শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে বাংলাদেশের সম্ভাবনা


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি এবং পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গে ঢাকা সফরে আসছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনের বেশি আশাবাদীরা মনে করছেন, এবার বাংলাদেশের ভাগ্যের চাকা সম্ভবত ঘুরতে শুরু করবে। চাকাটা ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশকে ঠিক কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে, তিস্তা চুক্তি ‘হনুজ দূর ওয়াস্ত’ই থেকে যাবে কি না এবং সম্প্রতি হঠাৎ করে ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভা ও রাজ্যসভায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন করার পেছনে বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে ‘ঘোল’ খাওয়ানোর উদ্দেশ্য রয়েছে কি না- এসব প্রশ্নও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। আলোচনা অবশ্যই অকারণে হচ্ছে না। প্রধান একটি কারণ হলো, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই দু’জন অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। তাদের সম্পর্ক একেবারে সাপে-নেউলের মতো। গত বছর, ২০১৪ সালে দেশটিতে যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখনও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে মিস্টার মোদিকে ‘কসাই’ বলেছিলেন, ‘তুই-তুকারি’ তো করেছিলেনই। এই পরস্পর বিরোধী ও দৃশ্যত শত্রুতাপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় রাজনীতিকদের ঐকমত্য রয়েছে বলেই দু’জনের এক সঙ্গে সফর করা সম্ভব হচ্ছে। কথা ওঠার অন্য কারণও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশকে ‘এক হাত’ নেয়ার ব্যাপারে তিনিও কখনো পেছনে পড়ে থাকেননি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় তার প্রধান একটি এজেন্ডাই ছিল ভারত থেকে কথিত বাংলাদেশীদের বের করে দেয়া। মিস্টার মোদী ভারতে অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচনে তার দল যদি জিততে পারে এবং তিনি নিজে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন তাহলে ক্ষমতায় গিয়েই ঘাড়ে ধরে বের করে দেবেন বাংলাদেশীদের! তখনও কথার পিঠে তেড়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সে অবস্থান কথিত বাংলাদেশীদের পক্ষে গিয়েছিল। এর পেছনেও মমতার ‘পলিট্রিক্স’ই ছিল, যে প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে বলা হবে। এদিকে মিস্টার মোদির জবাবে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিকরা বলেছিলেন, ভারত এমন কোনো আহামরি দেশ নয় যে, সেখানে যাওয়ার এবং গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করার জন্য বাংলাদেশীরা দিওয়ানা হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ থেকে একেবারেই যে যায় না বা সময়ে সময়ে যায়নি তা অবশ্য সত্য নয়। কিন্তু ঠিক কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকজন তারা এবং তাদের সংখ্যাই বা কত সে সব বিষয়ে নরেন্দ্রনাথ মোদিরও জানা থাকার কথা। না জেনে থাকলে তিনি পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। কারণ, বিজেপি ও কংগ্রেসের পাশাপাশি কমিউনিস্টদের হারিয়ে দেয়ার জন্য শ্রীমতি মমতা নাকি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘রিফিউজি’ ভোটারদের ওপরই প্রধানত নির্ভর করেছেন। ওদিকে কমরেড বুদ্ধদেব তো বহু বছর আগেই শুনিয়ে রেখেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে নাকি ‘স্রোতের মতো’ মানুষ গিয়ে হাজির হয়েছিল পশ্চিম বঙ্গে। যেন গিয়েছিল লাখে লাখেÑ হয়তো কোটিরও বেশি! কিন্তু কমরেড বুদ্ধদেবই আবার জানিয়েছিলেন, ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে নাকি লাখ চার-পাঁচেক বাংলাদেশী পশ্চিম বঙ্গে গিয়ে উঠেছিল!
নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে যেহেতু বলেছিলেনই সেহেতু অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের দায়িত্বটুকুও মিস্টার মোদির ওপরই বর্তেছিল। সেটা কিন্তু তিনি করেননি। মানে, করার সৎসাহস পাননি। কারণ, করতে গেলে নরেন্দ্রনাথ মোদিকে অন্য একটি সত্যও স্বীকার ও গলাধঃকরণ করতে হতো। সে সত্য হলো, তিনি শুধু ভারতে কথিত বাংলাদেশীদের দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতেই দিতে চাননি যে, বাংলাদেশীদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে রয়েছে। বড় কথা, এই ভারতীয়রা শুধু অবৈধভাবে বসবাসই করছে না, অবৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকরি-বাকরিও করছে। কিছুদিন আগেও এক টিভি টকশোতে জানানো হয়েছে, অবৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকরিতে নিয়োজিত ভারতীয়দের সংখ্যা কম করে হলেও লাখ পাঁচেক। হুন্ডিসহ অবৈধ পথে এদের পাঠানো অর্থের পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। রফতানি ও রেমিট্যান্সসহ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে এরাই রয়েছে পঞ্চম স্থানে! এর পরিমাণ সম্পর্কে কল্পনা করতে গেলেও চমকে উঠতে হয়। মিস্টার মোদি কিন্তু এত বড় একটি বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। কেন করেননি তার কারণ অবশ্য এতদিনে বোঝা যাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি কিন্তু এখন আর কথিত বাংলাদেশীদের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার কথা বলেন না।  কারণ, তেমন অবস্থায় বাংলাদেশ থেকেও যদি ভারতীয়দের ঘাড়ে ধাক্কা খেয়েই বেরিয়ে যেতে হয় তাহলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পঞ্চম খাতটি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। সে ধাক্কার ঠ্যালা সামাল দেয়া অন্তত মিস্টার মোদির পক্ষে সম্ভব হবে না।
পাশাপাশি রয়েছে মমতা ফ্যাক্টরও। কারণ, ২০১১ সালে পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট ও বামফ্রন্টের ভরাডুবি এবং মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট বিজয়ের একটি বড় কারণ হিসেবে বহুদিন পর দৃশ্যপটে এসেছিলেন নির্যাতিত ও বঞ্চিত মুসলমানরা। শতকরা হিসাবে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট থাকলেও পশ্চিম বঙ্গে তারা ‘সংখ্যালঘু’। গত বছর অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনেও মুসলমানরাই নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছেন। সে কারণে মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অতি হাস্যকর প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। মুসলমানদের উন্নতি-সমৃদ্ধির নানা ধরনের অঙ্গীকারের ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা। প্রতিটি দলই কয়েকজন করে মুসলমান প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন হাতে মুসলমানদের দোয়া চেয়ে বেড়িয়েছেন। তৃণমূলের নারী কর্মীরা গায়ে বোরখা চাপিয়েছিলেন, আর পুরুষরা মাথায় টুপি পরেছিলেন। মুসলমানদের নিয়ে বামফ্রন্টকেও ঠ্যালা-ধাক্কা কম দেননি মমতা। এই সত্য তিনি ফাঁস করেছিলেন যে, দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এক শতাংশ মুসলমানও শিক্ষা-চাকরি ও ব্যবসা পাননি। অর্থাৎ কমিউনিস্টরা নামেই ধর্মনিরপেক্ষ, বাস্তবে তারাও মিস্টার মোদিদের মতোই মনে-প্রাণে কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন!
এবার সংক্ষেপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলা যাক। ভারতের সবচেয়ে অবহেলিত রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। আওয়ামী এবং ভারতপন্থী শিবিরের পক্ষ থেকে এই দিদিমনিকে নিয়ে মাতামাতি এবং ‘এপার বাংলা-ওপার বাংলা’ বলে চামচামো যথেষ্টই করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে অন্য ভারতীয়দের নীতি-কৌশল ও অবস্থানকেই এগিয়ে নিয়েছেন। কিছু কিছু ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিরোধী কট্টর ভূমিকা পালনেরও অভিযোগ রয়েছে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখ করা যায়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এই বলে জোর প্রচারণা চালানো হয়েছিল যে, এবার তিস্তা চুক্তি ‘হবেই’! দৃশ্যত আয়োজনও ঠিকঠাক মতোই চলছিল। কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন মমতা একাই। তিনি শুধু খসড়া চুক্তিরই বিরোধিতা করেননি, একই সঙ্গে একেবারে শেষ মুহূর্তে ঢাকায় আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছিলেন। কারণ জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে পানি দেয়ার পরিমাণ নিয়ে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন মনমোহন সিং। কথা নাকি ছিল বাংলাদেশকে ২৫ হাজার কিউসেক দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তির খসড়ায় ৩৩ হাজার কিউসেক দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এতেই বেঁকে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি থেকে তখনকার ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত সবাই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মমতাকে রাজি করাতে পারেননি। কারণ, তিস্তা মমতার কাছে তাদের উত্তর বঙ্গের কৃষির জন্য ছিল ‘লাইফ লাইন’। যুক্তিও চমৎকারই দেখিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বাংলাদেশ তাদের শুধু প্রতিবেশী নয়, আত্মীয়ও। কিন্তু নিজে খাওয়ার পর অতিরিক্ত থাকলেই তো প্রতিবেশীর কথা মনে পড়বে! তার রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় ছয়টি জেলার চাষীদের নাকি প্রচুর পানির দরকার। অন্যদিকে তিস্তায় যে পরিমাণ পানি আছে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি আপাতত সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের ব্যাপারেও নেতিবাচক কথাই জানিয়ে রেখেছিলেন মমতা। বলেছিলেন, শুষ্ক মওসুমে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে তিস্তায় একেবারেই পানি থাকে না। তার সরকার দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় আরো দুই লাখ হেক্টর জমিতে সেচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানির একটা বড় অংশ নিতে হবে তিস্তা থেকে। সে কারণেও তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিম বঙ্গের পক্ষে রাজি হওয়া সম্ভব নয়। এভাবে নানা কথার মারপ্যাঁচে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের কোনো কোনো নেতা-নেত্রীর সঙ্গে তার পার্থক্য রয়েছে। তিনি আগে নিজেদেরটা দেখেন, কোনো দেশের দালালি করেন না। এজন্যই ‘দুই বাংলা যেন এক হয়ে গেছে’ মনে করলেও জামদানি শাড়ি ও ইলিশ মাছের প্রলোভন তাকে নাড়া দেয়নি, তার রাজ্যের স্বার্থের প্রশ্নে এক ইঞ্চিও ছাড় দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেবার প্রসঙ্গক্রমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আবারও ভারতীয়দের বাংলাদেশ নীতি প্রধান্যে এসেছিল। কারণ, তিস্তা বেশি আলোচিত হলেও ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে। বাংলাদেশের ওপারে তিস্তার ৪৫ কিলোমিটার উজানে ভারত এমন এক গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে যার ফলে কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ খুব একটা পানি পেতে পারতো না। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের পানি ভাগাভাগি নিয়েই এত কিছু ঘটেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাড় না বাঁকালেও এবং সত্যি সত্যি কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ লাভবান হতে পারতো না। এর কারণ শুধু মোট পানির পরিমাণ নয়, ভারতীয়দের চাণক্য কৌশলও। এই কৌশলের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থে যা কিছু করছে ও করেছে সেগুলোর কোনোটিতেই বাংলাদেশের এক ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। কারণ, চাণক্য কৌশল নিয়ে অগ্রসরমান ভারতীয়রা এখনো ‘অতুলনীয়’।
একটি উদাহরণ হিসেবে ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’র উল্লেখ করতেই হবেÑ যে চুক্তিটি এতদিনে, দীর্ঘ ৪০ বছর পর ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় অনুমোদন পেয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো আদায় এবং সীমান্ত চিহ্নিত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। বড় কথা, ওই চুক্তি অনুযায়ী ভারত একই সঙ্গে পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি। এই সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য মরণ বাঁধ হিসেবে চিহ্নিত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে ভারত নিয়েছিল চাতুরিপূর্ণ কৌশল। মুজিব-ইন্দিরা যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মওসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসতে পারে সেজন্য ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে। যুক্ত ইশতেহারের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কথা ছিল, ৪১ দিনের নির্ধারিত সময়ে ভারত ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি ফিডার ক্যানেল দিয়ে হুগলী নদীতে নিয়ে যাবে। কিন্তু ৪১ দিনের সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মওসুমে একতরফাভাবে গঙ্গার পানি নিয়ে যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফিডার ক্যানেল চালু করার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় পানি প্রবাহ যেখানে ছিল ৬৫ হাজার কিউসেক সেখানে ১৯৭৬ সালে এর পরিমাণ নেমে এসেছিল মাত্র ২৩ হাজার ২০০ কিউসেকে। এর প্রধান কারণ ছিল ফিডার ক্যানেল দিয়ে পূর্ণ ক্ষমতা অনুযায়ী ভারতের পানি প্রত্যাহার করে নেয়া। পরবর্তীকালেও ভারতীয়দের নীতি ও কার্যক্রমে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আগত আরেক আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ভারত যথারীতি চুক্তি লংঘন করায় ১৯৯৭ সালের মার্চেই সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ড স্থাপিত হয়েছিল- ২৭ মার্চ বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি আগেই উজানে উঠিয়ে নিয়েছিল।
এখানে ইতিহাসের উল্লেখ করার কারণ, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন তখন তাকে নিয়ে সীমা ছাড়ানো মাতামাতি করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মমতা কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস দেননি। ‘মনে হচ্ছে, নিজের দেশে এসেছি’ বলার পাশাপাশি তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে বলেছেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’! ভাবখানা এমন ছিল যেন মমতা চাইলেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে! আসলেও কি তা-ই? বাস্তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের প্রায় ৩০টির মধ্যে একটি মাত্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ভারত যেহেতু একটি যুক্তরাষ্ট্র সেহেতু তিস্তা চুক্তির মতো যে কোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর সম্মতি ও অনুমোদন দরকার পড়ে। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গে ক্ষমতাসীন মমতার তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকে চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছে। তাছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইলেই চলবে না, এ ধরনের বিষয়ে বিরোধী দলেরও সমর্থন থাকতে হবে। মূলত সে কারণে ২০১১ সালে ‘হবেই’ অবস্থায় এসে যাওয়া সত্ত্বেও মমতার বিরোধিতায় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। এই একটি বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস এবং নরেন্দ্রনাথ মোদির বিজেপি সরকারের মধ্যে কোনো মতানৈক্য দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্ভাব্য ঢাকা সফর নিয়ে উদ্বেগের কারণটিও এখানেই। সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর পরিবর্তে এখানে স্মরণ করা দরকার, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় মিস্টার মোদি বাংলাদেশ বিরোধিতাকে পুঁজি বানিয়েছিলেন, বাংলাদেশীদের ‘গাঁট্টি-বোচকা’ বেঁধে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। অন্যদিকে ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন’Ñ এই বাগাড়ম্বরের বাইরে আশাবাদী হওয়ার মতো একটি শব্দও উচ্চারণ করে যাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তা-ই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্রনাথ মোদিকে গুজরাটে হাজার হাজার মুসলিম হত্যার দায়ে ‘কসাই’ পর্যন্ত বলেছিলেন। সে দু’জনই এবার এক সঙ্গে ঢাকায় আসার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং দেশপ্রেমিকরা ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’ বললে তাদের দোষ দেয়া যাবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরকালেও তিস্তা চুক্তি ‘হনুজ দূর ওয়াস্ত’ই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে ‘ঘোল’ খাওয়ানোর সম্ভাবনাকেও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
শেষ করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দু’-একটি কথা বলা দরকার। যেমন বিএনপি ও চারদলীয় সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অতীতের অনেক সরকারই নাকি ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার এবং অন্য নানাভাবে ভারতবিরোধিতা করে দেখেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি বরং ভারতের সঙ্গে তিক্ততা বেড়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের কেউ কেউ নাকি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও গোপনে গিয়ে ভারতীয়দের পা ধরে থাকে! অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলটি কখনোই তথাকথিত ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ করেনি। বিএনপি বরং সব সময় জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা পালন করেছে। একে ‘ভারতবিরোধী’ না বলে ‘দেশপন্থী নীতি’ বলাই যথার্থ। উদাহরণ দিতে গিয়ে বিএনপির মুখপাত্র বলেছেন, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করা হলে এবং ফেলানীর মতো কিশোরীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হলে বিএনপি অবশ্যই তার প্রতিবাদ জানাবে। জানিয়েছেও। এমন অবস্থান কোনোভাবেই ভারতবিরোধী হতে পারে না। বরং এটাই একটি দেশপ্রেমিক দলের প্রধান দায়িত্ব। একে যারা ভারতবিরোধী নীতি বলতে চান এবং এর ভিত্তিতে বিএনপিকে যারা ভারত বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করেন তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই প্রশ্ন ওঠানো দরকার। ওই মুখপাত্র একই সাথে পরিস্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, জাতীয স্বার্থ পরিত্যাগ করে বিএনপি ভারত বা অন্য কোনো দেশকেই কখনো ছাড় দেবে না। অতীতেও ছাড় দেয়নি। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রতিটি বৈঠকে এ কথাটাই জানিয়ে এসেছেন। তিনি আরো বলেছেন, গভীর সম্পর্ক গড়তে হবে দু’ দেশের জনগণের মধ্যে। বেগম জিয়ার সফরের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তখন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়েছিল, অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন, তিস্তা চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য বৈষম্য, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ এবং ট্রানজিট তথা কানেক্টিভিটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি এতদিন যেসব দাবি জানিয়ে এসেছে সেগুলো সম্পর্কে মুখোমুখি বলার উদ্দেশ্যেই বেগম জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ ভারতের নেতাদের কাছে এসব বিষয়ে বিএনপির দাবি ও অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছিলেন তিনি। জবাবে ভারতীয়রাও বেগম জিয়াকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তারাও বলেছিলেন, ভারত শুধু বাংলাদেশের সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় না, অন্য সব দলের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক, সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে চায়। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি তার পূর্বসুরীর আশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করেন কি না। উল্লেখ্য, বিএনপি এরই মধ্যে তেমন আশাই প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের সব দলও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই চায়।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads