস্বীকার করে। এ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তার রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, ইরাকের তথা সাদ্দাম সরকারের হাতে কোনও মারণাস্ত্র নেই। কিন্তু মার্কিন সরকার, ফরাসী সরকার ও বৃটিশ সরকারসহ পাশ্চাত্য শক্তিগুলো জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টকে অবজ্ঞা করে তাদের অভিযোগে অটল থাকে এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ইরাকের সরকার, জনগণ ও জনপদের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেয়। এই অশুভ শক্তিগুলো লাখ লাখ নয় কোটি কোটি টন মানব বিধ্বংসী বোমা ফেলে ইরাকের জনপদ ও তেল ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করে দেয়। লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে এই দেশটি যে অবকাঠামো তৈরি করেছিল তাও ধ্বংস করে দেয়া হয়। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো বোমা ফেলে মানুষ, ঘরবাড়িও ধ্বংস করে দেয় এবং লাখ লাখ লোক প্রাণ হারায়। নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কেউই এই নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে যে, এক সাদ্দাম হোসেনের জন্য ইরাকে কোটি কোটি মানুষ হতাহত হয়েছেন। তাদের জন্য বিশ্ব বিবেক সামান্যতম অনুশোচনাও করেনি।
একইভাবে এক ওসামা  বিন লাদেন কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের গল্প সাজিয়ে আফগানিস্তানের মতো একটি মুসলিম দেশ ধ্বংস করে দিয়েছেন। অথচ এই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সাথে লাদেন অথবা মুসলমানদের সম্পৃক্তির সন্দেহাতীত প্রমাণ আজো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট থেকে এই সত্য বেরিয়ে এসেছে যে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে ইহুদী চক্রান্তেরই একটি অংশ ছিল। মুসলমানদের উপর দোষ চাপিয়ে তাদের ধ্বংস করা এবং মুসলিম দেশসমূহের সম্পদ লুণ্ঠনই এর লক্ষ্য ছিল। এর জের আমরা এখনো বহন করে চলেছি। শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমগুলো তাদের হাতে থাকায় তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে দুনিয়াবাসীর সামনে সত্য বলে চালিয়ে দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারছে। একই অবস্থা ঘটেছে লিবিয়ার ক্ষেত্রে। স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রের জিকির তুলে লিবিয়ার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এই যুদ্ধে গাদ্দাফী নিহত হন। লিবিয়ায় কি গণতন্ত্র ফিরে এসেছে? লিবিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের জনগণ এখনো তাদের জীবন, সম্পত্তি ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই দেশগুলোতে তাদের হস্তক্ষেপ এবং ‘যুদ্ধ’ শুরুর আগে সাধারণ মানুষের জীবনের যে নিরাপত্তা ছিল, চলাফেরার যে স্বাধীনতা ছিল, জীবনযাত্রায় যে সমৃদ্ধি ছিল তার কোনটিই এখন নেই। এখন তারা অসহায়, পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের ড্রোন হামলার শিকার, সৈন্যদের গুলী ও বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত।
মিসরের অবস্থা চিন্তা করুন। সেখানে কি ঘটেছে। স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। সে দেশের ইতিহাসের সর্বপ্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণ সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ইখওয়ানুল মুসলেমিন পরিচালিত জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে ক্ষমতাসীন করেছিল। ইখওয়ান নেতা ড. মুরসী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই আধিপত্যবাদী শক্তি ও ইহুদীদের অস্ত্র এবং আশীর্বাদ নিয়ে মিসরের সামরিক প্রধান নির্বাচিত ও জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট মুরসীকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেই দেশের শাসনভার গ্রহণ করে পুনরায় জনগণের উপর স্বৈরাচার, অত্যাচার-অবিচার চাপিয়ে দেয়। ক্রমবর্ধমান ইসলামী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য সেখানে এখন শুধু গ্রেফতার নির্যাতনই চলছে না বরং মিথ্যা, বানোয়াট মামলা দিয়ে নিরপরাধ আলেম-ওলামা ও ইসলামী নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়ার অশুভ কসরতও চলছে। যেমন বাংলাদেশেও এর অনুশীলন চলছে। গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নামে সর্বত্র প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে যারা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছেন তারা কিন্তু এসব ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। কিন্তু কেন? এই কেন’র উত্তর দিতে গেলে অনেক প্রশ্ন সামনে এসে যায় যা এই ক্ষুদ্র পরিসরের স্তম্ভে বিশ্লেষণ করা কঠিন। লাদেনকে এবং তার বাহিনীকে তারা সৃষ্টি করেছিল সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। এর আগে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে লেলিয়ে দিয়ে তারা একটি খেলা শুরু করতে চেয়েছিল। আট বছর এর কসরত চলেছে কিন্তু ইরানের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কুয়েত দখল করিয়ে পুনরায় এই খেলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়েছে। এখন চলছে সিরিয়া নিয়ে খেলা। এই খেলাকে বিস্তৃত করার জন্য তারা ইসলামিক স্টেট বা আইএস এর সৃষ্টি করেছে। উদ্দেশ্য অনেকগুলো। শিয়া-সুন্নি বিভেদ সৃষ্টি করে মুসলিম ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি, নব্য আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা, খনিজ তেল-গ্যাস-সোনা-রূপার খনি দখল, অস্ত্র ব্যবসা এবং ইহুদীদের নিরাপত্তা প্রদান। পাশ্চাত্যের এই বহুমুখী উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখেই তাদের তৈরি অথবা তাদের অনুপ্রাণিত সংঘাত, সংঘর্ষ ও জঙ্গি তৎপরতা অথবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলোকে বিচার বিবেচনা করা দরকার বলে আমি মনে করি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামিক স্টেট বা আইএস ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোন সংস্থা বা গ্রুপ নয়। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতিসহ সারা দুনিয়ার আলেম-ওলামা পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে একাধিকবার দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন যে, ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোনও স্থান নেই। যারা সন্ত্রাসী, খুনি, ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করে তাদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের লেশমাত্র নেই। তাদের কোনও ধর্মীয় পরিচয় নেই।
পক্ষান্তরে দেখা যায় যে, দেশে হোক বিদেশে হোক যখনই কোথাও কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটে তার দোষ মুসলমানদের উপরই চাপানো হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এই প্রবণতাটি একটি বিরাট বাধা। এই বাধা দূর করার জন্য প্রমাণহীন দোষারোপ যেমনি বন্ধ হওয়া দরকার, তেমনি ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সারা বিশ্বের সকল শ্রেণী সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাও প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads