শনিবার, ৯ মে, ২০১৫

বিএনপি-জামায়াত বিভক্তি মিশন, জনাব খানের চিন্তার সুস্থতা ও ‘বোকো হারাম’ প্রসঙ্গ!!


সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকমিটির শুনানিতে বাংলাদেশের বর্তমান আলোচিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হত্যা, গুম, খুন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম, ভোট ডাকাতি, বিরোধীদলীয় নেত্রীর ওপর হামলা, যুদ্ধাপরাধ বিচারের মানদন্ড, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ, শ্রমিক নির্যাতন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত শুনানি হয়েছে। শুনানিতে অনেকেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমেরিকাকে বাংলাদেশের ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, য্ক্তুরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে টানাপোড়েন চলছে। এক কথায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক মিডিয়া শেখ হাসিনার সরকারকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এ নিয়ে সরকারের উপর নানা ধরনের আন্তর্জাতিক চাপও অব্যাহত রয়েছে। বিরোধী দলের আপাতত কোন আন্দোলনের কর্মসূচি না থাকলেও সরকার প্রচন্ড অস্থিরতার মধ্যে সময় অতিক্রম করছে।
‘২৮ এপ্রিল, ২০১৫ অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ওপর কড়া নজরদারি করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা গণতন্ত্রের স্বার্থে এ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সরকারের প্রতি বার বার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম, কেন্দ্র দখল এবং বিএনপি জোট সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের খবরে হতাশ হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক মহল। নির্বাচনে অনিয়মের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে জাতিসংঘ। শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোনও করেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। এর আগে নির্বাচনের দিন কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, যে কোনো মূল্যে জেতা আসলে কোনো বিজয় নয়। পরে নির্বাচনে জালিয়াতি ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পাওয়া গেছে বলেও জানায় দেশটি। ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনও সব অনিয়মের তদন্ত দাবি করেন। একইভাবে জালিয়াতি ও সহিংসতায় সিটি নির্বাচন কলঙ্কিত হয়েছে বলে বিবৃতি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সিটি নির্বাচনকে ভুয়া আখ্যা দিয়ে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, আরেকটি ভুয়া নির্বাচন প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশ। সিটি নির্বাচনে অনিয়ম আর সহিংসতায় সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ জানান ঢাকা সফররত মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যানসহ প্রতিনিধিরা। (উৎস : নয়াদিগন্ত)
এমনি এক প্রেক্ষাপটে গত ৪ মে ২০১৫ জনাব মিজানুর রহমান খান দৈনিক প্রথম আলোর পত্রিকায় ‘যুক্তরাষ্ট্রের চোখে জামায়াত হবে ‘বোকো হারাম’?’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির হেডলাইন দেখে কৌতূহলী হয়ে অনেকে পড়ার চেষ্টা করছে হয়ত। অনেকের মধ্যে আমিও একজন। জনাব খানের লেখায় স্থান পেয়েছে, জামায়াত-বিএনপির বিভক্তি এবং আমেরিকাকে জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার তথাকথিত বিতর্কিত বয়ান। লেখাটির সারমর্ম হচ্ছে, বিএনপি যদি জামায়াত থেকে আলাদা নাই হয় তাহলে বিগত দিনে বিরোধীদলের আন্দোলন দমন করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২০ দলীয় জোটকে আইএস এর সাথে তুলনা করে জঙ্গি হিসেবে যেভাবে আখ্যায়িত করেছে, জনাব খান সাহেব তার থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক জামায়াতকে বোকো হারামের সাথে তুলনা করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দমনের জন্যে অনেকটাই উস্কিয়ে দেয়ার কাজটিই করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার সাথে। তাছাড়া বিএনপির কোন ভবিষ্যৎ নেই, নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ! এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, ইত্যাদির ব্যর্থতার দিক তুলে ধরে জনাব খান আমেরিকাকে ২০ দলীয় জোট থেকে মুখ ফিরিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে থাকার নসিহত করেছেন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় জনাব খান মার্কিন সিনেটে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সংক্রান্ত উপকমিটির যে মিটিং নিয়ে এমন মিথ্যাচার করলেন, ঠিক সরকারের অনুগত আরেকটি পত্রিকা দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম শুধু প্রথম আলোর জনাব মিজানের মনগড়া আজগুবি আষাঢ়ে গল্পে ভরা লেখাটির তুলনা করে বুঝবার জন্য।
দৈনিক যুগান্তর হেড লাইন করেছে ‘বাংলাদেশ এক চরম বিশৃঙ্খল রাষ্ট্র’ মার্কিন সিনেটে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান ম্যাট সালমন বাংলাদেশকে একটি চরম বিশৃংখল রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বিভক্ত। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচন ঘিরে সহিংস প্রতিবাদ হয়েছে। ফলে রাজনীতির উভয় পক্ষের অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। শুনানিকালে উপস্থিত ছিলেন ডেভিস ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ফরেন পলিসির অধীন এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিজা কার্টিস, ইলিনোয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটির চেয়ার অধ্যাপক ড.আলী রিয়াজ, গভর্নমেন্ট রিলেশনন্স হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের পরিচালক জয় কানসারা।
আলী রিয়াজ বলেন, ২০১৪ সাল তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকলেও ক্ষমতাসীন দল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সময়টায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সুযোগ বিনষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০১৫ সালের শুরুর দিকের রাজনৈতিক হানাহানির দায় এড়াতে পারে না। অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আচরণবিধি, ভীতিমুক্ত জীবনযাপনে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক কোনো ব্যক্তি কিংবা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সমন্বয়ে জাতীয় সংলাপ প্রয়োজন। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর)
অথচ দৈনিক প্রথম আলোতে জনাব খান লিখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কের কি অবসান ঘটতে যাচ্ছে? মনে হচ্ছে, বিএনপিকে তার ‘কৌশল-মিত্র’ জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে বিতর্কিত কৌশলগত সম্পর্ক ছিল, তার দোহাই দিয়ে বিএনপি এতকাল যতটা সহজে দলটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে চলছিল, এখন তাদের তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে জোট পুনর্গঠন করা উচিত, কিন্তু তা করতে গেলে তারেক রহমানকেও মাইনাস করার ঝুঁকি নিতে হবে।’ মিজান সাহেব তার লেখায় আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখাটি সাজিয়েছেন।
জনাব খান ও জাফর ইকবাল গংদের মনে রাখা দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার বয়ানে অনেক কিছু ঘটে যাবে তা আজকের যুগে মনে করার কোন কারণ নেই। আজকের গ্লোবাল পৃথিবীতে কোথায় কি হচ্ছে, কে কি বলছে স্যোশাল মিডিয়ার সুবাদে সবাই তা জানে। আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের লেখায় অসততার দিকটি একজন রিকশাওয়ালা শ্রমিক, কৃষক ও এখন ফেইসবুক ব্যবহারের সুবাদে আপনাদের লেখার অসততা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দিকটি বুঝে ফেলে। জনাব খান বুদ্ধিজীবীর লেবাসে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝে।
সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এডওয়্যার্ড সাঈদ তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Representation of the intellectual (১৯৯৩) গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের স্বভাব-প্রকৃতি, দায়-দায়িত্ব ও কর্মধারা চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, সরকারগুলো এখনো ব্যক্তিকে দমন করে চলেছে, ন্যায়-বিচারের ভয়াবহ ব্যত্যয় হচ্ছে, ক্ষমতা কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের করায়ত্ত করার প্রক্রিয়া তাদের কণ্ঠকে থামিয়ে দিচ্ছে। এবং প্রায়শই পথভ্রষ্ট হচ্ছেন বুদ্ধিজীবীরা।
আমরা এখন বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব আর অসততার যুগে বাস করছি। বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধত্ব গোটা সমাজব্যবস্থাকে বিপদগ্রস্ত করে। কখনও কখনও যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়। কারণ আমাদের সমাজের কলামিস্ট আর বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই বিভিন্ন সামাজিক, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী। কেউ সরকারি দমন-নিপীড়ন, হামলা-মামলা থেকে বাঁচতে চায়। কেউবা আবার সরকারি বিজ্ঞাপন কিংবা গোপন সুবিধা ভাগিয়ে নিতেও বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার পথে পা বাড়ায়। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখকদের এই তথ্য সন্ত্রাস অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্র থেকেও অনেক বেশি মারাত্মক।
জনাব খান এই লেখায় প্রচন্ড একপেশে নীতি অবলম্বন করেছেন। আমার মনে হয়, ইতোমধ্যেই প্রথম আলোর অনলাইনে পাঠক মন্তব্য দেখে তিনি তা উপলব্ধিও করেছেন। তিনি নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ও জোটের ক্ষেত্রে সুবিচার করতে পারেন নাই। তিনি তার লেখার শুরুতেই প্রশ্ন রেখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কের কি অবসান ঘটতে যাচ্ছে?’ আমি  জানি না তিনি হঠাৎ করে কোন উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত চিন্তা থেকেই এমন প্রশ্নের অবতারণা করলেন।
জনাব খান জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই এমনটি করেছেন, তা যে কোন পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য আওয়ামী লীগের মতই জনাব খানের কাছেও বিরক্তির কারণ। এজন্য তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখার মূল উদ্দেশ্যই বিএনপি-জামায়াতের জোটে বিভক্তি। এই সমস্ত কলামিস্টরা কখনো হয়ে যান বিএনপির উপদেষ্টা আর কখনো সাজেন আওয়ামী লীগের খয়ের খাঁ। অনলাইনে একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘সরকারের মামলার চাপেই কি মিজান সাহেব এমন আবোল তাবোল বকছেন?’ কারণ জনাব খানের একটি লেখা নিয়ে কিছুদিন পূর্বে তিনি কোর্টে গিয়ে সশরীরে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এমন কিছু ফুঁসিয়ে দিয়ে এমন লেখা!!
জনাব মিজান সাহেব বিএনপিকে এমন উপদেশই দিলেন, যা কামরুল-হানিফদেরকে হার মানিয়েছে। তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানকেও মাইনাস করার ঝুঁকি নেয়ার পরামর্শ দিয়ে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি এই উক্তির প্রতিফলন ঘটালেন!
তিনি লিখেছেন, ‘একাত্তরে নিক্সন-কিসিঞ্জারের অনুসরণ করা বিতর্কিত বাংলাদেশ নীতির একমাত্র বাংলাদেশী সমর্থক জামায়াতই এখনো রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হিসেবে টিকে আছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র বিচার প্রক্রিয়ার মান নিয়ে উচ্চকিত থাকলেও ধীরে ধীরে অবস্থান বদল করে।’ আমার মনে হয়, জনাব খান -যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলের যে কথা বললেন, তা একেবারেই অসত্য। জনাব আব্দুল কাদের মোল্লা, জনাব শহীদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের পূর্বে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধাপরাধ বিচারের অস্বচ্ছতা ও মানদ-ের প্রশ্ন তুলে সরকারকে এই রায় কার্যকর করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছিল। যা সারা দুনিয়ার মানুষ জানলেও জনাব খান সাহেব সেই সত্যটুকু অস্বীকার করেছে।
যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস এটিকে শুধু কালো আইন হিসেবেই চিহ্নিত করেনি বরং আইনটি সংশোধনের জন্য ১৭ টা পয়েন্টে অবজারবেশন সরকারের নিকট তুলে ধরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইন যথেষ্ট নয়।’ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্যা ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্যা ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন, দ্যা ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচারকাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিতর্ক বাড়বে। ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যালেন ডানকান ব্রিটিশ এ মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন।
আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশগুলো জামায়াতকে একটি মডার্ন ইসলামিক দল হিসেবেই জানে। প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট- এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন - ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটা গোঁড়া ধর্মান্ধ মৌলবাদী ইসলামপন্থী দল নয়। জামায়াতে ইসলামী একটি চরমপন্থী দল নয়। মুসলিম মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি মধ্যপন্থী দল। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক নেতা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দল হিসেবে বিবেচনা করেছেন। জামায়াতে ইসলামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের কাছে পেতে শুরু করেছে বিশেষ বিবেচনা। আওয়ামী লীগ এখন প্রমাণ করতে চাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী হলো একটি গোঁড়া ধর্মান্ধ ইসলামপন্থী দল। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে জামায়াত ক্ষমতায় আসবে। আর এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরো-মার্কিন জোট। কিন্তু ইউরো-মার্কিন জোটের অনেক নেতাই হতে পারছেন না আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জামায়াত সম্পর্কে এখন অনেক ভিন্নভাবেই ভাবছে বলেই মনে হয়।’ ( সূত্র: নয়া দিগন্ত )
মূলত জনাব খান সাহেবরাই বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের সাফল্য, জনপ্রিয়তা ও অগ্রগতিতে অস্থির হয়ে পড়েছেন। বিগত দিনের উপজেলা নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনের ঈর্ষণীয় ফলাফল অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। এবং অনেকের মধ্যে আফসোস ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। যারা জাতীয় পার্টিকে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে আনন্দের ঢেকুর দিচ্ছিল, অথচ উপজেলা নির্বাচনের ডাবল শূন্য ফলাফল আর সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে তিন প্রার্থীর জামানত হারিয়ে হতাশা এবং বিষণœতায় জনাব মিজান সাহেবও কি আক্রান্ত? ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত ৩৬ জন চেয়ারম্যান, ১২৯ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৩৬ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। যাদের  মোট প্রাপ্ত ভোট, ১৬,৪২,১৩৪। এত জুলুম-নির্যাতনের পরও এ অভূতপূর্ব ফলাফল সর্বত্র সাড়া ফেলে দিয়েছে। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল ও বর্জনের পরেও জামায়াতের ৫ জন কমিশনার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে।
জনাব খান সাহেব লিখেছেন, ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া সেই শেখ হাসিনা আর আজকের হাসিনা এক নন।’ আমার মনে হয় তিনি সত্য কথাই লিখেছেন। আমি তার কথার সাথে পুরোপুরি একমত। কারণ এখনকার শেখ হাসিনা গণতন্ত্র হত্যাকারী, এদেশের অসংখ্য আলেম-ওলামা, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, রাজপথে মুক্তি জনতার আন্দোলনকে দমন করতে হত্যা, গুম, খুনের জন্য দায়ী সে সরকার পরিচালনা করেছেন, তাতে সত্যিই বলতে হয়, সেই শেখ হাসিনা আর আজকের হাসিনা এক নন।
জনাব মিজান সাহেব লিখেছেন, ‘বিএনপি নাচতে নাচতে জামায়াতকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। এরপর জামায়াতী জোশে জেএমবি সারা দেশে বোমা ফাটালেও তাদের হুঁশ হলো না, ঘুম ভাঙতে খুব দেরি হলো কিংবা ভাঙলই না।’ একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে একথা সকলেরই জানা, জেএমবির উৎপত্তি হয়েছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলেই। এবং জেএমবির প্রধান শায়েখ আব্দুর রহমান যুবলীগ নেতা মির্জা আজমের ভগ্নিপতি। সুতরাং চার দলীয় জোটের ভাব মর্যাদা ক্ষুণ্ন ও দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যেই আওয়ামী লীগ এমন নাটক সাজিয়েছিল, একথা কেউই ভুলে যায়নি। বরং বেগম খালেদা জিয়ার সরকারই শায়েখ আব্দুর রহমান এবং বাংলা ভাইদের ফাঁসি দিয়েছিল। জনাব মিজান সাহেবরা অন্যকে কাসুন্দি ঘাটার কথা বলে নিজেই যেন কাসুন্দি ঘাটছেন?
মার্কিন কংগ্রেসের ফরেন রিলেশন্স কমিটিতে হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের পরিচালক জে কানসারা ব্যতীত কোন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যই জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে কোন বক্তব্য রাখেননি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ঐ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘জয় কানসারা যে সব ভিত্তিহীন, বানোয়াট, কাল্পনিক, অসত্য, অবাস্তব ও মনগড়া বক্তব্য রেখেছেন তা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতনের যে সব অভিযোগ তিনি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এনেছেন তা তার মনগড়া বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়।’ জনাব খান জামায়াত নিষিদ্ধ করা সম্পর্কে এবং জামায়াতের বিরুদ্ধে যে সব অপবাদ রচনা করেছেন তা এ দেশের জনগণের কাছে হাস্যকর। তিনি জামায়াতকে নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন ‘বোকো হারাম’-এর সাথে তুলনা করে নিজের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক ধারা সন্নিবেশিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা এ দেশের জনগণের নিকট অত্যন্ত স্পষ্ট।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads